রম্যগল্প
জিপিএ কালাম
কালাম ভাইয়ের মায়ের শেষ ফুঁ টাও ব্যর্থ হলো।
প্রতি পরীক্ষার আগে কালাম ভাইয়ের মা ছেলের জামার একটা বোতাম খুলে বুকে লম্বা ফুঁ দেন। তারপর যে কলম দিয়ে পরীক্ষা দেওয়া হবে সেই কলমে দেন দুই ফুঁ।
কলমের গায়ে ফুঁ ঠিক আছে। কিন্তু কালামের গায়ে ফুঁয়ের বিষয়টা কালাম ভাইয়ের ভালো লাগে না।
আম্মা, ফুঁ দেওয়া বন করেন। ছ্যাপ ছেডে তো।
হারামি পোলার কথা হুনছো! দুই গ্রামের মানুষ আহে আমার ফুঁ নেওনের লাইগা।
তাইলে তাগো লাইগাও কিছু ছ্যাপ জমা রাখেন। মুখ শুকাই যাইবে তো। তখন ছ্যাপ পাইবেন কই?
পরীক্ষার দিন ফুঁ-ফা দিয়া কোনো লাভ নাই। ফুঁ কি ওর হইয়া কলম ধরব? তোমার পোলারে বছরে তিনশ পয়ষট্টি দিন ফুঁ দেওন দরকার। মাথার ভিত্রে গু’ও নাই। আক্ষেপের সুরে বলেন কালাম ভাইয়ের বাবা। ছেলেকে তিনি ভালোই চেনেন।
একটা ভালো কাজে যাইতেছে, আপনি কু কথা কইয়েন না।
ওহ, তোমার সুপুত্তুররে নিয়া কিছু বললেই সেইটা কু কথা। শোনো, তোমার পোলার গায় খারাপ বাতাস লাগছে। ফুঁয়ের বাতাসে কাম হইব না।
স্বামীর কথায় কান দেন না কালাম ভাইয়ের মা। উল্টো তিনি ফুঁয়ের গতিবেগ বাড়ান। নিজের ফুঁয়ের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস। পশ্চিম পাড়ার খোনকার বাড়ির গাধা পোলাটাও গতবার ম্যাট্রিক পাস করল। তা কি আর এমনি এমনি। কিন্তু নিজের ছেলের বেলায় এসে কালাম ভাইয়ের মা বারবার ব্যর্থ।
কালাম ভাই এবারও ফেল।
এই নিয়ে তিনবার।
দান দান তিন দান। সবাই ভেবেছিল তৃতীয় দফায় এসে কালাম উৎরে যাবে। সে আশার গুড়ে বালি ছিটিয়ে কালাম ভাই ফেলের হ্যাট্রিক পূর্ণ করলেন।
রেজাল্টের পর স্কুলের হেডস্যার বললেন, কালাম তো স্কুলের সম্পদে পরিণত হচ্ছে।
মকবুল স্যার অতি বিনয়ী এবং অতি তেলবাজ। মানুষ তেল মাখে মাথায়। মকবুল স্যার মাখেন হাতে। তাতে হাত কচলাতে সুবিধা। প্রতিদিন স্কুলে আসার আগে হাতে খাঁটি সরিষার তেল মাখেন তিনি।
হাত কচলাতে কচলাতে হেডস্যারের দিকে এগিয়ে এলেন মকবুল স্যার।
স্যারের কথার এই এক মজা। কথার মইধ্যে কথা থাকে। ইনসাইট বিউটি। কিন্তু ফেল কম্পিটিশনে হ্যাট্রিক করা ছেলে স্কুলের সম্পদ হয় কীভাবে ধরতে পারলাম না।
ধরবেন কীভাবে। ধরতে হয় হাতে ছাই মাইখা। আপনে মাইখা আসেন তেল। হা হা হা।
হেডস্যারের মুখে কান্দুয়া হাসি। মন খারাপের মধ্যে তিনি এই হাসি হাসেন।
