শ্রদ্ধা

গ্রুবার থেকে স্নেইপ : আঁধারির অ্যালান রিকম্যান

Looks like you've blocked notifications!

চট করে তাঁর নাম বললে সবাই চিনে ফেলবেন, এমনটা আশা করা একটু বেশি বেশি। ক্রেডিট লাইনের নাম দেখে দেখে সিনেমা দেখার অভ্যেস সবার থাকে না, আশাও করা যায় না। অথচ তাঁকে কে না চেনেন? হ্যারি পটারের প্রফেসর স্নেইপ, স্লিথেরিনের হাউস টিউটর, রহস্যময় খলনায়ক থেকে সবশেষে এক নিভৃতচারী ভালোবাসার জাদুকর! আবার ‘ডাই হার্ড’ সিরিজের সেই কলজে-কাঁপানো খলনায়ক হ্যান্স গ্রুবারের কথাও তো ভুলতে পারবে না এইটি’জ জেনারেশন! এতসব স্মৃতিকে দুই প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে অনেকটা নীরবেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন পৌরুষদীপ্ত এই অভিনেতা—অ্যালান রিকম্যান।

দর্শকপ্রিয় ব্রিটিশ এই অভিনেতা গতকাল ৬৯ বছর বয়সে মারা গেলেন, নিজের বাসাতেই ছিলেন শেষ মুহূর্তে। বেশ কিছুদিন ধরে প্রাণঘাতী ক্যানসারের সঙ্গে লড়ে চলেছেন নিভৃতে। ৩০ বছরের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে শুধু রুপালি পর্দাই নয়, মঞ্চও কাঁপিয়েছেন সমান দাপটে। কেবল ‘হ্যারি পটার’ সিরিজ দিয়ে তাঁকে চিনলে কিন্তু চলবে না! ‘ডাই হার্ড’ সিরিজে দুর্ধর্ষ হ্যান্স গ্রুবারের ভূমিকায়, কখনো বা রবিন হুডে খিটমিটে নটিংহামের শেরিফ—অ্যালান রিকম্যান সবখানেই দেখিয়েছেন, অভিনয়টা তাঁর মজ্জায় মিশে থাকা, প্রক্রিয়াগত নয়!

জন্ম ১৯৪৬ সালে, লন্ডনে। পড়াশোনার বিষয় আর্টস হলেও পরবর্তী সময়ে ডিজাইনিংকে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নেন। কিন্তু যাঁর নিয়তি নাটকের মঞ্চ কিংবা সিলভার স্ক্রিন, তাঁকে কি আর নকশাবাজির ভাঁজে-খাঁজে আটকে রাখা সম্ভব? রিকম্যানও ঝুঁকে পড়লেন অভিনয়জগতের দিকে। রয়্যাল একাডেমি অব ড্রামাটিক আর্ট থেকে অভিনয়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে যোগ দেন ইংল্যান্ডের বিখ্যাত রয়্যাল শেকসপিয়র কোম্পানিতে। সোজাসাপ্টা ভাষায়, নাটকের দল যাকে বলে আর কী। সময় গড়িয়ে বড় পর্দার সঙ্গেও কাজ শুরু করে দিয়েছেন, পেয়েছেন দুনিয়াজোড়া খ্যাতি। তবে মঞ্চের জন্য ভালোবাসা কখনোই ছাড়তে পারেননি। যেন প্রথম প্রেমের মতো ছিল তাঁর কাছে মঞ্চের আলো-আঁধারি দুনিয়া। আমৃত্যু যুক্ত থেকেছেন এই নাটকের দলের সঙ্গে।

নাটকে ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয়ের পাশপাশি অ্যালান রিকম্যান টেলিভিশনের পর্দায় হাজির হতে থাকেন নিয়মিত। ছোট পর্দায় অভিষেক হয় ১৯৭৮ সালে, বিবিসি টেলিভিশন চ্যানেলের সিরিজ ‘রোমিও জুলিয়েট’-এ ‘টাইবাল্ট’ চরিত্রে রূপদানের মাধ্যমে। পরে ‘শেলি’, ‘বাস্টেড’, ‘স্মাইলিজ পিপল’সহ বেশ কিছু টেলিভিশন সিরিজে ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।

