মুক্তির কথা
শিল্প, সাহিত্য, চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ
ভাষা আন্দোলনের চেতনাবীজ থেকে আমাদের সাহিত্যের যে অগ্রযাত্রা সূচিত হয়েছিল, তার রেশ রয়ে গেছে আজও। সাহিত্যের সব মাধ্যমে সেই চেতনার ধ্বনি প্রতিধনিত হয়েছে- সেই বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে দশদিগন্তে। এই ছড়িয়ে পড়ার প্রবহমান ধারা আজও বহমান। মূলত বাহাত্তর থেকে এর সূত্রপাত হলেও সাহিত্যবোদ্ধারা বলছেন, বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে সাহিত্যে স্বাধীনতা, স্বতন্ত্র ও পৃথক সত্তার প্রাথমিক জাগরণ ঘটেছিল। এই জাগরণের ঢেউ ক্রমান্বয়ে প্রভাবিত করেছে পরবর্তীকালের সাহিত্যিকদের মধ্যে। জাগরণের বিষয়টি চলতে থাকে পরম্পরা।
আমাদের সাহিত্য মূলত তার আপন পথ ধরে অগ্রবর্তিত হয়েছে। এই অগ্রসর হওয়ার নেপথ্যে দেশপ্রেম, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, প্রগতি, শ্রেণি-বৈষম্যসহ নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তার বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। লেখায়, রেখায়, নাটকে, ছড়ায়, কবিতায়, গল্প-উপন্যাসে এর প্রতিধ্বনি উঠেছে বারবার। সৃজনশীল মানুষের যূথবন্ধ চিন্তাভাবনায়, রচনায় বাঙময় হয়ে উঠেছে প্রতিবাদ। প্রতিবাদের ভাষা সর্বজনীন রূপ পেয়েছে- পেয়েছে গ্রহণযোগ্যতাও। আত্মপ্রকাশের তীব্রতায় ব্যক্তি ও সমষ্টির আবেগ জীবন উন্মোচনের ঐকান্তিকতায় এবং দেশপ্রেমের প্রবল তীব্রতায় সাহিত্যের সব মাধ্যম নিজেই হয়ে উঠেছে পরিপূর্ণ। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিপর্যয়, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা জাতীয় জীবনে গভীর রেখাপাত সৃষ্টি করে সাময়িক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছিল যার প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি।
দৃশ্যপটের পালাবদল ঘটতে থাকে। শুরু হয় স্বাধীনতার যুদ্ধ। একাত্তরের পর একটি যুদ্ধোত্তর দেশে নানা ধরনের স্বপ্ন ও সম্ভাবনার বীজ তৈরি হতে থাকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই স্বপ্ন ও সম্ভাবনা প্রবলভাবে কাজ করতে থাকে। দ্বিধাহীন আত্মপ্রকাশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের পটপরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা, প্রেম ও সংগ্রাম- সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সৃষ্টির মধ্যে আনন্দ খুঁজে নেওয়ার প্রেক্ষাপটও তৈরি হয়। এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে সৃষ্টিশীল মানুষের গণজাগরণ ঘটতে থাকে। একাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত সময়ে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সব মাধ্যমে এই প্রবহমানতার প্রমাণ পাওয়া যায়। নাটক-চলচ্চিত্র-সংগীতও এই অগ্রযাত্রায় শামিল হতে থাকে। পঁচাত্তরের শোকাবহ ১৫ আগস্ট জাতীয় জীবনে নিয়ে আসে একবিপর্যয়। এ সময়ে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি তাদের ষড়যন্ত্র পরিপূর্ণ করতে নানা অপতৎপরতা নিয়ে মেতে ওঠে। নতুন প্রজন্মের সামনে তারা বিকৃত ইতিহাস তুলে ধরার অপচেষ্টাও চালাতে থাকে। দেশের উন্নয়নকে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও চলে। গণতন্ত্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িক চেতনতার বিকাশ ও সৃষ্টিশীল চিন্তাচেতনা স্তব্ধ করে দিতে সমাজের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এক অলিখিত বিধিনিষেধের আরোপ। এ সময় সামরিকতন্ত্রের নামে দেশে সৃজনশীল কর্মকাণ্ড রোধে নানা পদক্ষেপ চালু হয়। কিন্তু এত প্রতিবন্ধকতা, বিধিনিষেধের ঘেরাটোপকে উপেক্ষা করে সৃজনশীল মানুষরা তাদের রচনায়, লেখায়, রেখায়, আঁকায়, নাটকে প্রবন্ধে চলচ্চিত্রে তুলে ধরেন মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তর, বাঙালি হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐহিত্য।
উপন্যাস
