বিশ্ব কবিতা দিবস
‘এই যে কবিতা, বইবে আমার স্বাক্ষর’
কবিতা ভালোবাসার ভাষা, কবিতা প্রতিবাদের ভাষা। কবিতা বলতে কি আবেগের বিজ্ঞানকে বোঝানো হয়ে থাকে? আবেগ ও বিজ্ঞান এ দুটির সংমিশ্রণ ঘটলেই পঙ্ক্তিমালাগুলো কবিতা রূপ ধারণ করে। কবিতা শিল্পের এমন একটি শাখা, যেখানে ভাষার নান্দনিক গুণাবলির ব্যবহারের পাশাপাশি ধারণাগত এবং শব্দার্থিক বিষয়বস্তু ব্যবহার করা হয়। বিশ্লেষকদের মতে, কবিতা প্রতি মুহূর্তে আচরণে-আবরণে, আহ্বানে নিজের অস্তিত্ব তথা বোধজাত উপলব্ধি ঠিক রেখে নিজেকে ভাঙে আবার গড়ে। সেই কবিতাও আছে নির্দিষ্ট দিবস, যা পালন করা হয় বিশ্বব্যাপী।
১৯৯৯ সালে ২১ মার্চ তারিখটিকে বিশ্ব কবিতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে ইউনেসকো। এই দিবস পালনের উদ্দেশ্য হলো বিশ্বব্যাপী কবিতা পাঠ, রচনা, প্রকাশনা ও শিক্ষাকে উৎসাহিত করা।
ইউনেসকোর অধিবেশনে এই দিবস ঘোষণা করার সময় বলা হয়েছিল, ‘এই দিবস বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কবিতা আন্দোলনগুলিকে নতুন করে স্বীকৃতি ও গতি দান করবে।’
একসময় বিশ্ব কবিতা দিবস পালন করা হতো অক্টোবর মাসে। প্রথম দিকে কখনো কখনো ৫ অক্টোবর এই উৎসব পালিত হলেও বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে রোমান মহাকাব্য রচয়িতা ও সম্রাট অগস্টাসের রাজকবি ভার্জিলের জন্মদিন স্মরণে ১৫ অক্টোবর এই দিবস পালনের প্রথা শুরু হয়। অনেক দেশে আজও অক্টোবর মাসের কোনো দিন জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কবিতা দিবস পালন করা হয়। এই দিবসের বিকল্প হিসেবে অক্টোবর অথবা নভেম্বর মাসের কোনো দিন কবিতা দিবস পালনেরও প্রথা বিদ্যমান আছে।
বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে পালন করা হয় এই কবিতা দিবস। কবিতা ছড়িয়ে যায় সকল হৃদয়ে, আবৃত্তি হয় একের পর এক, রচনা, পাঠ ও কবিতা প্রকাশনা উৎসাহিত হয়।
১৯৯০ সালে আমেরিকা থেকে বিশ্ব কবিতা দিবস ঘোষণার যে দাবি জানানো হয়, তার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালে ২১ মার্চকে বিশ্ব কবিতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে ইউনেসকো। এর আগে ১৯৫১ সাল থেকে জাতীয় কবিতা মাস উদযাপন শুরু হয় কানাডা এবং আমেরিকায়। বিশ্ব কবিতা দিবস পালনের উদ্দেশ্য হচ্ছে : কবিতার পাঠ-রচনা-চর্চা এবং পাঠদান-প্রক্রিয়ায় উন্নয়ন সাধন।
সাহিত্যে মিশ্রসংস্কৃতির সাম্প্রতিক উপস্থিতি আমাদের যেমন বিস্মিত করে, তেমনি জোগায় বিচিত্র আনন্দ-অভিজ্ঞতা। অ্যাপার্টমেন্টে আর ক্লাসরুমে নানা সংস্কৃতির লোকের হাজির থাকার ব্যাপার থেকে হয়তো সমাজে এবং সাহিত্যে প্রবেশ করেছে এ রকম ধারণার প্রকাশ-চেষ্টা। জীবন-ভালোবাসা-মূল্যবোধ-শান্তি এবং সংগ্রাম সম্বন্ধে যেহেতু প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর রয়েছে আলাদা আলাদা সমৃদ্ধ ঐতিহ্য, তাই সাহিত্যেও