স্মৃতিকথা
দুই চিন্তক বদরুদ্দীন উমর ও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
দেশ থেকে দূরে থাকলে হয়তো এমনই হয় : যাদের সঙ্গে একসময় কাজ করেছি, তাদের কথা মনে হয়। বারবারই। আর বন্ধুদের সঙ্গে ওই কথাগুলো শেয়ার করার ইচ্ছাও হয়। তো, অল্প বয়সেই বাংলাদেশের যে দুজন বাম চিন্তক ও অ্যাক্টিভিস্টের একেবারে কাছাকাছি থেকে কাজ করেছি, তাঁদের একজন হলেন বদরুদ্দীন উমর, অন্যজন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
বদরুদ্দীন উমরের হাতে-গড়া (অন্যদের ভূমিকাও ছিল অবশ্য, বিশেষ করে আমার শিক্ষক ও কমরেড আহমদ ছফার) বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বেশ কয়েক বছর কাজ করার কারণেই উমর ভাইয়ের একেবারে কাছাকাছি আসার সুযোগ ও সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আর ওই পদে আমার একজন যোগ্যতর পূর্বসূরি ছিলেন আমার দীর্ঘ সময়ের কমরেড, বন্ধু ও শ্রদ্ধেয় ভাই আনু মুহাম্মদ। সে সময়ে আমাদের সংগঠনের হয়তো সবচেয়ে সক্রিয় মানুষটা ছিলেন ওই সংগঠনেরই সহসভাপতি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। না বলে পারছি না যে, সেই সময়টা ছিল বাংলাদেশ লেখক শিবিরের ইতিহাসে এক উত্তাল, দারুণ তাৎপর্যময় অধ্যায়।
অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে আমার সরাসরি শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর হাতে-গড়া বাম সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘সময়’-এর একজন সম্পাদক হিসেবে কাজ করার কারণে তাঁরও কাছাকাছি আসার সুযোগ আমার হয়েছিল। বেশ কয়েক বছর একই অফিসে তাঁর পাশের টেবিলে ছিল আমারও টেবিল, যেখানে, বলতে দ্বিধা নেই, আমি একটু ভয়েসয়েই খানিকটা গুটিসুটি মেরে বসে থাকতাম। আমার শিক্ষকের অনেক কাছাকাছি এলেও তাঁর সঙ্গে আমার একধরনের শ্রদ্ধাভরা দূরত্ব ছিল।
বেশ কিছু কথা মনে পড়ছে আজ। অক্সফোর্ডে পড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেওয়া, বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিকের পক্ষে সার্বক্ষণিক রাজনীতি করা এই বদরুদ্দীন উমর বাসে চলাফেরা করতেন। একদিন আমি আমাদের পুরানা পল্টনের লেখক শিবিরের অফিস থেকে বাসে করে তাঁকে নিয়ে যাচ্ছি তাঁর মিরপুরের বাসায়। তখন কথায় কথায় জানতে পারলাম, তিনি বাংলাদেশের সমস্ত ‘শীর্ষস্থানীয়’ এবং ‘লোভনীয়’ পুরস্কার—আদমজী পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ (এবং পরে এমনকি একুশে পদক) অন্যান্য পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন একের পর এক। তখন বাক্যের গনগনে চুল্লিতে তাঁর শব্দসব ফুটছিল টগবগ করে। তাঁর সততা আর সাহসের সামনে আমার মাথা নত হয়ে এসেছিল। মনে হলো, এই পাশে বসা মানুষটার পাশে না বসে তার পায়ের কাছে বসে থাকি। হাত দিয়ে তাঁর পা ছুঁয়ে দিই! তাঁর ওই সততা আর সাহসের কারণেই বদরুদ্দীন উমর সত্য কথাটা যেভাবে নির্দ্বিধায়, নির্ভয়ে এবং পরিষ্কারভাবে উচ্চারণ করতে পারেন, তা কেউই তাঁর মতো করে পারেন না বলে আমি মনে করি। খালি খালি আমার প্রিয় মানুষ আহমদ ছফা এই কথা সাহস নিয়ে বলেন নাই, ‘আমি বদরুদ্দীন উমরের যুগে বাস করি বলে গর্বিত।’
