গল্প
অনাকাঙ্ক্ষিত
এই অনাত্মীয় ঢাকা শহরে বৃষ্টি কোনো রোমান্টিকতা নিয়ে আসে না। বরং এ যেন ভীষণ বিড়ম্বনার উপকরণ মাত্র। এখানে ওখানে জলজট। সেই জলে ভেসে বেড়ায় ভাগাড়ের হাড্ডি-মাংস। ইটের সুরকি দিয়ে চাপা দেওয়া রাস্তার ক্ষতগুলো দাঁত বের করে হাসে, খানাখন্দ হা করে থাকে জলহস্তির মতো। রিকশা কিংবা অটো কিংবা মানুষ আটকা পড়ে ওই হা-এর ফাঁদে। সারা শহর যানজটে হয়ে পড়ে নাকাল, অচল। সন্ধ্যার কিছু আগে আগে একঝাঁক বৃষ্টি নেমে এলো এ উত্তপ্ত নগরীতে। তবে এ নিয়ে ভাবার আজ ফুরসত নেই শোভনের। বারোতলা ভবনের আটতলায় অফিস তাঁর। বিদেশি অ্যাড ফার্ম। ভিতরটা এয়ারকন্ডিশনে শীতল থাকে সবসময়ই। চারদিকে গাঢ় রঙের পর্দা টানানো। জানালা খুলে আকাশ দেখার সুযোগ হয় না কখনো। আজ কেন জানি হঠাৎ বাইরের দৃশ্যটা দেখতে খুব ইচ্ছে হলো তার। জানালার কাচটা টান দিতেই ক্ষুধার্ত বাঘের মতো ঝাপিয়ে পড়ল বৃষ্টিভেজা এক রাশ হাওয়া। কনে দেখা আলো ভিজছে বৃষ্টিতে। মনে হলো কে যেন সুগন্ধি সাবান দিয়ে ধুয়ে দিয়েছে পুরোটা আকাশ। এ যেন কোনো কনের গায়ে হলুদের স্নান। এমন ঝলমলে দিনে যে কেউ কবি বনে যেতে পারেন। কিন্তু শোভনের মন অন্য কিছু ভাবছে। মনে তার ঘাপটি মেরে আছে গুমোট হাওয়া। কাউকেই শেয়ার করতে পারছে না সেই অনুভূতি।
ঘণ্টাখানেক আগে খবরটা আসে বড়দা সোহমের কাছ থেকে। ফোনটা পেয়েই বুঝেছিল কিছু একটা হয়েছে। ওপাশ থেকে সোহম বলে- ‘শোভন, তোর মা আর নেই।’
কথাটা শুনে মনের ভেতর খুব যে কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে, তা নয়। শোভনের নির্বিকার উত্তর- ও আচ্ছা।
-‘তুই আসবি না? তোর ভাইবোনেরা সবাই হাসপাতালে। ওখান থেকে মরদেহ নেওয়া হবে ময়মনসিংহে।’
যন্ত্র ভেদ করে ভেসে আসা কথাগুলোতে মনোযোগ দিচ্ছিল না শোভন। বরং টেবিলের ওপর মেলে ধরা ফাইলটাতে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিল আলতোভাবে। প্রত্যুত্তর না পেয়ে সোহম আবার জিজ্ঞেস করে- ‘কী শোভন, কথা বলছিস না যে? কখন আসছিস তুই?’
এক শব্দে শোভন উত্তর দেয়- দেখি।
২.
ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে মেজো মামি তাকে একটু অন্যভাবে ভালোবাসে। এ ভালোবাসা আর সবার মতো না। কেমন কেমন জানি। মেজো মামা প্রিয়তোষ সেন হতদরিদ্র। জিলাপি পট্টিতে এক চিড়া-মুড়ি-গুড়ের দোকানে কাজ করেন। চার ছেলেমেয়ে তার। অভাব সবসময়ই গায়ে গায়ে লেপ্টে থাকে তাদের। তারপরও শোভন কখনো ময়মনসিংহে গেলে মামি যেন আহ্লাদে আটখানা হয়ে যান। বাকিতে দুধ কিনে পায়েস করে খাওয়ান। মামাতো ভাইগুলো হ্যাংলার মতো শোভনের সেই খাওয়া গোল হয়ে বসে দেখে।
মামাবাড়িতে গেলে সাধারণত ছোট মামার বাড়িতেই ওঠে শোভনরা। ছোটবাজারে এই দেবতোষ মামার রড-সিমেন্টের ব্যবসা বেশ জমজমাট। বড় মামা পরিতোষ শয্যাশায়ী। হার্টের অসুখ, ডায়াবেটিস, হাইপ্রেশার ইত্যাদি নানা রোগে ন্যুব্জ। একসময় সিটি কলেজিয়েট স্কুলে মাস্টারি করতেন। এখন রিটায়ার্ড। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে মামাবাড়ি যাওয়াটা যেন একটা বাৎসরিক রুটিন ছিল সেই সময়। মা, বাবা, দাদা, দিদি- সবাই মিলে হৈ-হুল্লোর করে দিন কাটানো। একই পাড়াতে থাকতেন মামারা। তবে যার যার বাড়ির ছাদ তার তার। সোহম-শুভ্রা-শোভনরা এলেই দৃশ্য বদলে যেত। মামাতো ভাইবোনেরা একট্টা হয়ে এখানে-ওখানে ছোটাছুটি, লাফালাফি। সে এক কাণ্ডই বটে! পাঁচ-সাত দিন যেন পারিজাত নেমে আসতো মামাবাড়িতে। ঢাকায় ফেরার আগের রাতে কান্না পেত খুব। আবার সেই স্কুল, সেই কোচিং, সেই টিউটরের পড়া, সেই বন্দী জীবন। ধুর ছাই! ভালো লাগে না।
৩.
ক্লাস সেভেনের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে ওইবার মামাবাড়ি যাওয়া। না গেলেই বরং ভালো ছিল শোভনের। এক রাতের ঘটনা। মামাতো ভাইবোনেরা একসঙ্গে সারাদিন দস্যিপনা করে রাতে ঘুমাতে গেছে এক বিছানায়। রাত ১২টা সাড়ে ১২টা বাজে হয়তো। ছোট মামা বাড়ি ফিরেছেন কখন জানা নেই। খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে মা-বাবার সঙ্গে পাশের ঘরে আলাপ করছিলেন মামা-মামি। আর এসময়ই হঠাৎ কী মনে করে শোভনের ঘুমটা ভেঙে গেল। অন্ধকার ঘর। পাশের ঘরে আলো জ্বলছে তখনো। তার ছটা এসে পড়ছে অন্ধকার ঘরেও। মামার কণ্ঠ ভেসে এলো- ‘দাদাবাবু, শোভন কি জানতে পেরেছে সবকিছু? ও তো বড় হচ্ছে, বুঝতে শিখছে। আমার মনে হয়, এখনই বলে রাখা ভালো। তা ছাড়া মেজো বৌদি তো শোভন বলতে এখন পাগল।’
বাবার উত্তর- ‘এখনো বলিনি। তবে বলব সময়-সুযোগ মতো। আরেকটু বড় হোক বরং। এই সময়টাতে শরীরে চেঞ্জ আসছে। গলার স্বর ভেঙেছে। এখন এমন সত্যটা হয়তো সহজভাবে নিতেও পারবে না ও।’
‘তা আপনি যেদিনই বলেন দাদাবাবু, আসল কথাটা জানার পর তার ভেতর ধাক্কা লাগবেই।’- মামির উত্তর।
মায়ের কথা- ‘শোভন আমার। আমার সোহম-শুভ্রার চেয়ে কোনো অংশে কম নয় সে। ওকে আমি কিছুতেই হারাতে পারব না। এর চেয়ে সারাজীবন সত্য চাপা থাকবে। এক জীবনের কত কথাই তো গোপন থেকে যায়। না হয় এটাও থাকল। তা ছাড়া মেজদার অবস্থা তো আজও পরিবর্তন হয়নি। তার ঘরে থাকলে কী আর শোভন এমন বাড়ন্ত হতে পারত?’
কথাগুলো বাজ পড়ার মতো শোভনের কানের ওপর এসে পড়ছিল যেন। তার মানে আমার মা, আমার সত্যিকারের মা নয়; আমার মেজো মামিই আমার মা? কখনোই হতে পারে না। এ মিথ্যা, সব মিথ্যা। এটা নিশ্চয়ই সে স্বপ্ন দেখছে। ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন! ঘুম ভাঙলেই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে আগের মতো। সকাল হলেই সব কিছু হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে কর্পূরের মতো।
আধো অন্ধকারেই বিছানা ছেড়ে ওঠে শোভন। পাশের ঘরের পর্দা সরিয়ে দাঁড়ায় সে। অনেকটা ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে সবাই। মা ডুকরে কেঁদে ওঠে। বাবা বলে- কীরে শোভন, এত রাতেও তুই ঘুমাসনি?
