গপ্পো তক্ক যুক্তি

টাকার জন্য ছবি বানাই না : কিউ

Looks like you've blocked notifications!
ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা কিউ। ছবি : আইবিএন লাইভ

ভালো নাম কৌশিক মুখার্জি। কিন্তু তাঁর মতে, কৌশিক মুখার্জি সিনেমা বানাতে পারে না। তাই সিনেমার খাতিরে নাম পাল্টে রেখেছেন কিউ। আলোচনায় আসেন ২০১০ সালের ছবি ‘গান্ডু’ দিয়ে। ২০১২ সালে মুক্তি পায় তাঁর আরেকটি আলোচিত ছবি ‘তাসের দেশ’। দেশ-বিদেশের নামকরা চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত এবং প্রশংসিত হয়েছে তাঁর ছবিগুলো। ফিচার ফিল্মের পাশাপাশি বানিয়েছেন ডকুমেন্টারি। 

১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি তাঁর জন্ম। বেড়ে ওঠা কলকাতায়। লেখাপড়া শেষে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করেছেন ১২ বছর। তার পর হাত দেন সিনেমার কাজে। ভারতীয় ইনডিপেনডেন্ট ছবির অন্যতম পরিচালক মনে করা হয় তাঁকে। বাংলা ছবি এবং ডকুমেন্টারি নির্মাণেও এনেছেন ভিন্নতা এবং বিষয়-বৈচিত্র্য।  

বিনোদনভিত্তিক ভারতীয় ওয়েবসাইট গ্ল্যামশ্যামকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ছবি নিয়ে কথা বলেছেন কিউ। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন পংকজ সাবনানি। 

প্রশ্ন : ‘তাসের দেশ’ নিয়ে সিনেমা বানানোর আইডিয়া কীভাবে আপনার মাথায় এলো?

কিউ : আমার বয়স যখন ছয় বা সাত, তখন থেকেই আমি তাসের দেশের সঙ্গে আছি। এটা মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খুব জনপ্রিয় একটা নাটক। আমি ছোটবেলা থেকে এটা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। ‘তাসের দেশ’ দিয়েই আমি রবীন্দ্রনাথকে চিনেছি।

প্রশ্ন : ছবিটা বানানোর পেছনে আপনার উদ্দেশ্য কী ছিল?

কিউ : আমি জানি না। এই ছবি বানানোর জন্য আমার কোনো চাপ ছিল না। এই ছবি বানানোর পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল অন্তত দৈত্যের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া। বাঙালি হওয়ার কারণে আমি আমার সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন এবং এই ছবির মাধ্যমে আমি আমার অতীতকে ভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করেছি।

প্রশ্ন : আপনি কি কোনো সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন আনতে চেয়েছেন?

কিউ : আমি সব সময়ই পরিবর্তন আনার জন্য ছবি বানাই। শুধু একটা নির্দিষ্ট বিষয় নয়, আমি সমাজের অনেক বিষয় পরিবর্তন করতে চাই। মানে তারা জিনিসগুলোকে যেভাবে দেখে, সেই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে চাই। অন্তত আমার নিজের কাজের ক্ষেত্রে আমি মানুষের পরিচয়ের দিকে তাকাতে চেষ্টা করি। তাদের যৌন পরিচয়ের ইস্যুটা পরিষ্কার করতে চাই।  জানি না, আমার কথা শুনে আমাকে বেয়াদব মনে হচ্ছি কি না। কিন্তু আমার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, সমাজের চড়াই-উতরাই এবং চলে আসা প্রথা, বংশপরম্পরার সঙ্গে কাজ করা। তাই আমার সমাজ যা করে তার সমালোচনা আমি করব। সেটাই আমার আসল কাজ।

প্রশ্ন : আপনি কি সচেতনভাবেই সমাজের বিরুদ্ধে যেতে চান?

কিউ : অবশ্যই, এটা আমি ভেবেচিন্তেই করি। ব্যাপারটা এমন নয় যে, আমি সব সময়ই এ রকম করি। এগুলো বোঝার মতো যথেষ্ট বয়স আমার হয়েছে। যেকোনো সমাজেই শিল্পীদের ভূমিকাটা থাকে, সমাজের সমালোচনা করা। এই ক্রমাগত সমালোচনার মাধ্যমে সমাজটাকে টিকিয়ে রাখা। সেটাকে নষ্ট হতে না দেওয়া। সমাজটা কিসের জন্য, সেটা বারবার মানুষকে বলা। আমার সেটা করতে ভালোই লাগে। এখন আমি কতটা সফল হতে পারলাম, সেটা তো আমার হাতে নেই। আমি শুধু নিজের কাজটা করার চেষ্টা করতে পারি। 

প্রশ্ন : ‘তাসের দেশ’-এর একটা অন্যতম বক্তব্য হচ্ছে স্বাধীনতা। স্বাধীনতার ব্যাপারে আপনার ধারণা কী?

