সমতলের আদিবাসী

কড়ারা কি পারবে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে?

Looks like you've blocked notifications!
কড়া গ্রামের নারীরা। ছবি : সালেক খোকন

কড়াদের বিয়েতে বর-কনের সিঁদুর পর্ব হয় চাষাবাদের প্রতীক জোয়ালের উপর দাঁড়িয়ে গোপনীয়ভাবে। দুই পক্ষের মাহাতোর উপস্থিতিতে জোয়ালের দুদিকে বর ও কনে দাঁড়ানোর পর পরই চারদিকে কাপড় দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়। বর ও কনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জোয়ালে তাদের এক পা পাশাপাশি স্পর্শ করিয়ে রাখে। আর ঐ অবস্থায় বর তার হাতের তালুতে সিঁদুর নিয়ে কনেকে পরিয়ে দেয়। এটাই কড়াদের বিহা (বিয়ে)।

সিঁদুর পর্বের পর বর-কনেকে পালন করতে হয় খান্দা বা দশের খাবার পর্ব। নতুন হাঁড়িতে বা যেটিতে খাবার রান্না হচ্ছে সেই তাতে একটি কুলায় থাকা ঘাস, চাল ও ধান বর-কনেকে এক সাথে ঢেলে দিতে হয়। অতঃপর পরিচিত জনেরা ঘাস আর ধান ছিটিয়ে নব দম্পতিকে আশীর্বাদ করে আর কনের হাতে গুজে দেয় নানা উপহার।

কনে নিয়ে যাওয়ার পরের দিন কনেপক্ষ বরের বাড়িতে যায়। এ সময় তাদেরও আপ্যায়ন করা হয় হাড়িয়া, মাছ, মাংস আর ভাত দিয়ে। অতঃপর কনে ও বরকে বাড়িতে নিয়ে আসে কড়ারা। একে বাহারোতা বলে।

কড়া আদিবাসীদের বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মত পার্থক্য তৈরি হলে বা বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর প্রয়োজন হলে উভয়পক্ষের মাহাতো ও দশজনের উপস্থিতিতে পালন করতে বিশেষ ধরনের আচার। এটিকে বলে পাতপানি। একটি কাসার বাটিতে পানি নিয়ে চার-পাঁচটি আমপাতাসহ একটি ছোট্ট ভাঙ্গা ডাল ডুবিয়ে রাখতে হয়। অতঃপর কাসার বাটির দুই দিকে দাঁড়িয়ে স্বামী ও স্ত্রী দুটি পাতা ধরে এবং একইসাথে টেনে পাতা ছিড়ে ফেলে। আদি বিশ্বাস মতে, পাতা ছেড়ার সাথে সাথেই তাদের বিবাহের বিচ্ছেদ ঘটেছে বলে মনে করা হয়।

এ আদিবাসী সমাজে অবাধ মেলামেশায় কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। ছেলে মেয়ের অবাধ মেলামেশা ধরা পড়লে মাহাতো বা পাঁড়ে, গড়াৎকে দিয়ে বেটকি বা সভা ডেকে শাস্তি নির্ধারিত করেন। এ ধরনের অপরাধে  ছেলের জুজুরী  (লিঙ্গে) তে দড়ি বেধে লাঠি দিয়ে ডাং (টান) দেওয়া হয়। আর মেয়ের দুই হাত বেঁধে গায়ে পানি ঢেলে কুলা দিয়ে চারপাশ থেকে বাতাস দেওয়া হয় ঠাণ্ডা লাগানোর জন্য।

বর্তমানে কড়া আদিবাসী সমাজে নিজ গোত্রে বিবাহ যোগ্য কনে নেই। ফলে আদিরীতি ভেঙে এখন শুধু একই গোত্রেই নয় বরং ছেলেদের বিয়ে করানো হচ্ছে অন্য জাতির আদিবাসীদের সঙ্গেও। এভাবে কড়া গ্রামের প্রশান্ত কড়া বিয়ে করেছেন পাশের মুণ্ডা পাহান গ্রামের শেফালিকে। কেদু কড়া তুরি পাড়ার মিনাকে, মানিক কড়া ভুনজার পাড়ার কাজলি ও খেরচা কড়া ভুনজার পাড়ার বানারশিকে বিয়ে করেছে। ফলে কড়াদের বিয়ে সংস্কৃতি ও আচারগুলো পরিবর্তিত হচ্ছে ক্রমান্বয়ে।

