আমার প্রথম বই প্রকাশের ঘটনা
মেলায় ১০ তারিখের মধ্যে বই না এলে আমি দাঁড়ি কাটব না প্রকাশক র্যামন পাবলির্শাসের সৈয়দ রহমতউল্লাহ রাজনকে জানিয়ে দিলাম।
১৯৯৬ সালে একুশের বইমেলয়ার ঘটনা। একদিন লেখক হবো এই বাসনাকে বুকে ধারণ করে ১৯৮২ সালে এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে বরিশালের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে এসেছিলাম। এসেই একটি রাজনৈতিক দলের অফিসে পিওন ও দপ্তরির কাজ নিতে বাধ্য হলাম। কারণ, ঢাকা শহরে আমার কোনো আত্মীয় নেই, বন্ধু নেই যেখানে উঠতে পারি। যেভাবেই হোক ঢাকায় আমাকে টিকে থাকতে হবে। কারণ, আমি লেখক হবো। আর ঢাকায় না থাকলে লেখক হওয়া যাবে না। সেইকালেই আমি সেটা বুঝেছিলাম।
রাজনৈতিক দলের অফিসটা ছিল প্রেসক্লাবের উল্টোদিকে, এখন যেখানে মহিলা পরিষদের অফিস। সেখানে নানা স্তরের লোকজন আসত। নানা মাত্রিকতায় অনেক মানুষ ও লেখকের সঙ্গে পরিচিত হতে লাগলাম। লেখার মকসোও শুরু করলাম- শিশুদের জন্য লেখা দিয়ে। প্রথম লেখা ছাপা হয়েছিল বাংলা বাণীর শিশুদের পাতা ‘শাপলা কুঁড়ির আসর’-এর পাতায়। পাতাটা দেখতেন ওয়াহিদ রশীদ মুরাদ।
গল্পটার নাম ছিল ‘চোর’। আজও মনে পড়ে- লেখাটা নিয়ে লুঙ্গি পরেই বাংলার বাণীতে গিয়েছিলাম। বুক কাঁপছিল। ভয় পাচ্ছিলাম। কোনো একজনকে জিজ্ঞেস করে শাপলা কুঁড়ির আসরের বক্সে লেখাটা রেখে দৌড়ে বের হয়েছিলাম। পরের সপ্তাহেই গল্পটা ছাপা হলে আমার পৃথিবীটাই পাল্টে যায়। ধীরে ধীরে আমি ঢাকা শহরের সাহিত্যের দুটি আসর ‘খেলাঘর’ এবং ‘শাপলা কুঁড়ির আসর’-এ নিয়মিত যেতে শুরু করলাম। নিজেকে তৈরি করতে করতে চলে গেল কয়েকটি বছর। ইতিমধ্যে পত্রপত্রিকায় লিখতে লিখতে আমার একটি পরিচিতি গড়ে ওঠে।
কয়েক বছর যাওয়ার পর বই প্রকাশের ইচ্ছে জাগে। আর বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলায় নিয়মিত যেতাম। যেতাম বাংলা বাজারেও। বাংলা বাজারের বিশাকা প্রকাশে কাজ করতেন খসরু। খসরু আমার উপজেলা ভাণ্ডারিয়ার মানুষ। আমি বই প্রকাশের আকাঙ্ক্ষাকে খসরুকে জানালে, আমাকে নিয়ে যায় র্যামন পাবলির্শাসের রাজনের কাছে। রাজন অসাধারণ মানুষ। আড্ডাবাজ। মিশুক। প্রাণবন্ত। ফলে রাজনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলাম। আমি উপন্যাসের বিশাল পাণ্ডুলিপি দিয়ে দিলাম।
ছিয়ানব্বই সালেও সব কম্পোজ হতো হাতে। উপন্যাস কম্পোজ হচ্ছে, প্রুফ দেখছি কিন্তু নাম ঠিক করতে পারছি না। এক একটা নাম ঠিক করছি, রাজন নাকচ করে দিচ্ছে। এক সময়ে বললাম ‘দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস’। রাজন বললো উপন্যাসের ঘটনার সঙ্গে এই নামটা যায়। নামটা রেখে দিলাম ‘দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস’।
সমর মজুমদার কভার আঁকলেন। সবুজ জমিনে কয়েকজন নারী ও পুরুষের আকৃতি। ভালো লাগল। সমরদা সেই সময়ের একজন ব্যস্ত প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন। ইদানীং দাদার প্রচ্ছদ কম দেখতে পাচ্ছি। তাঁর সাথে দেখাও হয় না অনেক দিন। জানি না কেমন আছেন!
