নুতন বই
অঘোর মণ্ডলের ‘এক্সট্রা কাভার’
স্কোর কার্ডকে পাশে সরিয়ে রেখে এ দেশে যাঁরা ক্রিকেট রিপোর্টিং শুরু করেন, সেই তালিকায় অঘোর মণ্ডলকে টপ অর্ডারের দিকেই রাখতে হবেন। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে অঘোরদাকে দেখেছি ঘাস মাড়ানো আপদমস্তক রিপোর্টার হিসেবে। দেশে-বিদেশে এক সঙ্গে ট্যুরও করেছি বহুবার। কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা কখনো পেশাদারত্বের বাউন্ডারি লাইন অতিক্রম করেনি। তবে বেড়েছে পরস্পরের কাজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। কারণ, অঘোরদার কাছে ক্রিকেটার, কর্মকর্তাদের চেয়ে ক্রিকেট খেলাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। খবরকে পূর্ণতা দিতে তাঁর লেখায় ঘুরে-ফিরে ক্রিকেটার ও কর্মকর্তারা এসেছেন। তবে সেটা সঙ্গত কারণেই। ইনিংস বড় করার পথে বড় ব্যাটসম্যানও অনেক কিছু ইম্প্রোভাইজ করার পাশাপাশি যেমন ছেঁটে ফেলেন কিছু আলগা শট, অঘোরদা তেমনি ক্যারিয়ারকে পথে অনেক কিছু ইম্প্রোভাইস করেছেন তাঁর লেখায়। পাল্টেছেন ভাষা, আঙ্গিক অনেক কিছু। কিন্তু ক্রিকেটীয় দর্শন থেকে স্টেপ আউট হননি কখনো।
ক্রিকেট কাভার করতে এক গোলার্ধ থেকে অন্যগোলার্ধ ঘুরে বেড়ানো অঘোর দা এবার পাঠকদের সামনে হাজির করতে যাচ্ছেন ‘এক্সট্রা কাভার’ নামক বইটি। যার মুখবন্ধ লেখার প্রস্তাবটা পেয়ে আমি একই সঙ্গে গর্বিত এবং উত্তেজিত। এটা আমার কাছে অজানা-অচেনা নতুন উইকেটে ব্যাট করতে নেমে পড়ার মতো। দাদাকে ধন্যবাদ জানিয়ে জানতে চেয়েছিলাম; ‘এত লোক থাকতে আমাকে বেছে নিচ্ছেন কেন!’ হাসতে হাসতে আমার প্রশ্ন বাউন্ডারির ওপারে ফেলে দিলেন যেন তিনি। বললেন, ‘বাংলাদেশ ক্রিকেটে যাঁর এমন গোটা দুয়েক রেকর্ড আছে, অন্যরা চাইলেও যা মুছে ফেলতে পারবেন না, সেই লোকটার হাতের ছোঁয়া আমার ক্রিকেট বইয়ে থাকবে না, তা কী করে হয়!’ আসলে এই হচ্ছে অঘোর মণ্ডল। কাউকে নিয়ে মুগ্ধতায় আবেগের বাড়তি উচ্ছ্বাস নেই্। আবার কারো প্রাপ্যটুকু দিতে সামান্যতম কাপার্ণ্য নেই। তাই কুমার সাঙ্গাকারা-মাইকেল ক্লার্কের বিদায় নিয়ে লিখতে গিয়ে টেনে এনেছেন স্যার ডনকে এবং খুব যৌক্তিকভাবে। মেলবোর্নে বিশ্বকাপ ফাইনাল শেষ হতে না হতে, সে রাতেই তিনি খুঁজেছেন ডেভিড বুন, রিকি পন্টিংকে! কারণ, তাসমানিয়ায় তাঁদের ছোট্ট শহর ল্যানচেস্টানে তৃতীয়বারের মতো ঢুকে পড়ল যে বিশ্বকাপ ফাইনালের ম্যান অব দ্য ম্যাচের ট্রফি। এভাবেই অঘোরদা তাঁর লেখায় তুলে এনেছেন জেমস ফকনারকে।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক পরিবর্তন যিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন, বড় অনেক সিদ্ধান্তের কথা সংবাদ মাধ্যমের অনেকের আগে জেনেছেন, তাঁর বইয়ে বাংলাদেশ উহ্য থেকে যাবে তা কী করে হয়? ব্রিসবেনে বসে তাই মার্ক টেলরকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে পারেন, ‘সাকিব বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সেটা মানতে আপত্তি কোথায়?’ টেলরের মুখ থেকে বের করে এনেছেন;‘ আমি তো আপত্তির কোনো কারণ দেখি না।’ আমি নিশ্চিত, ‘এক্সট্রা কাভারে’ পাঠক ক্রিকেটীয় এক্সট্রা অনেক কিছু পাবেন। যার কিছুটা ইতিহাসজাত। কিছুটা লেখকের নিজের অভিজ্ঞতাজাত।
তবে ১৬ বছর আগে নভেম্বরের এক সকালে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে এক ব্যাটসম্যানের খেলা দিনের প্রথম শট দেখে নাকি আমার ভাইকে অঘোর দা বলেছিলেন, ‘ সেঞ্চুরির আগে থামবে না এ ইনিংস। এখনো পারিবারিক আড্ডায় শফিক ভাই কথাটা প্রায়ই বলেন। কারণ, ব্যাটসম্যানের নাম ছিল বুলবুল। বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের দ্বিতীয় দিন ভারতের পেসার জাভাগাল শ্রীনাথকে এক্সট্রা কাভার দিয়ে বাউন্ডারি মেরেছিলাম দিনের শুরুতে। যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস নিয়ে। টাইমিংটাও হয়েছিল দারুণ। পরের টুকু সবাই জানেন। অঘোর দার এক্সট্রা কাভার নিয়ে বাড়তি কিছু লেখার দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না। আমি নিশ্চিত, ‘এক্সট্রা কাভার’ প্রথম সংস্কারণে সীমাবদ্ধ থাকবে না।
লেখক : সাবেক অধিনায়ক, জাতীয় ক্রিকেট দল বাংলাদেশ
(লেখাটি অঘোর মণ্ডলের নতুই বই ‘এক্সট্রা কাভারে’র মুখবন্ধ হিসেবে লেখা হয়েছে। বইটি বের করেছে তৃণমূল প্রকাশনী।)