‘পারদের মতো ভারী কিন্তু খুবই অস্থির এক সময়ের’ কবি
কবি রফিক আজাদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ১৯৭৫-৭৬ সালের দিকে, সম্ভবত সায়ীদ স্যারের (আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ) বাসায়, কণ্ঠস্বরকেন্দ্রিক আড্ডায়। স্যারের গ্রিন রোডের বাসায় তখন সেই সময়ের প্রতিষ্ঠিত কবি-লেখকদের সপ্তাহান্তের নিয়মিত আড্ডায় আমরা লেখক-যশপ্রার্থীরা রবাহুতভাবে উপস্থিত হলেও অনাহূত বলে বিবেচিত হইনি। আমরা মানে রুদ্র (রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লা), কামাল (কামাল চৌধুরী), ইফতেখার (ইফতেখারুল ইসলাম), মোমেন (আবদুল মোমেন/আন্দালিব রাশদি) এবং আরো অনেকে। আমরা তখন সবেমাত্র লেখালেখির জগতে পা রাখছি, হাঁটিহাঁটি পা পা না হলেও প্রতিষ্ঠিত লেখকদের তুলনায় নস্যি মাত্র। সেই আড্ডায় আমাদের, বিশেষত আমার, কাজ হচ্ছে শোনা। হুদা ভাইয়ের (মুহম্মদ নূরুল হুদা) সঙ্গে পূর্বপরিচয়ের সূত্রে এবং সুলতানা রেবুর কল্যাণে আমি সেখানে জায়গা পেয়েছিলাম। পরিচয় সেখানে হলেও রফিক ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় বাংলা একাডেমিতে। রফিক ভাই তখন উত্তরাধিকার নামের সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক।
দেশের অন্যতম সাহিত্য পত্রিকা উত্তরাধিকার, সেখানে লেখা ছাপা হওয়াটা এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। সে সময়ে দেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্য ও শিল্পকলাবিষয়ক পত্রিকা বেরোয় অসংখ্য, প্রতিটির মান ঈর্ষণীয়। তার সঙ্গে আছে লিটল ম্যাগাজিন। আমার বন্ধুরা অধিকাংশ কবি; ইফতেখার, মোমেন আর আমি কবিতা লিখি না; মোমেন আর সাবের গল্প লেখে—আমি আর ইফতেখার শুধু প্রবন্ধ। প্রধানত গদ্য লেখার কারণে আমরা ততদিনে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় ছাপা লেখার সূত্রে যৎকিঞ্চিৎ পরিচিত। আমাদের লেখা আর বয়সের মধ্যে কোনো মিল নেই এমন কথা শুনে আমরা অভ্যস্ত।
এ সময়ে রফিক ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পাওয়ার আরেক কারণ হচ্ছেন হুদা ভাই, বাংলা একাডেমিতে তাঁর অফিস আমাদের অলিখিত ঠিকানা। আমরা তখন সাহিত্য আন্দোলনের স্বপ্ন ও ঘোরের মধ্যে আছি। প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে আমাদের বিদ্রোহ ঘোষিত হয়েছে। সেই বিদ্রোহের সাথি হুদা ভাই। কিন্তু আমাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে আমাদের আগের দশকের লেখকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা, সেই দশকের অন্যতম প্রধান কবি হুদা ভাই আছেন আমাদের সঙ্গে। আমাদের একটা অন্যতম বক্তব্য হচ্ছে, ষাটের দশকের কবিতা বাংলাদেশের সমকালের মর্মবাণীকে ধরতে পারেনি, তাঁদের কবিতার মধ্যে আছে আছে অবক্ষয়ের ছবি। বাংলাদেশের মানুষ যখন এক গৌরবজনক জাগরণের মধ্য দিয়ে গেছে, সেই দশকের কবিরা কেন কেবল হতাশা ও অবক্ষয়ের কথা শোনালেন, তা নিয়ে আমাদের প্রবল ক্ষোভ ছিল। সেই সময়ের প্রতিনিধি হিসেবে, আমরা কবি হিসেবে রফিক আজাদকেই শনাক্ত করেছিলাম। ষাটের দশকে পশ্চিমের ‘হাংরি জেনারেশন’ তাঁদের যতটা প্রভাবিত্য করেছে, দেশের মানুষের সংগ্রাম ততটা তাঁদের উজ্জীবিত করেনি। আমরা একে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা বলেই চিহ্নিত করেছিলাম। