কামিল ক্লদেল : নির্বাসিত শকুন্তলা
প্রথিতযশা আধুনিক ভাস্করদের নাম স্মরণ করতে হলে, প্রথমেই যাদের নাম আসবে তাঁরা হলেন ভাস্কর অগুস্ত রদ্যাঁ, হেনরি মুর, আলবার্টো জিওকোমিট্টি, বার্বারা হেপওয়ার্থ, কনস্টান্টিন ব্রানকুসি এবং লুই বর্জুয়া। কিন্তু আজও খুব সীমিত সংখ্যক কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ভাস্কর কামিল ক্লদেলের নাম। যদিওবা উচ্চারিত হয়, মূলত উচ্চারিত হয় ভাস্কর রদ্যাঁর নামের সঙ্গে, এককভাবে নয়। শিল্পী কামিল ক্লদেল স্বতন্ত্র একজন শিল্পী হিসেবে পরিচিত হওয়ার আগে ভাস্কর রদ্যাঁর শিক্ষার্থী, সহকারী, প্রেমিকা অথবা কলালক্ষী হিসেবে বেশি পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন আত্মাশ্রয়ী রমণী, আত্মপরিচয়ে পরিচিত হতে চেয়েছিলেন এবং সেই লক্ষ্যে আজীবন কঠোর পরিশ্রম ও সাধনা করে গেছেন।
একটা সময় কামিল ক্লদেলের প্রতিভা পরিচিত ছিল সীমাবদ্ধ পরিমণ্ডলের মধ্যে। পরবর্তী সময়ে, আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগেও শিল্পকলার প্রেমিকদের মধ্যে কামিলের নাম এতটা পরিচিত ছিল না, আজ যতটা পরিচিত। তবে শিল্পকলার প্রতি যাদের আগ্রহ অসীম তাদের জ্ঞানের ক্ষেত্রটা অসম্পূর্ণ থাকবে যদি না তারা এই অসাধারণ শিল্পী সম্পর্কে জানার সুযোগ পান। কামিল ক্লদেল শুধু একজন প্রতিভাবান ভাস্কর ছিলেন না, তিনি ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী একজন নারী, যার হৃদয়ও ছিল সৌন্দর্যের অধিকারী। জ্ঞানের প্রতি ছিল তাঁর অসীম ভালোবাসা, শিল্পকলার প্রতি ছিল শুদ্ধ সততা। কামিল ছিলেন স্বাধীনচেতা, সংবেদনশীল, বুদ্ধিমতি এবং আত্মবিশ্বাসী একজন নারী। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন মমতাময়ী। প্রেমিকা হিসেবে ছিলেন অসাধারণ এবং তুলনাহীন।
ফরাসি এই ভাস্করের নামের পাশে ভারতীয় ধ্রুপদি সংস্কৃত ভাষার কবি কালিদাসের চরিত্র শকুন্তলার নামটা দেখে, মনে প্রশ্ন জাগতে পারে শকুন্তলার সঙ্গে কামিলের সাদৃশ্য কোথায়? কামিলের একটি ভাস্কর্যের নামকরণ করা হয় ‘শকুন্তলা’র নামে, এছাড়াও ভাস্কর কামিলের জীবনের সাথে কোথাও যেন মিল খুঁজে পাওয়া যায়, কালিদাসের শকুন্তলার জীবনের। শকুন্তলা একবার হারিয়ে ফেলেছিল তার জীবনের ভালোবাসা দুষ্মন্তকে, বনবাসে কাটাতে হয়েছিল তাকে জীবনের দীর্ঘ সময়। কিন্তু শকুন্তলার সাথে কামিলের পার্থক্য হলো কামিল তাঁর ভালোবাসার মানুষটিকে কোনোদিনও ফিরে পাননি তাঁর জীবনে আর। জীবনের দীর্ঘ সময় তাঁকে কাটিয়ে দিতে হয় নির্বাসনে, মানসিক হাসপাতালের শীতল একটি কক্ষে। কামিলের জীবনকে একটি শব্দে বর্ণনা করতে বলা হলে সেই শব্দটি হবে ‘দুর্দৈব’ আর তাঁর শিল্পকর্মকে একটি শব্দে বর্ণনা করতে বলা হলে, সেই শব্দটি হবে ‘সম্পর্ক’। নিয়তি এবং সম্পর্ক দুটোই; কামিল ও শকুন্তলার জীবনের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত।
