জন্মদিন
আধুনিক নাটকের জনক হেনরিক ইবসেন
বিশ্বখ্যাত নরওয়েজিয় নাট্যকার হেনরিক যোহান ইবসেন, যিনি সূত্রপাত করেছেন আধুনিক বাস্তবতাবাদী নাটকের। তাঁকে বলা হয় আধুনিক নাটকের জনক। নরওয়ের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ লেখক এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাট্যকার হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠিত। ইবসেন নরওয়ের জাতীয় প্রতীকে পরিণত হয়েছেন বলা যায়। তাঁর যুগে রুচিশীল ভাবা হতো না তাঁর নাটককে, কেননা তখন পারিবারিক জীবন ছিল ভিক্টোরিয় আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং এ আদর্শের বাইরে কিছু করাকে দেখা হতো না ভালো চোখে। ইবসেনের কর্ম কথা বলে মানবচরিত্রের বিভিন্ন বাস্তব দিক সম্পর্কে।
সামাজিক মূল্যবোধের বিভিন্ন উপাদানকে সমালোচকের দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করে ইবসেন প্রতিষ্ঠা করেছেন আধুনিক মঞ্চনাটক। ভিক্টোরীয় যুগে নাটকগুলো কেবল সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে কথা বলবে এমন ভাবা হতো। যেখানে সত্য সর্বদাই কালো শক্তির বিরুদ্ধে জয়লাভ করবে এবং সব নাটকই শেষ হবে তৎকালীন সামাজিক মূল্যবোধের গুণগান গেয়ে। ইবসেন এই ধারার বিপক্ষে গিয়ে নাটকের সমাপ্তিতে আনেন বৈচিত্র্য এবং জন্ম দেন নতুন ধারার। শেক্সপিয়রের মতো ইবসেনকেও ইউরোপীয় ধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
১৮২৮ সালের ২০ মার্চ নরওয়ের শিয়েন এলাকার এক সচ্ছল ব্যবসায়ী পরিবারে ইবসেনের জন্ম। তার বাবা নুড ইবসেন ও মা ম্যারিচেন অ্যাটেনবার্গ। তাঁদের ছিল জাহাজে করে কাঠ পরিবহনের ব্যবসা। নরওয়ের প্রাচীন ও স্বনামধন্য পরিবারের একটি ছিল ইবসেনের পরিবার। তবে ইবসেনের জন্মের কিছুদিন পরেই তাঁর পরিবারের আর্থিক অবস্থার ঘটে বেশ অবনতি। তাঁর মা দুঃখ থেকে বাঁচার আশায় মনোনিবেশ করেন ধর্মে আর বাবা শিকার হন বিষণ্ণতার। এ কারণে তাঁর রচিত চরিত্রগুলোর মাঝে তাঁর বাবা-মায়ের ছায়া লক্ষ করা যায়। আর্থিক সংকটের কারণে মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয় তাঁর নাটকের একটি প্রধান ভাব। এছাড়া মানুষের গোপন ঘটনার কারণে দ্বন্দ্বও ইবসেনের রচনার আরেকটি প্রধান বিষয়।
১৫ বছর বয়সে ঘর ছাড়েন ইবসেন। ফার্মাসিস্ট হওয়ার মানসে তিনি ছোট্ট শহর গ্রিমস্টাডে আস্তানা গাড়েন এবং এখানেই তার নাটক লেখার সূত্রপাত হয়। ১৮৪৬ সালে তিনি এক গৃহপরিচারিকার গর্ভে অবৈধ সন্তানের বাবা হন। কিন্তু সেই পিতৃত্ব অস্বীকার করেন তিনি। ইবসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির উদ্দেশে যান তৎকালীন ক্রিস্টিয়ানিয়ায় (বর্তমান অসলো)। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার চিন্তা বাদ দিয়ে আত্মনিয়োগ করেন নাটক রচনায়। কারণ তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার প্রাথমিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, কেননা ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি তিনি।