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে রফিক আজাদের কবিতা, বিশেষত স্বাধীনতা-পূর্বকালের কবিতার স্বর বিস্মিত করত যখন আমি জানি যে রফিক ভাই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন। ততদিনে রফিক ভাই তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতা, ‘ভাত দে হারামজাদা’ লিখে ফেলেছেন, তাঁর সেই পঙ্ক্তিমালা ১৯৭৪-৭৫ সালের এক অনন্য দলিল হয়ে উঠেছে। রাজনীতিতে যাঁরা আওয়ামী লীগের সমর্থক, তাঁদের কাছে রফিকের ভাইয়ের সেই কবিতা আপত্তিকর। তার পরও তাঁর কবিতার প্রধান সুর হিসেবে আমরা তাঁর সমসাময়িকদের মতোই একধরনের ‘রাজনীতি-বিমুখতা’ দেখতে পাই। একে আমরা এক ধরনের আত্মকেন্দ্রিকতা বলে বিবেচনা করি। সেটা অনেকাংশেই তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘অসম্ভবের পায়ে’র কবিতা থেকে আহরিত।
এই প্রেক্ষাপটে আমাদের সাহিত্য আন্দোলনের মূলবাণী এবং স্লোগান হয়ে ওঠে, ‘শিল্প ও রাজনীতি একই জীবনের দুই রকমের উৎসারণ’। এখন ভেবে অবাক হতে হয় যে আমরা স্লোগান হিসেবে যা তৈরি করেছিলাম, তা ছিল তিরিশের দশকের সবচেয়ে আপাত-রাজনীতিবিমুখ কবি জীবনানন্দ দাশের বাক্য থেকে ধার করা। আমাদের সেই তারুণ্য-উদ্দীপিত সাহিত্য আন্দোলনে ছিল রুদ্র, কামাল, জাফর (জাফর ওয়াজদ), মুক্তি (শাহজাদী আঞ্জুমান আরা), সাবের (মইনুল আহসান সাবের), মিনি (প্রয়াত আবিদ রহমান), জ্যোতি (প্রয়াত সাজ্জাদ হোসেন), সলিমুল্লাহ খান এবং আরো অনেকে। এরই মধ্যে আমরা আমাদের ঘোষণাপত্র হিসেবে ‘ঘোষণা’ লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছি, নিয়মিতভাবে বেরোচ্ছে ‘নক্ষত্রবীথি’ কবিতাপত্র, ১৯৭৮ সালের গ্রীষ্মকালে বেরোয় প্রবন্ধ সংকলন ‘স্বরূপ অন্বেষা’ এবং আমাদের মুখপত্র হিসেবে ‘বিশ্বাস’ নামের একটি পত্রিকার এক সংখ্যা আমরা বের করি। আমাদের সামনে তখন রফিক আজাদ সম্পাদিত ষাটের দশকের লিটল ম্যাগাজিন ‘টিপসহি’ হচ্ছে আদর্শ স্থানীয়। আদর্শ এই অর্থে যে টিপসহি লিটল ম্যাগাজিনটি খুব বেশি সময় না বেরোলেও ষাটের দশকের সাহিত্যের একটি নিজস্ব ধারা তৈরি করতে পেরেছিল। আমরা সেই ধারার সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে আমাদের আন্দোলনের কথা যখন ভেবেছি, তখন আমার টিপসহি-কেই ওই সময়ের প্রতিনিধি বলে ধরে নিয়েছিলাম। আমাদের সেই সাহিত্য আন্দোলনের মুখে ষাটের দশকের লেখকরা দীর্ঘদিন পরে ‘টিপসহি’র একটি নতুন সংখ্যাও বের করেছিলেন।