কিউ : এটা এককথায় বলে দেওয়া সম্ভব নয়। কয়েক শতক ধরে আমরা ‘স্বাধীনতা’ শব্দটা বোঝার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছি। আমি কোনোভাবেই বলতে চাই না যে, আমি স্বাধীনতা শব্দটার অর্থ জানি। আমি বলতে পারি যে, আমি স্বাধীনতার অর্থ শেখার চেষ্টা করছি। আমি নিজেকে স্বাধীন করার চেষ্টা করছি। এবং আমি চাই সবাই যে যার মতো স্বাধীন থাকুক। আমাদের কেন এই ধারণা জন্মায় যে, আমাদের সবাইকেই স্বাধীন হতে হবে? কারণ, অবশ্যই আমরা কেউই পুরোপুরি স্বাধীন না। কেউই পুরোপুরি সুখী না। আপনি আপনার জীবনে কয়জন সুখী মানুষ দেখেছেন? স্বাধীন বলতে আমি বোঝাচ্ছি যে সুখী এবং কোনো কিছুরই পরোয়া করে না। কোনো চিন্তা নেই জীবনে। 

প্রশ্ন : আপনি রবীন্দ্রনাথ দ্বারা বেশ প্রভাবিত। রবীন্দ্রনাথের কোন জিনিসটা আপনাকে আকৃষ্ট করে?

কিউ : এটা পুরোপুরি ঠিক নয়। আমি আসলে রবীন্দ্রনাথের তেমন ভক্ত না। আমি আসলে ‘তাসের দেশ’-এর খুব ভক্ত। এই নাটকটার ব্যাপারে আমার খুব আগ্রহ। রবীন্দ্রনাথের বেশিরভাগ উপন্যাসই রোমান্টিক ক্ল্যাসিক। তাঁর নাটক এবং তাঁকে ঘিরে থাকা সবকিছুর মধ্যেই একটা রোমান্টিসিজম আছে। মূলত সে একজন কবি। আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিনি কারণ, আমার জন্ম বাংলায় এবং আমি একজন বাঙালি। আমি বেড়ে উঠেছি তাঁর গল্প-কবিতা পড়ে। মানে আমাদের জীবনে রবীন্দ্রনাথ এতভাবে এসেছেন যে শেষ পর্যন্ত আমিও ‘তাসের দেশ’ বানিয়ে ফেললাম। 

প্রশ্ন : তাসের দেশ-এ ১৯টা গান রাখলেন কী ভেবে? এটা কি পুরো ছবির বক্তব্যের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকরা তৈরি করে?

কিউ : গানগুলো তো ‘তাসের দেশ’-এর মধ্যে ছিলই। এটা একটা মানসম্মত সাহিত্য। ১৯৩৩ সালে তাসের দেশ লেখা হয়েছিল। সিনেমা বানানোর সময় আমরা কিন্তু নাটকটার গঠন নিয়ে বেশি একটা মাথা ঘামাইনি। মূল নাটকে ২৪টা গান ছিল। আমরা সেটাকে কমিয়ে ১৯-এ নামিয়ে এনেছি।  

প্রশ্ন : তাসের দেশ কি সর্বসাধারণের জন্য?

কিউ : না, সবার জন্য না। কোনো কিছুই আসলে সবার জন্য না। আমরা জনসাধারণকে বোঝাতে চেষ্টা করি যে তাদের জীবনে এসব জিনিসের দরকার আছে, আদৌ আসলে যার দরকার নেই। আমি ১২ বছর বিজ্ঞাপনের জগতে কাজ করেছি। এবং আমি এই চাহিদা তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানি। আমি এমন অনেক জিনিস বেচেছি, যেগুলো কারো দরকার ছিল না, কোনো কাজেই লাগত না। কিন্তু আমরা তাদের বুঝিয়েছে যে জিনিসগুলো তাদের জন্য প্রয়োজনীয়। এখন আমি ছবির কনটেন্টের ক্ষেত্রেও একই কাজ করছি। আমি চাইছি মানুষ আমার কাজটা দেখুক। যদিও এটা না দেখলে তাদের কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু ভারতের বাজারে এই ‘সর্বসাধারণ’-এর আইডিয়াটা একটা বোকামি। মানুষ আসলে একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত থিয়েটারে বসতে চায়। কারণ, ঠান্ডা না থাকলে তারা তিন ঘণ্টা আরাম করে সেখানে থাকতে পারবে না। থিয়েটারে বসে তাদের কোনো কাজ নেই, মনোযোগ দিয়ে তারা ছবিও দেখে না। আর সে কারণেই এই সর্বসাধারণ-এর আইডিয়ার সঙ্গে আমি একমত না। সিনেমা হচ্ছে শিল্পের এমন একটা শাখা, যেখানে আপনি বস্তাপচা জিনিস দিয়ে কোটি কোটি টাকা আয় করতে পারবেন। এর জন্য কিছু জিনিসপত্র দরকার। আমি বিশ্বাস করি না যে, ১০০ কোটি মানুষের দেশে সবাই শুধু টাকা কীভাবে আয় করা যায় আর খরচ করা যায়, সেটা নিয়েই চিন্তা করে। এর বাইরেও অন্য কিছু নিয়ে মানুষ চিন্তা করে। হয়তো সে সংখ্যাটা কম, কিন্তু এ ধরনের মানুষও আছে।  

প্রশ্ন : ইনডিপেনডেন্ট ছবির জন্য কি ভারত সুখকর স্থান?