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক উপন্যাস। এসব উপন্যাসে উঠে এসেছে নানা প্রেক্ষাপট। তবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম উপন্যাস হলো- আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ উপন্যাস লিখিত হয়েছিল। ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ উপন্যাসের এক জায়গায় লিখছেন, ‘নীলক্ষেতের পরিত্যক্ত রেললাইনের দুই পাশে বাস করত হাজার হাজার গরিব মানুষ। সময়ে ঝড়ে-বন্যায় গ্রাম বাংলার লাখ লাখ বাস্তুহারা শহরের এসেছে- তারাই এখানে এসে হয়েছে বস্তিবাসী। সেই গরিব মানুষের বস্তি পুড়িয়ে অশেষ বীরত্ব দেখিয়ে গেছে পাক-ফৌজ।’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সুদীপ্ত শাহীন তার শ্রেণি অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধের মূলধারার সঙ্গে মিলে গিয়েছিলেন। শাহীন মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেনি এ কথা যেমন সত্য, ঠিক একই রকম এই শাহীনই মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী শক্তিরূপে নিয়োজিত থেকে নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থেকেছেন। আত্মজৈবনিক এ উপন্যাসের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক কালের প্রামাণ্য দলিল উঠে এসেছে, যা এ উপন্যাসকে আলাদাভাবে চিত্রিত করেছে।
শওকত ওসমান আমাদের আরেক শক্তিশালী লেখক। তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন একটি অসাধারণ উপন্যাস। ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’ উপন্যাসটি শওকত ওসমান মুক্তিযুদ্ধকালে লিখেছেন। একাত্তর সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত এ উপন্যাসে ২৫ মার্চের গণহত্যার বিভীষিকাময় চিত্রও বর্ণনা এ উপন্যাসে চমৎকারভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র স্কুলশিক্ষক গাজী রহমান রাজধানী থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’কে কাহিনীনির্ভর উপন্যাস বলা যাবে না তবে এটি চিত্রধর্মী উপন্যাস। শওকত ওসমানের আরেক উপন্যাস ‘নেকড়ে ও অরণ্যে’ বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে বাঙালি নারীদের ওপর যে অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে, সে উপন্যাসে তারই চিত্র উঠে এসেছে। এ ছাড়া শওকত ওসমানের ‘দুই সৈনিক’ ও ‘জলাংগী’ উপন্যাসেও মুক্তিযুদ্ধ সরাসরিভাবে এসেছে।
শওকত আলী নিভৃতচারী আরেক শক্তিশালী লেখক। তাঁর লেখায় কাল ও সময় দারুণ মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এক পরিশ্রমী লেখকের প্রতীক তিনি। ‘যাত্রা’ উপন্যাসে শওকত আলী মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকের সময়কালকে নির্ণয় করে রচিত। উপন্যাসটি ১৯৭২ সালে রচিত হলেও ১৯৭৬ সালে এর প্রকাশ। মূলত ‘যাত্রা’ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালের বিভিন্ন ঘটনা-অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে রচিত। শওকত আলীর প্রাঞ্জল বর্ণনা ও ঘটনার ভেতর প্রবেশ করে মুনশিয়ানার সঙ্গে তুলে ধরেছেন, ‘ওদিকে উত্তরে শহরের আকাশে এখনো ধোঁয়ার কুণ্ডলি। ডাইনে থেকে বাঁয়ে, গোনা যায় আজ- একটা, দুটো তিনটে-চারটে, পাঁচটা- ওই যে আরেকটা, ওদিকে বাঁয়ে আবার আরেকটা আরম্ভ হচ্ছে। তবু গোনা যায়। গতকাল গোনা যেত না।’
রশীদ করীম ‘আমার যত গ্লানি’ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধকে আবর্তিত করে মধ্যবিত্ত বাঙালির দ্বিধা ও অন্তর্দ্বন্দ্বের উন্মোচন করেছেন। দেশভাগের আগ থেকে একাত্তরের ২৬ মার্চ পর্যন্ত সময়কালের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এ উপন্যাসে উঠে এসেছে। ১৯৭০-এর প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সত্তরের নির্বাচন, গণপরিষদের অধিবেশন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, যুদ্ধের কবলে দেশ ও জাতি বিষয়গুলো মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের মননে কী রকম প্রভাব বিস্তার করেছিল তারই ধারাবাহিক ছবির নির্যাস এ উপন্যাস। ‘আমার যত গ্লানি’ উপন্যাসে লেখক বলছেন, ‘পঁচিশ তারিখের রাতে ট্রাকভর্তি মরা মানুষ দেখা গেছে। একটা দুটো নয়, ডজন ট্রাক। একটা-দুটা মরা মানুষ নয়, শত শত। রক্ত চুইয়ে পড়ছে। সবাই আবার মরেওনি। পাশে, নিচে, মরা লাশ; সেই অনড় স্তূপের ফাঁক দিয়ে হঠাৎ একটা হাত একবার নড়ে ওঠে।’
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। একাত্তর ও যুক্তিযুদ্ধ নানাভাবে উঠে এসেছে তাঁর হাতে। ‘নীল দংশন’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’ ও ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ সৈয়দ শামসুল হকের লেখা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। একাত্তরের যুদ্ধে ঢাকাসহ সারা দেশ যে বধ্যভূমিতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল তার নিখুঁত বর্ণনা ও চিত্র ঘটনার মাধ্যমে ঔপন্যাসিক পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। যুদ্ধের সময় পাকবাহিনী বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের কথা ‘নীল দংশন’-এ উঠে এসেছে। ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাসে জলেশ্বরীর চেতনায় ও প্রতীকে দেশকে ধারণ করার চেষ্টা করেছেন লেখক। ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ উপন্যাসে লেখক মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণ ঘটনাবলির বাঙ্ময় উপস্থাপন করে পাঠককে চমকে দিয়েছেন।
