বইমেলা
মুখোমুখি প্রচ্ছদশিল্পী চারু পিন্টু
চিত্রশিল্পী চারু পিন্টু। বাংলাদেশের বইয়ের প্রচ্ছদে তিনি কাজ করে চলেছেন নিরলসভাবে। বইয়ের লেখক-প্রকাশক এবং সচেতন পাঠক মাত্রই চারু পিন্টুর নাম জানেন। অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে বাংলাদেশের প্রচ্ছদশিল্পের নানা বিষয়ে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন।
প্রশ্ন : বিশ্বে প্রতিটি দেশে বইয়ের প্রচ্ছদে একটা ধারা থাকে। যেমন ধরুন, কলকাতার সঙ্গে আমাদের ভাষার মিল থাকলেও প্রচ্ছদে মিল নেই। বাংলাদেশের প্রচ্ছদের মূল প্রবণতা কী? বা কোথায় তা স্বতন্ত্র?
চারু পিন্টু : প্রতিটি দেশের সংস্কৃতি অনুযায়ী সেই দেশের শিল্পকলা গড়ে ওঠে। আপনি যদি ইউরোপের চিত্রকলা বা সংগীতের দিকে খেয়াল করেন, তাহলে সেখানে দেখবেন তাদের মতো করে তাদের ভাবটাই প্রকাশিত হয়। আফ্রিকানরা তাদের মতো করে প্রকাশ করে। ভারত আমাদের নিকটবর্তী দেশ, সে কারণে প্রায় কাছাকাছি সংস্কৃতি। আর বাংলা ভাষাভাষীদের কাঁটাতারের বেড়ায় সীমাবদ্ধ রাখা যায়, এটা মানতে পারি না। দেশভাগের পর কলকাতা আর আমাদের ভেতর হয়তো একটা কাঁটাতার পড়েছে, কিন্তু সংস্কৃতি তো আর পাল্টায়নি। তাই প্রচ্ছদের মিল-অমিল নিয়ে জটিলতা খুব বেশি আছে বলে আমার মনে হয় না। ওরা ওদের মতো করেই করে। ওরা রিয়েলিস্টিক কাজ প্রচ্ছদে বেশি ব্যবহার করে পাঠককে টানার জন্য; আর আমাদের দেশে অনেকটা বিমূর্তধারা ব্যবহার করা হয়। আমরা রিয়েলিস্টিক কাজকে অলংকরণ হিসেবে হয়তো দেখতে চাই, কিন্তু প্রচ্ছদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বৈপরীত্যটাই বেশি দেখি। হয়তো এটা আমাদের স্বকীয়তা বলি বা শিল্পের উন্নয়ন বলি, কিছু একটা তো হবে।
আর প্রচ্ছদকে আমরা পেইন্টিং হিসেবে ভাবি বলেই হয়তো আমাদের প্রচ্ছদ শিল্পনির্ভর বেশি হয়ে থাকে। ওরা বাণিজ্যের ব্যাপার বেশি চিন্তা করে আর আমরা শিল্পের ব্যাপারে বেশি চিন্তা করি, এটাও বড় একটা কারণ হতে পারে।
প্রশ্ন : প্রচ্ছদ করার সময় আপনি কোনটাকে বেশি গুরুত্ব দেন—বইয়ের থিম, নাকি নান্দনিক দিক?
চারু পিন্টু : প্রচ্ছদ করার ক্ষেত্রে অবশ্যই দুটো বিষয়কেই সমান গুরুত্ব দিতে হয়। বইয়ের বিষয় ও শিল্পমান মিলিয়ে তৃতীয় একটা বিষয় দাঁড় করানোর চেষ্টা করি। বইয়ের থিম অনেক সময় নান্দনিকতাকে উসকে দেয় বা সহজ করে দেয়।
প্রশ্ন : একটা ভালো প্রচ্ছদের জন্য গ্রন্থ-রচয়িতার সঙ্গে কথা বলা কোনো গুরুত্ব বহন করে কি না?
চারু পিন্টু : গ্রন্থের বিষয়বস্তু নিয়ে লেখকের সঙ্গে আলাপ করা যেতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয় না, প্রচ্ছদ নির্মাণের ক্ষেত্রে লেখকের সঙ্গে আলাপ করার দরকার আছে, তাতে প্রচ্ছদ নির্মাণের ক্ষতির আশঙ্কা প্রবল হয়ে ওঠে। কেননা, লেখকরা শিল্পের গুণাগুণ যতটা বোঝেন, তার চেয়ে শিল্পীই ভালো বোঝেন। শিল্পী কখনো লেখককে বলতে পারেন না যে আপনি এটা নয়, ওটা লিখুন। আসলে যে যার অবস্থানে স্বাধীনভাবে কাজ করাটাই জরুরি।
প্রশ্ন : আপনি প্রচ্ছদ করার সময় কতটুকু স্বাধীনতা নেন?
