প্রবন্ধ
বুদ্ধিজীবীর দায়
বর্তমান বাংলাদেশে একটি ক্রান্তিকাল চলছে। সভা, সেমিনার ও টেলিভিশনের আলোচনাতে অনেকে আলোচনা করছেন। তাঁদের আমরা বুদ্ধিজীবী বলে চিনি। কিন্তু কতটা ভূমিকা পালন করতে পারছেন তাঁরা দেশের জন্য। বাংলাদেশ বা অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশের কথাও যদি বলা হয়, বুদ্ধিজীবীরা খুব যে একটা ভালো ভূমিকা রেখেছেন তা কিন্তু বলা যাবে না। হাতে গোনা দু-একজন ব্যতীত এখানকার বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ প্রবন্ধে তাই আলোচনা করব সমাজে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা কী হবে? কারাই বা বুদ্ধিজীবী?
বুদ্ধিজীবী কী জিনিস?
বুদ্ধিজীবী আসলে কারা? বুদ্ধিজীবী কি সমাজে বিশিষ্ট কোনো সমাজ? এই সমাজ বা শ্রেণি কি অনেক বড় নাকি খুবই স্বল্প সংখ্যক নির্বাচিত মানুষ নিয়ে এ শ্রেণী গঠিত। বুদ্ধিজীবী আসলে কী জিনিস, কারা বুদ্ধিজীবী- এ নিয়ে বিংশ শতাব্দীর দুজন বড় পণ্ডিত, চিন্তাবিদ ভাবিত হয়েছিলেন। প্রথমেই বলা যাক ইতালীয় বিশিষ্ট মার্কসবাদী চিন্তাবিদ, তাত্ত্বিক, সাংবাদিক ও ইতালীয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতা আন্তোনিও গ্রামশির কথা। গ্রামশি ছিলেন এমন একজন র্যাডিকাল মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও কর্মী যাঁর যশ শুধু ইতালিতেই নয়, ইতালির বাইরে, সারা ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ায় তাঁর চিন্তা মার্কসবাদী এবং সমাজ চিন্তকদের প্রভাবিত করেছে। মার্কসবাদী ও প্রগতিশীল চিন্তা ও কর্মকাণ্ডের জন্য ফ্যাসিবাদী মুসোলিনির কারাগারে তাঁকে অন্তরীণ থাকতে হয়েছিল ১৯২৬ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১১টি বছর। আন্তনিও গ্রামশিকে দীর্ঘ ১১ বছর বন্ধী করে রাখতে পারলেও মুসোলিনি গ্রামশির চিন্তা ও লেখনিকে বন্ধী করে রাখতে পারেননি। ১১ বছরে কয়েকটি খণ্ডে গ্রামশি লিখেছিলেন দ্য প্রিজন নোটবুক। এই বইয়ে মার্কসবাদী রাজনীতি, সমাজ, রাষ্ট্র, সিভিল সোসাইটি, শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে গ্রামশির চিন্তা ও মূল্যায়ন পাওয়া যায়। এই গ্রন্থে একটি অধ্যায়ে গ্রামশি বুদ্ধিজীবী নিয়েও আলোচনা করেছিলেন। গ্রামশি তাঁর প্রিজন নোটবুকে লিখেছেন, ‘সব মানুষই বুদ্ধিজীবী, কিন্তু সব মানুষই সমাজে বুদ্ধিজীবীর কাজ করে না।’ তাহলে গ্রামশির মতে সব মানুষই বুদ্ধিজীবী। কিন্তু সমাজে যাঁরা বুদ্ধিজীবীর কাজ করেন তাঁদের আবার গ্রামশি দুই ভাগে ভাগ করেছেন। এদের একদল হলো ট্রাডিশনাল ইন্টেলেকচুয়াল বা ঐতিহ্যবাহী বুদ্ধিজীবী। এই দলের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষক, চার্চের যাজক, মন্দিরের সাধু কিংবা মসজিদের মাওলানা। এসব মানুষ যুগ যুগ ধরে একই কাজ করেন বলে এদের বলা হয় ঐতিহ্যবাহী বুদ্ধিজীবী। আরেক দল বুদ্ধিজীবী রয়েছেন যাঁদের গ্রামশি আখ্যায়িত করেছেন অর্গানিক বুদ্ধিজীবী হিসেবে। গ্রামশির মতে এই দলের বুদ্ধিজীবীরা সারাসরি শ্রেণি, উদ্যোগ এবং এককথায় বলতে গেলে উৎপাদনের সাথে জড়িত। এসব বুদ্ধিজীবীর মুনাফা বৃদ্ধি, আরো ক্ষমতা অর্জন, আরো নিয়ন্ত্রণ অর্জনের জন্য ব্যবহার করা হয়। গ্রামশি বলেন, ‘পুঁজিবাদী উদ্যোক্তরা তাদের পাশাপাশি শিল্প টেকনিশিয়ান, রাজনৈতিক অর্থনীতির ওপর বিশেষজ্ঞ, পুঁজিবাদসৃষ্ট নতুন সংস্কৃতি এবং আইন ব্যবস্থাকে লালন-পালন করতে পারে এ রকম ব্যক্তি তৈরি করে।’ যেমন আজকালকার দিনে বিজ্ঞাপন অথবা জনসংযোগ বিশেষজ্ঞ যাঁরা কোনো ডিটারজেন্ট পাউডার কিংবা এয়ারলাইনস কোম্পানির পসার বৃদ্ধিতে কাজ করেন গ্রামশির চোখে তাঁরা অর্গানিক বুদ্ধিজীবী। একইভাবে গণতান্ত্রিক সমাজে যদি কেউ জনমত লাভ করার জন্য কাজ করে গ্রামশির চোখে সে ও অর্গানিক বুদ্ধিজীবী। গ্রামশির মতে, অর্গানিক বুদ্ধিজীবীরা সবসময় সক্রিয় থাকেন। তারা সবসময় প্রাণান্ত চেষ্টা করেন মানুষের মন পরিবর্তন ও বাজার প্রসার করতে। তাঁরা শিক্ষক ও যাজকদের মতো নন। শিক্ষক ও যাজকরা সবসময় এক জায়গায়ই পড়ে থাকেন। বছরের পর বছর তাঁরা একই কাজ করে যান। তাঁদের কাজে কোনো পরিবর্তন আসে না। আর অর্গানিক বুদ্ধিজীবীরা সবসময় পরিবর্তিত অভিজ্ঞতা ও কাজের মধ্য দিয়ে যান।
বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে বিংশ শতাব্দীর আরেকজন পণ্ডিত জুলিয়েন বেন্দার মত কিন্তু গ্রামশির মত থেকে ভিন্ন। ১৯৬৯ সালে লেখা দ্য ট্রিজন অব দ্য ইন্টেলেকচুয়ালস গ্রন্থে বুদ্ধিজীবীরা কেমন হবেন সে সম্পর্কে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন তিনি। বেন্দার মতে বুদ্ধিজীবীরা হলেন ইশ^রের বিশেষ দান এবং নৈতিকতাসম্পন্ন দার্শনিক রাজা এবং যাঁরা মানবজাতির নৈতিকতা তৈরির জন্য কাজ করেন। বেন্দা সেসব বুদ্ধিজীবীর তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন যাঁরা বুদ্ধিজীবীর নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে আপস করেন। তিনি যাঁদেরকে বুদ্ধিজীবী বলে মনে করেন এ রকম কিছু নাম তিনি উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার তিনি নাম নিয়েছেন সক্রেটিস ও যিশুর। নিকট সম্প্রতি যেসব বুদ্ধিজীবীর নাম তাঁর লেখায় এসেছে তাঁদের মধ্যে রয়েছেন স্পিনোজা, ভলতেয়ার ও আর্নেস্ট রেনান। তাঁর মতে, সত্যিকার বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা হবে অনেকটা যাজকদের মতো, কারণ বুদ্ধিজীবী শ্রেণি যা ধারণ করেন তা হলো চিরন্তন সত্য এবং চিরন্তন ন্যায়বিচার- যা এই পার্থিব পৃথিবীর নয়। কিন্তু বেন্দা বুদ্ধিজীবীর বৈশিষ্ট্য বা আদর্শ হিসেবে যে যাজক বা ধর্মীয় গুরুর কথা বলছেন তা একদম আক্ষরিকভাবে নিলে হবে না। তিনি বুদ্ধিজীবীদের ধর্মীয় যাজকের সাথে তুলনা করেছেন মূলত সাধারণ মানুষদের সাথে পার্থক্য টানতে। সাধারণ মানুষরা যেমন সবসময় ব্যস্ত থাকেন গৃহস্থালি আয় উন্নতি ও ব্যক্তিগত অর্জন নিয়ে, বেন্দার কামনা, বুদ্ধিজীবীরা সে রকম হবেন না।
বেন্দা বলেন, সত্যিকার বুদ্ধিজীবী হবেন তারা, যাদের কাজকর্ম ও সাধনা বস্তুগত উন্নয়নের জন্য চালিত হবে না। যারা জাগতিক লাভালাভ থেকে শিল্প বা বিজ্ঞান বা মেটাফিজিক্স চর্চায় আনন্দ খুঁজবেন। বেন্দার ভাষায় সত্যিকার বুদ্ধিজীবীরা বলবেন, ‘এই পৃথিবী আমার রাজ্য নয়।’ এই কথাটি দিয়ে বেন্দা আসলে বোঝাতে চেয়েছেন, এই যে পৃথিবী, যে পৃথিবীতে মানুষ শুধু তাৎক্ষনিক, বস্তুগত লাভ, নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ, ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত থাকে বুদ্ধিজীবীদের পৃথিবী সে রকম ক্ষুদ্র স্বার্থে চালিত হবে না। বুদ্ধিজীবীদের কাজ হবে নিঃস্বার্থ এবং আপসহীন জ্ঞানচর্চা।
বেন্দা যে আপসহীন, নিঃস্বার্থ এবং নিরবচ্ছিন্ন জ্ঞানচর্চার কথা বলছেন তা কি অপার্থিব ও জনবিচ্ছিন্ন? বেন্দা তাঁর লেখায় যেসব উদাহরণ এবং বুদ্ধিজীবীর কর্মকাণ্ডের কথা বলছেন তা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে তিনি সম্পূর্ণ অপার্থিব এবং জনবিচ্ছিন্ন চিন্তাবিদদের সমর্থন করেন। গূঢ় দুর্বোধ্য এবং একেবারে ধর্মীয় জ্ঞানচর্চাকেও তিনি সমর্থন করেননি। বেন্দার মতে, আসল বুদ্ধিজীবীরা শুধু নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন না। তারা দুর্নীতিকে প্রত্যাখ্যান করেন, দুর্বলকে রক্ষা করেন এবং ত্রুটিপূর্ণ ও শোষণমূলক কর্তৃত্বকে অমান্য করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীর উদাহরণ দিয়েছেন যাঁরা বিভিন্ন সময়ে অন্যায়, শোষণ, নির্যাতন এবং অপঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। যেমন বেন্দা উদাহরণ দিয়েছেন ফেনেলন ও মেসিলনের যাঁরা প্রতাপশালী রাজা লুই চর্তুদশের যুদ্ধকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বলেছেন ভলতেয়ারের কথা। ভলতেয়ার পালাতিনে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছিল তাকে নিন্দা জানিয়েছিলেন। বেন্দা উদাহরণ দিয়েছেন আর্নেস্ট রেনানের। আর্নেস্ট রেনান প্রবল পরাক্রমশালী