রিজিয়া রহমানের এপিক ফর্মে লেখা ‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাসে আড়াই হাজার বছর পূর্বকাল থেকে একাত্তর সালের স্বাধীনতা যুদ্ধকাল পর্যন্ত সময়সীমা ও এর ঘটনাপ্রবাহকে বিস্তৃত কলেবরে তুলে এনেছেন।
স্বাধীনতার পর এপিক ফর্মে আবু জাফর শামসুদ্দীন বর্ণনাত্মক রীতিতে তাঁর ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ উপন্যাস ইতিহাসের বিশাল পটভূমিকে মহাকাব্যিক আয়তনে রূপ দিয়েছেন। বিচিত্র জীবন ও চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটেছে এতে। এ ছাড়া তার ‘দেয়াল’ উপন্যাসটি যুক্তিযুদ্ধের অনন্য সাধারণ দলিল হিসেবে পরিগণিত।
‘খাঁচায়’ উপন্যাসে রশীদ হায়দার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অবরুদ্ধ নগরজীবনের চিত্র বিশাল ক্যানভাসে লিপিবদ্ধ করেছেন। ঢাকা শহরের তিনতলার ফ্ল্যাটে অবরুদ্ধ ও আতঙ্কগ্রস্ত কয়েকটি পরিবারের বিপন্নতা, অসহায়তা, নিরাশ ও সংশয়ের কাহিনী ‘খাঁচায়’ উঠে এসেছে। কলেবরে ক্ষুদ্র হলেও ‘খাঁচায়’ উপন্যাসটিতে বন্দিদশা থেকে মানুষের মুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষাও বড় হয়ে এসেছে। ‘অন্ধ কথামালা’ রশীদ হায়দারের আরেকটি মুক্তিযুদ্ধনির্ভর উপন্যাস। এ উপন্যাসে লেখক বাংলার জনপদ, তার অন্তর্গত ব্যক্তি ও সমষ্টি, ব্যক্তির প্রত্যাশা, অপ্রাপ্তি, সংকট ও যন্ত্রণার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’ উপন্যাসে নায়ক খোকা সমাজ-সত্তা-বিচ্ছিন্ন একজন ব্যক্তি। লেখক এ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের সময় মধ্যবিত্ত শ্রেণির যে অংশ নিরাপদ থাকার আকাঙ্ক্ষায় যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি এড়িয়ে নিরাপদ অবস্থানে ছিলেন তাঁদের ছবি এঁকেছেন।
‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সেলিনা হোসেনের একটি ভিন্নমাত্রার রচনা। এ উপন্যাসে তিনি গ্রামীণ জীবনের ঘটাপ্রবাহের সুনিপুণ ছবি তুলে এনেছেন। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল হলো এ উপন্যাসের সময়কাল। বিস্তৃত পটভূমিতে লেখা ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসে গ্রামীণ জীবনযাত্রা, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মানুষের পরিণতি ও আকাঙ্ক্ষা, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার ও নারী নির্যাতন, রাজাকার বাহিনীর অপতৎপরতা অতি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
আহমদ ছফা খুব কম লিখেছেন কিন্তু যা কিছু লিখেছেন তা তাঁর রচনাশৈলীর জন্য হয়ে উঠেছে অনন্যসাধারণ। ‘অলাতচক্র’ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আহমদ ছফার এক অনবদ্য রচনা। এ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এক তরুণের কলকাতা যাপনের চিত্র উঠে এসেছে। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবীদের একাংশের সমালোচনাও দেখা যায় এই উপন্যাসে। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে রচিত ‘ওঙ্কার’ উপন্যাসটিও ছফার এক অনন্য সৃষ্টি। এক বোবা মেয়ের ঘটনার পরম্পরায় আকস্মিক সবাক হয়ে ওঠার ঘটনা চমকে দেয় পাঠককে। বোবা মেয়ের সবাক হয়ে ওঠার এই ঘটনা ষাটের দশকের বাঙালি জাতিসত্তার জাগরণের ইঙ্গিতকে সুস্পষ্ট করে। ‘ওঙ্কার’ উপন্যাসে সামরিক শাসন পীড়িত, অবরুদ্ধ জাতীয় অস্তিত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছে সুবিধাবাদী, প্রতারক ষড়যন্ত্রপরায়ণ ও পাকিস্তানি আদর্শের ধারক-বাহক আবু নসর মোক্তাবেরের বোবা মেয়ে। আহমদ ছফা প্রান্তিক চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে নির্মোহ দৃষ্টি নিয়ে ‘ওঙ্কার’-এ তুলে ধরেছেন দেশ-বিভাগেরও কালের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন।
হাসনাত আবদুল হাই রচিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘তিনি’। উপন্যাসটিকে শিল্প স্বভাবের বিবেচনায় উল্লেখ করা যেতে পারে প্রতীকী বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত উপন্যাসে। উপন্যাসের চরিত্র নওয়াজেশ আলীর সঙ্গে লেখক সর্বগ্রাসী প্রাণী তিমির সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