কামিল ক্লদেলের জীবনটা, অন্য অনেক বিখ্যাত শিল্পীদের মতো নাতিদীর্ঘ ছিল না। কিন্তু তাঁর সৃজনশীলতার চর্চার মৃত্যু ঘটে খুব অল্প বয়সে। বলা যায় তাঁর পেশাগত জীবনের হত্যা এবং আত্মহত্যার সমন্বয়ে একটা ঘটনা ঘটেছিলো খুব অসময়ে এবং আকস্মিকভাবে। শুনতে যেমন বিদঘুটে লাগছে, বিষয়টা মূলত তার থেকেও জটিল। কামিলের জীবন শেক্সপিয়ারের নাটকের থেকেও নাটকীয় এবং ফ্রান্সিসকো গয়ার শিল্পকর্মের থেকেও বিষাদময়। এদিথ পিয়াফের সঙ্গীতের মতো অমসৃণ ও করুণ।
কামিলের পেশাগত ও সামাজিক জীবনের অবসান ঘটলেও তাঁর জৈবিক শরীরটুকু নিয়ে তিনি বেঁচে ছিলেন অনেকগুলো বছর; একটি পরিপূর্ণ জীবন বলা যায়। তাঁর জীবনের শেষ তিরিশটা বছর কাটাতে হয়েছিল মানসিক হাসপাতালের লম্বা কোরিডোরে হেঁটে বা বাগানে প্রকৃতির মধ্যে মুক্ত জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করে বা হীম শীতল পাথরের দেয়ালের কোনো কক্ষে ডুকরে ডুকরে কেঁদে। তাঁকে এই অন্ধকূপে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল আর কেউ নয়, তাঁর জন্মদাত্রী মা এবং তাঁর অনুজ, যাকে তিনি নিজ সন্তানের মতো করে মানুষ করেছিলেন। শিল্পী কামিলকে তাঁর বাবা যত দিন বেঁচে ছিলেন আগলে রেখেছিলেন ও তাঁর শিল্প চর্চায় সব রকমের সহযোগিতা করেছিলেন। কন্যার স্বপ্নকে তিনি শ্রদ্ধা করেছেন এবং কামিলকে তাঁর শিল্পচর্চায় সর্বোত্তম স্বাধীনতা প্রদান করেছিলেন। সেই কাজটি করতে তিনি সবধরনের ঝুকির মোকাবিলা করেছেন, এমনকি করেছেন বাড়তি পরিশ্রম।
কিন্তু ১৯১৩ সালে পিতার মৃত্যুর পরপরই, তাঁর মা তাঁকে জোরপূর্বক মানসিক হাসপাতালে প্রেরণ করেন। এবং কামিলের ছোট ভাই ও বোন মায়ের পক্ষেই থেকে যান আজীবন। প্রথমত তারা সবাই খুব প্রথাগত, রক্ষণশীল, ধার্মিক মানুষ ছিলেন এবং দ্বিতীয়ত পারিবারিক সম্পত্তির লোভের কারণে। ভিল ইভরার্ড হাসপাতালে তাঁকে সাময়িকভাবে রাখা হয় এবং পরে স্থায়ীভাবে রাখা হয় সেন্ট হসিপটালিয়ের মন্টফাভে, আভিনিয়ঁতে। কামিল তাঁর একটি চিঠিতে সেই সময়কার কষ্টের কথা ব্যক্ত করেছিলেন এভাবেই – ‘একাকী বিড়ালদের সাথে আমার জীবন কাটানো আর লাঞ্ছিত অনুভব করার জন্য আমাকে তিরষ্কার (কী ভয়াবহ যেন সেই অপরাধ) করা হয়েছে। আর সেই অভিযোগের উপর ভিত্তি করে যে, স্বাধীনতাহীন, খাদ্য, উষ্ণতা আর এমনকি ন্যূনতম চাহিদা থেকে বঞ্চিত হয়ে সাড়ে পাঁচ বছর আমাকে একজন অপরাধীর মতো বন্দী করে রাখা হয়েছিল।’
শকুন্তলা এবং কামিল, সৃষ্টি ও স্রষ্টা