নাপোলিয়নের বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং নিন্দা জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি বলেছেন নিটশের কথা, নিটশে কিভাবে ফ্রান্সের প্রতি জার্মানির বর্বরার নিন্দা জানিয়েছিলেন। বেন্দা বলছেন এখন বেশির ভাগ ‘বুদ্ধিজীবী’ নামধারীরা নিজেদের নৈতিকতাকে বিসর্জন দিচ্ছেন। নিজদেরকে যুক্ত করছেন সাম্প্রদায়িকতা, উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং শ্রেণি স্বার্থের সাথে। ১৯২৭ সালের দিকে বেন্দা যখন বুদ্ধিজীবী নিয়ে লিখছিলেন তখনই তিনি অনুমান করছিলেন ‘বুদ্ধিজীবীরা’ কত ভালো চাকর হতে পারে সরকারের। বুদ্ধিজীবীরা কিভাবে সরকারি নীতি, সিদ্ধান্ত ও এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া সরকারবিরোধীদের ঘায়েল করবার জন্যও বুদ্ধিজীবীরা সরকারের কাছে জরুরি।
বেন্দার মতে সত্যিকার বুদ্ধিজীবীরা যেকোনো পরিস্থিতিতে এমনকি পুড়ে মরবার, একঘরে হওয়ার এবং ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকিও নিতে হবে। তাঁরা হবেন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব এবং বস্তুগত বা গৃহাস্থালি চিন্তা বা দুঃশ্চিন্তা থেকে নিজেদের দূরে রাখবেন। এরফলে বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা বেশি হয় না এবং নিয়মিত রুটিন করেও বুদ্ধিজীবী তৈরি হয় না। বেন্দার মতে বুদ্ধিজীবীদের ব্যক্তিত্ব হবে খুবই শক্তিশালী। তাঁরা সব সময় ভারসম্যের বিরুদ্ধে। এ কারণে বেন্দা প্রদত্ত সংজ্ঞায় বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা খুবই কম এবং এর সংখ্যা এত কম যে হাতে গোনা যায়। তবে নারীদের তিনি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেননি। এক্ষেত্রে বেন্দা পুরুষতাতিন্ত্রকতারই পরিচয় দিয়েছেন বলতে হবে। তাঁর মতে নারীদের উচ্চ কণ্ঠ এবং স্থূল অভিসম্পাত মানবতার ওপর নিক্ষিপ্ত হয়। আমরা এ রকম অনেক নারী পণ্ডিত/বুদ্ধিজীবীর কথা বলতে পারি যাঁরা এমন তাঁর প্রদত্ত বুদ্ধিজীবীর বৈশিষ্ট্যের সিংহভাগই পূরণ করেন। যেমন হানা আরেন্টের কথা বলা যায়। বলা যায় টমি মরিসনের কথা।
তবে কিছু সীমাবদ্ধতা শর্তেও বেন্দা প্রদত্ত বুদ্ধিজীবীর বৈশিষ্ট্য বেশ আকর্ষণীয় এবং গ্রহণযোগ্য। তিনি যেসব উদাহরণ টেনেছেন সেগুলোরও অনেকই গ্রহণযোগ্য। এডওয়ার্ড সাঈদের মতে, দ্রেফুসের হত্যার ঘটনা এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বেন্দার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। দ্রেফুস ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এ দুটি ঘটনাই তখনকার বুদ্ধিজীবীদের জন্য ছিল এক কঠিন পরীক্ষা, তখন জার্মানিতে সেমেটিক জাতিদের বিরুদ্ধে অপরাধ চলছিল, এন্টি সেমেটিক যে মিলিটারি আগ্রাসন, নির্যাতন ও গণহত্যা চলছিল তার বিরুদ্ধে সাহসের সাথে বুক চিতিয়ে কথা বলার সাহস কে দেখাবে। ইহুদি মিলিটারি অফিসার আলফ্রেড দ্রেফুস তাকে যে হত্যা করা হয়েছিল কয়জন বুদ্ধিজীবী এর বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস দেখাতে পেরেছিল! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বেন্দা আবার তাঁর বইটি পুনরায় প্রকাশ করেন। এ সময় তিনি যেসব বুদ্ধিজীবীরা নাৎসিবাদীদের সহযোগিতা করেছিল এবং কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়াই কমিউনিস্টদের ব্যাপারে উৎসাহ দেখিয়েছিলেন তাদের তিনি নতুন করে আক্রমণ করেন। যাই হোক বেন্দার দ্য ট্রিজন অব দ্য ইন্টেলেকচুয়াল গ্রন্থে বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে অনেক রক্ষণশীল ধারণা পোষণ করলেও তাঁর মতে বুদ্ধিজীবী হবে এমন ব্যক্তি যিনি হবেন রাগী, স্বতস্ফূর্ত, প্রচণ্ড সাহসী এবং রাগী এবং যাঁর সমালোচনার বাইরে থাকবেনা পৃথিবীর কোনো বড় শক্তি।