রাবেয়া খাতুনের ‘ফেরারী সূর্য’ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের আক্রমণ-প্রতি আক্রমণের চিত্র আছে। ‘ফেরারী সূর্য’ উপন্যাসে নাগরিক জীবনের অদ্ভুত বর্ণনা রয়েছে- রয়েছে পাকবাহিনীর বর্বরতার আখ্যানভাগও।
শামসুর রাহমানের ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ উপন্যাসে যুদ্ধ চলাকালে বুদ্ধিজীবীদের মানস পরিচয়কে বড় করে তুলে ধরেছেন। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কবি ও সাংবাদিক নাদিম ইউসুফ ২৫ মার্চের গণহত্যা প্রত্যক্ষ করে। মুক্তিযুদ্ধে তার দ্বন্দ্বময় টানাপড়েন জলপাই রঙের চললেও তার ভেতরে লাশ, ব্যারিকেড, মর্টার, চিৎকার, আগুন, কারফিউ, রেডিও, কুকুরের ডাক, ট্রাক, জলপাই রঙের জিপ- নানা বিষয় তুমুল কাজ করতে থাকে। মূলত আত্মজৈবনিক ঢঙে শামসুর রাহমান মুক্তিযুদ্ধে নিজের কথা বলার চেষ্টা করেছেন।
আমজাদ হোসেনের ‘অবেলায় অসময়’ মুক্তিযুদ্ধের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রাম, বাংলার সার্বিক চিত্র পাওয়া যায়। উপন্যাসের বিষয় পাক বাহিনীর আক্রমণে ভীতসন্ত্রস্ত গ্রামবাসীর নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানকে কেন্দ্র করে।
হুমায়ূন আহমেদকে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হিসেবে গণ্য করা হয়। হুমায়ূন আহমেদ সফলভাবে মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে মধ্যবিত্ত শ্রেণির এক ভিন্ন মাত্রার ছবি চিত্রায়িত করেছেন। লেখকের বাবা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এবং লেখক নিজেও মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছেন। লাখ লাখ পাঠকের কাছে বিপুলভাবে জনপ্রিয় এই লেখক, পাঠককে নিয়ে গেছেন এক অচিনলোকে যেখানে আনন্দ-দুঃখ-ভালোবাসা মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। ‘শ্যামল ছায়া’, ‘অনিল বাগচীর একদিন’, ‘সৌরভ’, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘১৯৭১’ এবং জোছনা ও জননীর গল্পসহ অন্যান্য উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে পরিকল্পিতভাবে। প্রত্যক্ষভাবে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময় থেকে দেশ যখন উল্টোপথে চলছিল, তখন মানুষের মধ্যে একধরনের হতাশা দেখা দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ, সংক্রাচিন্তার বিষয়গুলো মুখ থুবড়ে পড়ছিল। সে সময় ‘রাজাকার’, ‘পাকহানাদার বাহিনী’ বলা প্রায় নিষিদ্ধ ছিল তখন হুমায়ূন আহমেদের কল্যাণে দেশের মানুষ ‘তুই রাজাকার’ বলার সাহস পেয়েছিলেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত তাঁর একটি জনপ্রিয় নাটকে টিয়া পাখির মুখ দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ রাজাকারদের প্রতি তার এবং দেশবাসীর পুঞ্জীভূত ঘৃণা জানিয়ে দিয়ে তিনি সবার শ্রদ্ধাভাজনে পরিণত হন।
হুমায়ূন আহমেদ ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক উপন্যাস রচনায় পূর্বের সব রীতিনীতিকে ভেঙে তৈরি করেছেন নতুন এক নিজস্ব ফর্মেট। উপন্যাস রচনার কোনো প্রচলিত রীতিনীতি তিনি এখানে মানেননি। যেভাবে লিখে আনন্দ পেয়েছেন সেভাবেই লিখেছেন। অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ এই তিনটি কালকে কখন যে লেখক একাকার করে দিয়েছেন উপন্যাসের ভেতর, কখন পাঠককে যে নিয়ে গেছেন স্বপ্নে, কখন ফিরিয়ে এনেছেন বাস্তবে টেরই পাওয়া যায় না। ঘটনার ধারাবাহিকতা, ইতিহাসের তথ্যসূত্র, ঐতিহাসিক চরিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ক্রমবিবরণ সব মিলিয়ে ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ শেষ পর্যন্ত কেবল মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসই থাকেনি, হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস।
ইমদাদুল হক মিলনকে বলা হয় দেশের অন্যতম শক্তিশালী ও অধ্যবসায়ী লেখক। তিনি দুই হাতে লিখতে পারার ক্ষমতা রাখেন। ইমদাদুল হক মিলন তাঁর ‘ঘেরাও’, ‘কালো ঘোড়া’, ‘বালকের অভিমান’, ‘মহাযুদ্ধ’, ‘নিরাপত্তা হই’ উল্লেখযোগ্য। ‘কালো ঘোড়া’ উপন্যাস একটি গ্রামকে ফিরে। ক্র্যাক, মুক্তিযুদ্ধ, শান্তি কমিটির মানুষজন যুদ্ধকে সামনে রেখে তাদের ফায়দা লুটে নিচ্ছে- এর মধ্যেই সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ত, বিপন্নতা এবং এরই মধ্যে মানুষের ভেতর জমে থাকা প্রতিরোধ ও প্রতিশোধের চরম প্রকাশ কীভাবে হতে পারে তার জ্বলন্ত প্রমাণ ‘কালো ঘোড়া’।
