পিয়াস মজিদের গল্পগ্রন্থ নগর ঢাকায় জনৈক জীবনানন্দ
পিয়াস মজিদ মূলত কবি হিসেবেই পাঠকদের মধ্যে অধিক পরিচিত। তাঁর মননশীল গদ্যলেখাও সবার নজর কেড়েছে সংযমী লেখনী ও সারবান বিশ্লেষণক্ষমতার কারণে। কিন্তু তাঁর কথাশিল্পী-সত্ত্বাও যে কোনোক্রমেই উপেক্ষার নয়, তা বোঝা গেল সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ নগর ঢাকায় জনৈক জীবনানন্দ পাঠান্তে। বাহ্যিক আয়তনে মাত্র চার ফর্মার বই, ক্রাউন সাইজ। মোটমাট সাতখানা গল্পের সমষ্টি। আকারে খুব বড় নয়, কিন্তু বইটিতে অন্তর্ভুক্ত গল্পগুলোর ভেতরকার বীক্ষণ-আকাঙ্ক্ষা ও ভাবনা-বিস্তার ―দুই-ই অত্যন্ত বৃহৎ সম্ভাবনা ও আয়তন নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়।
প্রথম গল্প মনে করি এই গল্প গার্সিয়া মার্কেসের কথাই ধরা যাক। এ কি কেবল এক মহান কথাশিল্পী গাবোর বয়ান নির্ভর করে তাঁকে গল্পের ভঙিমায় শ্রদ্ধা জানানো? মোটেও তা নয়। গার্সিয়া মার্কেসের কথনবিশ্ব কিংবা চিন্তাজগতের সাথে বোঝাপড়া করতে করতেই গল্পকার এখানে নিজের স্বকাল-স্বদেশের সাহিত্য কি সমাজকেও বিচার করতে থাকেন। মার্কেজের হত্যাকাণ্ডময় কলম্বিয়ার সাথে মিলিয়ে পিয়াস মিলিয়ে নেন বাংলার কোনো এক গণহত্যাধস্ত অঞ্চলকেও : আমি যেমন কলাবাগিচা হত্যাকাণ্ড- ভুলিনি সারাজীবন তেমনি আপনারাও ভুলবেন না আপনাদের ১৯৭১। গণহত্যার রাত; সে কলম্বিয়া কিংবা মংলা যেখানে হোক তা বিস্মৃত হওয়া মহাপাপ।
আবার নামগল্পটির কথাই ধরা যাক। স্থান : বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের ঢাকা শহর। ঘটনাচক্রে সেখানে হাজির হয়েছেন কবি জীবনানন্দ দাশ(এ কি কোনো পুনর্জন্মের ঘটনা? পিয়াস অবশ্য এটি রহস্যের মোড়কেই রেখে দিয়েছেন।)। রাজধানী শহরে বহুমাত্রিক জীবনানন্দ-ব্যবসা ও নানাবিধ তৎকেন্দ্রিক আড়ম্বরের মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাঁকে। অভিজাত আলোচনা সভা, জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকার ক্রোড়পত্র, মোবাইল ফোনের রিংটোন থেকে আরম্ভ করে রেস্টুরেন্টের নাম― কোথায় নেই তিনি! অতঃপর ইত্যকার আয়োজনের যন্ত্রণায় তিতিবিরক্ত জীবনানন্দ নিষ্কৃতির সন্ধানে রওনা দেন বরিশাল পানে। এই হয়তো গল্পটির মূল কাহিনী-কাঠামো, কিন্তু এর শক্তিমত্তা নিহিত আদতে অন্য জায়গায়। ফ্যান্টাসি বা কমিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে নয়, এক ধরনের নির্মোহ বয়ানের মাধ্যমে জীবনানন্দকে ঢাকা শহরে ফিরিয়ে এনে গল্পকার চোখে আঙুল দিয়ে এই ভড়ংময় মেট্রোপলিটনের সাহিত্য-সমাজের তাবৎ কৃত্রিম আয়োজনের প্রতি এক নীরব বিদ্রƒপই যেন বা ছুড়ে দেন। কেউ কেউ অবশ্য এটিকে নিছক ফ্যান্টাসি গল্প হিসেবে গণ্য করতে চাইবেন, কিন্তু তলিয়ে পড়লে আসল ক্যারিশমাটা টের পাওয়া যাবে। আর গদ্যচালের মধ্যে এক ধরনের সূক্ষ্ম রসবোধ চারিয়ে দেওয়াতে আলাদা ধরনের উপভোগ্যতা তৈরি হয়েছে গল্পটিতে। শশীকুসুম অন্তর্জাল আবার নেটভিত্তিক বাস্তবতার অন্তর্গত হিম ও উত্তাপময় সময়কে ভিন্নতরভাবে প্রকাশ্য করে তোলে আমাদের নিকট। অপরদিকে, কোথায় পাব শহীদুলকে গল্পটিও এ রকম উন্মোচনকামী বৈশিষ্ট্য ধারণ করে রয়েছে। এ গল্প কথোপকথনের আঙ্গিকে শুধু কথাকার শহীদুল জহিরকেই চেনায় না, চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের শিল্প-সমাজ-সময়ের হাড়হাড্ডিময় বাস্তবতাকেও দেখিয়ে দেয়।
ঝরাপাতা জয়ন্তী এপিটাফের ঘ্রাণও জীবন ও ফ্ল্যাশ-মব বাস্তবতা গল্প তিনটির মধ্যে কি কোনো গূঢ় ঐকতান লভ্য? বর্তমান আলোচকের পড়তে গিয়ে অন্তত তাই মনে হয়েছে। নাগরিক বাস্তবতা থেকে মনোজগতের বিচ্ছিন্নতা― দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুর ঘ্রাণই মিলেমিশে যায় এই তিনটি গল্পে। ঝরাপাতা জয়ন্তে পড়ি : নির্বাচনী তফসিল, কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচি, দুর্নীতির বন্যা, কাফকার কয়েদ কলোনি, শান্তিনিকেতনের স্মৃতি, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, আসন্ন বিসিএস প্রমুখ নানান বিষয় থাকলেও গল্পটা যাচ্ছে অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের দিকে। ব্যক্তিমানুষের ক্রমাগত পুড়তে পুড়তে বিলয় হবার গল্পই যেন নানান মাত্রায় পিয়াস বর্ণনা করে চলেন এই গল্পত্রয়ীতে।
সবার শেষে থাকা এক যে ছিল ফেসবুক অবশ্য একেবারেই ভিন্ন ধরনের গল্প। বইয়ের অন্য গল্পগুলোর সঙ্গে একে মেলানোর চেষ্টা না করাই ভালো। আর গল্প তো অনেক ধরনেরই হয়।
পিয়াস মজিদ প্রথাগত আখ্যানের পথে না হেঁটেই যে নতুন কথন-শৈলীর নির্মাণ করতে চেয়েছেন, তাকে সাধুবাদ জানাই। বৈচিত্র্যের সন্ধানী যেকোনো কথাসাহিত্যমোদি পাঠক এই বই থেকে ভাবনার ও ভাঙনের বহু উপাদান খুঁজে পাবেন, এমন আশা তো আমরা করতেই পারি।
নগর ঢাকায় জনৈক জীবনানন্দ।। প্রচ্ছদ-ধ্র“ব এষ।। ৬৪ পৃষ্ঠা।। ফেব্র“য়ারি ২০১৬।। প্রকাশক-অন্যপ্রকাশ।