উত্তাল ঊনসত্তর

আসাদ এক চেতনার নাম

Looks like you've blocked notifications!

‘আবার আসবো ফিরে’ ব’লে সজীব কিশোর
শার্টের আস্তিন দ্রুত গোটাতে গোটাতে
স্লোগানের নির্ভাঁজ উল্লাসে
বারবার মিশে যায় নতুন মিছিলে, ফেরে না যে আর।’

(‘বারবার ফিরে আসে’, শামসুর রাহমান)
হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা নিয়ে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদী কণ্ঠ নিয়ে মিছিলে গিয়েছিল আসাদ। আর ফিরে আসেনি। তাঁর সে রক্তস্নাত শার্ট আজ বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় বাঙালির জীবনীশক্তির ইতিহাসকে। শুধু একজন বীর শহীদ নয়, আসাদ হয়ে ওঠে একটি চেতনার নাম।

বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক থেকেই বাঙালিরা ভালোভাবে বুঝতে শুরু করে তাদের অবস্থান। ১৯৬৮ সালে জারীকৃত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সংবাদ সম্মেলন করে ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অধিকার আদায়ের এই কর্মসূচি অচিরেই গণ-অভ্যুত্থানে রূপলাভ করে। আইয়ুব সরকারের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের দুই অংশ একসঙ্গে আন্দোলনে নামে। পূর্ব পাকিস্তনে বিপুলসংখ্যক ছাত্রজনতার নেতৃত্বে ছিলেন আসাদ। 

পুরো নাম আমানুল্লাহ আসাদুজ্জামান। ১৯৪২ সালের ১০ জানুয়ারি নরসিংদীর শিবপুর থানার ধানুয়া গ্রামে জন্ম হয় আসাদের। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে স্নাতকোত্তর পড়ার সময় তিনি নিজ যোগ্যতায় অলংকৃত করেছিলেন ‘ন্যাপ’ ও ‘কৃষক সমিতির’ ঢাকা হল শাখার সভাপতির পদ। সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন’-এর। তরুণ বয়সেই তিনি ছিলেন গরিব ছাত্রদের শিক্ষার বিষয়ে সদা জাগ্রত। শিবপুরে ‘শিবপুর নৈশ বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠায় ছিলেন অগ্রগামী। মওলানা ভাসানীর নির্দেশনায় কৃষকদের সংগঠিত করতে তিনি শিবপুর, মনোহরদী, রায়পুর, নরসিংদী প্রভৃতি স্থানে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছিলেন। ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণার পর ১৪ জানুয়ারি সারা দেশে হরতাল পালিত হয়। ৬ দফা ও ১১ দফার প্রতি সমর্থন জানিয়ে তাদের সঙ্গে একাগ্রতা পোষণ করে ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, যাতে সবার আগে ছিলেন আসাদ। বিক্ষুব্ধ জনতার সে হরতালে পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ছাত্ররা দেশব্যাপী সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার আহ্বান জানান। তাঁদের আন্দোলনকে রুখতে তৎকালীন গভর্নর মোনেম খান জারি করেন ১৪৪ ধারা। ২০ জানুয়ারি দুপুরে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আসাদ তাঁর মিছিল নিয়ে এগিয়ে যান চানখাঁরপুল এলাকা দিয়ে। পুলের ওপরই পুলিশ তাঁদের বাধা দিয়ে মিছিল ছত্রভঙ্গ করার চেষ্ট করে। কিন্তু ছাত্ররা স্বৈরাচারবিরোধী স্লোগানে আরো বেশি মুখরিত হয়ে উঠলে পুলিশও তাদের ঠেকাতে বদ্ধপরিকর হয়। প্রতিবাদী আসাদ কাউকে ভয় না করে তীব্র কণ্ঠে প্রতিবাদী স্লোগান দিতে থাকেন। তাঁর কণ্ঠ চিরতরে রোধ করতে খুব কাছ থেকেই পুলিশ গুলি চালায়। গুরুতর আহত হন আসাদ। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। অর্জন করেন ঊনসত্তরের বীর শহীদের মর্যাদা। 

এরপরও আন্দোলন দমে না গিয়ে বরং বেগবান হয়ে উঠল। আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে আবার মিছিল বের হলো। ছাত্রজনতা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে জমায়েত হয়ে আসাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ২২, ২৩, ২৪ জানুয়ারি দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দিল। আবার পুলিশ গুলি চালাল কিন্তু শেষাবধি আইয়ুব সরকার ১৪৪ ধারা স্থগিত করতে বাধ্য হলো। প্রাণ দিয়ে আসাদ বাঙালির জাতীয় চেতনাকে চিরজাগ্রত করে গেলেন। আসাদের যৌবনদীপ্ত বিক্ষুব্ধ সাহসী পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে হেলাল হাফিজ তাঁর ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতায় লিখলেন-

‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়,
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’

শোকাতুর ও আবেগাপ্লুত বিপুল ছাত্রজনতার অশ্রুস্নাত মিছিলে আসাদের রক্তরঞ্জিত শার্ট দেখে চুপ করে থাকতে পারলেন না প্রয়াত কবি শামসুর রাহমানও। তিনি বুঝলেন এই শার্ট সূচনা করেছে নতুন জাতীয় চেতনার। এই শার্ট কেবল রাজপথে নয়, বাঙালির জাতীয়তা বোধকে ছড়িয়ে দেবে বাংলার আনাচে কানাচে। তিনি তাই আসাদের শার্ট কবিতায় লিখলেন-

‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্ত করবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের 
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।’

আসাদের মহান আত্মত্যাগের সম্মানে বাংলাদেশে আইয়ুব খানের নামে যেসব স্থান ও স্থাপনা ছিল সেগুলোর নাম পরিবর্তন করে আসাদের নাম যুক্ত করা হয়। আমরা পাই আসাদ গেট, আসাদ এভিনিউ, আসাদ পার্ক, শিল্পী প্রদ্যত দাস নির্মিত ভাস্কর্য ‘গণজাগরণ’। তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য শিবপুরে গড়ে ওঠে ‘শহীদ আসাদ কলেজ’, ‘শহীদ আসাদ কলেজিয়েট স্কুল ও কলেজ’। তাঁর স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে ও দেশের জন্য তাঁর মহান ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রতিবছর ২০ জানুয়ারি পালিত হয় ‘শহীদ আসাদ দিবস’।

গণ-অভ্যুত্থানের ৪৬ বছর পর আসাদ এখন শুধু একটি নাম নয়, নয় শুধু একজন বীর বাঙালি ছাত্রনেতার পরিচায়ক। আসাদ এখন একটি চেতনার নাম, জাগরণের নাম যা যুগ যুগ ধরে বাঙালির জাতীয় চেতনাকে অক্ষয় করে রেখেছে। আমরা দেখেছি-

‘বারবার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট
ময়দানে ফিরে আসে, ব্যাপক নিঃসর্গে ফিরে আসে
ফিরে আসে থমথমে শহরের প্রকাণ্ড চোয়ালে।’

বারবার আসাদ আসে লাখো তরুণের বেশে। আমাদের দৈন্য, লজ্জাকে মুছে দিয়ে জাগায় নতুন চেতনা। ১৯৬৯ পেরিয়ে গেলেও আসাদের শার্ট আজও ম্লান হয়নি। তার সে শার্ট উজ্বল সূর্যের মতো আজও দীপ্তিমান। শামসুর রাহমানের কবিতায় তারই প্রকাশ-

‘আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।’

লেখক : শিক্ষক, এমিনেন্স কলেজ, উত্তরা, ঢাকা