কড়াদের মধ্যে তিনজন আদিবাসী ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এরা হলেন থোপাল কড়া, কিনা কড়া ও সাতান কড়া। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে শিববাড়ী ইয়ুথ ক্যাম্পে ট্রেনিং নেন এরা। ট্রেনিং শেষে সাত নম্বর সেক্টরের অধীনে কমান্ডার ইদ্রিস আলীর নেতৃত্বে হামজাপুর ক্যাম্প থেকে হিলিসহ নিকটবর্তী গ্রামগুলোকে শত্রুমুক্ত করার জন্য যুদ্ধ করেন তারা। কিন্তু এই তিন আদিবাসী এখনো মুক্তিযুদ্ধের কোনো সরকারি সনদ পায়নি। ফলে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ও সরকারি সুবিধা লাভ থেকে বঞ্চিত রয়েছে তারা।

কড়ারা উৎসবে ঝুমের নাচ আর বিয়েতে খেমটা নাচ পরিবেশন করে থাকে। এদের একক কোনো নাচ নেই। সব নাচই সমবেত। এ আদিবাসী শিশুরা মায়ের ঘুম পাড়ানির গান আর বাবার আদরের ভাষা শুনে শুনেই তাদের জাতির ভাষা শিখে ফেলে। গান -

‘ইয়ারে ডিম চড়ওয়া ডিমা পার দে/নুনুক খনামে আগ লাগাল নুনু নিন্দারে দে’ (ভাবার্থ : কোকিল পাখিকে ডাকা হচ্ছে, সে যেন তার ডিম পাড়া শেষ করে চলে আসে এই শিশুটির বিছানায়। আর তারপর তা দিয়ে গরম করে দেওয়া বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে দেয় শিশুটিকে।)

‘নিন্না নিন্নারে নুনু/মায়ে গেল সুইহা বোচল/দাদি কান্দা বুলো হে/ বাপ গাড়ি মান’ (ভাবার্থ : ছোট বাচ্চা ঘুমিয়ে পড়, তোর মা গেছে সুই বেচতে, দাদি কাঁদছে আর বাবা গেছে গাড়ি বাইতে।)

ধাঁধাকে কড়া ভাষায় বলে বান্তা। কড়ারা তাদের উৎসবের অংশ হিসেবেই ধাঁধার খেলা খেলে থাকে।

‘দাশটা মারাত রাগদেলকে, দুটা মারত পাকারকে মারকে-ঢিলা বাছা’(মানে উকুন আনা- দুই হাতের দশ আঙ্গুল থাকলেও উকুন মারা হয় দুই আঙ্গুল দিয়ে।)

‘ভুরুত পাংখি, একজন ডুবেলকে দুজন সাক্ষী। (এটি হচ্ছে সেচ দেওয়ার জন্য টিন জাতীয় বালতি বিশেষের দুই দিকে দড়ি বেঁধে দুজন টেনে ধরা।)

‘ঘার হোত দুয়ার না খলে’- ডিমা। (এটি হচ্ছে ডিম। ঘর আছে কিন্তু দুয়ার নাই)

কড়াদের ধর্ম সনাতন। আদিতে কড়া শিশুদের হাতে বিশেষ পদ্ধতিতে কাকড়া ও বিছার প্রতিকৃতি তৈরি করা হতো। এটিকে বলে খোদনা বা জাতির চিহ্ন। একসময় এই চিহ্ন দেখেই চেনা যেত কড়াদের। এখন কড়া সমাজে এর প্রচলন নাই বললেই চলে। এদের পূজাতে মূর্তির ব্যবহার নেই। অভাব মুক্তির জন্য এরা কারমা, দেবতাকে নানা কষ্টের কথা শোনাতে বিষহরি এবং গবাদিপশুর মঙ্গলের জন্য এরা গট পূজা পালন করে থাকে।