চারু পিন্টু : কাজ করার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা না থাকলে কাজ কীভাবে সম্পন্ন হবে? আমি সব সময় মনের আনন্দে পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়েই কাজ করি।
প্রশ্ন : প্রচ্ছদের ভাষা আর বইয়ের ভেতরের ভাষায় কতটুকু মিল থাকা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
চারু পিন্টু : দেখুন, বইয়ের ভাষার ওপর ভিত্তি করেই প্রচ্ছদ নির্মিত হয়। একজন লেখক তাঁর উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ অথবা কবিতায় যা লেখেন, সেটা দেখার ক্যানভাস বৃহৎ। তাঁদের লেখায় দৃশ্যকল্পটা আসলে ব্যাপক জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠে, সেই সম্পূর্ণ কথনটা তো আর প্রচ্ছদে আনা সম্ভব নয় বা প্রকাশ করাও উচিত নয়। কেননা, তাহলে বই না পড়ে প্রচ্ছদ পড়েই পাঠক চলে যাবেন! হা হা হা! বরং সেই লেখা গল্প বা উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয়টাকে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রচ্ছদ আঁকা হয়, যেন পাঠক ন্যূনতম ধারণাটা উপলব্ধি করতে পারেন।
প্রশ্ন : কবিতা, কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ—সাহিত্যের তিনটি জনপ্রিয় বিভাগ। তিন বিভাগেই আপনি কাজ করেন। এ ক্ষেত্রে কোনটাতে আপনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন? আর কীভাবে আপনি এই তিন বিভাগের আলাদা আলাদা মেজাজ প্রচ্ছদে ধরার চেষ্টা করেন?
চারু পিন্টু : আসলে সাহিত্যের সব শাখার প্রচ্ছদই আমার প্রিয়। তবে কবিতা-ছোটগল্প-প্রবন্ধ সাহিত্যে বেশি চঞ্চলতা নিয়ে কাজ করতে ভালো লাগে। এ ক্ষেত্রে কবিতা, কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ—তিনটেই আলাদা বিষয়, এটা বুঝতে তো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তিনটার চরিত্রই তিন রকম। তার ভেতর আবার ছোট ছোট শাখা তৈরি হয়। কবিতা হতে পারে দ্রোহের, মুক্তিযুদ্ধের বা লোকজ অথবা অ্যাবসার্ড। তো, সেটা কথাসাহিত্য বা প্রবন্ধের ক্ষেত্রেও হতে পারে। সবকিছু ভেবেই তার পর সিদ্ধান্তটা নিয়ে প্রচ্ছদের রূপ দাঁড় করানো হয়।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের স্বনামধন্য প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রুব এষ তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি সব ধরনের বইয়ের কাজই করি। বইয়ের মান যাচাই করার সুযোগ কই আমার? আমি তো পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে এটা করছি। কেউ যদি আমাকে সিনেমার বইয়ের কাভার করতে দেয়, আমি সেটাও করব। শাবনূর-পপির ছবি দিয়েই করব। আমি ভাই ইন্টেলেকচুয়াল আর্টিস্ট না। প্রচ্ছদ করে কিছু পরিবর্তন করার ইচ্ছা আমার নেই। যে কারোর বই আমি করব। বই যে মানের, প্রচ্ছদও সে মানেরই হবে।’ তাঁর এই কথা সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? পেশাদার প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে আপনি নিজের কাজ কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
চারু পিন্টু : আসলে ধ্রুবদা বাংলাদেশের প্রচ্ছদের রাজা, এটা আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাঁর আছে। বাংলাদেশের প্রচ্ছদের এই নান্দনিকতায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাঁর চিন্তার প্রয়োগটা অস্বীকার করা যাবে না কখনো। ধ্রুবদা তাঁর পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে হয়তো ঠিকই বলেছেন। তাঁর চিন্তার জায়গাটা অনেকটা ক্লিয়ার। তিনি লেখার চরিত্রের সঙ্গে প্রচ্ছদ মিশে যাওয়ার পক্ষে বলেছেন, এটা তো সত্য।
তবে এখানে একেকজন শিল্পীর চিন্তাধারা অবশ্যই আলাদা এবং তা হওয়া উচিতও। আমি মনে করি, লেখার গুণগত মানের ওপর নির্ভর করে শিল্পী তাঁর কাজটাকে কী আঁকবে আর কতটুকু নান্দনিকতায় ভরপুর করে তুলবে। একটা ভালো বই আর চটুল বইয়ের প্রচ্ছদ নিশ্চয়ই এক হবে না। এখন শিল্পী সিদ্ধান্ত নেবেন, তিনি চটুল বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকবেন কি না। এটা একান্তই তাঁর সিদ্ধান্তের ব্যাপার। আমি আঁকব না; কিন্তু কেউ না কেউ আঁকবেন। না হলে কাজ অসমাপ্ত থেকেই যাবে। প্রচ্ছদ বাদে বই প্রিন্ট কীভাবে হয়? তবে এ কথা সত্য যে, পেশাদারিত্বের জন্য সব ক্ষেত্রে নিজেকে সমর্পণ করব না, এটাই স্বাভাবিক। এখন আমাকে কেউ যদি উগ্রপন্থী মৌলবাদীদের পক্ষে কোনো বইয়ের প্রচ্ছদ করতে বলে, অবশ্যই সেটা আমি করব না। বা কুরুচিপূর্ণ কোনো বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকতে বলা হয়, সেটাও আমি করব না। আমি তো আমার দেশ বা আদর্শ থেকে বিচ্যুতি হতে পারি না।
প্রশ্ন : এবারের প্রচ্ছদে আপনি কী ধরনের পরিবর্তন আনছেন?
