জীবন নিয়ে ভাবনা নেই, মৃত্যু নিয়ে ভয় নেই : হাসান আজিজুল হক
হাসান আজিজুল হক বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক। ছোটগল্পের যুবরাজ হিসেবেও তিনি খ্যাত। লিখে চলেছেন ছয় দশক ধরে। কেবল গল্প লিখেও যে লেখক হিসেবে নিজের অবস্থান শক্ত করা যায় এবং সাহিত্যে স্থায়ী আসন নেওয়া যায়, তিনি তাঁর উজ্জ্বল উদাহরণ। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ—আত্মজা ও একটি করবী গাছ, নামহীন গোত্রহীন, পাতালে হাসপাতালে, জীবন ঘষে আগুন, আগুন পাখি, সাবিত্রী উপাখ্যান প্রভৃতি। লেখালেখির জন্য রাষ্ট্রীয় বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। আজ ২ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্মদিন। জন্মদিনের ঠিক আগমুহূর্তে তাঁর সঙ্গে কথা হয় তাঁর জীবন-ভাবনা, জীবন-অভিজ্ঞতা, লেখালেখি ও প্রাসঙ্গিক নানা বিষয়ে। লেখালেখিতে যেমন পাওয়া যায় একজন কুশলী গদ্যকার ও নির্মোহ বর্ণনাশৈলীর হাসান আজিজুল হককে, তেমনি তাঁর অসংখ্য সাহিত্যভাষণ ও সাক্ষাৎকারেও দেখা মেলে একজন তুখোড় আড্ডাবাজ ও হাস্যরসিক হাসান আজিজুল হকের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এহসান মাহমুদ।
এহসান মাহমুদ : আপনার সঙ্গে কথা বলছি জন্মদিনের ঠিক আগমুহূর্তে। তাই আপনাকে জানাচ্ছি জন্মদিনের আগাম শুভেচ্ছা। এই যে বছর ঘুরে জীবন থেকে একটি বছর চলে গেল কিংবা নতুন একটি বছর শুরু করতে যাচ্ছেন—বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
হাসান আজিজুল হক : জন্মদিন নিয়ে আমার কোনো বিশেষ ভাবনা নেই। এটি আগেও ছিল না। নববর্ষের সময় যেমন আমার মনে হয় না, একটি বছর বুঝি চলে গেল, একটি নতুন বছরের যাত্রা শুরু হলো—তেমনি জন্মদিনও আমাকে বিশেষভাবে বা আলাদাভাবে ভাবায় না। তবে জন্মদিনের সময় অনেকে ফুল নিয়ে, ছবি নিয়ে, মিষ্টি নিয়ে আসেন। অনেক লোকজন আসেন এ বিষয়টি ভালো লাগে। সত্যি বলতে কি, জীবন নিয়ে আমার তেমন কোনো ভাবনা নেই।
মাহমুদ : এই যে বয়স বেড়ে যাচ্ছে, মৃত্যুচিন্তা আপনাকে ভাবায় না?
হক : তোমাকে আগেই বলেছি, জীবন নিয়ে আমার কোনো ভাবনা নেই। তেমনি মৃত্যু নিয়েও আমার কোনো ভয় নেই। সময়ের কারণে দেহে হয়তো বার্ধক্য এসে যায়। এটা তো ন্যাচারাল। এটাকে অস্বীকার করব কী করে? তবে দৈহিক বার্ধক্য এলেও আমি মনে করি যে বৃদ্ধ হয়ে যাইনি! যদি তাই হয়, তবে কি তুমি রবীন্দ্রনাথকে বুড়ো রবীন্দ্রনাথ বা বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ বলবে? রবীন্দ্রনাথ তো এখন পর্যন্ত বলা চলে যে আমার চেয়ে বেশি বয়স পেয়েছেন। আমাদের দেহ নানা ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে এতটা বছর পেরিয়ে এসেছে, কষ্ট সয়েছে, তাই তার একটি সময় বিশ্রামের প্রয়োজন হবেই। তখনই দেখা দেয় বার্ধক্য। তাই বার্ধক্য দোষের কিছু নয়। আর মৃত্যু নিয়ে আমার কোনো ভয় নেই। মৃত্যু নিয়ে আমাকে আলাদা করে ভাবতেও হয় না। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য মৃত্যুকে শ্যামসম বলে আখ্যা দিয়েছেন। আমার কাছে মৃত্যু তেমনটিও নয়। আসলে আমি মৃত্যু নিয়ে মোটেও ভাবি না।
মাহমুদ : এবার আমরা ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। এখন কী পড়ছেন বা কোন কাজে সময় বেশি দিচ্ছেন?
