সাক্ষাৎকার
আমার কাজ হচ্ছে সত্যকে তুলে ধরা : তানভীর মোকাম্মেল
তানভীর মোকাম্মেল, এ দেশের স্বনামধন্য একজন চলচ্চিত্র পরিচালক। মুক্তিযুদ্ধের ওপর অনেক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তিনি। তাঁর নির্মিত উল্লেখ্যযোগ্য কিছু চলচ্চিত্র হলো ‘স্মৃতিতে একাত্তর’, ‘নদীর নাম মধুমতী’, ‘রাবেয়া’, ‘কর্ণফুলীর কান্না’ ও ‘জীবনঢুলী। কেন তিনি মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে এতগুলো চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে তিনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন, কাহিনীচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্রে সত্য কী করে প্রকাশিত হয়- এসব নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হয় এনটিভি অনলাইনের।
প্রশ্ন : ১৯৯১ সাল থেকে আপনি ধারাবাহিকভাবে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণে আপনি কীভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন এবং কেন?
উত্তর : আমি অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের বিষয় ছাড়াও ওই সময়কালে অন্য বিষয়েও ছবি তৈরি করেছি। ‘লালন’, ‘লালসালু’, ‘চিত্রা নদীর পারে’ আমার এসব ছবির বিষয়বস্তু মুক্তিযুদ্ধ নয়। তবে সংখ্যায় মুক্তিযুদ্ধের ওপর ছবির সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। ‘নদীর নাম মধুমতী’, ‘রাবেয়া’, ‘জীবনঢুলী’, প্রামাণ্যচিত্র ‘১৯৭১’ কিম্বা ‘তাজউদ্দীন আহমদ : নিঃসঙ্গ সারথি’। হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধের ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণে আমি আসলেই বিশেষভাবেই অনুপ্রাণিত বোধ করি।
আসলে আমি যে প্রজন্মের, ১৯৭১ সালে আমরা ছিলাম কৈশোর-যৌবনের সন্ধিক্ষণে, সে বয়সে মানুষের সংবেদনশীলতা খুব তীক্ষ্ণ থাকে। মানুষের মন থাকে গভীরভাবে স্পর্শকাতর। ওই সময়েই আমরা দেখলাম ভয়াবহ সব গণহত্যা, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর ইসলামী সাম্প্রদায়িক শক্তি রাজাকার-আলবদরদের নৃশংসতা, নারী ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা, আবার মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও ত্যাগ-তিতিক্ষা। এসবই হয়তো আমার সেই নবীন বয়সের অবচেতন মনে এত গভীর অভিঘাত ফেলেছিল যে আজও যখন আমি কোনো ছবি তৈরি করার কথা ভাবি তখন মুক্তিযুদ্ধের কোনো বিষয়ই সর্বাগ্রে আমার মনে চলে আসে। এত অসংখ্য ঘটনা, এত স্মৃতি!
প্রশ্ন : ১৯৭৫ সালের পর দীর্ঘ কয়েক বছর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ না হওয়ার মূল কারণ কী ছিল বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও কারাগারে চার নেতাকে হত্যার মাধ্যমে দেশে একটি প্রতিবিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। শুরু হয়েছিল এক উল্টাপুরাণ। মুক্তিযুদ্ধের কথা তখন বলাই যেত না। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে নীরবতা বা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিকৃত সব কথাবার্তা রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেই শুরু হলো। ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী’ কথাটা বলা যেত না, বলা হলো ‘হানাদার বাহিনী’ (কোনো দেশের হানাদার বাহিনী!!), ১৯৭১ সালকে মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল না বলে বলা শুরু হলো ‘গণ্ডগোলের বছর’! যেন মুক্তিযুদ্ধটা ছিল নেহাতই এক ‘গণ্ডগোল’!! এ ছিল আমাদের জাতির এক চরম দুঃসময়। এ ব্যাপারে আমরা খুবই বিরক্ত ছিলাম। তবে আমাদের তো তখন বয়স কম, সামর্থ্যও কম। ফলে বড় ছবি তৈরি করা তো সম্ভব ছিল না। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখবেন যে ওই সময়টাতেই আমি ‘হুলিয়া’ স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিটা শুরু করি, কিছু দিন পর মোরশেদুল ইসলাম শুরু করেন ‘আগামী’। আমরা কিন্তু বসে ছিলাম না।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্যে সরকার যে পরিমাণ অনুদানের টাকা দেয় সেটা কি যথেষ্ট?
