মানুষ তার চিবুকের কাছে ভীষণ অচেনা ও একা

Looks like you've blocked notifications!

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে কত বয়স ছিল মেয়েটির? একুশ কি বাইশ? মিছিল, স্লোগান, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, বিষণ্ণতা আর বেদনায় নীল হয়ে সারা শহরময় একা একা ঘুরে বেড়ায়। তার মাথার ওপর উজ্জ্বল আকাশ আর পায়ের নিচে কালো রাজপথ। এ ছাড়া আর তার কেউ বেদনা বোঝে না। তীব্র রৌদ্রময়তায় তার হিম লাগে। সেই রকম দিনে আমের মুকুলের হু-হু করা সৌরভের মাঝে তার পড়ার টেবিলে কেউ একজন নীল খাম রেখে যায়। অসম্ভব সুন্দর হাতে লেখা অক্ষর। সে ভেবে পায় না, কে রেখে গেল? গতানুগতিক প্রেমপত্র ভেবে সে ফেলে দিতে চায়। পরক্ষণেই মনে হলো না, সে রকম নয়।

এর মাঝে কয়েকটি লাইন, কবিতার...

‘অতোটুকু চায়নি বালিকা/অত শোভা, অত স্বাধীনতা!/ চেয়েছিল আরো কিছু কম,/আয়নার দাঁড়ে দেহ মেলে দিয়ে/ বসে থাকা সবটা দুপুর, চেয়েছিল/ মা বকুক বাবা তার বেদন বুঝুক।

একটি জলের খনি তাকে দিক তৃষ্ণা এখনই। চেয়েছিল একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী।’

 ( নিঃসঙ্গতা : যে তুমি হরণ করো)

ধ্বক করে ওঠে হৃৎপিণ্ড তার। ঠিক! অতটুকু তো বালিকা চায়নি কখনো। বালিকা তবে কী চেয়েছিল? মা বকুক, বাবা তার বেদনা বুঝুক! তাই তো! আর শেষের ওই লাইনটি এমন আমূল কাঁপিয়ে দিল কেন? পত্রলেখক কে ছিল, মেয়েটি তা ভুলে গেল। তার মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে কবিতার রচয়িতাকে খোঁজা। সে সবাইকে ধরে ধরে জিজ্ঞেস করতে থাকে। তুমি জানো? তুমি জানো? তুমি জানো, কবির নাম? তিন দিন তিন রাত্রি ধরে একটানা অনুসন্ধানের পর পাওয়া যায়। পাওয়া গেল। তরুণী পেয়ে যায় কবির নাম। আবুল হাসান। সে সঙ্গে পেয়ে যায় পাকাপাকিভাবে ‘নিঃসঙ্গতা’ শব্দটিকে। ‘নিঃসঙ্গতা’ শব্দটির সঙ্গে যেন সে নতুন করে পরিচিত হলো। কার্তিকের হিমধরা রাতের মতো, চৈত্রের ভাঁপ ওঠা মাটির মতো সে নিঃসঙ্গতা টের পায়। নিঃসঙ্গতায় সে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হতে থাকে। আবুল হাসান তার ঘুম কেড়ে নেয়। সূর্য ওঠার আগে সে ঘুম থেকে ওঠে। টকটকে সূর্যটাকে সে কপালের টিপ করতে চায়। গেলাসে গেলাসে সে নিঃসঙ্গতা পান করতে থাকে। তার পায়ে পায়ে ঘুঙুর হয়ে নিঃসঙ্গতা বাজতে থাকে। তন্নতন্ন করে সে খুঁজতে থাকে কবির অস্তিত্ব। তার জীবনের সঙ্গে কী একাকার করে ফেলে! তার চেতনার আকাশে ঝড় ওঠে। অনিবার্য সে ঝড়। সে ঝড় তার পথ আগলায়, সে লম্বা চুল বেণী করে, খোলে, খোঁপা করে, সেই খোঁপা ভেঙে পড়ে পিঠের পরে।

‘অবশেষে জেনেছি মানুষ একা।

 জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছে ভীষণ অচেনা ও একা

দৃশ্যের বিপরীতে সে পারে না একাত্ম হতে

এই পৃথিবীর সাথে কোনো দিন’

(পাখি হয়ে যায় প্রাণ)

 

মেয়েটির শ্বাস যেন বন্ধ হয়ে যেতে চায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর জীবনানন্দ দাশের পর আবুল হাসান তার ঘরে জায়গা করে নেয়।

‘এই মৃত্যু জন্ম দেয় শিল্পের কুসুম

এই আমি সঙ্গমের অনাদি পিপাসা। ’

 

কী বলে এই কবি!