মঈনুল আহসান সাবেরের ‘পাথর সময়’, ‘পরাজয়’, ‘কেউ জানে না’, ‘সতের বছর পর’ মুক্তিযুদ্ধের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। উল্লিখিত উপন্যাসের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাত্তোর বিশেষ করে স্বাধীনতা প্রাপ্তির ১৭ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রাজনৈতিক সংকটের স্বরূপ এবং তার পরিণতি বিধৃত করেছেন। তার উপন্যাস চতুষ্টয়ের স্বরূপ ও পরিণতি দেখা যায় রাজনীতিতে অর্থনীতি ও সমাজজীবনে কীভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধে পরাজিত শক্তির পুনরুত্থান ঘটছে।
মঞ্জু সরকার তাঁর ‘নগ্ন আগন্তুক’, ‘তমস’ ও ‘প্রতিমা উপাখ্যান’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির আস্ফালন ও পুনরুত্থানের চিত্র বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
নাটক
নাটককে বলা হয়ে থাকে জীবনের আয়না। জীবনের সঙ্গতি-অসঙ্গতি, পাওয়া না পাওয়া নাটকে মূর্ত হয়। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও নাটকের অনুষঙ্গ। সমকালীন বিষয়ও বাদ যায় না। নাটকে অনেক না বলা কথা প্রতীকী অর্থে বলে দেওয়া যায়। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে আমাদের নাটক নানাভাবে ঐতিহাসিক সত্যগুলো উঠে এসেছে শৈল্পিকভাবে। নাটক খুলে দিয়েছে বদ্ধ দরজা। ভেঙে দিয়েছে অচলায়তন।
নাটকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের আগের ও পরের নানা আখ্যাতন ভাগ উঠে এসেছে অত্যন্ত কুশলতার সঙ্গে। নাটকের মাধ্যমে মানুষের কাছে উন্মোচিত হয়েছে সত্যের দশ দিগন্ত। স্বাধীনতা-পরবর্তী গত চার দশকে নাটক তার কাঙ্ক্ষিত পথে অগ্রসর হয়েছে। আঙ্গিক, বিষয়, পরিপ্রেক্ষিতে- সবদিক থেকে নাটক অতিক্রম করেছে তার পথ। যে পথে সাফল্য এসেছে শতধারায়। মমতাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ শামসুল হক, জিয়া হায়দার, সেলিম আলদীন, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সাঈদ আহমদদের হাত ধরে নাটক তার কাঙ্ক্ষিত পথে এগিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধনির্ভর নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মমতাজউদ্দিন আহমেদের নাটকগুলো হচ্ছে- ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’, ‘এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ‘বর্ণচোর’। তাঁর নাটকে যুদ্ধের নির্মম বস্তুময় সত্য চরিত্র পাত্রের আচরণ ও সংলাপে রূপায়িত হয়েছে। ‘কী চাহ শঙ্খচিল’ (১৯৮৫) নাটকে পাক হানাদারকে নারী নির্যাতনের মর্মন্তুদ চিত্র রূপায়িত হয়েছে। আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘নিঃশব্দ যাত্রা’ (১৯৭২, ‘নরকে লাল গোলাপ’ (১৯৭৪), জিয়া হায়দারের ‘সাদা গোলাপে আগুন’ (১৯৮২), নীলিমা ইব্রাহিমের ‘যে অরণ্যে আলো নেই’ (১৯৭৪) উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাব্যনাটক সৈয়দ শামসুল হক অসাধারণ মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন তাঁর নাটকে। তাঁর অন্যতম উল্লেখযোগ্য নাটক হলো ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘নূরলদীনের সারা জীবন’। মুক্তিযুদ্ধের সংরক্ত চেতনাবাহী কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাটক হচ্ছে- কল্যাণ মিত্রের ‘জল্লাদের দরবার’ (১৯৭২), সাঈদ আহমদের ‘প্রতিদিন একদিন’ (১৯৭৮), আল মনসুরের ‘হে জনতা আরেকবার’ (১৯৭৪), রণেশ দাশগুপ্তের ‘ফেরী আসছে’ প্রভৃতি। এ ছাড়া আবদুল্লাহ আল মামুন, আতিকুল হক চৌধুরী, মামুনুর রশীদ, সেলিম আলদীন, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, আখতার ফেরদৌস রানা টেলিভিশন নাটকে মুক্তিযুদ্ধকে উপস্থাপন করেছেন।
প্রবন্ধ
মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে অসংখ্য প্রবন্ধ, মননশীল রচনা। এসব রচনায় মুক্তিযুদ্ধের জানা-অজানা নানা অধ্যায় উঠে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের ওপর সর্বাধিক মননশীল প্রবন্ধ, নিবন্ধ রচনা করেছেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। শাহরিয়ার কবিরও লিখেছেন অসংখ্য রচনা। তবে এম আর আখতার মুকুল, জাহানারা ইমামই প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যগ্রন্থ লিখে বিষয়টিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন। এম আর আখতার মুকুলের আমি বিজয় দেখেছি ও জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরই ধারাবাহিকতায় শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক স্মৃতিময় প্রবন্ধ, ডায়েরিসহ বিভিন্ন লেখা।