উত্তর : না, যথেষ্ট নয়। সরকারের উদ্দেশ্যটা ভালো, অনুদান প্রথাটাও ভালো। তবে টাকার অঙ্কটা আরো বেশি হলে ভালো হয়।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রায় চার ঘণ্টার প্রামাণ্যচিত্র ‘১৯৭১’ নির্মাণ করেছেন আপনি। এই প্রামাণ্যচিত্রতে মুক্তিযুদ্ধের পুরো চিত্রটা কি তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে?
উত্তর : ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এক মহাকাব্যিক বিষয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধ হয়েছে, লাখ লাখ মানুষ সেসব যুদ্ধে ও গণহত্যায় প্রাণ হারিয়েছে, এক কোটি মানুষ দেশত্যাগ করেছিল, লাখ লাখ পরিবারের জীবনে নেমে এসেছিল চরম বিপর্যয়। এই সমস্ত কিছু একটা মাত্র প্রামাণ্যচিত্রে তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান যে বিষয়গুলো গণহত্যা, নারী নির্যাতন, শরণার্থীদের ব্যাপক দেশত্যাগ, বিভিন্ন বাহিনী গঠন, গেরিলা যুদ্ধ ও নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সম্মুখযুদ্ধ এবং পরিশেষে ১৬ ডিসেম্বর বিজয়, এ সব কিছুই ‘১৯৭১’ ছবিটাতে এসেছে। তা ছাড়া রয়েছে সে সময়কার রাজনীতি, মুজিবনগর সরকারের কর্মকাণ্ড এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির দিকগুলো। ফলে কেউ ‘১৯৭১’ প্রামাণ্যচিত্রটি দেখলে মুক্তিযুদ্ধের একটা সার্বিক চিত্র পাবেন। নতুন প্রজন্মের জন্যে এ ছবিটা তাই খুবই শিক্ষণীয় হতে পারে।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের ওপর কাহিনীচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র কোনটাতে আপনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন?
উত্তর : একজন শিল্পী হিসেবে আমার কাজ হচ্ছে সত্যকে তুলে ধরা। এখন সত্যের কাছে আপনি দুভাবেই পৌঁছাতে পারেন, প্রামাণ্যতার মাধ্যমে প্রামাণ্যচিত্র, আবার মানুষের জীবনের গল্প নিয়ে কাহিনীচিত্র। প্রামাণ্যচিত্রে আপনি তথ্যের সত্যকে তুলে ধরেন, কাহিনীচিত্রে জীবনের সত্যকে। যেহেতু শিল্পী হিসেবে আমার কাজ হচ্ছে সত্যকে তুলে ধরা, ফলে কাহিনীচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র দুই ক্ষেত্রেই আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।
প্রশ্ন : ভালো প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করার জন্য কী প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : মননশীল ও পরিশ্রমী গবেষণা। গবেষণা করতে আমার ভালো লাগে। বিশেষ করে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক নিয়ে। আমার ‘১৯৭১’ বা ‘তাজউদ্দীন আহমদ : নিঃসঙ্গ সারথি’ প্রামাণ্যচিত্র দুটির পেছনে অনেক গবেষণা ছিল। আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাহিনীছবি তৈরির সুবিধা হচ্ছে যে গল্পের কোনো শেষ নেই! বাংলাদেশের যে কোনো পরিবারের একাত্তর সালের অভিজ্ঞতার কাহিনী নিয়েই একটা চলচ্চিত্র তৈরি করা সম্ভব।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাহিনীচিত্র তৈরি করার সময় আপনি কি কোনো সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন?
উত্তর : কিছু সমস্যা রয়েছে। মূল সমস্যাটা হচ্ছে সে সময়কার যথাযথ অস্ত্র, গোলা-বারুদ, যানবাহন, এসব জোগাড় করা যা আবার কেবল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীরই রয়েছে। তাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া অ্যাকশন-দৃশ্যগুলো দুর্বল হয়ে পড়তে বাধ্য। যেমনটি আমার ‘নদীর নাম মধুমতী’ ছবিটির ক্ষেত্রে ঘটেছিল। সেনাবাহিনীর কাছ থেকে অস্ত্র-শস্ত্র, যানবাহন না পেলে মুক্তিযুদ্ধের ওপর বিশ্বাসযোগ্য ছবি তৈরি করাটা কঠিন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমি এ পর্যন্ত তিনটি বড় কাহিনীচিত্র তৈরি করেছি ‘নদীর নাম মধুমতী’, ‘রাবেয়া’ আর ‘জীবনঢুলী’। সেনাবাহিনীর সহায়তা পেলে ভবিষ্যতে আরো ছবি করতে চাই।