তবে বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে গ্রামশির সামাজিক বিশ্লেষণ, ব্যক্তি হিসেবে একজন বুদ্ধিজীবী সমাজে কিছু নির্দিষ্ট কর্মকাণ্ড করে থাকেন, বেন্দা প্রদত্ত বুদ্ধিজীবীর বৈশিষ্ট্য থেকে বাস্তব। বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীতে যখন ব্রডকাস্টার, একাডেমিক, কম্পিউটার এনালিস্ট, খেলা ও গণমাধ্যম আইনজীবী, ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট, পলিসি এক্সপার্ট, সরকারের উপদেষ্টা এবং আধুনিক বিশাল গণমাধ্যম গ্রামশির বিশ্লেষণকে আরো প্রাসঙ্গিক ও বাস্তব প্রমাণ করে।
এখনকার দিনে যারা যে ক্ষেত্রেই কাজ করুক না কেন তা যদি জ্ঞান উৎপাদন এবং বণ্টনের সাথে যুক্ত হয় গ্রামশির চোখে তারা সবাই বুদ্ধিজীবী। ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো বলেছেন, তথাকথিত বৈশ্বিক বুদ্ধিজীবীর (তাঁর মনে ছিল হয় জাঁ পল সার্ত্রের কথা) স্থান নিয়েছেন নির্ধারিত বুদ্ধিজীবীরা, তাঁরা শৃঙ্খলার মধ্যে কাজ করেন এবং নিজেদের পারদর্শিতাও ব্যবহার করতে পারেন। এখানে ফুকো বিশেষভাবে মার্কিন পদার্থবিদ রবার্ট ওপেনহেইমারের কথা বলেছেন। ওপেনহেইমার তাঁর বিশেষ ক্ষেত্র ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানবিষয়ক প্রধান হয়েছিলেন।
এডওয়ার্ড সাঈদের মতে বুদ্ধিজীবী হলো এমন একজন ব্যক্তি সমাজে যার কিছু নির্দিষ্ট গণ ভূমিকা থাকে যা একজন সাধারণ প্রফেশনালের মতো না। তাঁর মতে বুদ্ধিজীবী এমন একজন ব্যক্তি হবেন যার ওপর একটি নির্দিষ্ট বার্তা, একটি দৃষ্টিভঙ্গি, একটি দর্শন এবং মতামত জনগণের কাছে তুলে ধরার দায়িত্ব থাকে। বুদ্ধিজীবী তার এই দায়িত্ব বা ভূমিকা পালন করেন একটা চিরন্তন নীতি থেকে, তা হলো সব মানুষই স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার পাবার অধিকার রাখে এবং ইচ্ছাকৃত অথবা অনিচ্ছাকৃত মানুষের এই অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে এবং সাহসিকতার সাথে লড়াই করতে হবে। এডওয়ার্ড সাঈদ তাঁর রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য ইন্টেলুকচুয়াল গ্রন্থে বলেন একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাঁর শ্রোতা-দর্শক বা পাঠকের সামনে কোনো বিষয় শুধু তুলে ধরার জন্যই তুলে ধরেন না, তিনিও একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে মানুষের স্বাধীনতা বা ন্যায়বিচারের জন্য কাজ করেন। মানুষের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারকে এগিয়ে নিতে চেষ্টা করেন। এডওয়ার্ড সাঈদের ব্যক্তিগত জীবন পর্যালোচনা করেও তাঁর কথা ও চিন্তার প্রতিফলন পাওয়া যাবে।
এডওয়ার্ড ওয়াদি সাঈদ জন্মগ্রহণ করেছিলেন জেরুজালেমে। তাঁর পরিবার ছিল প্রোটেস্ট্যান্ট খিস্ট্রান। কিন্তু এডওয়ার্ড সাঈদ কোনো ধর্মেরই অনুসারি ছিলেন না। তিনি পড়াশোনা করেন জেরুজালেম, কায়রো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ও হার্ভার্ডে। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন তিনি তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন। বিশ্বের দেড়শটিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বক্তৃতা দিয়েছেন। বির জেইট, শিকাগো, মিশিগান, জওহারলাল নেহেরু, জামিয়া মিলিয়া, টরেন্টো, গুয়েল্প, এডিনবার্গ, হেভারফোর্ড, ওয়ারইক, এক্সেটার, ন্যশনাল ইউনিভার্সিটি অব আয়ারল্যান্ড এবং কায়রো বিশ^বিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি লাভ করেন। এডওয়ার্ড সাঈদ বহু জনপ্রিয় গ্রন্থ লিখেছেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ওরিয়েন্টালিজম (১৯৭৮), দ্য কোয়েশ্চেন অব প্যলেস্টাইন (১৯৮০), কাভারিং ইসলাম (১৯৮১), দি ওয়াল্ডর্, দ্য টেক্সস্ট অ্যান্ড দ্য ক্রিটিক (১৯৮৩), আফটার দ্য লাস্ট স্কাই (১৯৮৬), ব্লেইমিং দ্য ভিক্টিম (১৯৮৭), কালচার অ্যান্ড ইম্পিরিয়ালিজম (১৯৯২), রিপ্রেজেন্টেশনস অব দ্য ইন্টেলেকুচুয়ালস (১৯৯৪) পলিটিক্স অব ডিসপজেসন্স (১৯৯৫), আউট অব প্লেস : এ মেমোয়র (১৯৯৯), দি অ্যান্ড অব পিস প্রসেস : অসলো অ্যান্ড আফটার (২০০০), রিফ্লেকশনস অন এক্সাইল এন্ড আদার এসেস (২০০০)।