হক : আমি সব সময়ই নতুন নতুন বিষয়ের ওপরে বই পড়তে পছন্দ করি। পছন্দটা এখন অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। নতুন বই না পেলে ভালো লাগে না। এ মুহূর্তে পড়ছি যে বইটি, সেটি একজন জাপানি লেখকের। বইটি আমার ছেলে এনেছে জাপান থেকে। বইটির কাহিনি গড়ে উঠেছে হিটলারের ইহুদি নিধন, নাৎসিদের অত্যাচার—এসব ঘটনা নিয়ে। আরেকটি মজার কাজ করছি এখন, সেটি হলো রক্তপাতহীন শুটিং করছি!
মাহমুদ : রক্তপাতহীন শুটিং মানে...?
হক : (অট্টহাসি হাসলেন হাসান আজিজুল হক) একদল লোক এসেছে ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে। অনেক আগে আমি ‘মফস্বল মহানগর’ বিষয়ে লিখেছিলাম। তারা আমার সেই লেখাকে কেন্দ্র করে একটি ভিডিও ছবি বানাতে চায়। সে অনুযায়ী শুটিং চলছে। আমাদের বাংলাদেশের কিন্তু একটি বিশাল এলাকা মফস্বল। আর তার বাইরে মহানগর ঢাকা। এসব নিয়েই লেখাটি। এখন তারা তা নিয়েই একটি ভিডিও ফরম্যাটে কাজ করে যাচ্ছে। আমাকেও ক্যামেরার সামনে বসতে হবে। কথা বলতে হবে। এখনকার ব্যস্ততা তা নিয়েই।
মাহমুদ : এবার আমরা আপনার লেখালেখি প্রসঙ্গে কথা বলব...
হক : এসব নিয়ে আর কী বলব বলো! অনেক তো বলেছি। এখন বরং না লেখা নিয়ে বলা যায়। (আবারও হাসলেন তিনি)
মাহমুদ : আচ্ছা, তবে আমরা সেসব বিষয় নিয়েই কথা শুরু করি। অনেক দিন আপনি গল্প লিখছেন না। কিন্তু রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধ কিংবা বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। এটা কেন হচ্ছে?
হক : আমার মনে হয়, আমাদের সমাজে এখন একধরনের চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। নানা ধরনের সংকট দেখা যাচ্ছে। তাই নানা বিষয়ে কথা বলতে হচ্ছে। লিখতে হচ্ছে। এগুলো নিজের ভেতরকার তাগিদেই লিখতে বা বলতে হচ্ছে। তার ফলে এ জাতীয় লেখাগুলো এখন তুলনামূলকভাবে বেড়ে গেছে। তা ছাড়া দীর্ঘকাল তো ছোটগল্পই লিখেছি। আরেকটি বিষয়, লেখক হিসেবে আমি যা করছি, সেটি জাবর কাটার পর্যায়ে চলে যাচ্ছে কি না, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হচ্ছে। জাবর না কেটে নতুন কিছু দিতে পারছি কি না, সেটাও একটি বিষয়। যাতে আমার লেখাগুলোকে জাবর কাটা না বলা যায়, তাই লেখা থেকে বিরত থাকছি। অন্যভাবে বলতে পারি, একটি নতুন রাস্তা খুঁজছি আমি। এখন গত কয়েক বছর স্মৃতিকাহন লেখায় বেশ টান অনুভব করছি। তাই এখন লিখে চলেছি একের পর এক স্মৃতিকাহন।
মাহমুদ : আপনার দীর্ঘ ছয় দশকের লেখালেখির জীবনে উপন্যাস লিখেছেন কেবল দুটি—আগুন পাখি ও সাবিত্রী উপাখ্যান। গল্প নিয়েই কাটিয়ে দিলেন অনেকটা সময়। কেন?
হক : উপন্যাস আমি লিখতে চেয়েছি শুরু থেকেই। কিন্তু পারিনি বলেই গল্প লিখেছি। তবে একেবারেই যে চেষ্টা করিনি, তা নয়। ‘তরলা বালা এক বঙ্গ রমণীর কথা’ নামে একটি লেখা শুরু করেছিলাম। লিখেও ছিলাম অনেকটা। তার পরে আর আগ্রহ বোধ করিনি। তাই লিখে শেষ করা হয়নি।
মাহমুদ : আপনি একবার বলেছিলেন, ‘বানিয়ে গল্প লিখতে পারি না। বাস্তবতার চোখে যা দেখি তার বর্ণনা দিয়ে গল্প বানানোর চেষ্টা করি।’ সেখানে কল্পনা কতটুকু থাকে?
