স্মৃতিচারণ

হুমায়ুন আজাদ আমার বাবা ও বইমেলা

Looks like you've blocked notifications!

প্রয়াত লেখক হুমায়ুন আজাদ আমার বাবা। ভালোবাসতেন বই আর বইমেলাকে। যেকোনো ধরনের বই পড়া ছিল তাঁর কাছে নেশার মতো। আর বইমেলাকে যেন তিনি রীতিমতো নিজের মধ্যে ধারণ করতেন। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে যাওয়া/আন্তর্জাতিক সেমিনারে এটেন্ড করার প্রতি কখনো তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখিনি। তাঁর স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়ানোর একমাত্র জায়গা ছিল বাংলা একাডেমির বইমেলা। মনে হতো, বছরের এই মাসটির জন্যই তিনি মুখিয়ে থাকতেন। সাজানো-গোছানো কোনো কেন্দ্রের চোখধাঁধানো আয়োজনে নয়, ধুলোয় মাখা বইমেলাতেই কেবল শ্বাস নিতে পারতেন তিনি। আর কোথাও গিয়ে তাঁকে সবার সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যে মিশতেও দেখতাম না। বলা বাহুল্য, তাঁর ঠোঁটকাটা স্বভাবের জন্য প্রিয় মানুষের সংখ্যা ছিল নেহাতই কম। আর সেসব হাতেগোনা প্রিয় মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়ার মোক্ষম জায়গা যেন ছিল এই বইমেলা। বোধহয় প্রিয় মুখগুলোর সঙ্গে দেখা হবে ভেবে মনে মনে শান্তিও পেতেন।

অক্টোবর থেকেই বাসার সবাই বুঝতাম, সামনে বইমেলা আসছে। তাঁর রুমের পাশ দিয়ে গেলে শুনতাম, কম্পিউটারে লেখার খটখট শব্দ। লেখা যখন প্রায় গুছিয়ে আনতেন, বাকি থাকত কেবল প্রুফ রিডিং, প্রচ্ছদ তৈরি আর ট্রেসিংয়ের কাজ। নিজ হাতেই বেশির ভাগ কাজ করতে চাইতেন। বইয়ের প্রচ্ছদের ব্যাপারে ভীষণ খুতখুতে ছিলেন। প্রচ্ছদশিল্পী সমর মজুমদার কাকা বাসায় আসতেন। কীভাবে আরো প্রচ্ছদে বইকে ফুটিয়ে তোলা যায়, সে বিষয়ে তো নানা পরিক্ল্পনা। পুরোনো বইয়ের নতুন প্রচ্ছদ হবে কি-না, এ বিষয়ে ওসমান গণি চাচার সঙ্গে আলাপ করতে দেখতাম। ফেব্রুয়ারির বইমেলাকে সার্থক করার জন্য তিনি অক্লান্তভাবে অক্টোবর থেকে কাজ করে যেতেন। তখন আমি এসব কিছুই বুঝতাম না। মাঝেমধ্যে মনে হতো, এসব তাঁর বাড়াবাড়ি। আর কদিন বাদেই তো এবারের বইমেলা। হয়তো লেখকরা সেই বাড়াবাড়িতে এখন ব্যস্ত। কিন্তু আজ আর কোনো বাড়াবাড়ি নেই আমাদের বাসায়, সবই স্তব্ধ।

‘আগামী প্রকাশনী’ থেকে তাঁর সব বই প্রকাশ পেত। প্রতিবছর কম করে হলেও পাঁচটি বই প্রকাশ পেতই। প্রথম দিকে তিনি স্টলে বসতেন না। একা একাই সারা বইমেলায় ঘুরে বেড়াতেন। সাক্ষাৎকার দিতেন। আর যদি ক্লান্ত হতেন, তখন তাঁর প্রিয় মানুষদের নিয়ে চটপটির স্টলে (তখন বইমেলার বাইরে খাবার স্টল বসত) বসে খেতেন আর আড্ডা দিতেন। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা বইমেলা না ঘুরে তিনি আগামীর স্টলেই বসতেন। ফেব্রুয়ারি মাসে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত আগামীর স্টল ছিল তাঁর প্রধান ঠিকানা। তাঁর পাঠকদেরও এ জন্য হয়েছিল বিশেষ সুবিধা। বাবার বেশির ভাগ বই যেহেতু ছিল বিশ্লেষণধর্মী, গতানুগতিকতার বাইরে, তাই পাঠক তাঁকে স্টলে বেশ ভালোভাবেই পেয়ে বসতেন। সে সময় বেশ কয়েকবার তাঁর সঙ্গে স্টলে বসার সুযোগ হয়েছিল আমার। চুপচাপ পেছনে বসে থাকতাম। বাবা আর তাঁর পাঠকদের কথা শুনতাম। একবার এক পাঠক তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কবি আথবা দণ্ডিত অপুরুষ’ বইয়ের নায়ক কি বাবা নিজেই নাকি? তাঁকে এর উত্তরে কেবল মৃদু হাসতে দেখেছি।

‘স্যার, সবকিছু ভেঙে পরে উপন্যাস লেখার পর আপনার পরিবারে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না বা নারী বইটা লিখতে স্যার কত সময় লেগেছে—এসব ছিল তাঁদের কমন প্রশ্ন।

‘স্যার, আপনার উপন্যাসগুলোতে আমাদের সমাজের এত বাস্তব সত্য চলে আসে যে ভয় লাগে। স্যার, আপনার ভীষণ সাহস।’

বাবা উত্তরে বললেন, ‘সত্যি কথা লিখলে বুঝি সাহস হয়, আমি তো কখনো ১০ তলা থেকে লাফ দিতে পারব না। ’

পাঠক : স্যার, সাবধানে থাকবেন। আপনার জন্য ভয় হয় ভীষণ।

বাবা : সাবধান কীভাবে হয় বলুন তো?