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- এম আর আখতার মুকুলের ‘আমি বিজয় দেখেছি’, শামসুল হুদা চৌধুরীর ‘একাত্তরের রণাঙ্গন’, সেলিনা হোসেনের ‘একাত্তরের ঢাকা’, এম এস এ ভূঁইয়ার ‘মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস’, মেজর রফিকুল ইসলামের ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে’, জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’, রফিকুল ইসলামের (বীর উত্তম) ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’, কাজী জাকির হাসানের ‘মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’, আসাদ চৌধুরীর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’, হেদায়েত হোসাইন মোরশেদের ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম,’ ‘ঢাকায় গেরিলা অপারেশন’, রশীদ হায়দার সম্পাদিত ‘১৯৭১ : ভয়াবহ অভিজ্ঞতা’, পান্না কায়সার সম্পাদিত ‘হৃদয়ে একাত্তর’।
ছোটগল্প
ছোটগল্প তার ক্যানভাসে মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেছে পরিপূর্ণভাবে। সাহিত্য সমালোচকরা বলছেন, ছোটগল্পে যেভাবে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও একাত্তর উঠে এসেছে তা শিল্পের অন্য কোনো মাধ্যমে তেমনভাবে ধরা দেয়নি। অসংখ্য গল্পে বিস্তৃত পরিসরে মুক্তিযুদ্ধের বিশালতা বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় প্রতিভাত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে একটা কথা না বললেই নয় যে, ছোটগল্পের লেখকরাই আবার তাদের উপন্যাসে একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। মূলক কথাসাহিত্যিকদের হাত ধরে বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধ পেয়েছি অমরতা।
সীমিত জীবনের পরিপূর্ণতার বিষয়টি ছোটগল্প চমৎকারভাবে তুলে এনেছে। কেউ কেউ বলছেন, কবিতা, উপন্যাস, ছড়া, প্রবন্ধ, নিবন্ধের চেয়ে ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধ অনেক বেশি সফলভাবে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। মূলত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতীয় চেতনার স্ফুরণ ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের গল্প তাই আমাদের সবার গল্প হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে জীবনের গল্প। কান্নার গল্প। দুঃখের গল্প। আনন্দের গল্প।
মুক্তিযুদ্ধের গল্প কে না লিখেছেন? সব লেখকের কলমে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তর। স্বাধীনতা। স্বল্প পরিসরে হয়তো সবার নাম উল্লেখ করা সম্ভব নয়। তবে আমরা বিশ্বাস করি কথাসাহিত্যের নবীন লেখক থেকে শুরু করে উত্তর প্রজন্মের গল্পকারদের হাতেও বাঙ্ময় হয়ে উঠবে মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্পগুলোর মাঝে উল্লেখযোগ্য আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের রেইনকোট, অপঘাত, জহির রায়হানের ‘সময়ের প্রয়োজনে’, শওকত ওসমানের ‘আলোক অন্বেষা’, কায়েস আহমদের ‘শেষ বাজি’, সত্যেন সেনের ‘পরীবানুর কাহিনী’, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘রোদের অন্ধকারে বৃষ্টি’, বিপ্রদাশ বড়ুয়ার ‘সাদা কাফিন’, সুব্রত বড়ুয়ার ‘বুলি তোমাকে লিখছি’, আসাদ চৌধুরীর ‘কমলা রঙের রোদ’, বুলবন ওসমানের ‘সোলেমান ভাই’, মাহবুব সাদিকের ‘জন্মান্ধ যোদ্ধা’, জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ‘দিন ফুরানোর খেলা’, ‘আমৃত্যু আজীবন’, ‘মুক্তিযোদ্ধারা’, ‘আবু রুশদের খালাস’, আলাউদ্দিন আজ আজাদের ‘স্মৃতি তোকে ভুলবো না’, আবু ইসহাকের ‘ময়না কেন কয় না কথা’, আবদুশ শাকুরের ‘ইশু’, আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘কালিমদ্দি দফাদার’, আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিনের ‘অল্পরী’, আমজাদ হোসেনের ‘কারবালার পানি’, আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘ব্ল্যাক আউট’, আবুবকর সিদ্দিকের ‘ফজরালি হেঁটে যায়’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘লোকটি রাজাকার ছিল’, ইমতিয়ার শামীমের ‘মৃত্তিকা প্রাক-পুরাতন’, জাহানারা ইমামের ‘রায়বাগিনী’, জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ‘আমৃত্যু’, ‘আজীবন’, জুলফিকার মতিনের ‘খোঁজা’, নাসরীন জাহানের ‘বিশ্বাস খুনি’, পূরবী বসুর ‘দুঃসময়ের অ্যালবাম’, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ‘মাধবপুরে’, ‘পৌষের আকাশে’, বশীল আল হেলালের ‘প্রথম কৃষ্ণচূড়া’, বুলবুল চৌধুরীর ‘নদী জানে’, মাহমুদুল হকের ‘বেওয়ারিশ লাশ’, মোহাম্মদ রফিকের ‘গল্প কিন্তু সত্য নয়’।