ভাস্কর কামিলের জন্ম হয়েছিল ১৮৬৪ সালের ৮ ডিসেম্বর, উত্তর ফ্রান্সের আইন শহরের ফের-অন-টারডেনোয়াতে । মাঠ আর পাহাড়ে ঘেরা ছোট্টো একটি শহর। পরবর্তীকালে কামিলের পরিবার ভিলনোভ-সুর-ফেরতে স্থানান্তরিত হয়, কামিলের স্মৃতিতে যে জায়গাটি সারাজীবন অম্লান ছিল। যার মাটির সাথে কামিলের ছিল হৃদয়ের বন্ধন। কামিলের শৈশবের অনেকটা সময় কাটে গ্রামে, সেখানে সে কাঁদামাটি পাথরে প্রকৃতিতে শিল্প খুঁজে পেতেন। মাত্র বারো বছর বয়সেই কামিলের সৃজনশীলতার উন্মেষ হতে শুরু করে। এবং ১৮৮১ সালে তিনি পরিবারের সাথে প্যারিস চলে আসেন উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য।
উনবিংশ শতাব্দীতে শিল্পকলার পাঠদানের প্রক্রিয়ায় নগ্নতার চর্চা ছিল অপরিহার্য, যে শিল্পী মানব শরীরের নগ্ন রেখাচিত্র সঠিকভাবে অঙ্কন করতে জানতেন না, তিনি প্রকৃত শিল্পী বলে গণ্য হতেন না। অধিকন্তু, নারীদের নগ্ন-চিত্র চর্চায় ছিল নিষেধাজ্ঞা। তবে প্যারিসের মতো আধুনিক একটি শহরে, অনেক সম্ভবনার দরজা ছিল উন্মুক্ত, বেশ কিছু প্রাইভেট আর্ট স্কুল নারীদের শিল্পকলার চর্চার সব ধরনের সুযোগ দিত তেমন একটি স্কুল ‘আকাডেমি কোলারোসি’তে কামিল শিক্ষার সুযোগ পান। মেধার সঙ্গে তাঁর শিক্ষাপর্ব সমাপ্ত করেন। তিনি শিক্ষা সমাপ্ত করবার পরে একটি স্টুডিওতে শিল্পচর্চা শুরু করেন, যেখানে অ্যালফ্রেড বুশের শিক্ষকতা করতেন। রদ্যাঁ আলফ্রেডকে সরিয়ে, উপযাচকের মতন নিজে সেই দায়িত্বটি নেন এবং ১৮৮৫ সালে রদ্যাঁ কামিলকে তাঁর সককারী হিসেবে কাজ করবার জন্য প্রস্তাব দেন।
রদ্যাঁর সঙ্গে যখন কামিলের পরিচয় ঘটে তখন কামিলের বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর, রদ্যাঁর সঙ্গে কামিলের বয়সের পার্থক্য ছিল ২৪ বছরের। তা স্বত্তেও তাদের মধ্যে গভীর প্রণয় ঘটে এবং পরিণাম হয় ভয়াবহ। মাত্র ১০ বছরের সেই সম্পর্ক থেকে সৃষ্টি হয় অসংখ্য অমর শিল্পকর্ম। তিনি রদ্যাঁর শিল্পকর্মের মডেলও হয়েছেন এবং ১৮৯২ সালে তিনি নিজেও রদ্যাঁর ভাস্কর্য গড়েছেন। তাদের মধ্যে বয়সের পার্থক্য থাকলেও কামিলের সীমাহীন অদম্য মানসিক শক্তি কামিলকে রদ্যাঁর সমপর্যায়ের বলেই মনে হয়, এমনও মনে হতে পারে কামিলের প্রতিভা রদ্যাঁর সুনাম থেকেও ছড়িয়ে গিয়েছিল অনেকটা। অন্যদিকে রদ্যাঁ বয়োজ্যেষ্ঠ এবং সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও, নানা কারণে তিনি ছিলেন একজন আক্রম্য এবং অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর মানুষ, সে জন্য কামিলকে তিনি ব্যবহার করেছিলেন তার উত্তরণের সিঁড়ি হিসেবে।
কামিলের গড়া রদ্যাঁর ভাস্কর্য, ১৮৯২