পাঠক : স্যার, লোকজন নিয়ে ঘুরবেন।

বাবা : আমি চিরকালের একা মানুষ।

এর পর আর কিছু কি বলার থাকে কারো?

তবে মাঝেমধ্যে ঘটনা অন্য রকম হতো।

পাঠক : স্যার, ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ বইটা পড়ে রাতে ঘুমাতে পারিনি। কিশোরদের জন্য গ্রামের সবকিছুর এত চমৎকার বর্ণনা আগে কোনো বইয়ে পাইনি। বইয়ের শুরুতে যে ‘মৌলির’ কথা বলেছেন, বই পড়ে তার প্রতি খুব হিংসা হয়েছে।

বাবা হেসে বললেন তাই! এ যে মৌলি, ওইখানে বসা।

পাঠক ও আমি দুজনেই লজ্জিত।

পাঠকদের সঙ্গে নানা কথার ফাঁকে তিনি তাঁদের বাড়িয়ে দেওয়া বইয়ে অটোগ্রাফ দিয়ে যেতেন। মুক্তোর মতো সুন্দর হাতের লেখা ছিল। বেশির ভাগ সময়ে অটোগ্রাফে শুভেচ্ছা জানাতেন। নতুন বই বের হলে তিনি আমাদের বাসার সবাইকে অটোগ্রাফসহ বই উপহার দিতেন। আমাকে অটোগ্রাফে বেশির ভাগ সময়ই লিখতেন, ‘মৌলিমণি...’।

যা দেখলে আজ এত বছর পরও মনটা ছটফট লাগে।

বইমেলায় বাবার পাশে সব সময় আগামী প্রকাশনীর ওসমান গণি চাচা থাকতেন। ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতেই তাঁরা দুজন একসঙ্গে শহীদ মিনারে যেতেন। বাসায় ফিরতেন ভোরের সময়। দরজা খোলার দায়িত্বটা আমার ওপরেই পড়ত এবং যথারীতি আমি বিরক্ত হতাম। আজ এক যুগ হয়ে গেল (সত্যিই!!!!!!!!)। আমাকে এখন আর বিরক্ত করার কেউ নেই।

বইমেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হওয়ায় তিনি বইমেলাকে বড্ড নিরাপদ ভাবতেন। কিন্তু ফুলের বাগানেও যে সাপ থাকে। মানুষরূপী বিষাক্ত সাপগুলোর নজরদারিতে যে তিনি ছিলেন, বোধহয় আঁচ করতে পারেননি তিনি। শিক্ষক মানুষ ছিলেন তো, তাই ভেবেছিলেন তাঁর যেকোনো লেখার জবাবই হয়তো প্রতিপক্ষ দেবে আরো কড়া কোনো ভাষায়। বড়জোর তাঁর কোনো বই হবে বাজেয়াপ্ত। কিন্তু বইমেলার সামনে রাস্তায় তাঁর মতো একজন শিক্ষক ও লেখককে কেউ চাপাতি দিয়ে হত্যা করতে আসবে, তা ঘুণাক্ষরেও তিনি চিন্তাও করেননি (আহত হওয়ার পরও তিনি তা বিশ্বাস করতে পারেননি)।

বারো বছর আগে (২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ সালে) বইমেলার রাস্তায় তিনিই প্রথম আক্রান্ত লেখক। এসব ঘটনা আজ পুরোনো। আজ বইমেলার সামনে যে তথাকথিত সিকিউরিটি থাকে, তা বোধ হয় তাঁরই রক্তের ফসল। বাবা চলে গেছেন এক যুগ হয়ে গেল। আজ তাঁকে ছাড়াই বইমেলায় যাই। এখন বইমেলার পরিসর অনেক বেড়েছে। চারপাশে টিভি চ্যানেলের ভিড়, বিভিন্নজনের নামে তৈরি চত্বরের (তাঁর মতো একজন বিখ্যাত লেখক ও ভাষাবিদের নামে কি কোনো চত্বর থাকতে পারত না বইমেলায়?) পাশ দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে আগামীর স্টলে আসি। দেখি তাঁর বইগুলো দেদার বিক্রি হচ্ছে।

মনে হয়, তাঁর লেখা বইগুলোই তাঁর দ্বিতীয় উপস্থিতি। বইমেলা তো লেখক-পাঠকদের এক হওয়ার জায়গা, তাই না। কিন্তু সে বইমেলা প্রায়ই যখন কোনো লেখকের রক্তে ভেসে যায় তখন তাকে ‘কি’ বলা যায়? তারচেয়ে বরং এই ভালো...রাঢ়িখালের মাটিতে শুয়ে আছেন তিনি... তাঁর মতো একজন সংবেদনশীল লেখকের ‘রক্তাক্ত বইমেলা’ দেখতে নিশ্চয়ই ভালো লাগত না, তাই না???