সাক্ষাৎকার

চেষ্টা করি লেখা যেন বোধগম্য হয় : মার্লন জেমস

Looks like you've blocked notifications!

জ্যামাইকার লেখক মার্লন জেমসের লেখা তৃতীয় উপন্যাসের নাম ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব সেভেন কিলিংস’। ২০১৪ সালের অক্টোবরে উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় এবং এর ঠিক এক বছর পর ২০১৫ সালের অক্টোবরে এটি জিতে নিল বুকার পুরস্কার। প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে উপন্যাসটি বিশ্বব্যাপী যে মাত্রায় পঠিত হয়েছে, ঠিক সে মাত্রায় সমালোচিতও হয়েছে এবং অবশেষে ১৩ অক্টোবর-২০১৫, মঙ্গলবার রাতে জেমসকে ভূষিত করা হয়েছে ম্যান বুকার বিজয়ী হিসেবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কী আছে এই ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব সেভেন কিলিংস’ উপন্যাসটিতে? বইটার নাম যদিও সাতটি খুনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, কিন্তু এটা মোটেও সংক্ষিপ্ত নয় এবং এখানে নিছক সাতটি খুনের কথা বলা নেই, বলা আছে আরো কিছু।

উপন্যাসটি পাঠককে নিয়ে যাবে সত্তরের দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের জ্যামাইকাতে, তার পর তাঁকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরবে আরো কয়েক দশক, পাঠককে নিয়ে যাবে আরো কয়েকটি দেশে। পাঠক তাঁর লেখায় আবিষ্কার করবেন বিচিত্র সব চরিত্র, এদের মধ্যে খুনি, সাংবাদিক, মাদক ব্যবসায়ী, এমনকি ভূত পর্যন্ত রয়েছে। জ্যামাইকার রাজধানী কিংস্টনের উত্তাল অবস্থাটাকে ধরার চেষ্টা করেছেন লেখক। সন্ত্রাস, দারিদ্র্য, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আর মাদকাসক্তির ভয়াবহ ছবি ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়। জ্যামাইকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বিশেষ করে জ্যামাইকার ওপর সিআইএর তৎপরতা এবং প্রভাব বইটিতে লক্ষণীয়। এখানে লেখক যেসব ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন, সেখানে কল্পনা যেমন আছে, নিরেট বাস্তবতাও আছে। কিছু কিছু চরিত্র বাস্তব এবং বিখ্যাত। তার মধ্যে বিশ্বখ্যাত শিল্পী বব মার্লে উপস্থিত। ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বরে গোটা জ্যামাইকায় যখন নির্বাচনী উত্তেজনা বিরাজ করছে, শিল্পী বব মার্লে তখন জ্যামাইকায়। ডিসেম্বরের ৫ তারিখে তাঁর গানের কনসার্ট হওয়ার কথা; কিন্তু এর মধ্যে ৩ তারিখ একদল বন্দুকধারী হামলা করল ববের বাসায়। এই হামলায় তিনি প্রায় মরতে বসেছিলেন। এ ঘটনার টানটান বর্ণনা পাওয়া যাবে উপন্যাসটিতে। যদিও উপন্যাসটিতে কোথাও বব মার্লের নাম নেই। লেখক মার্লন জেমস বব মার্লেকে এখানে সম্বোধন করেছেন ‘দ্য সিঙ্গার’ হিসেবে।

মার্লন জেমসের জন্ম ১৯৭০ সালে জ্যামাইকায়। তিনি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। তিনি সব মিলিয়ে তিনটি উপন্যাস লিখেছেন। এটি তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস। এ উপন্যাস নিয়ে জি কিউ ম্যাগাজিনকে দেওয়া তাঁর একটি সাক্ষাৎকারের কিছু অংশের অনুবাদ নিচে তুলে দেওয়া হলো। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিল মিশেল ডিন।

মিশেল : বইটিতে কোথাও বব মার্লের নাম নেই। তাঁকে বলা হয়েছে শুধু ‘দ্য সিঙ্গার’।

জেমস : হ্যাঁ।

মিশেল : তাঁকে এইভাবে অগোচরে রাখার সিদ্ধান্তটা আপনি কেন নিলেন?