আমাদের এসব কার্যক্রমের সময়ও আমাদের আড্ডার জায়গা বাংলা একাডেমিতে হুদা ভাইয়ের অফিস আর উত্তরাধিকার পত্রিকার সম্পাদক রফিক আজাদের টেবিল। আমরা কখনো যৌক্তিক এবং কখনো আবেগতাড়িত হয়ে ষাটের কবিদের সমালোচনা ও আক্রমণ করে যাচ্ছি, তাঁদের সময়ের প্রতিনিধি হিসেবে রফিক ভাইকে হরহামেশা সমালোচনায় জর্জরিত করছি; কিন্তু সম্পাদক হিসেবে, অগ্রজ লেখক হিসেবে বন্ধুর মতো করে তিনি আমাদের সঙ্গে কবিতা নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করছেন। আমাদের সময়কালের কবিদের লেখা প্রকাশে তিনি হচ্ছেন অগ্রণী। আমাদের সমালোচনায় তিনি নৈর্ব্যক্তিক, আমাদের লেখার গুণের প্রশংসায় তিনি উদার, দুর্বলতা শনাক্তে তিনি দ্বিধাহীন। আমাদের লেখা নিয়ে তাঁর উৎসাহ অপরিসীম। আমার মনে পড়ে যে দৈনিক বাংলা বা ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় আমার বা ইফতেখারের লেখা ছাপা হওয়ার পর দেখা হলে রফিক ভাই অবশ্যই সে বিষয়ে তাঁর মন্তব্য জানাতেন; তিনি যে গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে তা পড়েছেন, সেটা আমি বুঝতে পারতাম। তিনি কোনো দিন আমাকে বলেননি, ‘তোমার লেখা দেখলাম’; তাঁর বাক্যটা শুরু হতো আমার প্রবন্ধের কোনো একটি বিষয় নিয়ে, যার সঙ্গে তিনি একমত অথবা ভিন্নমত পোষণ করতেন।
১৯৭৭ সালে তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ বেরোল। নতুন কবিতার বই বেরোলে তা আদ্যোপান্ত পাঠ এবং আমাদের বন্ধুদের মধ্যে তা নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক তখন অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়। আক্ষরিক অর্থেই আমার আমাদের ভাগ করে খাওয়া চায়ের কাপে ঝড় তুলি। আমাকে অবাক করে দিয়ে রফিক ভাই একদিন আমাকে তাঁর বইয়ের একটা কপি দিয়ে বললেন, এর একটা রিভিউ লিখবে? আমি রফিক ভাইকে বললাম, আমি আপনার কবিতার সমালোচক। তাঁর উত্তর, সে জন্যই তো তোমাকে রিভিউ লিখতে বলছি। আমার বিস্ময় কাটে না। ‘কোথায় ছাপাব?’ এই প্রশ্নের উত্তর, যেখানে তোমার মতো করে লিখতে পারবে। আর কোথাও না হলে উত্তরাধিকারে দিও। এখানে ছাপা হবে। আমি দিন কয়েক পরে ফিরে গিয়ে জানালাম যে তাঁর এই বইটির আলাদা করে রিভিউ লিখলে সেটা ঠিক হবে না, আমার ধারণা এটা তাঁর কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে একটা মোড় ফেরানো বই। একে দেখতে হবে তাঁর আগের দুই গ্রন্থ ‘অসম্ভবের পায়ে’ এবং ‘সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে’র সঙ্গে একত্রে মিলিয়ে, তাঁর সঙ্গে তুলনা করে। ফলে এটি একটি প্রবন্ধের আকার নেবে, বই সমালোচনা হবে না। রফিক ভাই আমাকে জানিয়ে রাখলেন, সেটা উত্তরাধিকারে ছাপার ব্যাপারে তাঁর কোনো আপত্তি নেই।