এদের বড় উৎসব কারমা পূজা। এরা ভাদ্র মাসের চাঁদের পূর্ণিমায় এ পূজা পালন করে ধুমধামের সাথে। মূলত এটি গাছের পূজা। বিশেষ প্রজাতির ‘খিল কদম’ গাছের ডাল কেটে এনে পূজা করে এ আদিবাসীরা। কারমা পূজায় বিবাহিতরা খিল কদম গাছের ডাল কাটতে পারে না। গোত্রের মাহাতো পূর্ব থেকেই অবিবাহিত কোনো যুবককে কয়েক বছরের জন্য ডাল কাটা ও  বির্সজনের জন্য মনোনীত করে দেন। ডাল কাটার দিন নদীতে স্নান সেরে গাছের গোড়ায় ধূপ জ্বালিয়ে, সিঁদুর দিয়ে তিনটি তেলের পিঠা গাছের সাথে বেঁধে দেওয়া হয়। অতঃপর তিন চটে (তিন কোপে) ডাল কাটা হয়। ডালটি মাটিতে পড়ার আগেই সেটি ঘাড়ে করে নিয়ে যাওয়া হয় পূজাস্থলে।

সেখানে সবাই ঢাক-ঢোল বাজিয়ে ডালটিকে মাটিতে গেড়ে দেয়। একই সাথে দুটি লাল মোরগ বলি দেওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় কারমা পূজার আনুষ্ঠানিকতা। এ সময় নানা ইচ্ছে নিয়ে গাছের ডালটিতে বেঁধে দেওয়া হয় একটি করে তেলের পিঠা। সারা রাত চলে নাচ, গান আর হাড়িয়া খাওয়া।

ভোরবেলা দলের মাহাতো স্নান সেরে ভেজা শরীরেই প্রথমে এক বাটি দুধ ঢেলে দেয় খিল কদম গাছের ডালের মাথায়। অতঃপর তাকে ভক্তি করে ফিরে যায় নিজ বাড়িতে। মাহাতোর পর পরই অন্যরা একে একে দুধ ঢালতে থাকে। দুধ ঢালা শেষে যে যুবকটি ডাল কেটেছিল সে প্রথমে ডালটির চারদিকে তিন পাক ঘুরে ডালটিকে টান দিয়ে কাঁধে তুলে নেয়। অতঃপর ঢাক-ঢোলের তালে তালে সেটিকে বির্সজন দেয় নিকটবর্তী নদী বা পুকুরে।

কারমা পূজায় কড়াদের ধর্মের পরীক্ষা দিতে হয়। বাঁশের ডালার মধ্যে কালাই বীজ রেখে বালু ও মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। সেদিন থেকেই শুরু হয় উপোস। উপোস সময়ে রসুন, পেঁয়াজ, গরমভাত, মাছ ও মাংস খাওয়ার নিয়ম নেই। খেতে হয়  শুধুই নিরামিষ। যে কয়জন উপোস থাকে সে কয়টি ছোট কাঠি ডালায় পুতে দেওয়া হয়। কড়াদের রীতি অনুসারে উপোসকারী পুরুষ হলে কাঠির মাথায় কাজল আর মহিলা হলে সিঁদুর লাগানো হয়।

চার দিন পর ডালায় নতুন চারা গজালে এরা উপোস ভাঙ্গে। কড়াদের বিশ্বাস যাদের ধর্মে বিশ্বাস নেই ডালায় তাদের লাগানো কালাই বীজ থেকে চারা গজায় না। চারা গজালে বন থেকে কেটে আনা খিল কদম গাছের ডাল মাটিতে পুতে চারার ডালাটিও তার পাশে রাখা হয়। কড়া আদিবাসীরা আজো বিশ্বাস করে কারমা তাদের অভাবমুক্তি আর সৌভাগ্য লাভের পূজা।