আমার উপন্যাসের মূল ঘটনায় লাভলু ছিল কেন্দ্রীয় চরিত্র। লাভলুকে ঘিরে প্রেমিকা চৈতী, বন্ধু আদনান এবং আদনানের প্রেমিকা খঞ্জনা। দ্বিমুখি প্রেম আর পতনের আলেখ্যে ‘দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস’ উপন্যাসের ঘটনা গড়ে উঠেছে। লাভলু গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছে অনেকটা শূন্য হাতে, নিজেকে নির্মাণের অভিপ্রায়ে। দেখা হয় চৈতীর সঙ্গে। গভীর অনুরাগ দুজনের জন্য দুজনের। কিন্তু পরিণতি বিরহ। অন্যদিকে আদনানের সঙ্গে খঞ্জনার বিয়ে হয় এবং বিয়ের সব আয়োজন করতে হয় লাভলুকে। উপন্যাসের শেষের দিকে লাভলুর বাসায় উপস্থিত হয়, শৈশবে গ্রামে রেখে আসা মায়ের দ্বিতীয় ঘরের ছেলেমেয়ে রাখি আর খোকা। জানায় বাবা হাসপাতালে। যক্ষ্মা হয়েছে। লাভলু আগেরই দিনই জানতে পারে, প্রেমিকা চৈতীর বিয়ে হয়ে গেছে। নিঃসঙ্গ বেদনায় লাভলু যখন কাতর, তখন আসে শৈশবের সৎ বাবার দুঃসংবাদ। যে সৎ বাবা একদিন ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল।
লাভলু এখন কী করবে? লাভলু ফিরে যায় হাসপাতালে। মা অনেক বছর পর প্রথম সন্তানকে দেখে। আদনানের বিয়ের পর দিন সকালে মৃত বাবার লাশ নিয়ে লাভলু ফিরে যায় গ্রামে।
প্রথম উপন্যাস হিসেবে মোটামুটি সফল ছিল ‘দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস’। কিন্তু বইমেলার প্রথম সাত দিন পার হয়ে গেছে, বইয়ের দেখা নেই। আমি ভয়ানক উত্তেজিত। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত মেলায় থাকি, সবার বই আসছে, বিক্রি হচ্ছে আমি দেখছি। সহ্য হয়?
প্রকাশকের ওপর চাপ বাড়ানোর জন্য রাজনকে বললাম, আমার বই না আসা পর্যন্ত আমি দাঁড়ি কাটব না।
রাজন অবাক, পাগল নাকি?
হ্যাঁ। আমি পাগল হই আর যা হই আমার বইমেলায় আসার পর দাঁড়ি কাটব।
প্রথম সপ্তাহও চলে যায়, মনটা আমার ভয়ানক খারাপ। কী করব ভেবে পাই না। আমি সেদিনই বুঝেছিলাম প্রকাশকের কাছে পাণ্ডুলিপি হস্তান্তরের পর লেখকের কিছুই করার থাকে না। প্রকাশক তার প্রকাশ ভাবনায় যে লেখককে যেভাবে গুরুত্ব দেবেন বই সেভাবেই প্রকাশিত হবে। আরো বোঝা যায়, সব কিছুই প্রকাশকের হাতে থাকে না। কারণ, একটা বই হওয়ার পেছনে অনেক মানুষ যুক্ত থাকে। প্রত্যেকে যখন সুচারুভাবে কাজটা করে, তখনই বই প্রকাশিত হয়ে আমাদের হাতে আসে। কাগজ কেনা, প্রেসের মেশিনে ছাপা, বাঁধাই অন্যের হাতে থাকে।
আমার যত দূর মনে পড়ছে, আমার ‘দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস’ বইটি মেলায় এসেছিল ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখ। বইটি যখন র্যামন পাবলিশার্সের স্টলে অনেক বইয়ের মাঝে শুয়েছিল, আমি আমার নিজের চোখে বইটি দেখতে পেলাম, এক অসীম আনন্দ আমার বুকের ভেতরে পাল তুলে নাচছিল। কতদিন? প্রায় ২০ বছর আগের ঘটনা। এখনো আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। তখন মেলার পরিসর এত বৃদ্ধি পায়নি। আয়োজনও ছিল বটতলা ও পুকুরপারের এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। সীমাবদ্ধ সেই কাল পার হয়ে বইমেলা আজ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল প্রাঙ্গণে জায়গা করে নিয়েছে। অনেক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হচ্ছে কিন্তু আমার কাছে ১৯৯৬ সালের প্রথম বই ‘দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস’ প্রকাশের স্মৃতি উজ্জ্বল, অমলিন।
আর হ্যাঁ, বই প্রকাশের পরের দিনই দাঁড়ি কেটে মেলায় এসেছিলাম।