আমি আলোচনাটি লিখে রফিক ভাইকে দিলাম, সম্ভবত ১৯৭৮ সালের গোড়ার দিকে। রফিক ভাই সযত্নে লেখাটা পড়লেন। ব্যাকরণগত কিছু ত্রুটি, বানানের ভুল সংশোধন ছাড়া আর কিছুই বদলালেন না। লেখাটা ছাপা হলো উত্তরাধিকারে, শিরোনাম, ‘সুন্দরের দিকে চোখ রেখে’। তাঁর কবিতা থেকে নেওয়া একটি লাইন। (রফিক ভাইয়ের কবিতার এই পঙ্ক্তি থেকেই ১৯৯৪ সালে দিব্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত আমার সাহিত্যবিষয়ক রচনার সংকলন ‘সুন্দরের দিকে’র নামকরণ)। লেখাটা ছাপা হওয়ার পর রফিক ভাইয়ের প্রশংসা শুনে আমি থ হয়ে গেলাম। আমি লিখেছিলাম, ‘একজন কবিকে যে মানবিকতার ঝাণ্ডা তুলে ধরতে হয়, একজন শিল্পীকে যে শেষাবধি এক অকল্পনীয় মানবিকতার স্তরেই উঠে আসতে হয়, রফিক আজাদ তা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছেন এবং তা পেরেছেন বলে মানুষের প্রতিনিধি হয়ে এই হীন-বিরুদ্ধ প্রতিবেশে মানবিকতার লালফুল ফোটানোর সাধনায় তিনি নিবেদিত।’
“রফিকের সমাজ ঘনিষ্ঠতা কতদূর বিস্তৃত, তা নির্ণয় খুব একটা কষ্টকর কাজ নয়। কেননা, তাঁর প্রধান প্রবণতাই হচ্ছে নিজকে স্পষ্ট এবং তীক্ষ্ণ করে উপস্থাপিত করা। ‘পারদের মতো ভারী কিন্তু খুবই এক অস্থির এক সময়ের জলে’র ওপরে একটি ‘সংকীর্ণ সাঁকো’তে (ঘড়ির কাঁটার মতো, পৃ-৩০) দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি; যখন দুঃসময় গ্রাস করে আছে বহুদূর লোকালয় (অশ্রুজলে ধোয়া পথে, পৃ.-৩৫), যখন ‘সৈনিকের ভারী বুট, ট্যাঙ্কের ঘর্ঘর’ (এই রাতে, পৃ.-৪৩) রাত্রির নীরবতাকে ভেঙে দিচ্ছে, ‘রুঢ় বাণিজ্যিক সভ্যতার মার খেয়ে’ ‘যুগের কিছু প্রকৃতপ্রতিভা’... সংগত কারণে ‘মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে’, যে সময় ‘প্রতিটি সংসার ব্যায়ামের আখড়া খুলেছে’ (চলে যাবো সুতোর ওপারে, পৃ.-৫৮)—সে সময় রফিক ‘সভ্যতার সুতিবস্ত্রগুলো ফেলে পথে নেমে... সম্পূর্ণ শৃঙ্খলমুক্ত, যথারীতি সবাক, স্বাধীন’ হতে চেয়েছেন।” রফিক আজাদের কবিতার তিন পর্বের ধারাবাহিকতার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয়েছিল, ‘একজন ব্যক্তিকতাচ্ছন্ন কবি ব্যক্তিমোহব্যুহ ভেঙে ইতিহাস ও সভ্যতার ধারাক্রমে বিশ্বাসী একজন মানবিক কবি হয়ে উঠেছেন।’
এর পরে অনেক সময় গেছে, গত দুই-আড়াই দশকে রফিক ভাইয়ের কবিতা নিবিষ্ট চিত্তে পড়বার সুযোগ হয়নি; আমার প্রবাস জীবন, পেশা ও গবেষণার বিষয়ে পরিবর্তনের কারণে এবং সময়াভাবে সাহিত্য জগতের আলো থেকে দূরে আছি। মাঝেমধ্যে কবিতা পড়বার সৌভাগ্য হয়। বিচ্ছিন্নভাবে রফিক ভাইয়ের কবিতাও পড়েছি, মনে হয়েছে রফিক ভাই ‘চুনিয়া আমারে আর্কেডিয়া’ বইয়ে তাঁর পথযাত্রার যেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, সে পথে হেঁটেছেন অনেকটা পথ। প্রবাস জীবনের আরেক দুর্ভাগ্য হলো রফিক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়নি অনেক দিন। এখন আরেক ‘পারদের মতো ভারী কিন্তু অস্থির সময়ে’ তিনি ‘পায়ে হেঁটে বা পদব্রজে’ যাত্রা করলেন অনন্তের পথে। এই জীবনে রফিক ভাইয়ের সঙ্গে আর দেখা হবে না, আগামী জীবনে হবে কি?