গল্প
বছর বারো আগে
আরেকটু সতর্ক হলে দুর্ঘটনা এড়াতে পারতেন সুলেমান সাহেব।
ঠিক তার না। সতর্ক হওয়া উচিত ছিল সুলেমান সাহেবের ড্রাইভারের।
তাঁর ড্রাইভার মজিদ এমনিতে ভালো। আগে মিনিবাস চালাত। কিছুদন ধরে সুলেমান সাহেবের প্রাইভেট চালাচ্ছে।
সুলেমান সাহেব তাকে বলেছিলেন।
মানুষের হয় উন্নতি। বাস থেকে ট্রাকে ওঠে। তুমি বাস থেকে প্রাইভেটে নামলে যে?
এইটা স্যার আমার প্রাইভেট মানুষের চাওয়া।
প্রাইভেট মানুষ!
হ। আমার পরিবার চায় না বাস চালাই। কয়, বাস খুব ডেইনজার। আমিও ভাইব্বা দেখলাম, লাইফের তো কোনো জীবন বীমা নাই। তাই ছাইড়া দিছি।
মজিদ অস্ত্র জমা দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু ট্রেনিং তো রয়ে গেছে।
সে যে এখন বাস না, প্রাইভেট কার চালায় সে হুঁশ মজিদের মাঝে মাঝে থাকে না। বিশেষ করে যখন রাস্তা-ঘাট ফাঁকা থাকে।
আজকের দুর্ঘটনাও একদম ফাঁকা রাস্তায়। শুকনো মাটিতে উষ্টা খাওয়ার মতো।
ওভারটেক করা নিয়ে শুরু।
নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়ি খাদে পড়ে।
সুলেমান সাহেবের গাড়ি পড়েছে ছাদে।
গাড়ি ছিল ফ্লাইওভারের ওপর। সেখান থেকে একদম পাশের দোতলা বাড়ির ছাদে। ছাদে শক্ত রেলিং ছিল বলে আর নিচে নামতে হয়নি।
এরপর হাসপাতালের ওটি পর্যন্ত গড়িয়েছে ঘটনা।
সুলেমান সাহেবের আঘাত মারাত্মক।
মোবাইলে শেয়ারের সাম্প্রতিক দরপতন নিয়ে কথা বলছিলেন তিনি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজের পতনও টের পেলেন।
আশ্চর্যের বিষয় হলো ড্রাইভারের তেমন কিছু হয়নি।
ঘাড়ের ডানদিকে দুই আর ডান কনুইয়ের নিচ চার মোট ছয়টি সেলাইয়ের পর ডাক্তার বলেছে মনে হচ্ছে আউট অব ডেঞ্জার।
কিন্তু মজিদ মটকা মেরে পড়ে আছে।
ড্রাইভারি লাইনে সে পুরানা। ডাক্তারি হিসেবে মজিদ আউট অব ডেঞ্জার হলেও তার হিসেবে বিপদ এখনো কাটেনি। এখন গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা মানে চূড়ান্ত সর্বনাশ। সব দোষ তার ঘাড়ে চাপানো হবে। নগদে দু-চারটা চড়-থাপ্পড়ও পড়তে পারে। ঘাড়ের সেলাইয়ের দিকে তখন কেউ তাকাবে না।
সুলেমান সাহেবের বড় ছেলেকে মজিদের বড় ভয়। এই ছেলে বাপ-মাকেই মানে না। নেশার টাকা না পেলে তাদেরকেই মারতে যায়। মজিদকে কি সে ছেড়ে দেবে!
মজিদের কপাল ভালো। পরিবারের সবাই সুলেমান সাহেবকে নিয়ে ব্যস্ত। মজিদকে নিয়ে ভাবার সময় তাদের নেই। এদিক দিয়েও সে আপাতত আউট অব ডেঞ্জার।
তবুও ঝুঁকি নেয় না মজিদ।
ধরা পড়া চোর যেমন মাইরের সময় দম বন্ধ করে রাখে, মজিদও তাই করছে। তার অবস্থা দেখে ফিরে যাওয়া ডাক্তার আবার ফিরে আসে। মজিদের হাতটা নিয়ে নাড়ি পরীক্ষা করে। তারপর নার্সকে ডাক দেয়।
প্রেসারটা আরেকবার মাপো তো। আর দুটো ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দাও। আতঙ্ক এখনো কাটেনি।
২.