চারু পিন্টু : না, প্রচ্ছদে নতুন কিছু পরিবর্তন আনার তেমন কিছু নেই আমার। তবে এবার মনোক্রোম কালার আর ড্রইংয়ের ওপর বেশি প্রাধান্য দিয়েছি ।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে প্রচ্ছদশিল্প আলাদাভাবে শিল্প হয়ে উঠেছে কি না?
চারু পিন্টু : আসলে সেটা বলা মুশকিল। কেননা, শিল্প হয়ে উঠছে কি উঠছে না, সেটা পাঠকই বলবেন অথবা শিল্পসমালোচকরাই ভালো বুঝবেন। আমাদের জায়গা থেকে বলতে পারি, আমরা ভালো কিছু করার চেষ্টা করছি। এতটুকুই।
প্রশ্ন : তরুণরা কেউ যদি জীবিকার জন্য এটিকে পেশা হিসেবে নিতে চায়, তাদের সম্পর্কে আপনার উপদেশ কী থাকবে?
চারু পিন্টু : আমার মনে হয়, যেকোনো বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে নিলেই তা পেশা হয়ে উঠতে পারে, তা সে প্রচ্ছদ হোক আর ড্রেন পরিষ্কার করাই হোক। তবে প্রচ্ছদকে পেশা হিসেবে নেওয়ার আগে নিজের সঙ্গে নিজেরই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া উচিত এবং হাল না ছেড়ে দীর্ঘ সময় আঁকড়ে থাকা প্রয়োজন।
প্রশ্ন : লিটলম্যাগ যেহেতু নির্দিষ্ট কোনো থিমে হয় না, এ ক্ষেত্রে আপনি প্রচ্ছদ করার সময় কোন বিষয়টা খেয়াল করেন? আপনাকে প্রচুর লিটলম্যাগে প্রচ্ছদ করতে দেখি। যতদূর জানি, আপনি এর জন্য কোনো পারিশ্রমিক নেন না। এটা কি আপনি ভালো লাগা থেকেই করেন?
চারু পিন্টু : লিটলম্যাগ আমার কাছে একটা প্রাণের জায়গা। বাংলার লিটলম্যাগগুলো একেকটা একেক ধরনের কনসেপ্ট নিয়ে কাজ করে বিভিন্ন লিটলম্যাগ কর্মী। কেউ কেউ নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক কাজ করে, আবার অনেকেই প্রতিষ্ঠানবিরোধী কনসেপ্ট নিয়ে কাজ করে। তাদের যে নতুন নতুন চিন্তাধারা এবং বড় কাগজগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়া অনেক বড় ব্যাপার। কোনো অসংগতিকে কুর্ণিশ না করে একদল মানুষের দিনের পর দিন সংগ্রাম করে যাওয়া এটা অনেক বড় একটা ব্যাপার, বড় এক ঘটনা।
এই চিন্তাধারাকে আমি, আপনি সম্মান না জানিয়ে থাকতে পারি না। আর যাঁরা লিটলম্যাগ কর্মী, তাঁরা যে কতটা সঞ্চয় করে তিলে তিলে একটা কাগজের জন্ম দেন, সেটার উপলব্ধি অন্তত জানি। গাঁটের পয়সা খরচ করে এই পাগলামি সবাই করার ক্ষমতা রাখে না। আর লিটলম্যাগে অনেক লেখকের লেখার সমষ্টি নিয়েই কিন্তু ম্যাগকে দাঁড় করানো হয়। এখানে আমিও মনে করি, প্রত্যেক কর্মীর মতো অবশ্যই আমিও কর্মী এবং তাঁদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজেই কিছু কন্ট্রিবিউট করার চেষ্টা করি। আর যেহেতু লিটলম্যাগ কোনো বাণিজ্যিকধারা নয়, সেহেতু এখান থেকে পারিশ্রমিক নেওয়া আসলে আমার মনে হয় উচিত নয়। ১০টা-২০টা বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকার চেয়ে একটা লিটলম্যাগের প্রচ্ছদ আঁকাকে আমি অন্তত বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।