সৈয়দ শামসুল হকের ‘প্রাচীন বংশে নিঃস্ব সন্তান’, শওকত আলীর ‘লেলিহান সাধ’, রাবেয়া খাতুনের ‘মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী’, রশিদ হায়দারের ‘তখন’, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ‘মুণ্ডহীন মহারাজ’, বশীর আল হেলালের ‘প্রথম কৃষ্ণচূড়া’, আবুবকর সিদ্দিকের ‘মরে বাঁচার স্বাধীনতা’, সৈয়দ ইকবালের ‘একদিন বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য গল্প’, রাহাত খানের ‘মধ্যিখানের চর’, সেলিনা হোসেনের ‘আমিনা ও মদিনার গল্প’, হুমায়ূন আহমেদের ‘শীত’, ‘উনিশ শ’, মইনুল আহসান সাবেরের কবেজ লেঠেল, রশীদ হায়দারের কল্যাণপুর, এ কোন ঠিকানা। কায়েস আহমেদের আসন্ন, মাহমুদুল হকের কালো মাফলার, মামুন হুসাইনের মৃত খড় ও বাঙাল একজন, শামসুদ্দীন আবুল কালামের পুঁই ডালিমের কাব্য, আমজাদ হোসেনের উজানে ফেরা, মঞ্জু সরকারের শান্তি বর্ষিত হোক, হুমায়ুন আজাদের জাদুকরের মৃত্যু, সুচরিত চৌধুরীর নিঃসঙ্গ নিরাশ্রিত, রিজিয়া রহমানের ইজ্জত তাপস মজুমদারের ‘মাটি’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘প্রস্তুতি পর্ব’, আহমদ বশীরের ‘অন্য পটভূমি’সহ অসংখ্য গল্প। মুক্তিযুদ্ধকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছেন গল্পকাররা নানা ঢঙে।
শিশুসাহিত্য
আমাদের শিশুসাহিত্যেও মুক্তিযুদ্ধ উঠে এসেছে নানাভাবে। শিশুসাহিত্যের পরিসর সমৃদ্ধ হয়েছে একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধে। ছোটদের জন্যে রচিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক, উপন্যাস, গল্প, ছড়া। ছড়া শিশুসাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ছড়ায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস উঠে এসেছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ছড়া-কবিতায় উল্লেখযোগ্যরা হলেন, সুকুমার বড়ুয়া, এখলাস উদ্দিন আহমদ, আসাদ চৌধুরী, আখতার হুসেন, খালেক বিন জয়েন উদ্দীন, মাহমুদ উল্লাহ, আবু কায়সার, আবু সালেহ, ফারুক নওয়াজ, লুৎফর রহমান রিটন, আমীরুল ইসলাম, নাসের মাহমুদ, সুজন বড়ুয়া, আসলাম সানী, ধ্রুব এষ, রোমেন রায়হান, সারওয়ার-উল-ইসলাম, ওবায়দুল গনি চন্দন, আনজির লিটন প্রমুখ।
সুকুমার বড়ুয়ার ‘সাক্ষী আছে’ ছড়ায় মুক্তিযুদ্ধ এসেছে এভাবে,
‘সাগর তীরে পথের ধারে
ঝুপড়ি দালান হাট বাজারে
থানায় থানায় জেলায় জেলায়
নদীর জলে- বনের কাছে
মুক্তি সেনার রক্ত রেখা
সাক্ষী আছে সাক্ষী আছে।
গর্ত ছেড়ে সাপের ছানা
কোন সুযোগ দিচ্ছে হানা
মীরজাফরের প্রেতাত্মারা
কিসের জোরে কোথায় নাচে?
সাক্ষী আছে সাক্ষী আছে।
ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে দিতে
রক্ত দলিল পুড়িয়ে দিতে
ফন্দি করে আবার কারা
নকশা বানায় নতুন ধাঁচে?
তন্দ্রাহারা বীর বাঙালীর
বুদ্ধি বিবেক সাক্ষী আছে।’
কিশোর গল্পেও মুক্তিযুদ্ধ তার দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে। কাইজার চৌধুরী, আলী ইমাম, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন, আবু সাঈদ জুবেরী, ইমদাদুল হক মিলন, আমীরুল ইসলাম, আশরাফুল আলম পিন্টু, রফিকুর রশীদ, মাহবুব রেজা, সারওয়ার-উল-ইসলাম, মনি হায়দার অমল সাহা, মনিরা কায়েস মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখেছেন।
কবিতা
গল্প, উপন্যাস, ছড়া, প্রবন্ধ, নাটকের মতো কবিতায়ও মুক্তিযুদ্ধ সমানভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। কোনো কোনো কবিতায় বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তর। কবিতাপ্রিয়রা তাই বলছেন, কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন পড়েছে সবচেয়ে বেশি।
কবিরা তাদের হৃদয়ের গভীর থেকে তুলে আনে পঙক্তিমালা। জীবনের জয়গান। কবিরা সত্য উচ্চারণে পিছপা হন না। স্বাধীনতার জন্য মানুষের আত্মত্যাগ কবিদের দায়বদ্ধ করে তোলে। আর সেই কারণে কবি শামসুর রাহমান অকপটে উচ্চারণ করতে পারেন কঠিন সত্য। ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা’ কবিতায় এই কবি বলেন,
তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতকাল ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতকাল দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?