এডওয়ার্ড সাঈদ নিজেকে শুধু নিরবচ্ছিন্ন জ্ঞানচর্চাতেই আবদ্ধ করেননি, তিনি সরাসরি যুক্ত ছিলেন মাঠের আন্দোলন, সংগ্রাম ও লড়াইয়ে। তিনি যে নীতি ও আদর্শে বিশ্বাস করতেন, সে নীতির জন্য তিনি লড়াই করেছিলেন। তাঁর বিভিন্ন পাণ্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থের কারণে তিনি বেশির ভাগ পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীর কাছে ছিলেন অচ্ছুত। বেশির ভাগ পশ্চিমা বুদ্ধিজীবী তাঁকে নোংরা ভাষায় আক্রমণ করেছেন। বিশেষ করে ১৯৭৮ সালে যখন ওরিয়েন্টালিজম : ওয়েস্টার্ণ কনসেপশনস অব দ্য ওরিয়েন্ট প্রকাশিত হয় তখন তাঁর ওপর ইউরোসেন্ট্রিক বা ইউরোপকেন্দ্রিক বেশির ভাগ পণ্ডিতের আক্রমণের পরিমাণ বেড়ে যায়। ওরিয়েন্টালিজম গ্রন্থ আজ বিশ্ব পাণ্ডিত্যের জগতে একটি ধ্রুপদি কাজ হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
ওরিয়েন্টালিজম গ্রন্থে সাঈদ দেখিয়েছেন যে ওরিয়েন্ট বা প্রাচ্যকে পাশ্চাত্য নিজেদের সুবিধার জন্য নিজেদের মতো করে নির্মাণ ও উপস্থাপন করেছে। এই নির্মাণ ছিল অনেকটা রোমান্টিক, এক্সোটিক। ওরিয়েন্টালিজম এক ধরণের জ্ঞান যে জ্ঞান ও চর্চায় প্রাচ্যকে ‘আদার’ বা ‘অন্য’ করা হয়। এই ‘অন্য’ একদিকে রোমান্টিক এবং ‘এক্সোটিক’ অন্য। অন্যদিকে এই ‘অন্য’ হচ্ছে ‘অসভ্য’ এবং ‘বর্বর’, ‘অন্য’ যাদের সভ্যতার আলোয় আনাই পাশ্চাত্যের কাজ বলে মনে করে পাশ্চাত্য। আর এভাবেই ওরিয়েন্টালিজমের মাধ্যমে জায়েজ করা হয় ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ, গণহত্যা, নির্যাতন ও লুটপাট। আর এ জন্যই এডওয়ার্ড সাঈদ ‘ইউরোপকেন্দ্রিক’ পণ্ডিতদের চোখের কাঁটা। আরো একটি কারণে এডওয়ার্ড সাঈদ সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী পণ্ডিতদের কাছে অপ্রিয়, সেটা হলো ফিলিস্তিনি নিপীড়িত মানুষ ও রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়ানোর কারণে। লেখা ও এক্টিভিজম দুটি দিয়েই তিনি দাঁড়িয়েছিলেন ফিলিস্তিনি মানুষের পাশে। এডওয়ার্ড সাঈদেরও মার্তৃভূমি ফিলিস্তিন এবং মাতৃভাষা আরবি। ১৯৪৮ সালে জোরপূর্বক ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠিত ও ইসরায়েলি উপনিবেশ স্থাপন শুরু হলে এডওয়ার্ড সাঈদ ও তাঁর পরিবারকে উদ্বাস্তু হতে হয়।
এডওয়ার্ড সাঈদ তাঁর যুক্তরাষ্ট্র জীবনকে সবসময় নির্বাসনের জীবন হিসেবে দেখেছেন। ফিলিস্তিন ও ফিলিস্তিনি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মূল্য দিতে হয়েছে তাঁকে আজীবন। তাঁর পরিবারও তাঁকে বলেছিল, ‘তুমিতো সাহিত্যের শিক্ষক। সেটাই কর। তোমার এসব রাজনীতিতে জড়িত হওয়ার দরকার কী। এটা তোমার জন্য ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসবে।’ কারণ এডওয়ার্ড সাঈদের পরিবার জানত এর ফলাফল কী হতে পারে। এডওয়ার্ড সাঈদ ফিলিস্তিনি মানুষের পাশে দাঁড়ানোয় আমেরিকায় তাঁর ব্যক্তিগত জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল সিআইএ। শুধু তিনিই নন তাঁর পুরো পরিবারকেই অনেক খারাপ আচরণ সহ্য করতে হয়েছিল এ জন্য। এমনো হয়েছে ফিলিস্তিনিদের অধিকারের জন্য লড়াই করবার জন্য তাঁকে অনেক সুশীল বা বুর্জোয়া সমাজের সভায় নিষিদ্ধ করা হয়েছিলেন এবং তাঁকে সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। তাই যেটা আমি বলতে চেয়েছি যে বুদ্ধিজীবী কেমন হবে বা তাঁর ভূমিকাই কেমন হবে তা এডওয়ার্ড সাঈদ তাঁর কর্মকাণ্ড দিয়ে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে গেছেন।
এডওয়ার্ড সাঈদের মতে প্রাইভেট ইন্টেলুকচুয়াল বলে কিছু নেই। তাঁর মতে যখন কোনো বুদ্ধিজীবী কোনো শব্দ লেখেন এবং ছাপাতে দেন তখনই তিনি পাবলিক জগতে প্রবেশ করেন। আবার একেবারে পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল বলেও কিছু নেই। কারণ যখন যেকোনো বিষয় নিয়ে একজন বুদ্ধিজীবী লেখেন বা মত প্রকাশ করেন তখন সেখানে শুধু পাবলিক চিন্তা বা মতাদর্শই নয় সেখানে সেই বুদ্ধিজীবীর ব্যক্তিগত মতামতও যুক্ত হয়।