১৯৮৫ সালে রিকম্যান প্রথম নজরে এলেন ভিন্নভাবে, ক্যারিয়ারে ব্রেক থ্রু যাকে বলা যায় অনায়াসে। মঞ্চনাটক ‘লেস লিয়াজনস ডেঞ্জারাসেস’-এর প্রধান চরিত্র ‘ভালমন্ট’-এ রূপদান করে দর্শক ও সমালোচকদের অকুণ্ঠ প্রশংসা জুটল তাঁর। পরবর্তী সময়ে নাটকটি আমেরিকান ব্রডওয়ে থিয়েটারে প্রদর্শিত হয় এবং রিকম্যান তাঁর চরিত্রের জন্য মঞ্চনাটকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ টনি অ্যাওয়ার্ডে ‘সেরা অভিনেতা’ হিসেবে মনোনয়ন পান। জাত শিল্পীর জন্য সুযোগ একবার হলেই চলে, বাকিটা এমনিই হয়ে যায়। তেমনটাই রিকম্যানের ক্ষেত্রে ঘটেছে।

১৯৮৮ সালে বড় পর্দায় এলেন রিকম্যান, অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্র ‘ডাই হার্ড’-এর মাধ্যমে। জন ম্যাকটিয়ারনান পরিচালিত এ চলচ্চিত্র আশাতীত সাফল্য লাভ করে। ঠান্ডা মাথার জার্মান সন্ত্রাসী দলের প্রধান হিসেবে রিকম্যানের অনবদ্য অভিনয় তাঁকে অমরত্ব এনে দেয়। অনেকাংশে এই চলচ্চিত্রে অ্যালান রিকম্যানের শক্তিশালী অভিনয়ের ছায়ায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল ব্রুস উইলিসের জন ম্যাকক্লেইন চরিত্রটি। এএফআই-এর করা শতাব্দীসেরা ১০০ খলচরিত্রের মধ্যে হ্যান্স গ্রুবার চরিত্রটি রয়েছে ৪৬ নম্বরে।

‘ডাই হার্ড’-এর পর আর কখনো ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে হয়নি অ্যালানকে। কখনো বড় পর্দায় নটিংহ্যামের শেরিফ হয়ে, কখনো ছোট পর্দায় গ্রিগরি রাসপুতিনের ভূমিকায়, আবার কখনো বা মঞ্চে নোয়েল কাওয়ার্ডের নির্দেশনায় ‘প্রাইভেট লাইভস’-এ অভিনয় করে বারবার নিজের অভিনয় প্রতিভার প্রমাণ দিয়েছেন। ২০০১ সালে মুক্তি পায় রিকম্যান অভিনীত ‘হ্যারি পটার’ সিরিজের প্রথম চলচ্চিত্র। পুরো সিরিজে কখনো নাক গলানো প্রফেসর, কখনো ঠান্ডা মাথার খুনি, কখনো ট্র্যাজিক হিরোর ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করে ‘সেভেরাস স্নেইপ’ চরিত্রটিকে দর্শকের কাছে অমর করেছেন এই অভিনেতা।

এর পাশাপাশি তিনি অভিনয় করেছেন ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’, ‘মাইকেল কলিন্স’, ‘লাভ অ্যাকচুয়ালি’, ‘পারফিউম : স্টোরি অব আ মার্ডারার’, ‘সুইনি টোড : দ্য ডেমন বারবার অব ফ্লিট স্ট্রিট’, ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’, ‘দ্য বাটলার’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে।

অ্যালান রিকম্যান মনে করতেন, ‘প্রতিভাবান হওয়া একটি দুর্ঘটনা। এ দুর্ঘটনাকে লালন করা একটি বিশাল দায়িত্ব।’ তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর এই দুর্ঘটনার জন্য, তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর চরিত্রগুলোর মধ্যে। হ্যান্স গ্রুবার কিংবা সেভেরাস স্নেইপ হয়ে কিংবা নটিংহামের শেরিফ হয়ে—সব সময়। মানুষ মরে গেলে মরে যায়, কিন্তু কাজগুলো তো বেঁচে থাকে মানুষেরই মাঝে, তাই নয় কী!