জীবনানন্দ : একগুচ্ছ অনুভব
১.
যেকোনো কিছুতেই শুরুর চেয়ে শেষটাই বড়। যেমন : জীবনানন্দের প্রথম বই ঝরা পালক যেখানে অনেকাংশে নজরুল-মোহিতলালের অপভ্রংশমাত্র, সেখানে সাতটি তারার তিমির পর্যন্ত এসে দেখি তিনি সম্পূর্ণই আলাদা। আর এত বেশি আলাদা যে, রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের পর তাঁর স্বরই এক নিমেষে চেনা যায়- এতটাই নিজস্ব ও মৌলিক কাব্যস্বর সৃষ্টি করে গেছেন তিনি।
২.
কবিতার প্রাথমিক বোধটুকু হয়তো শুরুতে কয়লার মতোই। আর একেই পুড়িয়ে-গলিয়ে-ছেনে একজন কবি হীরকখণ্ড করে তোলেন। ধরা যাক ‘বনলতা সেন’ কবিতার কথাই। এর অন্তত তিনটি খসড়া পাওয়া যায়। এখন আমরা যেটিকে পাঠ করি এর আগের খসড়াগুলোকে পড়লে যে কারো মনে হতেই পারে যে, এত কাঁচা কবিতা লিখেছিলেন জীবনানন্দ! অথচ এখন যখন আমরা সর্বশেষ রূপটি পাঠ করি একে হীরকের চেয়েও উজ্জ্বল ও দ্যুতিময় মনে হয়।
৩.
কবির মাতৃভাষা বা নিজভাষা (যে ভাষায় তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে লেখালেখি করেন) যে কত গুরুত্বপূর্ণ এরও প্রমাণ ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি। বাংলা কবিতাটি পড়ার পর কেউ যখন কবিরই অনূদিত ইংরেজি কবিতাটি পড়ে উঠবেন, তার মনে হতেই পারে যে, কবি নিজ হাতে নিজের কবিতাটিকেই হত্যা করেছেন! কারণ বাংলাভাষার সুর-স্বাদ-গন্ধ আর গাঢ় অনুভূতির কিছুই প্রায় খুঁজে পাওয়া যায় না সেই অনুবাদটিতে।
৪.
কবিতা যে কেবল ভাব আর আবেগ দিয়েই লেখা হয় না, টের পাই যখন জীবনানন্দের পাণ্ডুলিপিতে অজস্র কাটাকুটি লক্ষ করি। শব্দের পর শব্দ আর পঙ্ক্তি বদল করে করে যেন তিনি এক-এক খণ্ড পাথর কুঁদে কুঁদে বানিয়েছেন অনুপম কবিতা-ভাস্কর্য।
৫.
বর্ষা চিরকালই বাংলার কবিদের প্রিয় ঋতু এবং রবীন্দ্রনাথ কেবল বর্ষার কবিতা-গানের ভেতর দিয়েই বাঙালির কাছে চির-অমর থাকতে পারেন। অথচ জীবনানন্দে দু-একটি অনুল্লেখ্য কবিতা ছাড়া বর্ষার রচনা নেই বললেই চলে।
৬.
বাংলায় হেমন্ত ঋতু বোধ করি কেবল কাগজে-কলমেই আছে। বাস্তবে এর অস্তিত্ব আমরা বহুকাল ধরে তেমনভাবে আর টের পাই না। অথচ এও যে ছিল এক সতেজ-সক্রিয় ঋতু, কেবল জীবনানন্দের কবিতাই তা জীবন্তভাবে ধরে রেখেছে।
৭.
প্রকৃত কবিতা বোধহয় কবি তাঁর অদৃশ্য রক্ত দিয়ে লেখেন। এ কথা সবচে বেশি মনে হয় জীবনানন্দের অনেক কবিতা পড়ে ওঠার পর। কেননা, তাঁর বহু বহু পঙ্ক্তি আমাদের হৃৎপিণ্ড বিদ্ধ করে আমাদের রক্তের ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ে।
৮.
প্রকৃত কবি ও কবিতা চিরকালই দূরবিস্তারী ও বিচিত্রপথগামী। বড় বড় সমালোচকও অনেক ক্ষেত্রে তার থৈ পান না। এর বড় প্রমাণ, যে বুদ্ধদেব বসু প্রথম দিকের জীবনানন্দকে তীব্র আলোচনা-মূল্যায়নের ভেতর দিয়ে, রীতিমতো লড়াই চালিয়ে প্রতিষ্ঠা পাইয়ে দিতে সচেষ্ট, তিনিই তাঁর পরবর্তী আরো বিকশিত কাব্যবোধ ধরতে না পেরে বিরক্ত হয়ে লিখেছিলেন, ‘জীবনানন্দ কী লিখছেন আজকাল!’
৯.
সাহিত্যের সবচেয়ে বড় শত্রুও যে জীবনের পরম মিত্র হতে পারেন- এরও এক জীবন্ত উদাহরণ আছে জীবনানন্দে। যে সজনীকান্ত দাস শনিবারের চিঠিতে শ্লীল-অশ্লীল সব ভাষায় প্রায় সারা জীবন জীবনানন্দকে চাবুক মেরে গেছেন, তিনিই ট্রাম দুর্ঘটনার পর হয়ে উঠলেন কবির সবচে বড় মিত্র ও শুভার্থী। আপ্রাণ চেষ্টা করলেন কবিকে বাঁচাবার, সহযোগিতা করলেন সর্বক্ষেত্রে। যদিও বুদ্ধদেব বসু একে ভড়ং ভেবে করেছেন কঠিন খিস্তি, ‘বুড়ো বেশ্যার ঢং দেখে বাঁচিনে!’
১০.
বহু কবি-লেখক-তত্ত্বপণ্ডিত জীবনানন্দকে ‘নেতিবাদী’ বলে বেশ তারস্বরে চেঁচিয়েছেন এবং কেউ কেউ ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাটিকে ঘিরে কবিকে তুলোধুনো করেছেন। অথচ এই কবিতাটির ভেতরই রয়ে গেছে সবচে জীবনবাদী লাইন : ‘গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে...।’ আর সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, বিষণ্ণ-ব্যক্তিও ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রবল আশাবাদ পোষণ করতে পারেন। জীবনানন্দ কি তাঁর আপাত নেতি-হতাশার ভেতর দিয়ে রবিকরোজ্জ্বল আশাবাদী আগামীর কথাই সবচেয়ে বেশি বলে যাননি?