১৮৮৮ সালের শেষদিকে কামিল মনোনিবেশ করেন শকুন্তলা নির্মাণে। তার কিছুদিন আগে তিনি লন্ডন ভ্রমণ শেষে, রদ্যাঁর সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হন যে রদ্যাঁ কোনো নারী শিক্ষার্থীকে নিয়োগ করতে পারবে না এবং তাদের সম্পর্ককে সামাজিক স্বীকৃতি দেবে। যদিও বাস্তবে সেরকমটা ঘটতে আমরা দেখিনি কখনই। তাই কামিল ‘শকুন্তলা’ সৃষ্টিতে মনোসংযোগ করেন এবং তিনি সফলভাবে শকুন্তলাকে নির্মাণ করেন। এই ভাস্কর্যে দেখা যায় নারী শরীরটি বসে ঝুকে আছে আর পুরুষ শরীরটি নারীর কাছে হাঁটু গেড়ে বসে আছে, যেন নারীর সীমাহীন ভালোবাসার কাছে পুরুষটি আত্মসমর্পণ করছে। মানব মানবীর এই দৈহিক ও মানসিক গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক, তার কথা বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে কামিলের শিল্পকর্মে। একই সালে প্যারিসে সালোন ( ফরাসি শিল্পীদের শিল্পকলা প্রদর্শনী) সম্মানসূচক স্বীকৃতি পেয়েছিলেন শিল্পী কামিল ক্লদেল। তাঁর সফলতার দরজা খুলতে শুরু করেছে যে সময়টি, ঠিক সেই সময় তাঁর খুব আপনজনেরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে তাঁর সেই পথকে রুদ্ধ করে দেয়।
কেনো কামিলের ভাস্কর্যে মানব-মানবীর প্রেম এত তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে? শকুন্তলা (১৮৮১), দ্য ওয়ালর্টয (১৮৮৯), দ্য ম্যাচিউর এইজ (১৮৯৮-১৯১৩) প্রভৃতি শিল্পকর্মে মাধ্যমে, কামিল অভিব্যক্ত করেছেন ভালোবাসার জন্য তাঁর তৃষ্ণা। কারণ শিল্পী রদ্যাঁকে তিনি সর্বস্ব উজাড় করে ভালোবেসেছিলেন। পরিণামে পেয়েছেন যন্ত্রণা এবং অবজ্ঞা। শকুন্তলার আরো বেশ কয়েকটি ভার্সন রয়েছে। মার্বেল ভার্সনের নামকরণ করা হয় ভার্টুমনুস এ পোমোনা ( ১৯০৫) এবং ব্রোঞ্জ ভার্সনের নামকরণ করা হয় অ্যাবান্ডনমেন্ট (লা'আবোঁডোঁ)। কামিলের প্রকৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসার ফসল তাঁর সৃষ্টি শিল্পকর্মগুলো। মাটিকে সে বিশেষ ভালোবাসতো, যেকোনো কাঁদামাটির দলা থেকে সৃষ্টি করতে পারত অসম্ভব সুন্দর শিল্পকর্ম, গ্রিকপৌরাণিক কাহিনীর প্রতি ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ (পার্সিয়াস অ্যান্ড দ্য গরগন, ১৯০৫) যেমন ছিল ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনীতে।
সৃষ্টিতে মগ্ন শিল্পী কামিল ক্লদেল
কিন্তু জীবনের অন্ধকার সময়ে, তিনি তাঁর শিল্পকর্মগুলোকে ধ্বংস করে ফেলেছিলেন তার মধ্যে মাত্র নব্বইটি শিল্পকর্ম আজও টিকে আছে, সেগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই ভাস্কর্য, অল্পকিছু চিত্রকলা এবং রেখাচিত্র। সেই সব শিল্পকর্ম পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় কামিল কত বড় মাপের শিল্পী ছিলেন। তিনি প্রথম নারী আধুনিক ভাস্করের মর্যাদা পাবার যোগ্য। তাঁর ভাবনা সেই সময় ছিল সময়ের বহু আগের, তিনি ছিলেন আভোঁগার্ড শিল্পী। তাঁর বিষয় নির্বাচন, উপাদান নির্বাচন, শৈলী, সবকিছুকে বিবেচনায় আনলে বোঝা যায়, তিনি যদি জীবনের আরো ৩০টা বছর তাঁর শিল্পচর্চা অব্যাহত রাখতে পারতেন তবে আজ শিল্পকলার জগৎ কতটা ঋদ্ধ হতো!