সাঈদ বলছেন শেষপর্যন্ত বুদ্ধিজীবীরা হচ্ছেন এক ধরণের প্রতিনিধিত্ব ব্যক্তি যে কোনোকিছু, কোনো বিষয়ে কোনো অবস্থান, চিন্তা শত প্রতিবন্ধকতা সত্যেও তাঁর প্রকাশ করেন। সাঈদের মতে, বুদ্ধিজীবীরা হলেন এমন ব্যক্তি যাঁরা কোনো ঘটনা কথা বলা, লেখা, শিক্ষকতা বা টেলিভিশনে উপস্থিতির মাধ্যমে তুলে ধরেন। বুদ্ধিজীবীর কাজ এমন হবে যে কাজে ঝুঁকি, সাহসিকতা এবং ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন সম্ভাবনা থাকে।
বুদ্ধিজীবীর দায়
এডওয়ার্ড সাঈদ বুদ্ধিজীবীদের পাবলিক বা জনভূমিকার কথা বলেছেন। তাঁর ‘দ্য পাবলিক রোল অব রাইটার্স’ এ ইন্টেলেকচুয়ালস প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন যে সমাজে বুদ্ধিজীবী বা লেখক কীভাবে পাবলিক বা জন হয়ে ওঠে। প্রথমেই প্রশ্ন তুলেছেন বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা কি কখনো অরাজনৈতিক (আমরা যেমনটা বলে থাকি) হতে পারে? এবং সেটা যদিও হয় তা কতটুকু, তার মাত্রা কতটুকু? এ প্রশ্নের উত্তরও তিনি তাঁর প্রবন্ধে দিয়েছেন। সাঈদ বলেন, বুদ্ধিজীবী এবং লেখকদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো যে রাজনৈতিক এবং পাবলিক জগত এত প্রসারিত হয়েছে যে এখন বাস্তবিক অর্থে এর কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। একজন লেখক এবং বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা এখন বিবিধ ও প্রসারিত। এখন আবার অনেকে বলছেন যে গোলকায়নের এই যুগে প্রকৃত বুদ্ধিজীবী আর বিরাজ করে না। বুদ্ধিজীবীর কোনো অস্তিত্ব নেই। তাদের মতে ঠাণ্ডা যুদ্ধের সমাপ্তি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষ করে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় এখন ভুরিভুরি লেখক এবং বুদ্ধিজীবী তৈরি করে, বিশেষায়নের যুগ, নব্য বৈশ্বিক অর্থনীতির বাণিজ্যিকীকরণ এবং পণ্যায়নের যুগ রোমান্টিক ও নায়কোচিত সাহসী নিঃসঙ্গ একান্ত নিবেদিত প্রাণ বুদ্ধিজীবীদের ধ্বংস করে দিয়েছে। তবে সাঈদ এর সাথে একমত নন। তাঁর মতে এখনো লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রাণ রয়েছে। এখন তাঁদের চিন্তাচেতনা ও কর্মকাণ্ড জনজীবনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
সাঈদ লক্ষ করেছেন, এখনো অনেক মানুষ আছে যারা মনে করে যেকোনো দুঃসময়ে লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা এমন মানুষ যাদের আমাদের শুনতে হবে। দিকনির্দেশনা নিতে হবে যাদের কাছ থেকে। বুদ্ধিজীবীরা এমনও হতে পারেন যে তাঁরা কোনো একটি দলের নেতা হতে পারেন যে দল ক্ষমতা অর্জন বা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে।
আরব-ইসলামী বিশ্বে এখন বুদ্ধিজীবীর জন্য দুটি শব্দ ব্যবহার করা হয়। এর একটি হল মুতাকাফ এবং অন্যটি হলো মুফাকির। প্রথম শব্দটির উদ্ভব হয়েছে তাকাফা বা সংস্কৃতি থেকে। অর্থ্যাৎ বুদ্ধিজীবী হবেন এমন ব্যক্তি যিনি সংস্কৃতিবান। দ্বিতীয় শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ফিকর বা চিন্তা (মানে একজন চিন্তাশীল মানুষ) থেকে। তারমানে বুদ্ধিজীবী শুধু সংস্কৃতিবান মানুষই হবেন না তিনি একজন চিন্তাশীল মানুষও বটে। দুটি ক্ষেত্রেই এই শব্দ দুটির সম্মান খুব বেশি। আরব বিশ্বে রাজতন্ত্রের ফলে এখন যে নৈতিক অবক্ষয় চলছে, সেই অবক্ষয়ের যুগে অনেক মানুষই নেতৃত্বের জন্য ধর্মীয় বা অসাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবীদের দিকে তাকিয়ে। যদিও এসব দেশের সরকারগুলো চেষ্টা করছে বুদ্ধিজীবীদের তাদের মুখপাত্র বানাতে। কিন্তু এ অঞ্চলে সংগ্রাম ও লড়াইয়ের মতো আসল বুদ্ধিজীবীদের অনুসন্ধানও চলছে।