হক : আমার এই কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করো না। গল্প যেটাকে বলে তৈরি করা, তেমন কোনো গল্পই আমার নেই। আমি আসলে বলতে চেয়েছিলাম, আমার কোনো উদ্ভাবনী ক্ষমতা নেই। এটা বিনয় করে বলছি নাকি গূঢ় অর্থে সত্য বলছি, সেটা বিচার করবে পাঠক।
মাহমুদ : আপনার গল্পের ইঙ্গিতের দিকে এবার খেয়াল করব। ‘আত্মজা ও করবী গাছ’ আপনার বহুল পঠিত ও আলোচিত গল্প। এ গল্পের ঘটনা, ভাষা ও পরিবেশ একটি ফুলগাছের। কিন্তু আবহ ও ইঙ্গিত দেশভাগ তথা ’৪৭-এর দাঙ্গা...
হক : তুমি ঠিকই ধরেছ। গল্পটি লিখেছিলাম ’৬৬-এর দিকে। ’৪৭-এর ভারত ভাগ এবং বাংলা ভাগ হওয়ার বিষয়টি গল্পটি পড়লে বোঝা যায়। তখন কোন সম্প্রদায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, আমি সেদিকে যাব না। আমি কেবল চেষ্টা করেছি মানুষের উন্মুল হওয়ার বেদনাটি ধরতে।
মাহমুদ : আপনার ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পের পরিবেশ বর্ণনায় একটি উপমার ব্যবহার আমাকে অনেক দিন ভাবিয়েছে। গল্পে কলাপাতার দুলুনিটা যেভাবে এনেছেন, সেটি কি আপনার একটি মনোহর বাক্য লেখার প্রচেষ্টা, নাকি যাতে হুবহু ছবিটি দেখা যায় তার চেষ্টা?
হক : তুমি যাকে বলছ মনোহর বাক্য লেখার প্রচেষ্টা, তা নয়। আমার অভ্যাস হচ্ছে, ক্যামেরা দিয়ে একটি ছবি তুলে যে জিনিসটা লোকজনকে দেখানো যায়, ক্যামেরা না থাকলে লিখে জিনিসটাকে অবিকল যদি সে রকম আনতে পারি, সেই চেষ্টা করে যাওয়া। এখন সেটি তোমার কাছে মনোহর বলেও মনে হতে পারে। তবে আমার চেষ্টাটি থাকে হুবহু ছবিটি লিখে তুলে ধরার।
মাহমুদ : আজকাল একটি বিষয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে, সেটি হলো গল্পে ‘গল্প’ থাকাটা কতটা বাঞ্ছনীয়?
হক : আজকাল বিভিন্ন বিষয়ে নানা আলোচনা হয়, যার অনেকটাই অন্তঃসারশূন্য। গল্পে গল্প থাকবে কি থাকবে না, এই আলোচনাও তেমনি। গল্পে গল্প থাকা বা না থাকা কোনো বিষয় নয়। শেষ পর্যন্ত লেখাটি গল্প হয়ে উঠল কি না, সেটিই আসল।
মাহমুদ : আবার আপনার লেখালেখি প্রসঙ্গ। সমালোচকরা বলে থাকেন, আমারও মনে হয়েছে, বিশেষ করে ‘জীবন ঘষে আগুন’ গল্পটি পড়ার পরে আপনার মধ্যে একধরনের কাব্যগুণ আছে, যা আপনার লেখাকে আরও শক্তিশালী ও জোরালো করেছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই...
হক : আমি কবিতা লিখিনি। কারণ, তাহলে আমাদের বড় বড় কবির ভাত মারা যাবে! (অট্টহাসি) শোনো, একটা কথা বলি, তোমার বা কারো যদি মনে হয় যে আমার লেখায় কবিতার ছন্দ আছে, তবে তাতে দোষ কী? যে যেভাবে ভাবে, ভাবুক না।
মাহমুদ : জন্মদিনের আগমুহূর্তে আপনি আমাকে এতটা সময় দিয়েছেন, সে জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার সুন্দর ও সুস্বাস্থ্য কামনা করছি। আবারও জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
হক : তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ। তুমিও ভালো থেকো।
সাক্ষাৎকার গ্রহণের তারিখ : ২৭ জানুয়ারি-২০১৫