ইবসেনের প্রথম উপন্যাস ক্যাটিলিনা (১৮৫০) একটি বিয়োগান্তক উপন্যাস, যা তিনি প্রকাশ করেন ব্রিনিউল্ফ বিজার্ম ছদ্মনামে। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর। তবে মঞ্চায়িত হয়নি সেই নাটক। তাঁর প্রথম মঞ্চস্থ নাটক হচ্ছে দ্য বুরিয়াল মন্ড (১৮৫০), যা নজর কেড়েছে খুব কমই। তবুও নাট্যকার হওয়ার রাস্তা থেকে ইবসেন পিছু হটেননি। এই নাটকগুলোর পর কয়েক বছরে ইবসেন কিছুই প্রকাশ করেননি।
বার্গেনের একটি নরওয়েজিয় নাট্যগোষ্ঠীতে কিছুদিন চাকরি করেন ইবসেন। সেখানে তিনি ১৪৫টিরও বেশি নাটকে নাট্যকার, পরিচালক এবং প্রযোজক হিসেবে কাজ করেছেন। সেই সময়ে তাঁর নতুন কোনো নাটক প্রকাশ করেননি তিনি। নাট্যকার হিসেবে সাফল্য লাভে ব্যর্থ হলেও এই গোষ্ঠীতে তিনি অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন যা পরবর্তীকালে তাঁর লেখার কাজে আসে।
১৮৫৮ সালে ক্রিস্টিয়ানিয়াতে আসেন ইবসেন এবং ক্রিস্টিয়ানিয়ার জাতীয় থিয়েটারের পরিচালক নিযুক্ত হন। তিনি সুজানা থোরেনসেন নামের এক নারীকে বিয়ে করেন, যার গর্ভে তাঁর একমাত্র সন্তান সিগার্ড ইবসেনের জন্ম হয়। খুবই অর্থকষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করেছেন ইবসেন-সুজানা দম্পতি এবং নরওয়ের জীবন নিয়ে খুব হতাশাগ্রস্ত ছিলেন তিনি। ১৮৬৪ সালে ইবসেন ক্রিস্টানিয়া ত্যাগ করে স্বেচ্ছানির্বাসনে চলে যান ইতালিতে। এরপরের ২৭ বছর আর স্বদেশে ফিরে আসেননি তিনি। ২৭ বছর পর যখন তিনি দেশে ফিরেন, তত দিনে তিনি নাট্যকার হিসেবে আরোহন করেছেন খ্যাতির শীর্ষে।
ইবসেনের পরবর্তী নাটক ব্র্যান্ড (১৮৬৫) তাঁকে এনে দেয় সমালোচকদের প্রশংসা, যেটির জন্য তিনি ছিলেন ক্ষুধার্তের মতো অপেক্ষা করছিলেন। এই নাটক তাঁকে এনে দেয় আর্থিক সফলতাও। ১৮৬৭ সালে তিনি প্রকাশ করেন পিয়ার গিন্ট, যেটির সুরারোপ করেছেন জনপ্রিয় সুরকার এডভার্ড গ্রেগ। যদিও ইবসেন ডেনমার্কের দার্শনিক শন কিয়ের্কেগর্দের রচনার সাথে আগেই পরিচিত ছিলেন, তবুও তাঁর ‘ব্র্যান্ড’ নাটকের আগে সেটার প্রকাশ দেখা যায়নি। এরপর থেকে কিয়ের্কেগর্দের আদর্শ নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেন তিনি। প্রথমে তাঁর বন্ধু জর্জ ব্রান্ডেস ইবসেনের সাথে কিয়ের্কেগর্দের তুলনা করলে বিরক্ত হয়েছিলেন ইবসেন। পরে তিনি কিয়ের্কেগর্দের রচনায় আকৃষ্ট হন এবং আইদার/অর ও ফিয়ার অ্যান্ড ট্রেম্বলিং বই দুটি পড়েন। ইবসেনের পরবর্তী নাটক পিয়ার গিন্টে কিয়ের্কেগর্দের প্রভাব লক্ষ করা যায়।