কামিলের বিশেষত্ব ছিল তিনি দুটো মাধ্যমকে মিশ্রিত করে ভাস্কর্য গড়তেন, যেমন মার্বেল বা অনিক্স পাথরের সাথে বোঞ্জকে জুড়ে দিতেন। শিল্পকলা নিয়ে তিনি পরিক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভীত ছিলেন না, বরং ছিলেন আধুনিক মানসিকতার। কামিলের শিল্পকলায় সমসাময়িক পোস্ট ইম্প্রেশনিস্টদের প্রভাব লক্ষণীয়, আর্ট ন্যুভো বা জাপানি ছাপচিত্রের প্রভাবও সুস্পষ্ট। তবে এই সব ভিন্নধর্মী শৈলীকে তাঁর শিল্পকর্মে আশ্রয় দেওয়া প্রমাণ করে তাঁর মুক্ত মনের কথা। ‘দ্য ওয়েভ’ (১৮৯৭)-এ অনিক্স পাথরের মাঝে ব্রোঞ্জের গড়া তিনটি নারী শরীর সুন্দর ভাবে ভাসছে। তাঁর জীবনে সম্পর্কের মধুরতা দেখা না গেলেও কাজের মধ্যে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন, নারী মূর্তির অবয়বের মধ্যে দিয়ে, জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আটপৌরে কাজের মধ্যে দিয়ে, যেমন ফায়ারপ্লেসের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা, বা স্নানঘরে বিভিন্ন বয়সের নারীদের কানাকানি (দ্য গসিপস, ১৮৯৭)। ‘দ্য ওয়েভ’-এ শিল্পী কাটসুশিকা হকুসাইয়ের ‘দ্য গ্রেট ওয়েভ’ এর প্রভাব (১৮৩২) সুস্পষ্ট, তবে পাথরের মতো কঠিন একটি পদার্থকে পানির মতো তরল একটি পদার্থে বা সমুদ্রের ঢেউকে প্রকাশ করা অত্যন্ত দুরূহ একটি কাজ, যা তিনি করেছেন সফলতার সাথে।
কামিলের ভাস্কর্য, দ্য ওয়েভ, ১৮৯৭
কামিলের জীবনে সব সম্পর্কগুলো অভিশাপে রূপান্তরিত হয়েছিল। রদ্যাঁর সাথে, মায়ের সাথে এবং পরিবারের অন্যদের সাথে তাঁর সম্পর্কের তিক্ততা, তাঁর গর্ভপাতের যন্ত্রণা, সব কিছুকে তিনি তাঁর শিল্পকর্মের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। মূলত তাঁর সেই যন্ত্রণা আমরা দেখি রদ্যাঁর সাথে তাঁর বিচ্ছেদের পরবর্তী সময়গুলোতে। কামিল যে শিল্পকর্মগুলোর জন্য বিখ্যাত তাদের মধ্যে ‘দ্য ম্যাচিউর এইজ’ অন্যতম, যেখানে তিনি দেখিয়েছেন একজন পুরুষকে একজন বৃদ্ধ নারী টেনে নিয়ে যাচ্ছে, পুরুষটি যেন সম্মোহিত এবং একজন তরুণী হাঁটু গেড়ে বসে পুরুষটির জন্য অনুনয় বিনয় করছে। স্পষ্টই এখানে তিনি রদ্যাঁর সাথে তাঁর সম্পর্কের বর্ণনা করেছেন। রদ্যাঁ রোজ নামের একজন রমণীর সাথে সম্পর্কে যুক্ত ছিলেন আজীবন, কামিলের সব যন্ত্রণার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন যিনি, তাকেই কামিল অভিব্যক্ত করেছেন। রোজকে কামিল কুৎসিত ও বৃদ্ধ দেখিয়েছেন (বাস্তবে যদিও সত্যি ছিল এটাই)। কামিলের প্রতিশোধের তীব্রতা কিছুটা হলেও মিটিয়েছেন সৃষ্টির মাধ্যমে।
দ্য ম্যাচিউর এইজ (১৯৯৮-১৯১৩)
এদিকে শকুন্তলাকে (১৮৮১ সালে) যখন কামিল সৃষ্টি করেছিলেন তখন তিনি, ছিলেন আবেগময়ী একজন তরুণী, তিনি তাঁর সমস্ত সত্তা দিয়ে পেতে চেয়েছিলেন রদ্যাঁকে, সেই তীব্র প্রেমের প্রতিশ্রুতি তিনি ব্যক্ত করেছেন শকুন্তলার মাধ্যমে। শকুন্তলা এবং দ্য ম্যাচিউর এইজ কামিলের সাথে রদ্যাঁর সম্পর্কের দুটি ভিন্ন মেরুর কথা, বলে শুরু ও শেষ বিন্দুর কথা।