ফরাসি ভাষাভাষি অঞ্চলে খোদ ‘ইন্তেলেকতুয়েল’ শব্দটিই পাবলিক রিলম বা জনজগতের অবশিষ্টাংশ ধারণ করে। এই তো সদ্য ইন্তেকাল করা বুদ্ধিজীবী সার্ত্রে, ফুকো ও আরন এ বিষয় নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক করেছেন। তবে আমেরিকায় আবার কোনো রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, লবি বা সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবীদের জনজগতের অভাব নেই। এসব বুদ্ধিজীবী এসব প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠীর সাথে অর্গানিকভাবে যুক্ত।
উপরের আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে বেশির ভাগ পণ্ডিত বুদ্ধিজীবীর জন বা গণ ভূমিকার কথা বলছেন। কিন্তু বুদ্ধিজীবীর গণ ভূমিকা হয় কিভাবে? কি করবেন বুদ্ধিজীবী সমাজে। সমাজে বুদ্ধিজীবীর কাজ হবে যেকোনো অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলা। এ অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে হয় তাঁর স্বার্থ হানি হতে পারে। এমনকি জীবনও বিপন্ন হতে পারে। তারপরও বুদ্ধিজীবীদের সামাজিক ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক সাম্য, জন স্বাধীনতা এবং অধিকারের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। বিশ্বজুড়ে এমন অনেক উদাহরণ আছে যে মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার লড়াইয়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে অনেক বুদ্ধিজীবীকে দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হয়েছে এমনকি মৃত্যুকেও বরণ করেছেন। এমনই একজন মানুষ ছিলেন।
এলসালভাদোরের কবি ফেদরিকা গার্সিয়া লোরকা। চিলির স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লিখে, দাঁড়িয়ে লোরকাকে নিহত হতে হয়েছিল। শত হুমকি শর্তেও লোরকা ভয়ের কাছে, অন্যায়ের কাছে নিজেকে শপে দেননি, মাথা নোয়াননি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি মাঠে নেমে লড়াই করা এ রকমই আরেকজন বুদ্ধিজীবী হলেন এক সময়কার ফরাসি উপনিবেশ মার্তিনিকে জন্ম নেওয়া ফ্রাঞ্জ ফানন। ফানন ফরাসি দমন ও শোষণমূলক উপনিবেশবাদকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন। তিনি তাঁর লেখা দিয়ে ও এক্টিভিজম দিয়ে আজীবন ফরাসি উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। ফরাসি উপনিবেশকারদের বিরুদ্ধে আলজেরিয়ার স্বাধীনতার লড়াইয়ে ফানন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আলজেরিয়ার বিপ্লবকালীন ফ্রাঞ্জ ফানন আল মুজাদ্দেদ নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করে সরাসরি আলজেরিয়ার বিপ্লবে ভূমিকা পালন করেন। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করা এই তরুণ বুদ্ধিজীবী চারটি গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেন। এগুলো হলো রেচেড অব দ্য আর্থ, ব্লাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক, এ ডাইয়িং কলোনিয়েলিজম, টুওয়ার্ডস আফ্রিকান রেভ্যুলুশন। তাঁর রেচেড অব দি আর্থ এবং ব্লাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়েছে। প্রত্যেকটি গ্রন্থেই ফ্রাঞ্জ ফানন উপনিবেশকারদের নিপীড়ন ও শোষণের তীব্র সমালোচনা করেছেন।
মার্তিনিকের আরেকজন কবি ও বুদ্ধিজীবী এমে সেজায়ের নিজের লেখালেখি এবং কর্ম দিয়ে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে গিয়েছেন যে সমাজে একজন বুদ্ধিজীবী কিভাবে ভূমিকা পালন করতে পারেন। সেজেয়ার লড়াকু মানুষ, যে মানুষ তার প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করে যান উপনিবেশবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। লড়াই করে যান ইতিহাসের ‘সাময়িক প্রভুদের বিরুদ্ধে’- মানুষের ইতিহাস নির্মাণের তরে। সেজেয়ার তাঁর প্রতিটি রক্তস্পন্দন থেকে তৈয়ার করেন এমন সব ধ্বনি, ছন্দ, শব্দতরঙ্গ ও ভাষ্য, যা তৎক্ষণাৎই নেমে পড়ে লড়াইয়ের ময়দানে। ক্যারিবীয় অঞ্চলের এ মানুষটি লড়াই করে যান উপনিবেশবাদী জ্ঞানতত্ত্বের বিরদ্ধে। তার পদ্য, গদ্য ও বক্তৃতামালা তীরের ফলার মতো ফালা ফালা করে দেয় উপনিবেশবাদী জ্ঞানতত্ত্বকে। সেজেয়ারের মহৎ কীর্তি ডিসকোর্স অন কলোনিয়েলিজম একাই উদাম করে দেয় সাদা চামড়ার নিচের শয়তানিকে; ন্যাংটা করে ফেলে উপনিবেশকারদের খায়খাসলত।
