রম্যগল্প
হিসাবরক্ষক
এক অফিসের হিসাব বিভাগে গেছি।
সামান্য লেনদেনের মামলা।
হিসাব বিভাগের মধ্যবয়স্ক নির্বাহী অতি সামান্য কাজকে মহাগুরুত্বসহকারে দেখছেন। একবার চশমা খুলছেন। আবার পরছেন। আঙুলের কড়ে একক, দশক, শতক, সহস্র, অযুত গুনছেন। নিজের আঙুলের কড়ের ওপরও যেন তাঁর অবিশ্বাস। আঙুলের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। আবার গোনা শুরু করলেন।
এক কাগজ চেক করলেন তিনবার। এর মধ্যে দুবার তাকালেন আমার মুখের দিকে। সন্দেহে ভরপুর স্থির দৃষ্টি। কিছুটা হতাশাও আছে। হাতে ছাই মেখে বসে আছেন অথচ ধরতে পারছেন না।
মানুষকে ধরা যাঁদের অভ্যাস, কোনো কারণে সেটা না পারলে তাঁরা অস্থির হয়ে যান।
এত ছোট কাজে এত বেশি সম্মানী? আশ্চর্য!
বাধ্য হয়ে ভেতরে চেপে থাকা অস্থিরতা প্রকাশ করলেন তিনি।
হাসলাম। বললাম, সাইনটা কার?
নির্বাহী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সাইন দেখলেন।
সাইন তো এমডি স্যারেরই।
হুমম। প্রতিষ্ঠানটা কার? আপনাদের এমডি সাহেবের নিশ্চয়ই?
তো...
নির্বাহী মরা মাছের দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকালেন।
তো, এত বড় প্রতিষ্ঠান তো তিনি হিসাব-নিকাশ ছাড়াই দাঁড় করাননি। তিনি আপনার-আমার চেয়ে অনেক বেশি হিসাবি বলেই আজ এই প্রতিষ্ঠানের মালিক। আর আপনি তাঁর টাকা গোনেন এবং আমি তা নিই।
এ রকম প্রতিষ্ঠান স্যারের আরো চারটা আছে। তিনি জিরো থেকে হিরো হয়েছেন।
এই তো লাইনে আসছেন। যিনি জিরো থেকে হিরো হয়েছেন, তিনি কি না বুঝে সাইন করার মানুষ? নিশ্চিয়ই না। সো, প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে তিনি যদি সাইন করে দেন, তাহলে তো আপনার একটা কাজই করার থাকে। গুনে গুনে টাকাটা দিয়ে দেওয়া। অথচ আপনি টাকা দিতে যত সময় নিচ্ছেন, আমার পুরো কাজটা শেষ করতেও তত সময় লাগেনি।
নির্বাহী এবার আমার পরিচয় নিয়ে কিছুটা সন্দিহান।
সন্দেহ খারাপ জিনিস। বুকের জোর কমায়।
তিনি আমার মুখের দিকে একবার তাকান। তারপর চোখ নামিয়ে নেন টাকার বান্ডিলের দিকে।
কথা না বাড়িয়ে টাকা গোনা শুরু করেন তিনি।
দাঁড়ান।
শুরুতেই থামিয়ে দিই তাঁকে।
ছ্যাপ দিয়ে টাকা গুনবেন না। আমার সূচিবাই আছে। তা ছাড়া ছ্যাপ লাগালে টাকায় মরিচা পড়ে।
আমার কথা শুনে নির্বাহী এবার পুরাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।
এই সময়টা হচ্ছে গল্প বলার মোক্ষম সময়।
তাঁকে বললাম, শোনেন, প্রতিষ্ঠানের টাকাকে কখনো নিজের টাকা ভেবে টেনশন করবেন না। তাতে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা থাকে। আপনাদের অফিস থেকে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অনেক দূরে। যাইতে যাইতে খবর চলে আসবে...
এটা তো আমার দায়িত্ব।
অবশ্যই আপনার দায়িত্ব। কিন্তু সব দায়িত্বেরই একটা সীমানা থাকে। এমডি সাহেব সই করে দিয়েছেন। আপনার দায়িত্ব হচ্ছে ছ্যাপ ছাড়া সেই টাকা গুনে দেওয়া। এখন আপনি যদি এই টাকা নিয়ে অযথা টেনশন করেন তাহলে কী হবে? আপনার প্রেশার বাড়বে। প্রেশার বেশি হওয়ায় রক্ত গিয়ে ধাক্কা দেবে হার্টে। হার্ট ঠেলা দেবে ব্রেইনে। খেলা শেষ হবে স্ট্রোকে।
হিসাব নির্বাহীর মুখ হাঁ। তাকিয়ে আছেন পাঁচশ টাকার ছাপানো হাইকোর্টের দিকে।
মওকা পেয়ে তাঁকে নতুন করে হাইকোর্ট দেখানো শুরু করলাম।
শোনেন, আমার পরিচিত একজন আছেন। অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন। আপনার মতো মালিকের টাকাকে নিজের টাকা ভেবে টেনশন করত। এতবার টাকা গুন তো যে ছ্যাপের ঘষায় টাকার প্রিন্ট অর্ধেক উইঠা যাইত। মুখের ছ্যাপ টাকার গায়ে লাগানোর কারণে তার মুখ থাকত সব সময় শুকনা। এই করতে করতে বেচারা একদিন করল স্ট্রোক। এখন এক সাইড প্যারালাইজড হয়ে বেকার। স্ট্রোক করার ১৫ দিনের মধ্যে মালিকপক্ষ তাঁকে চাকরি থেকে আউট করে দিয়েছে। এখন খোঁজও নেয় না। তিনি পড়ছেন মাঝ দরিয়ায়।
কী বলেন!
নির্বাহীর চোখে অবিশ্বাসের দৃষ্টি।
কী বিশ্বাস হচ্ছে না? ফোনে ধরাই দি। কথা বলেন। জীবন থেকে নেওয়া অভিজ্ঞতা শুনতে পারবেন। কাজে লাগবে।
না না। ঠিক আছে।
আচ্ছা ফেসবুক ওপেন করি। সেই লোক আমার সঙ্গে ফেসবুকে আছে। ছবি দেখাই আপনাকে। একটা ছবি একশ কথার সমান।
প্যারালাইজড লোক ফেসবুকে কী করে?
আরে ভাই, বাম সাইড প্যারালাইজড হইছে। মন তো আর প্যারালাইজড হয় নাই। তা ছাড়া ডান সাইড তো ঠিক আছে। বেকার মানুষ। কাজ নাই তাই ফেসবুকিং করে। আগে মালিকের টাকা গুনত, এখন ফেসবুকের লাইক গোনে।