রফিক আজাদ বাংলা কবিতার সন্তান
অকালপ্রয়াত বোনের ‘জীবন’ ধারণ করে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন রফিক আজাদ। বোন চলে গিয়েছিলেন রফিক আজাদ ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই, কিন্তু জীবনটা রেখে গিয়েছিলেন অনাগত ভাইয়ের জন্য নিবিড় আনন্দে। আর এই যে চলে গেলেন রফিক আজাদ, তিনি রেখে গেলেন কী? তা কি অনাগত দেহে প্রাণ সঞ্চার করে ভবিষ্যৎকাল কাটাবার শক্তি জোগাবে? নাকি নিরেট বস্তুর জড়ত্ব নিয়ে এ ঘাট থেকে ও ঘাট হাঁপিয়ে বেড়াবে?
না তো তেমন করে বোধকরি একবারও ভাবেননি তিনি। তিনি দাসত্ব করেছিলেন কবিতার, আর কবিতা তার কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিল অমরত্ব। কোথাও প্রস্থান করে নয়, বরং এক জীবন বেঁচে থেকেই তিলে তিলে কণা কণা শ্বাসপ্রশ্বাস একটি একটি পঙ্ক্তির বিনিময়ে ফতুর করেছিলেন এবং শেষ শ্বাসটুকু ফুরোবার আগ পর্যন্তও কেবল কবিতাতেই ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত করেছেন নিজেকে। একবার গল্পচ্ছলে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘তোমাদের মতো বয়সে প্রতি বইমেলায় অন্তত দু-তিনটি করে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছি। আর আজ চেষ্টা করে ১০ বছরেও একটি বই লেখা সম্ভব হয়ে ওঠে না।’ বুঝতে ভুল হওয়ার কথা নয়, তিনি সর্বদাই মগ্ন থাকতেন, এমনকি ১০ বছর পর্যন্ত মগ্ন থাকতেন একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের ব্যাকুলতায়। রফিক ভাইয়ের সঙ্গে যতবারই দেখা হয়েছে : আলোচনার বিষয় করে নিয়েছেন তরুণ কবি আর সাম্প্রতিক কবিতাকে। তাঁর পাঠকক্ষে ব্যাপকভাবে পঠিত হয়েছে তরুণ কবির কবিতা।
২০০৮ সালে আমি কবিতায় এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কার পাবার পর একটি সাহিত্য আড্ডায় দেখা হয়েছিল রফিক ভাই ও দিলারা আপার সঙ্গে। ওই প্রথম দিলারা আপার সঙ্গে আমার মুখোমুখি দেখা ও কথা। রফিক ভাই, আমার দিকে হাত তুলে আপাকে বললেন, ‘ওই দেখ আমার প্রিয় কবি আসছে’ ভীষণ লজ্জা পেয়েছিলাম সেদিন। জানলাম আমার প্রাপ্ত ওই পুরস্কারের জুরি বোর্ডে ছিলেন দিলারা আপা। রফিক ভাই হাসতে হাসতে বললেন, ‘তোমার শীতের প্রকার বইটি দিলারার এতই ভালো লেগেছে যে, ও তোমাকে এত বেশি নম্বর দিয়েছে, অন্য বিচারকরা কোনো নম্বর না দিলেও তুমি পুরস্কারটা পেয়ে যেতে।’ সে কী হাসির রোল উঠেছিল তখন চারপাশে! আর একদিন আমার প্রিয় শিশুসাহিত্যিক ও ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনের সামনে রফিক ভাই আমাকে তাঁর ‘প্রিয় কবি’ সম্বোধন করলে আবারও লজ্জায় মুষড়ে পড়েছিলাম। বলাই বাহুল্য, সত্যিকারের ভালোবাসা যাকে বলে আমি তাই পেয়েছিলাম মুক্তিযোদ্ধা ও কবি রফিক আজাদের কাছ থেকে।
