বিশ্বসেরা ১০০ বই
হেনরিক ইবসেনের ‘এ ডলস হাউস’
নরওয়েজিয়ান নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের লেখা তিন অঙ্কের নাটক ‘এ ডলস হাউস’। বই আকারে নাটকটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭৯ সালের ডিসেম্বরে। একই মাসের ২১ তারিখ ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনের রয়েল থিয়েটারে বড়দিন উপলক্ষে প্রথম নাটকটি মঞ্চস্থ হয়।
নরওয়েজিয়ান ভাষায় লেখা হেনরিক ইবসেনের নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয় ‘এ ডলস হাউস’ (A Doll’s House) নামে। তবে এ নিয়ে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করে থাকেন। সাহিত্যবিশারদদের অনেকেই বলে থাকেন, নরওয়েজিয়ান এই নাটকের সঠিক ইংরেজি অনুবাদ হবে ‘এ ডল হাউস’ (A Doll House), সেটা ইবসেনের নামের সঙ্গে অনেক বেশি মানানসই।
ঊনবিংশ শতাব্দীর বিয়ে-সংসার ব্যবস্থা ও সামাজিক নিয়মকানুনের সমালোচনা করার কারণে বিখ্যাত হয়ে আছে ইবসেনের এই নাটক। সে সময়ে নাটকটি নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি।
নাটকের মূল চরিত্র নোরা। একসময় স্বামী, সংসার আর সন্তানের দায়িত্ব ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে চায় সে। নিজেকে নতুন করে চেনার, জানার আগ্রহ তৈরি হয় তার মধ্যে।
ইবসেন এই নাটক লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন এ ধারণা থেকে যে, ‘একজন নারী আধুনিক সমাজে কখনোই নিজের মতো করে বাস করতে পারে না।’ কারণ, এটি একটি পুরুষশাসিত সমাজ। এই সমাজের আইন তৈরি করে পুরুষরা, আইন প্রয়োগ ও বিচার প্রক্রিয়াও পুরুষদের হাতে। সে কারণেই তাঁরা পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নারীদের বিষয়গুলো নির্ধারণ করেন।
১৮৯৮ সালে ‘নরওয়েজিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর ওমেন্স রাইটস’-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইবসেন বেশ জোর দিয়েই বলেছিলেন, তিনি সচেতনভাবেই নারী অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে কাজ করেছেন। তবে কোনো প্রপাগান্ডার অংশ হিসেবে তিনি ‘এ ডলস হাউস’ লেখেননি বলেও দাবি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তাঁর কাজ ছিল মানবতাকে বর্ণনা করা।
২০০৬ সালে ইবসেনের শততম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়। ওই বছর সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশিবার প্রদর্শিত নাটকের সম্মান লাভ করে ‘এ ডলস হাউস’।
২০০১ সালে ইবসেনের স্বাক্ষরসংবলিত ‘এ ডলস হাউস’ নাটকের পাণ্ডুলিপিকে ইউনেস্কো এর ঐতিহাসিক মূল্য বিবেচনায় ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’-এর অন্তর্ভুক্ত করে।
কাহিনী সংক্ষেপ
স্বামীর অসুস্থতার সময় নোরা হেলমার বড় অঙ্কের অর্থ গোপনে ধার করেছিলেন। তবে স্বামীকে সেটা জানতে দেননি তিনি। কষ্ট করে হলেও একাই কিস্তিতে সেই ঋণ শোধ করে যাচ্ছিলেন। এদিকে নোরার স্বামী টোরভাল্ড মনে করেন, নোরা এখনো অনেক ছোট এবং অনেক কিছুই সে বুঝতে পারে না। আর সে কারণেই নোরাকে ‘ডল’ (পুতুল) বলে ডাকেন তিনি।
এরই মধ্যে ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান টোরভাল্ড। দায়িত্ব পেয়েই ব্যাংকের কর্মী নিলস ক্রোগস্তাদকে চাকরিচ্যুত করার উদ্যোগ নেন তিনি। নিলসের বিরুদ্ধে অভিযোগ, স্বাক্ষর জাল করে টাকা তুলেছিলেন তিনি। এই নিলসের কাছ থেকেই টাকা ধার করেছিলেন নোরা।
পরে জানা যায়, আসলে নিজের বাবার স্বাক্ষর জাল করে টাকাটা নোরাই তুলেছিল স্বামীকে সুস্থ করে তোলার জন্য। এ সময় নিলস নিজের চাকরি বাঁচানোর জন্য নোরাকে অনুরোধ করে। নয়তো নোরার স্বামীর কাছে সব ঘটনা খুলে বলার হুমকি দেয়।