মামা-মামি নিশ্চুপ। কাচা ঘুম ভাঙা স্বরে শোভনের ভূতুড়ে কণ্ঠ প্রশ্ন করে- তোমরা এতক্ষণ ধরে যা যা বলছিলে তার একটাও সত্যি নয় বলো? কী হলো বাবাই, বলো? কী হলো মা- বলো?
মা এসে জাপটে ধরে তাকে। কাঁদতে কাঁদতে বলে- ‘না, না, আমাদের কথার এক কানাকড়িও সত্যি নয় বাবা। সব মিথ্যা, সব মিথ্যা।’
সেই রাতে আর দুই চোখ এক করতে পারেনি শোভন। বারবার কেবল মনে হতে থাকে, এত দিন যাকে মা বলে ডেকে এসেছে, ওই নারীর গর্ভে তার জন্ম হয়নি? জন্ম দিয়েছে তার মেজো মামি? এই জন্যই কি ওই মামির মুখের আদলের সঙ্গে তার এত মিল? সেই রাতের ভেজা বালিশ সাক্ষী, কী উলট-পালট করে দিয়েছিল তাকে একটা সত্য সামনে এসে।
৪.
‘আন-এক্সপেক্টেড চাইল্ড’ শব্দটির সঙ্গে আরো পরে পরিচয় হয় শোভনের। তার মানে, সন্তানটি দম্পতির আরাধ্য থাকে না; বরং সঙ্গমের একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ফসল মাত্র। বড় হয়ে শোভন জেনেছে, ক্ষুধার্ত মানুষের যৌনাকাঙ্ক্ষা বেশি, দরিদ্র মানুষের যৌনতাই অন্যতম বিনোদন। যতই এসব জানতে থাকে সে, ততই গা ঘিনঘিন করে ওঠে তার। কোনো এক লেখায় পড়েছিল সে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী কলমা দেবী একবার মৃত সন্তান প্রসব করার পর নাকি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিলেন- যাক বাবা, বাঁচা গেল। অভাবের সংসারে অযথা একটা পেট বাড়ত। সন্তানের জন্য কমলা দেবীর শোক তো ছিলই না, বরং ওই দিন থেকেই নাকি দিব্যি সংসারের কাজে মন দিয়েছিলেন তিনি। একজন গর্ভধারিণী কোন অবস্থায় এমনটা ভাবতে পারেন- এ নিয়ে অনেক ভেবেছে শোভন। ভাবে, মানিকের ওই মরা বাচ্চাটির কথা।
৫.
সত্যটা প্রকাশের পর থেকে আর মামাবাড়ি যেতে চাইতো না শোভন। মামিকে তার মা হিসেবে ভাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তার পিসিমাই তার মা- একমাত্র মা। সেই রাতের পর থেকে কে যেন একটানে বড় করে দিয়েছে শোভনকে। দুরন্ত শোভন তারপর থেকে ক্রমাগত শামুকের মতো গুটিয়ে নেয় নিজেকে। খোলস ছেড়ে আর বের হয়নি। আজ সেই মামি মারা গেছেন। শোভনের কেবলই কমলা দেবীর কথা মনে পড়তে থাকে। নিজেকে ওই মৃত সন্তানের প্রতিনিধি হিসেবে অনুভব করতে থাকে।
৬.
কথা ছিল পারমিতার সঙ্গে আজ তার দেখা হবে চারুকলার সামনে। ইস্কাটনের অফিস শেষে শাহবাগের দিকে হাঁটতে থাকে শোভন। সন্ধ্যার পর ক্লান্ত মানুষের ভিড় জমে থাকে রাস্তার মোড়ে মোড়ে। বাস এলেই হামলে পড়ে সেটার ওপর। বাড়ি ফেরার এমন বুভুক্ষু মন সেইভাবে কখনো তার হয় না। মোবাইল ফোনে পারমিতার নাম ভেসে ওঠে। বৃষ্টিস্নাত শহরের কাদাজল পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শোভন মোবাইল ফোনে কথা বলতে থাকে পারমিতার সঙ্গে। দেখা হয় দুজনার। মুখোমুখি দুই-একটি কথা শেষে রিকশায় করে দুজনে ঘুরে বেড়ায় কিছুক্ষণ। নিউমার্কেটের এক ফাস্ট ফুডের দোকানে বসে বার্গার আর কফি খায়। রাত ৮টার আগেই রোকেয়া হলে পারমিতাকে পৌঁছে দিয়ে বাড়ির পথে হাঁটতে থাকে শোভন। বড়দা সোহম কল করে তার মোবাইল ফোনে। -‘কী রে, কোথায় তুই?’