কামিল ক্লদেল মানসিক হাসপাতালের চার দেয়ালের ভেতরে জীবনের শেষ বছরগুলো কাটিয়েছিলেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একটি শিল্পকর্মও তিনি নির্মাণ করতে পারেননি। একজন শিল্পীর জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি হলো তাঁকে তাঁর সৃষ্টি থেকে বঞ্চিত করা। সেটা মৃত্যুর যন্ত্রণা থেকেও যন্ত্রণাময়। শিল্পীদের জীবন যদিও মুক্তোর মতো মসৃন নয় তবুও কামিলের ক্ষেত্রে যেন মাত্রাতিরিক্ত ছিল, এমনকি মৃত্যুর পরেও কামিল সুবিচার পাননি। মৃত্যুর পূর্বেও যারা তাঁকে কোনোধরনের সাহায্যের বা বন্ধুত্বের হাত এগিয়ে দিয়েছিলেন, ব্যর্থ হয়েছিলেন। মৃত্যুর পরেও তাঁর ভাগ্যে জোটেনি তেমন কোনো শ্রদ্ধা। খুব ছোট একটা গ্রামে, মানসিক হাসপাতালের সাধারণ একটি সমাধিস্থলে তাকে সমাধিস্ত করা হয়। তাঁর পরিবারের কোনো সদস্য তাঁর শবযাত্রায় বা শেষকৃত্যতে উপস্থিত ছিল না, এমনকি তাঁর মরদেহকে পরিবারের কোনো সদস্যও দাবি করতে আসেননি। কী নিষ্ঠুর হতে পারে মানুষ! শিল্পীদের প্রতি পরিবারের, সমাজের, রাষ্ট্রের এহেন আচরণ যেন খুব স্বাভাবিক। এটাই যেন শিল্পীদের অবধারিত নিয়তি।
শকুন্তলা
কামিল ক্লদেলের নাম বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবার উপক্রম হলেও, কামিলকে তাঁর অসংখ্য ভক্তরা ধরে রেখেছে হৃদয়ে। অনেক পুস্তক বা পত্রিকার পাতায় কামিলের কথা লেখা আছে, সেই শব্দগুলো যেন একেকটি স্মৃতিস্তম্ভ। কামিলের শিল্পকর্ম আজ শোভা পাচ্ছে রঁদ্যার ভাস্কর্যের পাশে; এটা কামিলের জন্য আশীর্বাদের নাকি অভিশাপের ঠিক করে বলা সম্ভব নয়, কারণ কামিল বেঁচে থাকলে নিজেকে আজ কোনো অবস্থানে দেখতে চাইতেন, একজন মুক্ত মানুষ হিসেবে বা নারী বা ভাস্কর হিসেবে, সেটা তাঁর রেখে যাওয়া শিল্পকর্ম আর চিঠি পত্রগুলো থেকে অনুমেয়; তিনি অন্যের করুণার পাত্র হয়ে জীবন কাটাতে চাননি। তিনি ছিলেন স্বাধীন শিল্পী, যিনি ভালোবাসার কথা বলতে চেয়েছিলেন তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে। যে ভালোবাসা এই বৈষয়িক পৃথিবীতে শুধুই বোকামি নামে পরিচিত। শকুন্তলা এই পৃথিবীকে দিয়ে গেছে ভরতকে আর কামিল রেখে গেছেন তাঁর সন্তানতুল্য শিল্পকর্ম। তাঁকে কে অস্বীকার করতে পারে? কামিল, যাঁর জন্ম হয়েছিল পৃথিবীর উন্নত সভ্য দেশ ফ্রান্সে, দীর্ঘ ৭৮ বছরের যন্ত্রণাময় জীবন যাপনের পর ১৯৪৩ সালের ১৯ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কামিলের পরিবারের সদস্যদের কথা আজ পৃথিবী জানতে পারছে কামিলের নামের মাধ্যমে, যারা একদিন অনেক চেষ্টা করেছে এই পৃথিবী থেকে চিরতরে কামিলের নিশানা মুছে দিতে। আজ প্যারিসের বুকে রয়েছে কামিলের নামে একটি জাতীয় প্রদর্শনশালা ‘দ্য মিউজে কামিল ক্লদেল’। কামিল আজ অগণিত শিল্পপ্রেমিকদের আরদ্ধের বিষয়। পৃথিবীর মানুষ কামিলকে মনে রাখবে আজীবন, যে নামটি নির্বাসিত হওয়ার আর কোনো আশঙ্কা নেই।
দ্য মিউজে কামিল ক্লদেল, প্যারিস, ২০১৭