আসতে থাকে জীবনেরই মতো ঐতিহ্যসমৃদ্ধির আলোবাতাস। ভাষা এবং মানবিক বিষয় হিসেবে পাঠক্রমে কবিতা সব সময়ই একটি জটিল পরিসর হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। কবিতার পাঠদান এবং পাঠগ্রহণ সত্যিই অন্যান্য প্রাত্যহিক প্রয়োজনীয় বিষয়ের মতো, দরকার আছে কি না সে প্রশ্নও যে মাঝে মাঝে ওঠে না, তা কিন্তু নয়। অন্যদিকে পাঠদানের গতানুগতিক রীতি এবং শিক্ষকের প্রয়োজনীয় যোগ্যতার অভাবের চিত্রও আমাদের কাছে বিরল নয়। মিশ্রসংস্কৃতির এই প্রবল প্রবাহের কালে, ব্যক্তিসচেতনতার বিবেচনা-প্লাটফর্মে, কবিতাবিষয়ক বোধির জটিলতা সত্যিই দুঃখজনক এবং রীতিমতো ভয়ংকর।
সাধারণত ‘কবিতা কী’? ‘কীভাবে কবিতা পড়তে হয়’?—এ জাতীয় প্রশ্ন তৈরি করতে হয় সমাগত পরীক্ষার জন্য। অতএব, কবিতার সৌন্দর্য আর তার সামর্থ্যের বিষয়টি অনালোকিতই রয়ে যায়। কবিতা অনুধাবন করা-না-করার ব্যাপারগুলো পাঠ্যপুস্তকের মোড়কে আবদ্ধ থাকে পুরো শিক্ষাবর্ষ জুড়ে। তবে কবিতাকে আমরা কীভাবে মোকাবিলা করি কিংবা কবিতা আমাদের চেতনাকে কতটা জাগ্রত করে, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শিক্ষার্থীরা যেমন ব্যাপক পাঠাভ্যাস অনুশীলন করতে পারে না, তেমনি লেখার কৌশল রপ্ত করতেও তাদের যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া হয় না। আমাদের বিশ্বাস, যে বিষয়ের কবিতা পাঠ করছি, যদি ওই ধারণা সমৃদ্ধ একটি নতুন কবিতা, নতুন প্রকাশ-পদ্ধতিতে লিখতে বলা হয়, তাহলে শিক্ষার্থীর মনোযোগ ও সৃজনশীলতার প্রতি আগ্রহ এবং শ্রদ্ধা বাড়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রাত্যহিক ব্যবহার্য শব্দাবলি সৃজনশীল পথে প্রয়োগ করে ‘গ্রুপওয়ার্ক’-এর মাধ্যমে কবিতা সৃষ্টির আনন্দ লাভের পাশাপাশি তারা কবিতা বোঝার ব্যাপারেও আগ্রহী হয়ে উঠবে ধীরে ধীরে। সচরাচর পাঠকক্ষে কবিতা বোঝার জন্য একটা ধারণা চাপিয়ে দেওয়া হয়, ওই ব্যাখ্যা বা ধারণা শিক্ষার্থীরা পুরোপুরি আয়ত্ত করতে পারে না। ‘ক্রিয়েটিভ রাইটিংস’ অথবা ‘প্র্যাকটিস মেকস পারফেক্ট’ ধারণাগুলো যদি কবিতার ক্লাসে আরোপ করা যায়, তাহলে হয়তো কবিতাকে পাঠকের মগজ-দরজায় হাজির করানোর কাজ কিছুটা সহজ হতে পারে।
কবিতার বিশ্লেষণ অত্যন্ত সরল হওয়া প্রয়োজন, সাবলীলভাবে বর্ণনাকারীকে প্রবেশ করতে হবে মূল বক্তব্যে। মূল বক্তব্যের অনুভূতিটি মাথায় ঢোকাতে পারলেই কবিতা ধরা দেবে পাঠকের হাতে। কবির জীবন এবং সময়কালও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠা উচিত। আজকের বিশ্বে কবিতা পাঠের কষ্ট-ক্লান্তির জন্য শিক্ষার্থীরা দায়ী নয়; দায়ী তাদের আকর্ষণ-অনুভব সৃষ্টি করতে ব্যর্থ শিক্ষক বা প্রশিক্ষক। কেননা, শিক্ষার্থী কিংবা প্রশিক্ষণার্থীরা প্রথমে পড়তে, শুনতে শুরু করে। এরপর তারা অর্থ-অনুসন্ধানের দিকে মনোযোগী হয়। ওই মনোযোগ-সৃষ্টিকারী অনুভূতিটি জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব বর্তায় শিক্ষকের ওপর।