‘আমার কাছে আগুন ছিল না। আমি চাঁদের আগুনে/ শাদা সিগ্রেট জ্বালিয়ে বসেছিলাম কুয়াশায়!/ কে ওখানে? শীতরাতে পউষ পাখির গলা শোনা গেল জ্যোৎস্নায়, / কে ওখানে?/ পাখির কণ্ঠের গানে/ কুয়াশায় আমি কালো জ্যোৎস্না ঘুরে হঠাৎ তখনো/ চাঁদের আগুনে পুড়ে/ ছুঁয়ে দিতে উদ্যত হলাম/ অপসৃয়মাণ তুমি?/ তোমাকে না ছুঁতে পেরে/ আমি নিজ নিয়তির অন্তর্গত রোদনকে বোল্লাম/ দ্যাখো/ আমি আর কাঁদতে পারবো না/

(ঘুমোবার আগে, যে তুমি হরণ করো)’

মেয়েটি সারা রাত কাঁদে। লাল ফোলা দুই চোখে আয়নার দিকে তাকায়—বলে, পাখি, তুমি কেঁদেছিলে কেন?

কোথায় কাঁদলাম?

ওই যে ঘুমোবার আগে, তুমি কাঁদলে আর আমিও সারা রাত কাঁদলাম।

আহা! নারী! তুমি কি জানো না, মানুষ তার চিবুকের কাছে ভীষণ অচেনা ও একা!

জানি তো, তুমিই তো বলেছ। তাই কি তুমি ঝিনুক? ভেতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও। কী হলো, উত্তর দাও কবি!

কবিকে তখন বড় অচেনা মনে হয়।

এক-একদিন ভাবে, সাহস করে সে কবিকে জিজ্ঞেস করবে, ‘নিঃসঙ্গতা’ কবিতাটি কি তুমি আমাকে নিয়ে লিখেছ? যদি না বলেন? তাই সাহস হয় না। প্রত্ন খননের মতো সে আবিষ্কার করতে থাকে প্রতিনিয়ত ঝিনুকের মতো মুক্তো ফলায় কবি, নীরবে, বেদনা সয়ে সয়ে, বেদনার্ত নীরবতা গ্রাস করে তাকেও।

আবুল হোসেন জীবনকে ভালোবেসেছেন, মানুষকে ভালোবেসেছেন। তবু অভিমানহত কণ্ঠে তাঁকে বলতে শোনা যায়—

‘আমি ফিরবো না আর, আমি কোনোদিন/ কারো প্রেমিক হবো না, প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী চাই আজ। আমি সব প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হবো।’

আসলেই আবুল হাসান সব প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। আর এভাবেই কবি নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন।

আবুল হাসানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাজা যায় রাজা আসে’। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘যে তুমি হরণ করো’। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পৃথক পালক পালঙ্ক’। তিনটি কাব্যগ্রন্থের বৈশিষ্ট্যই ভিন্ন। শামসুর রাহমান লেখেন—বাংলাদেশের কবিগোষ্ঠী, যাদের কবিতা বারবার আমৃত্যু পড়বে, তাদের মধ্যে আবুল হাসান নিঃসন্দেহে অন্যতম। আবুল হাসানকে ব্যবচ্ছেদ না করলেও একজন কবি পাওয়া যাবে। ব্যবচ্ছেদ করলে কবি ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। কেননা, মায়া-মমতা-দুঃখবোধ—সবটুকু জড়িয়ে থাকে কবিকে। যৌবনের বিষণ্ণতা, নৈঃসঙ্গ ও দীর্ঘশ্বাসের কবি তিনি। তিনি একাধারে মায়ের, বোনের, প্রেমিকার। গ্রাম, স্মৃতি, হাহাকার, ও নস্টালজিয়া আক্রান্ত তাঁর কবিতায় জীবনের উচ্ছ্বাস, প্রেমাকুলতার গভীর উপলব্ধি দৃশ্যমান। পাখির সঙ্গে, নদীর সঙ্গে, নারীর সঙ্গে তিনি আত্মকথনে মগ্ন। মৃত্যুভাবনা, ক্লান্তি, হতাশা আছে তাঁর কবিতায় জীবনের মতোই। আছে সুন্দর, আছে আরাধনা। একটা ঘোর আচ্ছন্ন করে, তাড়িত করে তাঁর কবিতা। পাঠিকা নিজের অজানিতে চলে যায় কবিতার ভেতর, হাঁটে আবুল হাসানের সঙ্গে সঙ্গে। তাঁর অংশীদার হয়ে ওঠে। তাঁর শব্দের অনুরণন নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করতে থাকে নারীর পরানে।