...
রাইফেল কাঁধে বনে-জঙ্গলে ঘুরে-বেড়ানো
সেই তেজী তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে-
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে
নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিদ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।
মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা, নারকীয়তা কবিতার শরীরে পেয়েছে ভিন্নমাত্রা। ‘অন্তর্গত’ কবিতায় সৈয়দ শামসুল হক বলছেন সেই কথা,
হঠাৎ স্তব্ধতা বিদীর্ণ হয়ে যাবার একটি শব্দ আমরা
শুনতে পাই।
হঠাৎ চব্বিশটি রক্তাক্ত দেহ-রমণী, শিশু, যুবক, প্রৌঢ়-
আমরা দেখতে পাই এক মুহূর্তের জন্যে,
রক্তাক্ত এবং লুণ্ঠিত,
দ্বিতীয়বার আর নয়,
রক্তাক্ত, লুণ্ঠিত এবং প্রাণহীন-
দেয়ালের পায়ের কাছে চত্বরে তারা শুয়ে আছে।
মুক্তিযুদ্ধের সব রকম অনিবার্য অনুষঙ্গ বঙ্গবন্ধু শেখ মুক্তিযুদ্ধের রহমান। স্বাধীনতার মহান নেতা হিসেবে বারবার ঘুরেফিরে আসে তাঁর নাম। সঙ্গত কারণে তাই কবিতার মধ্যে ইতিহাস, চেতনা মূর্ত হয়ে ধরা দেয়। নির্মলেন্দু গুণের ‘স্বাধীনতা এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতায় তুলে ধরেছেন সেই ইতিহাস। সেই আখ্যান।
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা-
কে রোধে তাহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালো তার অমর কবিতাখানি :
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ’
সেই থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের।
দেশের প্রবীণ-নবীন কবিরা তাদের কবিতায় তুলে এনেছেন মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতা। একাত্তর। কবিতার ভেতর দিয়ে তারা তাদের দায়বদ্ধতার পর্বটি সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে চান দেশের সমৃদ্ধ অতীতকে। ঐতিহ্যকে। কবিতার জমিনে তাই ফুটে ওঠে বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
চলচ্চিত্র
চলচিত্রের পর্দায়ও নানাভাবে জীবন্ত হয়ে উঠেছে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। সেলুলয়েডের ফিতায় ধরা পড়েছে সময়। খ্যাতিমান পরিচালকরা তাঁদের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের বিস্তৃত অধ্যায়কে চিত্রায়িত করেছেন অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে। জীবনের আখ্যান চলচ্চিত্রকাররা বিনি সুতোর মালার মতো ফ্রেমবদ্ধ করেছেন। চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধকে ইঙ্গিতসহ আকারে ফুটিয়ে তুলেছেন যেসব চলচ্চিত্রকার তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, চাষী নজরুল ইসলাম, আলমগীর কবির, আবদুল্লাহ আল মামুন, আমজাদ হোসেন, সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকি, তানভীর মোকাম্মেল, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, শেখ নিয়ামত হোসেন, তারেক মাসুদসহ আরো অনেকে। মূলত এই প্রতিভাবান চলচ্চিত্রকারদের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস দেশের গণ্ডি ছেড়ে বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়েছে। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি সঙ্গীতের মাধ্যমেও মুক্তিযুদ্ধ সাধারণ মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে গেছে। এ ক্ষেত্রে গীতিকার ও সুরকারদের ভূমিকা অসামান্য।
চিত্রকলা
রংতুলির মাধ্যমে খুব দ্রত মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়। তুলির আঁচড়ে, রঙের জাদুময়তায় একজন শিল্পী অনেক কথাকে ব্যক্ত করে দিতে পারেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চিত্রকলায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। লাল-সবুজের সংগ্রামকে দশদিগন্তে ছড়িয়ে দিতে চিত্রকলার তুলনা চিত্রকলাই। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান, মোহাম্মদ কিবরিয়া, আমিনুল ইসলাম, মোহাম্মদ সফিউদ্দিন, মুর্তজা বশীর, কাইয়ুম চৌধুরী, কালাম মাহমুদ, প্রাণেশ মণ্ডল, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, হামিদুর রহমান, নভেরা, রফিকুন নবী, হাশেম খান, মনিরুল ইসলাম, এমদাদ হোসেন, শাহাবুদ্দীন, কালিদাস কর্মকার, সৈয়দ লুৎফুল হক, বীরেন সোম, শিশির চক্রবর্তী, কাজী হাসান হাবিব, আফজাল হোসেন, মাসুক হেলাল, ধ্রুব এষ, উত্তম সেন প্রমুখ শিল্পীরা তাঁদের তুলিতে নানা বর্ণে, নানা মাত্রায় মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে গেছেন অন্য এক উচ্চতায়।
স্বাধীনতার ৪৪ বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে। এত দীর্ঘ সময়েও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব একটুও কমেনি। বরং আশ্চর্যের ব্যাপার, দিন যত যাচ্ছে তার প্রভাব যেন আরো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।