কড়ারা মনে করে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের সময় মানবজাতির দায়িত্ব সৃষ্টিকর্তার সাহায্য প্রার্থনা করা। তাই এ সময় এরা উপোস অবস্থায় ধুপ জ্বালিয়ে, মাদল-ঢোল বাজিয়ে, বাড়ির চালে পানি ছিটিয়ে, আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে, ‘মামা, গাহানা ছাড়! এ নিয়ে এদের মধ্যে প্রচলিত লোককাহিনীটি এমন-

‘মানব জাতি একবার খুবই অভাবের মধ্যে পড়ে। মানব জাতিকে বাঁচানোর জন্য চাই ধান। চন্দ্র এবং সূর্য মানুষের জন্য ধান দিতে অনুরোধ করে দোসাদ দেবতাকে। তাদের প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে দোসাদ দেবতা ধান দেয় মানুষকে, তবে আবার ফেরত দিতে হবে এই শর্তে। কিন্তু সে বছর দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে মানবজাতি সে ধার আর পরিশোধ করতে পারে না। চন্দ্র ও সূর্য মানব জাতির পক্ষে সেই ধান ধার নিয়েছিল বলে দোসাদ দেবতা এখনো সুযোগ পেলেই চন্দ্র ও সূর্যকে আক্রমণ করে। এতে চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণ ঘটে।’

এ ছাড়া কড়ারা মনে করে লরিক নামক একটি শক্তিশালী জন্তুকে একটি কুয়োর পানিতে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। কুয়োটি বিশেষ ঢাকনা দিয়ে লাগানো এবং তার ওপরে পৃথিবী। লরিককে শান্ত রাখার জন্য পৃথিবী থেকে নালা দিয়ে গরুর রক্ত দেওয়া হয়। রক্ত না দিলেই সে নাড়াচাড়া দিয়ে ওঠে। আর তখনই পৃথিবী কেঁপে ওঠে এবং ভূমিকম্প হয়।

এ আদিবাসীদের কেউ অসুস্থ হলে তাকে সুস্থ করে তোলার দায়িত্ব পড়ে মাহান বা কবিরাজের ওপর। আদিতে চিকিৎসায় তন্ত্রমন্ত্র আর জঙ্গলের গাছগাছালির ওষুধই ছিল একমাত্র অবলম্বন। চিকিৎসায় কড়াদের একটি মন্ত্র-গুরু জ্ঞান/জারাই সিঁড়ি/কার দোহাই/বাগনা সিং/কামরুক্ষা/ কে জারে/ গুরু জারে/ গুরু জ্ঞান/ মাই জারে/ জারাই সিঁড়ি/কার দোহাই/ মা মনসাক দোহাই/ কে জারে/ মা পদ্মা জারে।’ হারিয়ে যাওয়া বস্তু উদ্ধার, সাপের বিষ নামানো, পেটব্যথা বা মাথাব্যথা কমানো, রাতের বেলা পথ চলতে যেন সাপে না কাটে সে কারণে সাপের মুখ বন্ধ করা সবই চলে মন্ত্র দিয়ে। তারা বিশ্বাস করে যে মাহান (কবিরাজ) মিথ্যা বলে না, পাপ কাজ থেকে বিরত থাকে, তার শক্তি তত বেশি। তবে বর্তমানে কড়ারা আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণে উৎসাহিত হচ্ছে।

ভূমিকেন্দ্রিক বৈষম্য, নানা অবহেলা আর অনটনের মধ্যেও নিজেদের টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে কড়ারা। তারা কি পারবে নিজেদের জাতিটিকে টিকিয়ে রাখতে? কড়ারা হারিয়ে গেলে এ দেশ থেকে হারিয়ে যাবে একটি জাতি, জাতির ভাষা ও তাদের সংস্কৃতিগুলো। এই জাতিটিকে টিকিয়ে রাখতে তাই প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগ।