রম্যগল্প
শোকেস
কিছু জিনিস থাকবে শোকেসে।
আর শোকেসের জিনিস মানে বিশেষ জিনিস। দূরের জিনিস। ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। কাঁচঘেরা দূরত্বে, দূর থেকে দেখতে হবে।
ছোটবেলায় এমনই ছিল ধারণা।
ধারণাটা পোক্ত করেন মকিম ভাই আর তাঁর বাবা।
মকিম ভাই আমাদের দুই ক্লাস ওপরে পড়তেন। কিন্তু তাঁকে স্কুলের স্যারদের চেয়েও বেশি ভয় পেতাম আমরা।
এর প্রধান কারণ মকিম ভাই ছিলেন বামপন্থী।
না। রাজনীতির না।
তার বাম হাতে ছিল রাজ্যের শক্তি। মাঝেমাঝে তিনি সে শক্তি প্রদর্শন করতেন। একবার তার বাউয়া চড় খেয়ে একজনের ডান কান বন্ধ হয়ে গেল। অর্ধেক শোনে অর্ধেক শোনে না। কানে বাতাস ফিরিয়ে আনতে পুরো এক সপ্তাহ সময় লেগেছিল।
এলাকায় মকিম ভাইয়ের নাম হয়ে গেল ‘ড্যাবরা মকিম’। কিন্তু আমরা ভুলেও সেই নামে ডাকতাম না। কান বন্ধ হওয়ার ঘটনায় আমাদের কানে পানি গেছে।
সে সময় মকিম গাজী নামের এক সন্ত্রাসী দেশজুড়ে তোলপাড় ফেলে দেয়। সন্ত্রাসী মকিম গাজীর কল্যাণে আমরা জানতে পারি ডাণ্ডাবেড়ি নামে একটা জিনিস আছে এবং সেটা এমনই ভয়ংকর যে পা আর হাতকে এক ঘাঁটে জল খাওয়ায়।
আমাদের মকিম ভাইও গাজী বংশেরর ছেলে। আচরণেও অনেকটা মিল। মকিম ভাইকে ভয় না পাওয়ার কোনো কারণ নেই।
আমরা মকিম ভাইকে ভয় পাই।
তবে বিকেল বেলাটা অন্যরকম।
ফুটবল পাগল মকিম ভাই বিকেলে বেশ আন্তরিক। আমরা একসাথে ফুটবল খেলি।
সেই সময় চার নম্বর বলে ফুটবল খেলতাম আমরা। আর স্বপ্নে দেখতাম পাঁচ নম্বর ডিয়ার বল।
ডিয়ার বল মানে তখন বিশাল ব্যাপার। ভদ্রলোকেরা যেমন স্যান্ডোগেঞ্জির ওপর জামা পরেন ডিয়ার বলেরও তেমনি এক চামড়ার ওপর আরেক চামড়ার প্রলেপ। সেই চামড়া আবার খড়খড়ে চামড়া না। তুলতুলে। লিপজেল লাগানো ঠোঁটের মতো।
গল্প শুনতাম, ডিয়ার বল নাকি মেয়েদের শরীরের মতো নরম। জোরে শট নিলেও পায়ে টের পাওয়া যায় না।
মেয়েদের শরীর সম্পর্কে ধারণা ছিল না। কিন্তু বলার ভঙ্গিতে ঠিক বুঝতে পারতাম ডিয়ার বল কতটা পা বান্ধব।
যারা ডিয়ার বলে খেলত, তাদের পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আহা! ওদের পায়ের লাথি খাওয়াও সৌভাগ্যের বিষয়। কতভাবে যে তাদের সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু সর্বোচ্চ সম্পর্ক হয় বল কুঁড়িয়ে আনা পর্যন্ত। খেলতে আর নেয় না।
গরিবের মসলিন যেমন জর্জেট। তেমনি চার নম্বর বলকেই ডিয়ার মনে করে প্রিয়ার সাধ বান্ধবীতে মিটাই আমরা। তবে স্বপ্ন দেখা ছাড়ি না।
আগুনের দিনের মতো আমাদের স্বপ্ন দেখার দিনও শেষ হয়।
একদিন আমাদেরও ডিয়ার বল হয়।
আমাদের মানে মকিম ভাইয়ের।
মকিম ভাইয়ের বাবা একটা ডিয়ার বল কিনে আনেন।
বল বাসায় পৌঁছানোর আগে পুরো এলাকায় খবর পৌঁছে যায়।
উত্তেজনায় আমরা মেয়েদের শরীরের মতো নরম হয়ে যাই।
আহ! ডিয়ার বল! আজ থেকে আর পায়ে অ্যাংলেট পরতে হবে না। কী আনন্দ!
একসময় উড়তে উড়তে মকিম ভাইয়ের বাসায় চলে যাই আমরা।
খুব যত্ন সহকারে ডিয়ার বলে পাম্প করা হচ্ছে।
আস্তে আস্তে জেগে উঠছে ডিয়ার বল।
জেগে উঠতে থাকি আমরাও।
বিস্ময়ে আমাদের পায়ে ঝিনঝিন ধরে।
আর কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তারপর স্বপ্নপূরণ। এমন সময়ে বিগড়ালে চলে! পায়ের বোকামিতে বিরক্ত লাগে খুব।
ধাপ ... ধাপ ...
ডিয়ার বলে দুটো ড্রপ দেন মকিম ভাই।
আহা! কি মিষ্টি শব্দ। ডিয়ার বলের আওয়াজের মধ্যে চার নম্বর বলের কর্কশ ভাবটা নাই।
বলের দিকে আমাদের অবাক দৃষ্টি।
আমাদের দৃষ্টিতে উপেক্ষা করে বাবার হাতে বলটা দেন মকিম ভাই।
আমাদের হাত নিশপিশ করে। তর সয়না। হাত ঘুরে বলটা কখন আসবে আমাদের হাতে।
ধাপ ... ধাপ ...
মকিম ভাইয়ের বাবাও কয়েকটা ড্রপ দেন মাটিতে।
তারপর উপস্থিত আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে একটা অর্থহীন হাসি দেন।
তারপর ...
তারপর আমরা যখন বলের দিকে হাত বাড়াতে যাব ঠিক সেই মুহূর্তে শোকেসের তালা খুলে ডিয়ার বলটা শোকেসে রেখে দেন মকিম ভাইয়ের বাবা।
সেই থেকে ডিয়ার বলটা মকিম ভাইদের শোকেসেই ছিল। মাঝেমধ্যে শুধু পাম্প করার জন্য বের করা হতো।
মকিম ভাইয়ের ভয়ে আমরা দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখি এবং মেনে নেই কিছু জিনিস শোকেসে থাকবে। হোক সেটা পাঁচ নম্বর ডিয়ার বল।