জন্মদিন
কাজল নামের সেই ছেলেটি...
সম্ভ্রান্ত একজন শৌখিন বাবার সন্তান ছিল ছেলেটি। বাবার অদ্ভুত শখ ছিল সন্তানদের নাম বারবার বদলে নতুন নাম রাখার। ছেলেটির প্রথম নাম ছিল শামসুর রহমান। ডাকনাম কাজল। কিছুদিনের মধ্যেই বাবার শখ হলো নাম পরিবর্তনের। সে সুবাদেই তাঁর নাম বদলে গেল। এই পরিবর্তিত নাম নিয়েই ছেলেটি পরিচিত হলো অগণিত জনতার প্রিয় মানুষে। হয়ে উঠলেন কিংবদন্তি পুরুষ হুমায়ূন আহমেদ।
বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন সাব-ডিভিশন পুলিশ কর্মকর্তা। ১৯৭১ সালে তাঁর সাহসী বাবা শহীদ হন কর্তব্যরত অবস্থায়। লেখালেখির অভ্যাস তিনি যেন উত্তরাধিকার সূত্রেই লাভ করেছিলেন। ফয়জুর রহমান সে সময় পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। প্রকাশ করেছিলেন ‘দ্বীপ নেভা যার ঘরে’ নামের গ্রন্থ। মা আয়েশা ফয়েজও কম প্রতিভাবান ছিলেন না। লেখালেখিতে হাত না পাকালেও রচনা করেছিলেন আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘জীবন যে রকম’। তাঁদেরই সুযোগ্য পুত্র হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর লেখালেখির শুরুটা হয়েছিল ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসের মাধ্যমে। একজন নারীর কঠিন জীবনসংগ্রামকে নিখুঁতভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে নিজের মননশীলতার প্রথম পরিচয় রাখেন তিনি। একে একে রচনা করেন ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘কৃষ্ণপক্ষ’, ‘বহুব্রীহি’, ‘আমার আছে জল’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘একজন মায়াবতী’, ‘জোছনা ও জননীর গল্প’র মতো অসংখ্য জনপ্রিয় উপন্যাস। প্রচুর দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে তাঁর ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘অয়োময়’, ‘আজ রবিবার’, ‘তারা তিনজন’ ইত্যাদি নাটক। চলচিত্রজগতে আলোড়ন সৃষ্টিতে সক্ষম হয় তাঁর ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘দারুচিনি দ্বীপ’, ‘আমার আছে জল’, ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ ইত্যাদি চলচ্চিত্র।
তিনি বাংলার যুবসমাজের কাছে উপস্থিত হন বিভিন্ন চরিত্রের রূপ ধরে। বিচিত্র সব কর্মকাণ্ড আর অদ্ভুত সব ঘটনা নিয়ে হাজির হন পাঠকের সামনে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলোর কার্যক্রমে পাঠক আকৃষ্ট না হয়ে পারে না। কখনো তিনি হন উদাসীন, রহস্যময়, বেখেয়ালি চরিত্র হিমু, কখনো হয়ে যান বুদ্ধিদীপ্ত সুদর্শন যুবক শুভ্র, কখনো বা সামনে আসেন অতি বিচক্ষণ, তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অসাধারণ চরিত্র মিসির আলি হয়ে। মানুষের বিচিত্র বেখেয়ালিপনাকে সানন্দে, বিশেষ করে আশ্চর্য চরিত্রে রূপদান করেন এই শিল্পী। ফলে কিশোর, তরুণ, বয়স্ক সবার কাছেই তিনি হয়ে ওঠেন প্রিয় হুমায়ূন।
ভণিতা করতে মোটেও পছন্দ করতেন না তিনি। ভালোবাসতেন আড্ডা দিতে ও সবার সঙ্গে বসে আলোচনা করতে। অদ্ভুত সব শখ ছিল তাঁর। খুব ভোরে উঠে লিখতে বসতেন। মাটিতে বসেই লেখার রসদ খুঁজে পেতেন তিনি। লেখাকে ভালোবেসেই ছেড়ে দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পেশা। নিজে নিশ্চুপ থেকে মানুষের বিচিত্র স্বভাব, প্রকৃতি, আচরণ নিরীক্ষণ করতেন। হাজার হাজার চরিত্রের বিচিত্র স্বভাবের মানুষের কাছ থেকে তিনি জোগাতেন লেখার উপকরণ আর পূরণ করতেন নিজের অদ্ভুত সব শখ। এই শখেরই প্রতিফলন তাঁর অসাধারণ সব চরিত্র। বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে বইমুখী করতে তাঁর অনবদ্য অবদান রয়েছে। অতুলনীয় সব চরিত্রের স্রষ্টা হুমায়ুন নিজেও তাঁর পাঠক-দর্শক মহলে হয়ে উঠেছিলেন অনন্য চরিত্র। জীবনের শেষ দিকে নিজের মনের মতো গড়া বাগানবাড়ি ‘নুহাশপল্লী’তেই থাকতে পছন্দ করতেন তিনি। ১৯৪৮ সালের এমনই এক দিনে তিনি পৃথিবীকে আলোকিত করেছিলেন। কাজল নামের সেই ছেলেটিই যে একদিন সবার চোখের কাজল হয়ে উঠবে, তা কে ভেবেছিল? সবার মন জয় করে যখন ২০১২ সালে তিনি পৃথিবীকে বিদায় জানালেন, সারা দেশ কেঁদে উঠল এক গভীর বেদনার সুরে। তবে তিনি আমাদের থেকে দূরে যাননি। তাঁর রেখে যাওয়া অমূল্য সব সম্পদ লাখ লাখ পাঠক-দর্শকের মধ্যে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল। তিনি কোথাও যাননি, তিনি আসবেন ফিরে ফিরে হিমু হয়ে, মিসির আলি হয়ে। তাঁর জন্য মন সর্বদাই বলবে—
এক বরষায় যদি মন কাঁদে, তুমি চলে এসো, তুমি চলে এসো...
লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, জাবি।