মকবুল স্যারও হাসেন। ছাইবিষয়ক রসিকতার মাধ্যমে তাকে যে কিঞ্চিত অপমান করা হয়েছে অন্যদের সেটা বুঝতে দেন না।
স্যার, আপনার কথার ইনসাইট বিউটিটা যদি একটু খুলে বলতেন।
আরে ওই যে কথায় আছে না, ফেইলিউর ইজ দা পিলার অব সাকসেস। কালাম তো আমাদের সাকসেসফুল পিলার। স্কুলের খাম্বা।
জ্বি স্যার। মাশাল্লাহ পোলাটা বেশ লাম্বা।
সেটাই। পিলার তো স্কুলের সম্পদ তাই না? বিদ্যুতের খুঁটি হিসেবে কাজে লাগবে।
এইবার স্যার ধরতে পারছি আপনার কথা। সব কদু লাউ হয় না। দু-একটা গাছেই থাকে। থাকুক।
থেকে যায় কালাম ভাই।
তৃতীয় দফা ফেল করে নতুন ছাত্রদের সাথে দশম শ্রেণিতে বসে যায় সে।
ওদিকে তার মায়ের ফুঁয়ের ব্যবসা ধসে যায়। ছেলের সঙ্গে ফেলের খাতায় মায়ের নামও ওঠে।
কারণ সব ব্যবসাতেই প্রতিদ্বন্দ্বী থাকে।
‘ফুঁ’ ব্যবসায় আরো দু-একজন আছেন। যাঁরা কালাম ভাইয়ের মায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী। তারা বাজারে কথা রটায়। যার নিজের পোলাই তিনবার ফেল করে তার ফুঁয়ের কী মূল্য?
কথা যেহেতু যুক্তিযুক্ত তাই ফুঁয়ের বাতাস অন্যদের দিকে ঘুরে যায়।
চুপসানো বেলুন মুখে বসে থাকেন কালাম ভাইয়ের মা। তাঁর আক্ষেপের শেষ নেই।
সবাই জিপিএ পাঁচ ছয় পায়। তুই কি এক-দুইও পাইতে পারোস না? তুই জিপিএ পাইলে তো আমার এই দশা হয় না।
আমার জিপিএ পাইতে হইব ক্যান আম্মা?
মায়ের কথায় অবাক হয় কালাম ভাই।
গাধার বাচ্চা কয় কি! তোর জিপিএ মানে তো আমার জিপিএ। দ্যাখোস না লোকজন আসা বন্ধ।
ও এই কথা। এই জন্য তোমার মুখে ছ্যাপ নাই।
কালাম ভাই হাসে।
তোমার মাথায় একটুও বুদ্ধি নাই আম্মা। আরে আমার কি পাস কইরা জিপিএ হওনের দরকার আছে? আমি তো জন্মসূত্রেই জিপিএ।
জন্মসূত্রে জিপিএ মানে! হারামির কথা হুনছো? এই সার্টিফিকেট তোরে কে দিছে?
আব্বায় দিছে।
তোর আব্বায় ঠিকই কয়। তোর মাথায় গোবরও নাই।
বুঝছি। বোঝো নাই। শোনো, আব্বারে এলাকার মানুষ কী নামে চেনে? গাজী সাব?
হ।
আর আমার নাম তোমরা কী রাখছো?
আবুল কালাম।
তাইলে হিসাব কইরা দ্যাখো, আমি কিন্তু জন্মসূত্রেই জিপিএ কালাম। গাজীর পোলা আবুল কালাম। সংক্ষেপে কী হয়? জিপিএ কালাম।
কালাম ভাইয়ের মা সেসব হিসাবে যান না। ছেলেকে কাছে টেনে ফুঁ লম্বা দেন তিনি। এই পোলার মাথা পুরাই গেছে।