উপনিবেশবাদবিরোধী এসব তাত্ত্বিকদের মধ্যে এমে সেজেয়ার যেটা করেছেন তা হলো ঔপনিবেশিক জ্ঞানতত্ত্বের খুঁটিটা ভেঙে দিয়েছেন তিনি। এমে সেজেয়ার বলেছেন কি ‘সভ্যতা’ ও ‘সংস্কৃতি’র জন্ম দিয়েছে উপনিবেশকাররা? কি আলোকায়ন ঘটিয়েছে তারা। সেজেয়ার একেবারে সোজাসাপ্টা কথায়, চোখে আঙুল দিয়ে একটার পর একটা প্রমাণ হাজির করে দেখিয়েছেন, উপনিবেশকাররা ছিল লুণ্ঠনকারী, পাইকারি মুদি ব্যবসায়ী, জাহাজের মালিক, স্বর্ণ অনুসন্ধানকারী, ব্যবসায়ী ও খাদক। সেজেয়ার দেখিয়েছেন, কীভাবে উপনিবেশকাররা উপনিবেশিতদের সভ্যতাহীন, বর্বর এবং অধঃপতিত করেছে। আর বাধ্য করেছে তাঁর নিজের চিন্তা-চেতনা বলি দিতে; কাজ করেছে শঠতা, সংঘাত, বর্ণবিদ্বেষ ও নৈতিকতা অবক্ষয়ে। সেজেয়ার দেখিয়েছেন, ভিয়েতনামে হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ আর মাদাগাস্কারে কি আজব সভ্যতা নির্মাণ করেছিল উপনিবেশকাররা।
এডওয়ার্ড সাঈদও যেটা বলেছেন, বুদ্ধিজীবীদের কাজই হলো ক্ষমতা ও শক্তির মুখোশ উন্মোচন করা। ক্ষমতাশালীদের চাতুর্যকে মানুষের সামনে তুলে ধরা। ক্ষমতার বিরুদ্ধে যেকোনো নীরবতার বিরুদ্ধে কথা বলা এবং তাকে পরাজিত করা। ফ্রাঞ্জ ফানন ও এইমে সেজায়েরও ঠিক সে কাজই করেছিলেন।
বুদ্ধিজীবীরা শুধুই তাঁদের লেখা বা কথা দিয়ে ভূমিকা পালন করেন? এডওয়ার্ড সাঈদের মতে একজন বুদ্ধিজীবী শুধু লেখা বা কথা দিয়েই ভূমিকা পালন করেন না। একজন বুদ্ধিজীবী গান বা তাঁর শিল্পকর্ম দিয়েও ভূমিকা পালন করতে পারেন। সেক্ষেত্রে একজন গানের শিল্পী, চিত্র শিল্পীও বা খোদাই শিল্পীও বুদ্ধিজীবী। বিশ্বে এ রকম অনেক উদাহরণ রয়েছে যে গানের শিল্পী বা গায়করা তাঁদের গান দিয়ে বিভিন্ন অন্যায় অবিচারের বিরোধিতা করেছেন, নিন্দা করেছেন এবং নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন। মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে মানুষকে সংগঠিত করেছেন। একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি পরিষ্কার হবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যখন চলছিল সেতার বাদক রবিশঙ্কর এবং তাঁর ভিনদেশি বন্ধুরা, যেমন জর্জ হ্যারিসন, মিলে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ আযোজন করেছিলেন। এই কনসার্ট আয়োজনের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানো। বাংলা অঞ্চলের মানুষের প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছিল, অবিচার করা হয়েছিল এবং হত্যা ও নির্যাতন করা হয়েছিল তা বিশ্ব দরবারের কাছে উন্মোচন করা। পুরো বিশ্বকে এই নির্যাতনকে নিন্দা জানাবার আহ্বান জানানো এবং এই নির্যাতন রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানানো। এই ভূমিকা পালন করতে পারেন চিত্রশিল্পীরাও। আমরা দেখেছি গণ অভ্যুত্থান এবং বাংলাদেশের চিত্রশিল্পীরা তাঁদের ছবি দিয়ে পাকিস্তানি নির্যাতকদের নিন্দা জানিয়েছিলেন এবং দেশের মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এমনই একটি ছবি এঁকেছিলেন কামরুল হাসান। ইয়াহিয়া খানের মুখম-লকে তিনি পশুর চেহারায় এঁকেছিলেন এবং একে এর সাথে ক্যাপশন জুড়ে দিয়েছিলেন, “এই জানোয়ারকে হত্যা করতে হবে”। তাহলে এখন কি ভূমিকা রাখছেন আমাদের এ সময়ের বুদ্ধিজীবীরা? কতটা বুদ্ধিজীবীয় বলা যায় তাঁদের ভূমিকাকে?
দোহাই
1. Edward W. Said, Representations of the Intellectuals (Vintage Books: New York, 1996)
2. Antonio Gramsci, Slection from the Prison Notebooks of Antonio Gramsci, trans & ed. by Quintin Hoare and Geoffrey Nowell Smith (International Publishers, New York, 1992, reprint)
3. Aime Ceasire, Discourse on Colonialism (Monthly Review Press, New York, n.d)
আজিজুল রাসেল : গবেষক ও শিক্ষক ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস, বাংলাদেশ।