জেমস : প্রথমত, আমি এটা করেছি যাতে গল্পটা এখানে প্রাধান্য পায়। তিনি একজন বিখ্যাত মানুষ। তা ছাড়া ১৯৭৬ সালেই তিনি একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন, এমনকি জ্যামাইকাতেও। তাঁকে যখন গুলি করা হলো, বেশির ভাগ লোক জানতই না যে তিনি দেশে ছিলেন। আমি তাঁকে বব মার্লে হিসেবে ফুটিয়ে তুলতে চাইনি; বরং তিনি যা বলতে চেয়েছেন, সেটা বলতে চেয়েছি। বব মার্লে নিজে যা ছিলেন এবং তিনি যা বোঝাতে চেয়েছেন, তার মধ্যে তফাৎ আছে।

মিশেল : আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না, একটু ভেঙে বলবেন? 

জেমস : অনেক কিছুই বলা যায়, যেমন আমাদের দেশের মানুষের জন্য তিনি ছিলেন সংগ্রাম, আত্মস্বীকৃতি এবং স্বাধীনতার প্রতীক। কিন্তু পাশাপাশি তিনি একজন সাধারণ মানুষও ছিলেন, যাঁর ব্যক্তিগত অনেক সমস্যা ছিল। তাঁর নিজের ভেতর অনেক অসংগতি ছিল, যেমন তিনি একই সঙ্গে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন, আবার হতে চেয়েছেন নামকরা রক সংগীতশিল্পী। এ ধরনের অসংগতিই আসলে মানুষকে মানুষ করে তোলে; আবার যখন কোনো প্রতীকী জিনিসের পতন ঘটে, তখন এটাই আবার সমস্যা বাধায়। এর সঙ্গে মানিয়ে নিতে আমাদের কষ্ট হয়।                

মিশেল : বইটিতে বহু কণ্ঠের সহাবস্থান অত্যন্ত আশ্চর্যের। আপনি কীভাবে এত বিচিত্র মানুষ নির্বাচন এবং এদের বক্তব্যকে এক ছকে আটকালেন? ছক আঁকা কাগজ ছাড়া তো এটা অসম্ভব!

জেমস : ছক আঁকা কাগজ একটা সত্যি সত্যি ছিল! এটা ছাড়া কোনোভাবেই সবার দিকে খেয়াল রাখার উপায় ছিল না। এটা আমি বাধ্য হয়ে করেছি, কারণ আমি চেয়েছি কোনো বিশেষ চরিত্রের পক্ষ না নিতে। আমি প্রথম থেকেই চেয়েছি যে এ বইয়ে চরিত্ররাই নিজেদের কথা বলবে, আমি উপস্থিত থাকব না। শুধু এক জায়গাতেই আমি উপস্থিত হয়েছিলাম, সেটা হলো নিনা বুরগেস (যৌনকর্মী) নামের এক চরিত্রের মতামতে, তাও সেটা ছিল জ্যামাইকান সমাজ সম্বন্ধে।

গল্পে একের অধিক দৃষ্টিভঙ্গির ধারণাটা আমার খুব পছন্দের এবং এটা আমি পেয়েছি আমেরিকান লেখক উইলিয়াম ফকনারের কাছ থেকে এবং হয়তো তুর্কি লেখক ওরহান পামুক থেকেও। ব্যাপারটা অনেকটা যেন একসঙ্গে অনেক মানুষের জীবনবৃত্তান্ত এবং কর্মকলাপ মেলানো। এটা অনেকটা রবার্তো বোলানোর ‘দ্য স্যাভেজ ডিটেকটিভস’ বইয়ের মতো, যেখানে একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক লোক জটলা করছে।