‘পাখির পরান ধারণ করলেই নাকি কবিতা লেখা যায়!’ আবুল হাসান মানব জন্মকে খরচ করে কবিতা লেখেন। রাত্রির নিস্তব্ধতার মতো অন্তর্গত কান্না তাই কবিতার আঙিনায় অদৃশ্য আস্তরণের মতো জড়িয়ে থাকে। অনেকেই বলে থাকেন, আবুল হাসান যদি আর কিছু না লিখে কেবল ‘ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সয়ে যাও’ কবিতাটি লিখতেন, তা-ও আজীবন পাঠক তাঁকে মনে রাখতেন। তিনি অমর হয়ে থাকতেন। কেননা, এমন পঙক্তি কেবল শুদ্ধতার চর্চাকারী হলেই লেখা যায়। পাঠিকা জানে, আবুল হাসানের জন্মই হয়েছিল কবিতার জন্য। নিঃসঙ্গতা শব্দটিকে তার করে দিয়ে চলে গেছেন মহাপৃথিবীর নিঃসঙ্গ যাত্রায়।

বর্ণি গ্রামের ছেলে আবুল হাসান। ১৯৪৭-এর ৪ আগস্ট তাঁর জন্ম। ফরিদপুরের বর্ণি গ্রামের নানাবাড়িতে। বর্ণি গ্রামের বিদ্যালয় থেকে আরমানিটোলা। কবিতার শুরু এখান থেকেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পর কবিতাই ঘরবাড়ি হয়ে ওঠে। সে সময় উদ্বাস্তু যৌবন! অর্থের প্রয়োজন? কিন্তু কবিকে কি চাকরিতে পোষায়? কবিতা! কবিতা! কবিতা! অসুখ তো কী হয়েছে? অনিয়ন্ত্রিত জীবন, অমানুষিক পরিশ্রম, রাত জাগার অভ্যাস সবই তো তার থাকার কথা। বুকে অসহ্য যন্ত্রণা। এরই মাঝে ঐশ্বর্যময় সৃষ্টি সম্ভার কিছুটা দিয়ে, কিছুটা না দিয়ে তিনি চলে গেলেন ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর। চলে গেলেন কবিতার মোহাবিষ্ট মানব। ‘সে এক এমনই পাথর, কেবলই লাবণ্য ধরে...’

আবুল হাসান গতানুগতিক কবি নন। তিনি ছিলেন ভিন্নমাত্রার কবি। তাঁর বিষয় নির্বাচন, তাঁর শব্দচয়ন, ব্যঞ্জনা, কৌশল সব তাঁকে আলাদা করেছে। তাঁর কবিতায় বারংবার উঠে আসে সংশয়, সন্দেহ, উত্তেজনা, ভালো-মন্দ, উদিত দুঃখের দেশ, দুধভাত, সর্বোপরি কবিতা। কবি আবুল হাসান প্রসঙ্গে সলিমুল্লাহ খান একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, তিনি একজন দক্ষ, যোগ্য একজন সমর্থবান কবি, ভাবনায় পরিপক্ব কবি। কিন্তু পাঠিকার আজো আবুল হাসানকে বোঝা হয় না। সে কেবল অনুধ্যায়ী হয়। সে কেবল খুঁজতে থাকে কবির অন্তর্গত অনুভূতি। আর মেলাতে থাকে নিজেকে।

‘আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি। আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ! সচ্চরিত্র ফুল আমি যত বাগানের মোড়ে লিখতে যাই দেখি/ আমার কলম খুলে পড়ে যায় বিষ পিঁপড়ে, বিষের পুতুল।’

প্রিয় পাঠক! আমারও হবে না। আমার পক্ষেও সম্ভব নয়। আবুল হাসানের নিমগ্নতা, নৈঃসঙ্গ, আত্মধ্বংস তুলে আনা এই কলমের ডগায়...।