সাফল্যের সাথে সাথে আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে ইবসেনের এবং তিনি নাটকে তাঁর বিশ্বাস, বিচার ও চেতনার প্রকাশ ঘটাতে শুরু করেন। এই ধরনের নাটককে তিনি নাম দিয়েছেন ‘drama of ideas’, তাঁর পরবর্তী নাটকের সিরিজকে ইবসেন নাটকের স্বর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে, যেখানে তাঁর ক্ষমতা, সৃজনীশক্তি ও প্রভাবের পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে। এই ধরনের নাটক তখন ইউরোপে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল।
১৮৬৮ সালে ইবসেন ইতালি ছেড়ে চলে যান জার্মানির ড্রেসডেনে। সেখানে তিনি রচনা করেছেন তাঁর প্রধান সাহিত্য কর্মগুলো। এর মধ্যে রয়েছে এমপেরর অ্যান্ড গ্যালিলিয়ান (১৮৭৩), যা নির্মিত হয়েছে রোমান শাসক জুলিয়ান দ্য অ্যাপোস্টেটের জীবন ও সময় নিয়ে। যদিও ইবসেনের মতে তাঁর সমস্ত নাটকের মধ্যে এটিকেই শ্রেষ্ঠ বলে মনে করতেন, তবুও অধিকাংশ সাহিত্যিকই দ্বিমত পোষণ করতেন তার সাথে। তার পরের সাহিত্যকর্মগুলো প্রশংসা কুড়িয়েছে অনেক বেশি। ১৮৭৫ সালে ইবসেন মিউনিখে চলে যান এবং এখান থেকে ১৮৭৯ সালে প্রকাশ করেন বিখ্যাত নাটক আ ডলস হাউস। এই নাটকে ভিক্টোরিয় যুগের বিয়েতে পুরুষ ও নারীর ভূমিকা তুলে ধরেন তিনি, যার জন্য সমালোচনার মুখে পড়তে হয় তাকে।
‘আ ডলস হাউজে’র পর ইবসেন লেখেন ‘গোস্টস’ (১৮৮১), যাতে ছিল ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতার ধারার উগ্র বর্ণনা। সেখানে একজন বিধবা তার যাজকের কাছে প্রকাশ করেন যে, তিনি বিয়ের সময় তাঁর খারাপ দিকগুলো গোপন করেছিলেন। যাজক পরামর্শ দেন তাঁর তৎকালীন বাগদত্তাকে পরকীয়া সত্ত্বেও বিয়ে করার জন্য এবং মহিলা সে অনুযায়ী বিয়েও করেছিলেন এই আশায় যে তাঁর ভালোবাসায় তাঁরা একত্রিত হতে পারবেন। কিন্তু তিনি যা চেয়েছিলেন তা হয়নি। তাঁর স্বামীর পরকীয়া তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত চালিয়েছেন এবং এর ফলে তাঁর সন্তান সিফিলিসগ্রস্থ হয়ে পড়ে। এই রোগের নাম শোনাও তখন কলঙ্ক হিসেবে বিবেচিত হতো।
১৮৮২ সালে ইবসেন প্রকাশ করেন ‘অ্যান এনিমি অব দ্য পিপল’। আগের নাটকগুলোতে বিতর্কিত বিষয়াদি গুরুত্বপূর্ণ থাকলেও তা ব্যক্তিগত অঙ্গনের ভিতরেই সীমাবদ্ধ ছিল। ‘অ্যান এনিমি ইব দ্য পিপল’ নাটকে বিতর্কই প্রধান আলোচ্য বিষয় এবং পুরো সমাজই ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী। যে প্রধান বার্তা এই নাটকটির মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে তা হলো, কখনো কখনো একজন ব্যক্তির মতোই সঠিক হতে পারে যদিও সাধারণ জনতা সবাই ভিন্ন মত পোষণ করে। সাধারণ জনতাকে সেখানে তুলনা করা হয়েছে মূর্খ ও ভেড়ার পালের সঙ্গে। এর মাধ্যমে চলিত ভিক্টোরিয়ান বিশ্বাস, সমাজ একটি মহৎ প্রতিষ্ঠান এবং সর্বদা বিশ্বাসযোগ্য- এই ধারণাকে হেয় করার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯০৬ সালের ২৩ মে মারা যান এই মহান নাট্যকার।