আর আমার শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী রিকশায় চড়তে পছন্দ করতেন। এখনো করেন। তাঁর গাড়ি ছিল না, কিন্তু কেউ তাঁকে গাড়িতে 'লিফ্ট' দিতে চাইলে তিনি দারুণ অস্বস্তিতে পড়তেন। আমি নিজ চোখে দেখেছি তা। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক তখন গাড়ি হাঁকাতেন, তাঁদের নিয়ে তিনি কথা বলতে ছাড়তেন না। সেদিন ছিল এক হালকা রোদের শীত-সকাল। জীবনে প্রথমবার স্যারের সঙ্গে একই রিকশায় চড়লাম। আমি কিছুটা কাচুমাচু হয়েই তাঁর পাশে বসলাম। যাচ্ছি ওই লেখক শিবিরের অফিসেই। একসময় স্যার বললেন, ‘সংবাদে বের হওয়া তোমার লেখাটা পড়লাম।’ বেশ উৎসাহ দিলেন, কিন্তু এও বললেন, “তুমি লিখেছ ‘আসলো’, শব্দটা হবে ‘এলো’।” আমাদের শিরোধার্য স্যার! কী আর করা? আরো কাচুমাচু হয়ে বসলাম আমার গুরুর পাশে। তারপর হঠাৎ তিনি রিকশাওয়ালাকে থামতে বললেন। দেখি, তিনি আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন এক মিষ্টির দোকানে। বললেন, ‘এসো, মিষ্টি খাবে।’ আমি খানিকটা হতভম্ব। স্যার জিলিপি খেলেন, আমি খেলাম রসগোল্লা।
আমার বাবার কথা মনে পড়ল, যিনি আমাকে আমার কৈশোরে মফস্বল শহরের ক্লান্ত বিকেলে স্কুলের পরীক্ষা শেষে নিয়ে যেতেন মিষ্টির দোকানে আর বলতেন, ‘খা বাবা, খা, একটু মিষ্টি খা। পরীক্ষা ভালো দিয়েছিস তো?’ কিন্তু স্যার যখন আমাকে মিষ্টির দোকানে নিয়ে গিয়েছিলেন, তখন আমি কিশোর না; তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নতুন লেকচারার। তার পরও সেদিন স্যারের সামনে নিজেকে একজন কিশোর মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, আমি হাই স্কুলে পড়ি। মনে পড়ে, মিষ্টি খেতে খেতে সেদিন সকালে স্যার বললেন, ‘লিখবে। আরো লিখবে, হে। অনেক লিখবে। তবে অঙ্গীকার ছাড়া লেখা দাঁড়াবে না। অঙ্গীকারটা জরুরি জিনিস।’ আমাদের অঙ্গীকারবদ্ধ শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সেদিন সকালে আমাকে মোদ্দাকথাটা বলে দিয়েছিলেন জ্যঁ-পল সার্ত্রের উদ্ধৃতি না দিয়েই। স্যারের সঙ্গে হাজার হাজার কথোপকথনের স্মৃতি আছে, তবে একসময় তাঁর সঙ্গে কথা বলে এটা টের পেয়েছিলাম সহজেই যে, বাংলাদেশে ইংরেজি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ অধ্যাপক হলেও বাংলা সাহিত্যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো অগাধ পড়াশোনা করা মানুষ খুব কমই আছেন। যদিও এও সত্য যে, তাঁর লেখায় তিনি কতটা জানেন, তা তিনি ফলাতেন না মোটেই।
বদরুদ্দীন উমর আর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কাজকে প্রশ্নহীনভাবে গ্রহণ আর বর্জনের কথা বলি না আমি মোটেই; কিন্তু আমি মনে করি যে, তাঁদের কাজের যথাযথ মূল্যায়ন আমাদের দেশে এখনো হয় নাই। একটা সত্যি কথা না বলে পারছি না, আমিই বোধ করি প্রথম তাঁদের কাজের সমগ্রকে বিবেচনায় রেখে তাঁদের ওপর ইংরেজিতে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলাম। কিন্তু এও বলি যে, সেটা যথেষ্ট না মোটেই। আমার জীবনের একটা বড় সাধ, আমি যদি নিদেনপক্ষে তাঁদের কাজের ওপর একটা মূল্যায়নধর্মী বই সম্পাদনা করতে পারতাম!
ছবিতে বদরুদ্দীন উমর আর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী পাশাপাশি বসে আছেন! আরো আছেন আমাদের শওকত আলী ভাই। কী এক দারুণ মুহূর্ত!