রম্যগল্প
ভাবমূর্তি
টুলু ভাইয়ের ধারণা ছিল, ভাবের মূর্তিকে ভাবমূর্তি বলে। ভাব নেওয়ার কারণে মানুষের যে অবয়ব তৈরি হয়, তাহাই ভাবমূর্তি।
টুলু ভাই আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। গাল ফুলিয়ে নানা অ্যাঙ্গেলে নিজেকে দেখলেন। তার পর একদিন ভাব নেওয়া শুরু করলেন।
টুলু ভাই অনুভব করেছেন, তাঁর একটা ভাবমূর্তি থাকা দরকার। কোনো এক বিশিষ্টজনকে গলা চড়া করে বলতে শুনেছেন তিনি, ‘মানুষের ভাবমূর্তিটাই হলো আসল। যার ভাবমূর্তি নেই, তার কিছু নেই।’
সেই থেকে ভাবে কাতর আমাদের টুলু ভাই।
টুলু ভাই গান করেন।
প্রথম দিকে তাঁর গানের গলা খুব একটা পদের ছিল না। কিন্তু ওস্তাদ হিসেবে ঘষা সিরাজকে পাওয়ার পর বদলে যায় টুলু ভাইয়ের গলা।
গানের ওস্তাদের নাম ঘষা সিরাজ!
খটকা সবারই লাগে। কিন্তু উপাধিটা যেহেতু ভালোবেসে দেওয়া, তাই এ নিয়ে কেউ আর ঘষাঘষি করেনি। নামটা বসে যায়।
ঘষা সিরাজ বয়সে তরুণ, কিন্তু গানের ওস্তাদ হিসেবে তুখোড়। ঘষামাজায় তার ব্যাপক খ্যাতি। কথিত আছে, সিরাজের কাছে কাঠ পাঠালে সে ঘষেমেজে কোকিল বানিয়ে ফেরত পাঠায়। টাইগারকে বানিয়ে দেয় টিয়া।
কাঠ থেকে কোকিল এবং টাইগার থেকে টিয়া হওয়া প্রতিভার সংখ্যা অনেক। তারা কুহু সুরে ওস্তাদের নাম ছড়িয়ে দেয় চারপাশে।
গলা ঘষা ওস্তাদের নাম হয়ে যায় ‘ঘষা সিরাজ’।
ঘষা সিরাজের খণ্ডকালীন শিষ্য ছিলেন টুলু ভাই। ঘষেমেজে টুলু ভাইকেও দাঁড় করিয়ে দেন তিনি। বাজার চাঙ্গা করতে নিজের নাম বদলে ফেলেন টুলু ভাই। টুলু চৌধুরী থেকে টুলু সিরাজ।
বাজার ধরেও ফেলেছিলেন প্রায়। কিন্তু ওই যে ভাবমূর্তি। সব গুবলেট করে দিল। ভাবে পড়ার পর টুলু ভাইয়ের গলা ধরে এলো। গলা দিয়ে কথা পুরোপুরি বের হয় না। কথাকে চাবাতে গিয়ে প্রতি শব্দে টেল ড্রপ। কথার প্রথম অর্ধেক থাকে। লেজের অর্ধেক হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। যে অর্ধেক শব্দ শোনা যায় স্বাভাবিকভাবেই, তাদের অর্থ যায় পাল্টে।
ওওরে নীল দরিয়া, আমায় দে রে দে ছাড়িয়া...
টুলু ভাইয়ের কণ্ঠে দরিয়াকে মনে হয় দড়ি।
টুলু ভাইকে ব্যঙ্গ করে আমরা গাই—
ওওরে নীল দড়ি, আমায় দে রে দে পড়ি।
গানের গলায় দড়ি পরিয়েও টুলু ভাই নির্বিকার। তিনি ভাবে অটুট।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—কৃষ্ণকলি আমি তারে বলি...
টুলু ভাই চিবিয়ে চিবিয়ে গান—কৃষ্ণ আমি তারে বলি...।
ফোটার আগেই কলি হাওয়া।
সহ্যের সীমা ছাড়ালে টুলু ভাইকে থামাই আমরা।
ভাই, এইসব কী গাইতেছেন আপনে!
কেন। দা টেগোর সং। শোনোনি আগে?
আরে ভাই, আপনি তো মাইয়ারে পোলা, পোলারে মাইয়া বানায়া ফেলতেছেন। দরিয়ারে বানাইতেছেন ফাঁসির দড়ি।
সরি...। বাট আর্ট কালচারে এটা হয়।
ভাবের মধ্যে বাড়তি ভঙ্গি আনেন টুলু ভাই।
ভাই এসব থামান। এভাবে করলে গান তো আর গান থাকে না। গানের মধ্যে প্রাণও থাকে না।
কেন, কেন? গান থাকবে না কেন?
ভুরু নাচিয়ে জানতে চান টুলু ভাই।
গান তো ভাই পান-সুপারি না, যে সারাক্ষণ চাবানের ওপর রাখবেন। গীতিকার গান লেখছে বারো লাইন। চাবাইতে গিয়া আপনি অর্ধেক খাইয়া ফালান। এইটা কেমন কথা!
গান চাবাই মানে! গান কি চুইংগাম?
আমরাও তো তাই কই। চাবান ক্যান। চাবাইতে গিয়া চাইর শব্দের মধ্যে দুই শব্দ নাই। কৃষ্ণ আছে কলি নাই। এতদিন কিছু বলি নাই। কিন্তু ভাই আর না। আপনার ভালোর জন্য বলি, গানরে চুইংগাম বানানো বন্ধ করেন।
ও এই কথা?
টুলু ভাই হাসেন।
শোনো, এইটা হইলো ভাবমূর্তি।
ভাবমূর্তি!
হুমম। নিজের ভাবমূর্তি তৈরি করতে হলে ভাব নেওয়া জানতে হবে। আর ভাব নেওয়া মানে হচ্ছে অর্ধেক অডিয়েন্স শুনবে আর অর্ধেক হয়ে যাবে হাওয়া। যেটুকু হাওয়া হবে, সেটা নিয়ে অডিয়েন্স থাকবে টেনশনে। সব বুঝে ফেললে তো আর ভাবমূর্তি থাকে না। বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই যদি পুরোটাই বুঝে ফেলে, তাহলে তো বিসমিল্লাহতেই গলদ।
ও। এইবার বুঝছি ভাই।
ক্লিয়ার?
একদম ক্লিয়ার ভাই। আপনারও ওই বিসমিল্লাহতে গলদ। আপনার গলায় শুধু ভাবটাই আছে। গানটা পুরাই মূর্তি হয়ে গেছে।