পরের ধাক্কাটাই বেশি রিস্কি।
ডাক্তারের কথা শুনে সুলেমান সাহেবের স্ত্রীর চোখ-মুখ শুকিয়ে যায়।
গাড়ির ধাক্কাতেই বেচারার জীবন শেষ। এখন আবার কোন ধাক্কা।
দুর্ঘটনার সময় ওনার ছোটখাটো একটা অ্যাটাক হয়েছে। আর ছোট স্ট্রোকের পর বড় অ্যাটাকের ঝুঁকি থাকে। বর্তমানে ওনার যা ফিজিক্যাল কন্ডিশন। ওটা নিয়েই ভয়।
ও আল্লারে . . .
ডাক্তারের কথা শুনে শব্দ করে কেঁদে ওঠেন সুলেমান সাহেবের স্ত্রী।
আহা। কান্নাকাটি করবেন না। কুইক অপারেশনে যেতে হবে। আমাদের সিনিয়র স্যারকে খবর দেওয়া হয়েছে। উনি চলে আসবেন। এলেই অপারেশন। আপনারা টাকার ব্যবস্থা করুন।
সুলেমান সাহেব কিংবা তাঁর পরিবারের জন্য টাকা সমস্যা না।
এটিএম বুথে গিয়ে ঘঁষা দিলে টাকা আসবে।
ঘঁষা দিলে যাতে টাকা আসে সুলেমান সাহেব সে ব্যবস্থা করে রেখেছেন। ঢাকা শহরে তাঁর দু-দুটো বাড়ি। প্রাইম লোকেশনে চার-পাঁচটা ফ্ল্যাট। মাসে মাসে সেসবের ভাড়া। সব মিলিয়ে ব্যাংকে মোটা অঙ্কের সঞ্চয়। শেয়ারবাজারেও বড় ইনভেস্টমেন্ট আছে।
না। যা ভাবছেন তা না।
সুলেমান সাহেব ব্যবসায়ী না। মাঝারি পদের সরকারি চাকরি থেকে বছর তিনেক আগে রিটায়ার করেছেন।
সরকারি চাকরি করে তাহলে তিনি কীভাবে এত টাকার মালিক হলেন?
এসব খোঁজ না করে আমরা বরং তাঁর চিকিৎসার খোঁজখবর নিই।
সুলেমান সাহেবের অবস্থা ক্রিটিক্যাল। যদিও তাঁর সেন্স পুরোপুরি আছে। এবং তিনি টুকটাক কথাবার্তাও বলতে পারছেন।
টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। লাগলে আরো হবে।
সিনিয়র ডাক্তারও হাজির।
অপারেশন থিয়েটারও প্রস্তুত।
কিছুক্ষণের মধ্যে অপারেশন।
সিনিয়র ডাক্তার রিপোর্টগুলো দেখে সুলেমান সাহেবের বেডের কাছে আসলেন।
ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আপনি এই বন্ডে সই করে দিলেই অপারেশন শুরু করব।
সুলেমান সাহেবের স্ত্রীর দিকে কয়েকটা কাগজ বাড়িয়ে দেন সিনিয়র ডাক্তার।
কিছু না পড়েই সুলেমান সাহেবের স্ত্রী সই করতে যাবেন এমন সময় সুলেমান সাহেবের দুর্বল কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠ শোনা যায়।
না।
না! না মানে কি!
আমি অপারেশন করাব না।
সুলেমান সাহেবের কথায় উপস্থিত সবাই অবাক হয়।
পাগল নাকি। অপারেশন করাবে না। কথা বলো না তো। ডাক্তার না কথা বলতে বারণ করেছে।
কিন্তু সুলেমান সাহেব তারপরও কথা বলেন। কারণ কথা তাঁকে বলতেই হবে। তিনি যে আজ সত্যের মুখোমুখি।
সুলেমান সাহেব স্ত্রীকে আলাদা করে ডেকে নেন এবং ফিরে যান বছর বারো আগে।
সিনিয়র ডাক্তার মানে যিনি অপারেশন করবেন সুলেমান সাহেব তাঁকে চিনতে পেরেছেন। বারো বছর আগে আজকের এই সিনিয়র ডাক্তারকেই পরীক্ষার আগে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন সরবরাহ করেছিলেন তিনি। এ রকম ডাক্তারের হাতে জীবন নিরাপদ না।
সুলেমান সাহেব স্ত্রীর হাত চেপে ধরেন।
প্লিজ, এই ডাক্তারের হাত থেকে তোমরা আমাকে বাঁচাও।