এ ছাড়া আমি গে টেলিসির জনপ্রিয় প্রবন্ধ ‘ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা হ্যাজ এ কোল্ড’ দিয়েও অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম এবং এটাই ছিল সম্ভবত আমার চিন্তার খুব কাছাকাছি। তাঁর মতো আমিও একটা প্রধান বিষয়ে সময় কাটাচ্ছিলাম। কিন্তু আমার নজর ছিল তাঁর আশপাশের মানুষের দিকে, তারা কীভাবে তাঁকে দেখছিল।

মিশেল : বড় পরিসরে যে ধরনের ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক উপন্যাস আপনি লিখেছেন সেটা মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে সাহিত্যের ধারা পরিবর্তন করে কার্ল কানুসগার্ড ও এডওয়ার্ড আউবিনের লেখার মতো খানিকটা ব্যক্তিগত ঘরানার লেখার দিকে মোড় নিচ্ছে।

জেমস : দেখুন, যারা মনে করে না যে তাদের সমাজে এমন কোনো ইস্যু আছে যেটা নিয়ে লেখা যায়, ঈশ্বর তাদের মঙ্গল করুন! এর থেকে চমৎকার আর কী হতে পারে!

ইউ টু-এর একটা গানের অ্যালবাম ‘ওয়ার’ সম্বন্ধে সবচেয়ে সুন্দর যে কথাটা বলা হয়েছে তা হচ্ছে, এই অ্যালবামটা এমন একটা দিনের আশায় আছে, যেদিন এ ধরনের আর কোনো অ্যালবামের প্রয়োজন থাকবে না। এটা যদিও খুবই গালভরা একটা কথা, তবু কিছুটা অর্থ বহন করে। সেদিক থেকে বলতে হয় যে, আমার লেখাতে আমি তেমন বড় কোনো বিবৃতি অথবা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করি নাই, শুধু চেষ্টা করেছি বোঝাতে। যেসব দুর্বোধ্য ঘটনা আমার দেশে ঘটেছে, আমি চেষ্টা করেছি আমার লেখায় সেটা যেন সবার কাছে বোধগম্য হয়।

আর একটা ব্যাপার হচ্ছে যে আমার কাছে মনে হয়, মানুষ কার্ল কানুসগার্ড পড়ে ভুল বোঝে। আমার কাছে মনে হয়েছে, তাঁর লেখা ছয় খণ্ডের ‘মাই স্ট্রাগল’ পুরোপুরি রাজনৈতিক উপন্যাস। আমি মনে করি, তাঁর লেখা সমাজের সঙ্গে খুব বেশি মাত্রায় যুক্ত। এমনকি তাঁর প্রথম খণ্ডের সঙ্গে আমার অনুভূতি এতই মিলে গিয়েছিল যে আমার কাছে মনে হচ্ছিল যেন তিনি যেন আমাকে নিয়েই এটা লিখেছিলেন। এবং আমি সাদা চামড়ার কোনো লেখক না, যে কি না সুইডেনে বসবাস করে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমার বানানো চরিত্রগুলো কেবল তাদের ব্যক্তিগত গল্পগুলো বলছে। এমনকি সিআইএর যে লোকটা, সে পর্যন্ত বিষণ্ণ কারণ, তার স্ত্রী তার ওপর রেগে আছে এবং সে কিছুতেই মনে করতে পারছে না, তার দ্বিতীয় সন্তান কোথায় কখন গর্ভে ধারণ হয়েছিল, কাজেই এগুলো সবই ব্যক্তিগত গল্প। আমার কাছে শুধু মনে হয় না যে মানুষ, বিশেষ করে জ্যামাইকার মানুষ, রাজনীতি থেকে সহজে মুক্তি পাওয়ার মতো সুযোগ তাদের আছে। এমনকি আমার বইয়ের একটা চরিত্র এ ব্যাপারে খুব ভালোভাবে কথা বলেছে! নিনা বুরগেস বলছে, আমি রাজনীতি ঘৃণা করি এবং সে সঙ্গে এটাও ঘৃণা করি যে রাজনীতির কথা আমাকে জানতে হবে।

মিশেল : আপানার লেখার সঙ্গে আর কী কী জিনিস জড়িত আছে বলে আপনি মনে করেন? 