তবে টোরভাল্ডকে এ কথা বোঝাতে ব্যর্থ হয় নোরা। কারণ নোরার স্বামী মনে করেন, ব্যবসার বিষয়ে নোরা কিছুই জানে না এবং এটা বোঝার ক্ষমতাও তার নেই। একসময় টোরভাল্ড বুঝতে পারে, নোরাই তার বাবার স্বাক্ষর জাল করে ব্যাংক থেকে টাকা তুলেছে। এ কথা জানার পর বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয় টোরভাল্ড। যদিও সে জানে না যে তাকে সুস্থ করে তুলতেই নোরা এ কাজ করেছে।
শেষমেশ নোরাও বুঝতে পারে, যে ভালোবাসা সে টোরভাল্ডকে দিয়েছে, তার যোগ্য সে নয়। নোরাও তার পথ আলাদা করে নেয়।
লেখক পরিচিতি
আধুনিক গদ্য নাটক রচনার পথিকৃৎ বলা হয় হেনরিক ইবসেনকে। ১৮২৮ সালের ২০ মার্চ নরওয়ের স্কিয়েনে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। ইবসেনের বাবা ছিলেন নামকরা বণিক, কিন্তু ইবসেনের যখন আট বছর বয়স, তখন তাঁর বাবা দেউলিয়া হয়ে যান। তাই শৈশব থেকেই অভাব আর দারিদ্র্যের সঙ্গে পরিচিত হন তিনি।
১৮৫১ থেকে ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি বার্গেনের (বর্তমান অসলো) বিভিন্ন থিয়েটারে কাজ করেন। ২১ বছর বয়সে হেনরিক ইবসেন প্রথম নাটক রচনা করেন। পাঁচ অঙ্কের সেই ট্র্যাজেডি নাটকের নাম ছিল ‘ক্যাটিলাইন’(Catiline)।
১৮৫৮ সালে সুজানা থোরেসনকে বিয়ে করেন ইবসেন। তাঁদের একমাত্র পুত্রসন্তান জন্মানোর পর ইবসেন অনুভব করতে থাকেন, সংসারে নারী-পুরুষ একসঙ্গে থাকার চেয়ে সমঅধিকার নিয়ে থাকাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ‘এ ডলস হাউস’ নাটকেও তাঁর এই উপলব্ধির কথা উঠে এসেছে।
কিন্তু সমালোচকরা সব সময়ই তাঁর বিরুদ্ধে সমাজের প্রচলিত বিবাহব্যবস্থাকে অসম্মান করার অভিযোগ এনেছেন। তবু নিজের প্রায় সব লেখাতেই নরওয়েজিয়ান সমাজের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লিখেছেন ইবসেন।
তবে সমালোচকরা শুধু তাঁর লেখালেখি নয়, ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও কটূক্তি করা শুরু করলে ১৮৬৪ সালে নরওয়ের সরকারের বৃত্তি নিয়ে অসলো ছেড়ে ইতালিতে চলে যান ইবসেন। জীবনের বাকি ২৭ বছর তিনি প্রবাসেই কাটিয়ে দেন। ইতালি ও জার্মানিতেই কাটে তাঁর এই সময়গুলো।
লেখক হিসেবে ইবসেনের ক্যারিয়ারের শুরুটা খুব একটা আকর্ষণীয় ছিল না। ১৮৬৬ সালে গীতিনাট্য ‘ব্র্যান্ড’-এর মাধ্যমে তিনি আলোচনায় আসেন। এর পর তিনি লেখেন ‘পির গিন্ট’। এ দুটি নাটক তাঁকে নাট্যকার হিসেবে পরিচিতি এনে দেয়।
১৮৭৯ সালে ইতালিতে থাকার সময় তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘এ ডলস হাউস’ বই আকারে প্রকাশিত ও মঞ্চস্থ হয়। তবে আগের দুটি গীতিনাট্যের ধারা ভেঙে তিনি গদ্যধর্মী নাটক লেখা শুরু করেন এই নাটকটির মাধ্যমে। এই নাটকটির মাধ্যমেই পরবর্তীকালে মঞ্চনাটকে বাস্তববাদী একটি আলাদা ঘরানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় আরো দুটি নাটক লেখেন ইবসেন ১৮৮১ সালে ‘গোস্টস’ এবং ১৮৮২ সালে ‘অ্যান এনিমি অব দ্য পিপল’। এ দুটি নাটকও বেশ সাফল্য পায়।
এর পরপরই হেনরিক ইবসেনের নাটক বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হতে থাকে। বিশেষ করে ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয় ইবসেনের লেখা নাটকগুলো।
১৯০৬ সালের ২৩ মে মারা যান হেনরিক ইবসেন।
** বিশ্বসেরা ১০০ বইয়ের তালিকাটি তৈরি করা হয়েছে ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত তালিকা অবলম্বনে। এই তালিকাটি তৈরি করেছে ‘নরওয়েজিয়ান বুক ক্লাবস’। বিশ্বের ৫৪টি দেশের ১০০ জন লেখকের কাছে তাদের চোখে সেরা ১০টি বই ও লেখকের নাম চেয়েছিল নরওয়েজিয়ান বুক ক্লাবস। ১০০ জন লেখকের দেওয়া সেই তালিকার ভিত্তিতেই যাচাই-বাছাই করে তৈরি করা হয়েছে এই তালিকা।