কিউ : খুবই সুখকর জায়গা, কারণ এখানে সব জায়গাতেই বিশৃঙ্খলা। দ্বিধা আর বিশৃঙ্খলার মধ্যেই আপনি ছবির জন্য সেরা গল্পগুলো খুঁজে পাবেন। আপনি যদি বিষয়ভিত্তিক ছবি বানাতে চান, তাহলে এটা খুবই ভালো জায়গা। আবার একই সঙ্গে যখন ছবি বানানোটা একটা শিল্প আর্থিক দিক থেকেও এবং শৈল্পিক দিক থেকেও। এ দুই দিক থেকেই ছবি বানানোর জন্য ভারত সবচেয়ে বাজে জায়গা। কিন্তু আপনাকে এর মধ্যেই বাঁচতে হবে। 

প্রশ্ন : আপনার কি মনে হয়, ইনডিপেনডেন্ট ছবির জন্য ভারতে কোনো পরিবর্তন আসবে?

কিউ : আমার মনে হয়, ভারতে এমন কিছু নির্মাতা আছেন, যাঁদের কোনো দ্বিধা ছাড়াই ইনডিপেনডেন্ট ফিল্মমেকার বলা যায়। তাঁরা প্রচলিত ব্যবস্থার সঙ্গে কাজ করেন না। এবং তাঁরা সবাই, আমিসহ চেষ্টা করছে এমন আইডিয়া নিয়ে কাজ করতে, যেটা এই গোলমেলে অবস্থার অবসান ঘটাবে। আমার মনে হয়, এটা দারুণ একটা সময়, কারণ আমরা সবাই চেষ্টা করছি। এটা হচ্ছে সেই প্রস্তুতিকালীন। কিন্তু যখন পরিবর্তন আসবে আর পরিবর্তনটাই রীতি হয়ে দাঁড়াবে, তখন এই চেষ্টা করার মজাটা আর থাকবে না। 

প্রশ্ন : ‘গান্ডু’ করার পর কি আপনার মনে হয় যে এই ছবিটা আপনার ওপর বাড়তি প্রত্যাশা চাপিয়ে দিয়েছে?

কিউ : হ্যাঁ, মনে হয়। সবচেয়ে বিরক্তিকর হলো, আগে আমাকে কেউ চিনত না। আমি যেখানে খুশি গিয়ে শ্যুট করে চলে আসতে পারতাম। এখন আর সেটা পারি না। 

প্রশ্ন : আমরা কি আপনাকে বড় বড় তারকাকে নিয়ে বিগ বাজেটের ছবি বানাতে দেখব? 

কিউ : না। কারণ আমি এগুলো ঘৃণা করি। আমি কোনো বাণিজ্যিক হিন্দি ছবি দেখি না। 

প্রশ্ন : আপনার আসল লক্ষ্য কী থাকে? ছবি দিয়ে নিজের চলার মতো টাকা আয় করা নাকি কোনোমতে ছবির টাকাটা উঠে আসলেই আপনি খুশি, যাতে পরের ছবিটার কাজ শুরু করা যায়?

কিউ : এটা খুবই মজার প্রশ্ন। সবাই জিজ্ঞাসা করে যে, এই ছবি দিয়ে কি তুমি টাকা কামাতে চাইছ? আসলে সবখানেই পুঁজিবাদের ব্যাপারটা চলে আসে। মনে হয় যেন এটাই একমাত্র সত্যি। এটা যে বিনোদনেরও একটা মাধ্যম, সেটাকে আপনি পাত্তাই দিচ্ছেন না। মানুষজন জিজ্ঞাসা করে যে, এই ছবিটা না চললে তুমি কী করবে? তারা খুবই আগ্রহী এটা জানার জন্য। ৫০ বছর পেছনে ফিরে তাকান। তখন ভারতের নাম কী ছিল? তখন আমরা ছিলাম সমাজতান্ত্রিক, তারপর গণতান্ত্রিক এবং এখন ভারত রাষ্ট্র (রিপাবলিক অব ইন্ডিয়া)। প্রথমত, আমরা সমাজতান্ত্রিক। আমাদের সব প্রতিষ্ঠান সেভাবেই শাসিত হয়। তাই ভারতের ডাক্তারদের তাদের লেখাপড়ার জন্য কোনো পয়সা দিতে হয় না। ফিল্মমেকারদেরও লেখাপড়ার জন্য কোনো খরচ দিতে হয় না। তাই আমরা এটা টাকার জন্য করি না। টাকা ছাড়াও এমন কিছু বিষয় আছে, যার জন্য আপনি কাজ করতে পারেন। টাকাটাই সব না। এটা কখনো কখনো গুরুত্বপূর্ণ। খেয়েপড়ে বেঁচে থাকার জন্য যতটুকু লাগে।