মুক্তির কথা ভেবেই ছবি আঁকি : শাহাবুদ্দিন
বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর নাড়ির টান। তবে সস্ত্রীক দুই মেয়েকে নিয়ে বর্তমানে প্যারিসে থাকার কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ আজ অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে। তবু দেশের কথা মনে পড়লে এখনো দুই চোখ পানিতে ভরে ওঠে তাঁর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই সৈনিকের গলা ধরে আসে স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে। কিছুদিন আগে কলকাতার গ্যাঞ্জেস আর্ট গ্যালারিতে তাঁর প্রদর্শনীর ফাঁকে সংবাদমাধ্যমের কাছে নিজের দেশ বাংলাদেশ নিয়ে নানা কথার জাল বুনলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন।
কলকাতার মাটিতে এই নিয়ে তাঁর ষষ্ঠ চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হলো। কথায় কথায় বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বললেন, ‘সত্যি কথা বলতে গেলে বলতে হয়, আমি যে বাংলাদেশকে চিনতাম, সেই দেশ যেন এখন অনেকটাই বদলে গেছে। এখন আর আগের সঙ্গে মেলাতে পারি না। খুব কষ্ট হয়। তবে মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলো আজও আমার কাছে জীবন্ত। প্যারিসে বসেও আমি সেই সব স্মৃতিকে অনুভব করতে পারি। এখনো দেশের মাটিতে পা রাখলে মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোর স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে।’
বাংলাদেশে আজ একের পর এক লেখক-ব্লগার খুন হচ্ছে। যা কোনোভাবেই সমর্থন করেন না শাহাবুদ্দিন। তবে তিনি আশাবাদী, ‘একদিন নিশ্চয়ই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বর্তমান শেখ হাসিনা সরকার দেশকে সঠিক দিশা দেখাবে।’ আন্তর্জাতিক মানের এই চিত্রশিল্পী মনে করেন, আস্তে আস্তে বাংলাদেশ ঠিক পথেই এগোচ্ছে। দুই বাংলা থেকে আজ কয়েকশো যোজন দূরে প্যারিসে অবস্থান করেন তিনি। তবু যখন বাংলার মাটিতে আসেন, তখন দুই বাংলার মধ্যে কোনো তফাত আছে বলে মনে করেন না শাহাবুদ্দিন। বলেন, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত যেভাবে আমাদের পাশে ছিল, তা কখনই ভোলার নয়।’
আজ বিদেশে থাকলেও দুই বাংলার প্রতি তাঁর টান অকৃত্রিম। বাঙালি মাত্রই তিনি মনে করেন ‘আমার দেশের মানুষ’। নিজের মুখেই জানিয়ে দিলেন, ‘আমার তো মাঝে মাঝেই মনে হয়, কারা কবে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলোআর সেই ভুল সিদ্ধান্তের বোঝা আমরা এখনো বয়ে বেড়াব কেন! আমরা কি পারি না, দেশকালের এই সীমারেখা, কাঁটাতার সব তুলে দিতে? বার্লিনের পাঁচিল কি আমাদের দিশা দেখাতে পারে না?’ বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব চিন্তা আজকাল ভীষণভাবে তাঁর মাথায় কাজ করে বলেও জানালেন।
বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত প্রসঙ্গেও নিজের মতো করে মত ব্যক্ত করলেন এই কালজয়ী চিত্রশিল্পী। ভারতে অসহিষ্ণুতা নিয়ে যা চলছে তার নিরিখে ভারতকে অসহিষ্ণু বলতে রাজি নন শাহাবুদ্দিন। তিনি বলেন, ‘ভারত অসহিষ্ণু হলে এখানে বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণের মানুষ তাঁদের ভাবনা-চিন্তা ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানোর সুযোগ পেতেন না।’ তবে দেশের পরিবেশ শান্ত রাখার জন্য শিল্পী-সাহিত্যিকদের বড় ভূমিকা নেওয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি।
প্যারিসে ভয়াবহ বিস্ফোরণের সময়ে সেখানেই ছিলেন শিল্পী। আতঙ্কের সেই অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে বলেন, ‘আজ গোটা পৃথিবীতেই এক ভয়াবহ অশান্তির আবহ তৈরি হয়েছে, যা শান্তি থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে মানুষকে। তবে আমি স্বপ্ন দেখি, মানুষ শান্ত হবে, মনুষ্যত্বের জয় হবে। আমার কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আমার প্রেরণা। আর সেই প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি আজও ছবি আঁকি। মুক্তির কথা ভেবেই ছবি আঁকি। আসলে মুক্তি না পেলে যে শান্তি আসতে পারবে না।’