২০১৩ সালে শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত আমার ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ কাব্যগ্রন্থটি আমি রফিক ভাইকে উৎসর্গ করে ভীষণ তৃপ্তি পেয়েছিলাম। সম্মানের জায়গায় তিনি ছিলেন আমার পিতৃতুল্য; আর আমি তাঁর সন্তানতুল্য কী বয়সে কী কবিতায়! গতকাল পিতার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছি আমি; বঞ্চিত হয়েছি রফিক ভাইয়ের সরল তবু দার্ঢ্য উচ্চারণ থেকে। সন্তানের প্রতি পিতার দায়িত্ব একদিন শেষ হয়ে গেলেও; পিতার প্রতি সন্তানের তো দায়িত্বের শেষ থাকে না। আমি সেই সন্তানের অধিকার থেকে বলি যেসব বিশুদ্ধবাদী কিংবা তথাকথিত ভিন্নস্বরিক কবিযশোপ্রার্থী রফিক ভাইয়ের কবিতার ভুল ব্যাখ্যা করে তাঁকে শূলে চড়াতে মরিয়া হয়ে আছেন কিংবা রফিক আজাদের কবিতাকে বাংলা কবিতার সাম্প্রতিক আস্ফালনঝড়ে হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে চান; তাঁরা বাংলা কবিতার শাশ্বত ধারাবাহিকতায় একবার ডুব দিয়ে আসুন। দেখবেন কতটা অনায়াসেই আপনারা নিজের পাতা ফাঁদে পতিত হয়েছেন। আমি কবি রফিক আজাদের অগণিত সন্তানের একজন; আপনাদের জন্য আমি সশস্ত্র; তবে আমি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করি রফিক আজাদের অগনিত অমর পঙ্ক্তি আর তাঁর আপসহীন জীবনযাপনের এক অবিচল রীতি।
রফিক আজাদ বাংলা কবিতার সন্তান। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই বাংলার জন্য কবিতা লিখেছেন; সুতরাং বাংলা কবিতার বংশ লতিকা ছাড়া আর কোথাও তাঁর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ কথা কবি উচ্চারণ করেন তাঁর নিন্দুকের মুখে ছাই আর নিজের মুখে দেশপ্রেমের দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ করে :
“আমাকে খুঁজো না বৃথা কাশ্মীরের স্বচ্ছ ডাল হ্রদে,
সুইৎসারল্যান্ডের নয়নলোভন কোনো পর্যটন স্পটে,
গ্রান্ড ক্যানালের গন্ডোলায়ও নয়,
খুঁজো না ফরাসি দেশে পারীর কাফেতে, মধ্যরাতে;
রাইন বা মাইনের তীরে, সুবিস্তীর্ণ ফলের বাগানে...
আমাকে খুঁজো না জাম্বো জেটে,
দ্রুতগামী যাত্রীবাহী জাহাজের কিংবা কোনো
বৃহৎ সমুদ্রগামী যাত্রীবাহী জাহাজের ডেকে...
ভুল করে অন্ধ গলিঘুঁজি পার হয়ে, যদি এই
আঁধার প্রকোষ্ঠে আসো
দেখবে উবুড় হয়ে বাংলার এই মানচিত্রে
মুখ থুবড়ে প’ড়ে আছে চল্লিশ বছর...
আমার তৃষ্ণার্ত ঠোঁট ঠেকে আছে
পদ্মার ওপর
এবং আমার দু’চোখের অবিরল ধারা বয়ে গিয়ে
কানায়-কানায় ভ’রে দিচ্ছে সব ক’টি শুষ্ক নদী,
এবং দেখতে পাবে
শ্যামল শস্যের মাঠ
আমার বুকের নিচে আগলে রেখেছি...”
মানচিত্র আর অদম্য প্রেমের সংজ্ঞায় রফিক আজাদের কবিতা বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতায় চিরদিনের সংগ্রহ হয়ে থাকবে, সন্দেহ কি!