কোলরিজের মতে—‘কোনো কবিই বড় কবি হতে পারেননি সত্যসন্ধ দার্শনিক হওয়া ছাড়া।’ আর মার্কিন কবি জিন গ্যারেজের আরো স্পষ্ট উচ্চারণ—‘একটি কবিতার প্রতিটি পঙক্তিই হলো এক আত্মজীবনী।’ প্রকৃত অর্থে, জীবন সম্বন্ধে শৈল্পিক নিয়তির অনুভব, আত্মচিহ্নায়নের বিকাশ, শাশ্বত সামষ্টিক সম্পর্কসূত্র-অন্বেষা আর মগ্নচৈতন্যের অভিকেন্দ্রিকতাকে আবিষ্কারের মধ্যেই কবিতা রাখে তার সৃজন-বেদনার পদচিহ্ন। আরবি সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন কবি ইমরুল কায়েস প্রিয়তমাকে হারিয়ে কষ্টক্লান্তির এক মহাসড়কে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করেছিলেন—‘যদিও জানি বিলুপ্ত এই মোকামে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করে কোনো লাভ নেই।’ আর ঢাকার পিলখানায় সম্প্রতি যে বীভৎস দৃশ্যরাজি নির্মিত হলো, অনাগত সভ্যতা-পরিভ্রমণে, সাধারণের অবোধ্য অনুভবে বাংলাদেশের কবি শামসুর রাহমান প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল আগেই জেনেছেন, আর্থিক নিশ্চয়তা আর শান্তির আশাঘেরা ‘শুধু দুই টুকরো শুকনো রুটির নিরিবিলি ভোজ’ আপাতত শেষ কথা নয়। তিনি লিখেছেন : ‘হয়তো কখনো আমার ঠাণ্ডা মৃতদেহ ফের খুঁজে পাবে কেউ/শহরের কোনো নর্দমাতেই;— সেখানে নোংরা পিছল জলের/অগুনতি ঢেউ/খাবো কিছুকাল।’ অন্যদিকে, কবিতারই শরীর বেয়ে কল্পনা আর স্বপ্নের পথ ধরে প্রসন্নতার প্রশস্ত প্রান্তরের দিকে এগোতে দেখি স্প্যানিশ কবি হুয়ান রামোন হিমেনেথকে; রঙ আর ছবির রেখায় তিনি গাঁথেন স্বপ্নমালা, পরিয়ে দেন জীবন নামক মানবগলায়—‘মেয়েটি ছিলো সবুজ। সবুজ শুধু সবুজ। সবুজ তার চোখ দুটো,/ সবুজ তার চুল। তার সবুজ বাগানের বুনো গোলাপ ও না-ছিলো/লাল, না-সাদা— কিন্তু শুধুই সবুজ। সবুজ বাতাসের পথ দিয়ে/সে আসে/তার মিহি রেশমি কাপড়ের উজ্জ্বলতা না-নীল, না- সাদা— শুধুই সবুজ।’
পার্থিব হাওয়া আর প্রার্থিত ঢেউয়ের উল্টোদিকে হেঁটে-বেড়ানো বিপ্লবী নেতা চে গুয়েভারা শেষ অভিযাত্রাকালে তাঁর ডায়রির পাতায় লিখেছিলেন—‘এই যে কবিতা, বইবে আমার স্বাক্ষর’; আগামীর অভিপ্রায়মাখা এই বারতা আমাদের কানে আসে, মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া থেকে, কনস্টান্টিন কাভাফিণ্ডর নরম উদার উচ্চারণে; আলোকশিখা হাতে নিয়ে যেন কবি পথ দেখাচ্ছেন, অন্ধকারে পথ-খুঁজতে-থাকা কোনো অভিযাত্রীকে— ‘অনাগত দিনগুলো সব মেলে আছে সামনে/যেন মোমবাতির সারি, জ্বলছে উজ্জ্বল—/প্রাণবন্ত সব মোমবাতি, স্বর্ণালী আর ঈষদুষ্ণ।’ জীবনানন্দের ‘সকলেই কবি নন; কেউ কেউ কবি’ যেমন আমাদের চিন্তাভুবনকে আন্দোলিত করে, তেমনি তাঁর ‘যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ/মরিবার হ’ল তার সাধ’ জীবন-অভিজ্ঞানও জ্যোৎস্না আর অবোধ্য সব অনুভূতিকে সরব রাখে চেতন-অবচেতনের নীরব দরজায়।