-শাহবাগ।
-ওখানে কী করছিস? ময়মনসিংহ যাবো বলে আমরা সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছি। যাবি না তুই? গাড়ি রেডি।
-দেখি।
-‘দেখি মানে? এটা আবার কেমন কথা? শ্মশানে থাকতে হবে তো তোকে। আফটার অল সে তোর মা।’ সোহমের কণ্ঠস্বরে রাগ।
কথা বলতে ইচ্ছে করছে না বলে কলটা কেটে দেয় শোভন। মোবাইল ফোনটা সুইচ অফ করে রাখে। মেকি ভালোবাসা দেখাতে তার মন সায় দেয় না। শোক নয়, ক্ষোভ নয়, ঘৃণা নয় বরং স্বস্তির এক গভীর নিশ্বাস ফেলতে থাকে সে। দীর্ঘদিন গলায় আটকে থাকা একটা অসমাপ্ত অধ্যায়ের অন্তত অবসান হলো আজ। একটা সিগারেট ধরায়। সুখটান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বাতাসে মিলিয়ে দেয়।
৭.
গত কয়েকদিন ধরেই নাকি শোভনের কথা সরাক্ষণ আওড়াত মেজো মামি। একটিবারের জন্য হলেও দেখতে চাইতো তাকে। অনেকে অনেকবার অনেক আবেগের স্বরে শোভনকে জানিয়েছে সে কথা। একদিন দুপুরে মেজো মামা ফোন দেন। মিনিট পাঁচেকের মতো কথা বলেন। শোভন কেবল শুনে যায়। অবশেষে কোনো উত্তর না দিয়ে কল কেটে দেয় শোভন। হার্ট, কিডনি, লিভার আরো কী কী যেন অকেজো হয়ে পড়েছিল মেজো মামির। ঢাকায় নিয়ে আসা হয় দুইদিন হলো। তবে এক মুহূর্তের জন্যও শোভন ঢাকা মেডিক্যালের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের ১৮ নম্বর বেডের সামনে এসে দাঁড়ায়নি।
৮.
কেওয়াটখালি শ্মশানঘাট। মরদেহ স্নান করিয়ে সাজানো হয় চিতা। চুল্লির ওপর তোলা হয় সরলা দেবীর মরদেহ। নিজের জীর্ণ ছেলেরাই এক এক করে মুখাগ্নি করে। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে শিখা। তার পাশে নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে প্রিয়তোষ। গায়ে এসে লাগে তার আগুনের আঁচ। রক্তিম আলোয় ছেয়ে যায় তার মুখ। চোখের তলায় দেখা দেয় ঝিলিক। শোভনের জন্য স্ত্রীর ব্যাকুলতার কথা মনে পড়তে থাকে তার। কী পাগলামোই না করেছে সরলা! ভালো-মন্দ খাওয়াতে-পরাতে পারবে না বলেই তো একদিন নিজের ছোট বোনের হাতে তুলে দিয়েছিল সদ্য ভূমিষ্ঠ শোভনকে। সরলা কেঁদেছিল খুব, তবে বাস্তবতা তাকে দ্রুতই হার মানাতে বাধ্য করে। আজ তার শোভন অনেক বড় হয়েছে। মস্ত চাকরি করে। নিজের ভাঙা সংসারে থাকলে হয়তো অন্য ছেলেদের মতো দোকানে-দোকানে কাজ করে পেট চালাতে হতো। বারবার প্রিয়তোষের মনে হতে থাকে শোভন আসবে, পাশে এসে দাঁড়াবে। চিতা জ্বলে জ্বলে নিভে যেতে থাকে। রাত গভীর থেকে আরো গভীরতর হয়। ভোরের কিছু আগে ভস্ম হয়ে মিশে যায় সরলা। ভোরের কাক ডেকে যায়। শ্মশানের চাতালে ছড়িয়ে বসে প্রিয়তোষ তখনো ঠাঁয় প্রতীক্ষা করতে থাকে শোভন আসবে বলে। মনে তার গভীর বিশ্বাস, একবারের জন্য হলেও শোভন আসবেই, আসবে।