জেমস : আমার একটা জিনিস দেখার খুব আগ্রহ যে, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য দেশগুলোতে বর্ণবাদের প্রক্রিয়া কেমন। জ্যামাইকায় সবাই এটাকে বলার চেষ্টা করে শ্রেণিবাদ, বর্ণবাদ নয়; কিন্তু এটা একেবারে বাজে কথা। এটা যদি বর্ণবাদই না হয়, তাহলে জ্যামাইকাতে যা ঘটেছে সেগুলোকে বলতে হয়, আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক কাকতালীয় ঘটনা।

আমি চেষ্টা করেছি গৎবাঁধা ক্যারিবিয়ান জগতের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসতে। আমার তৈরি কোনো চরিত্রই মার্কিন চলচ্চিত্র ‘কুল রানিংস’-এর ভেতর দেখা যাবে না। আমার ইচ্ছা যে, এই দৃষ্টিভঙ্গিটাকে মার্কিন জগতের অন্যান্য জায়গাতেও ব্যবহার করা। ঠিক যেমন যুক্তরাষ্ট্রের টিভি সিরিজ ট্রু ডিটেকটিভ : একই ছক, অনেক চরিত্র, ২০ বছর। আমি এখানে শুধু পুরোপুরি বিভিন্ন ধরনের মানুষ ব্যবহার করতে চাই।                         

মিশেল : এই বহু দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারটা আমাকেও একই সঙ্গে ‘ট্রু ডিটেকটিভ’ এবং ‘দ্য ওয়ার’ টিভি সিরিজের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে কিছুটা হলেও।  

জেমস : আমি ‘দ্য ওয়ার’ সিরিজের প্রথম সিজন দেখেছি এবং আমাকে যারা চেনে, আমার বন্ধুরা, আমার ছাত্ররা, তারা সবাই আমার কাছে এর অনেক গুণগান করেছে। তারা আমাকে এও বলেছে যে, আমি যদি বাকিটা দেখি তাহলে নাকি আমি অবশ্যই লজ্জিত হব এটা ভেবে যে, বাকিটা এতদিন আমি দেখিনি কেন?

মিশেল : বইয়ে একই সঙ্গে অনেক ধরনের কথ্যভাষার ব্যবহার যে পাঠককে বই থেকে কিছুটা দূরে ঠেলে দিতে পারে, সে ব্যাপারে আপনি কি একটুও চিন্তিত ছিলেন?

জেমস : মার্কিন পাঠক নিয়ে আমার কখনই কোনো সমস্যা হয়নি। আমি একটুও অবাক হইনি, যখন দেখেছি যে ভাষা নিয়ে প্রথম সমালোচনা এসেছে ব্রিটিশ পাঠকদের কাছ থেকে। অনেকে অবশ্য এতে অবাক হয়েছেন, কারণ ব্রিটেন ও জ্যামাইকার মধ্যে এখনো একটা উপনিবেশ-পরবর্তী জিনিস রয়েছে। এটা এখনো ভালোমতই উচ্চারিত হয়, শুধু আমি পারি না!

অনেক সময় আমাকে আপস করতে হয়। আমি সাধারণত ইংরেজিতে লিখি, আমি চাই মানুষ যাতে আমাকে সহজে বুঝতে পারে। এটা গীতধর্মী এবং গীতধর্মী গদ্যের একটা মহৎ গুণ হচ্ছে, আপনি যদি কোনো কারণে শব্দগুলো নিশ্চিত করে বুঝতে নাও পারেন, কমপক্ষে এর সুর আপনাকে প্রভাবিত করবে। শিল্পী বব মার্লের গান যখন মানুষ না শুনে কবিতার মতো করে পড়ে, তখন যে কিছুই বুঝতে পারে না সেটা এর একটা কারণ। কিন্তু এই গীতভাব মূর্ছনার কারণেই মানুষ শেষ পর্যন্ত এটাকে বুঝতে পারে।