জেনোসাইড ও হত্যাযজ্ঞের সাহিত্য
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ মানুষকে হত্যা করছে। সেই নিষ্ঠুরতা বর্তমান শতাব্দীর আধুনিক মানুষের কাছে একটি ঘৃণ্য কাজ হিসেবে গণ্য। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতেই ঘটেছে কোটি মানুষের প্রাণসংহার। বিশ্বযুদ্ধ ও জাতিনিধনের সেই পরিকল্পিত ও ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ‘জেনোসাইড’ অভিধা পেয়েছে।
হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে একাত্তরে পাকিস্তানিদের বন্দিশিবির সেই জেনোসাইডের নির্মম ইতিহাসকে উজ্জ্বল করে রেখেছে। সাহিত্য, শিল্প, চিত্রকলা ও চলচ্চিত্রের নানা অভিব্যক্তিতে তা প্রকাশিত হয়েছে। জেনোসাইডের বিরুদ্ধে বিশ্বসাহিত্যে রচিত হয়েছে অজস্র কবিতা ও বৃহৎ প্রেক্ষাপটের উপন্যাস।
বাংলাদেশেও একাত্তরে সংঘটিত গণহত্যাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস। বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে জাতিনিধনের অনুপুঙ্খ ইতিবৃত্ত ধৃত হয়েছে।
অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তাঁর ‘দ্য রেপ অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থের ‘গণহত্যা’ অধ্যায়ে লিখেছেন, ‘সারা প্রদেশজুড়ে হত্যাকাণ্ডের সুব্যবস্থার নমুনার সঙ্গে জেনোসাইড বা গণহত্যা শব্দটির আভিধানিক সংজ্ঞার হুবহু মিল রয়েছে।’
তিনি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার মুখ থেকে জেনেছিলেন গণহত্যার লক্ষবস্তু ছিল—ক. বাঙালি সৈনিক, পুলিশ, আনসার প্রভৃতি; খ. হিন্দু সম্প্রদায়; গ. আওয়ামী লীগের লোক; ঘ. কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী; ঙ. অধ্যাপক ও শিক্ষক যাঁরা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। তবে তিনি এটাও লক্ষ্য করেছিলেন যে সেনাবাহিনীর নৃশংসতা ছিল নির্বিচার।
নিরপরাধ, সাধারণ মানুষকেও শত্রু হিসেবে গণ্য করেছিল তারা। তা ছাড়া তাদের গণহত্যা ছিল ‘শোধন প্রক্রিয়া’, যাকে শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান বলে মনে করত। সেই সঙ্গে এই বর্বরোচিত উপায়ে প্রদেশটিকে উপনিবেশে পরিণত করাও ছিল এর অন্যতম উদ্দেশ্য।
পাকিস্তানিদের ভাষ্য ছিল, ‘বিচ্ছিন্নতার হুমকি থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানকে চিরদিনের জন্য পবিত্র করতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সে জন্য যদি ২০ লাখ লোককে হত্যা করতে হয় এবং প্রদেশটিকে ৩০ বছরের জন্য উপনিবেশ হিসেবে শাসন করতে হয়, তবুও।’
শাসকদের এ ধরনের মানসিকতার সঙ্গে পশ্চিমাংশের মানুষের ঐক্য ছিল। আর এ জন্যই ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ হলেন গণহত্যার নীরব দর্শক।’
বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসক ও তাদের দোসর আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে হত্যাযজ্ঞ, ব্যাপক ধ্বংসলীলা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, হিন্দু জনগোষ্ঠী নিধন ও বিতাড়ন, রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্যাতন, মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বিচারে হত্যা করেছিল।
বাঙালি জাতির প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা থেকে তাদের ২৫ মার্চের ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হয়েছিল। সুপরিকল্পিত গণহত্যা ও জাতিগত নিধনযজ্ঞ জেনোসাইড বা গণহত্যা হিসেবে গণ্য হয়েছে। হিটলারের নাৎসি বাহিনী ইহুদি ও রাশিয়ার যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে যে বর্বরতা দেখিয়েছিল, ঠিক একই রকম আচরণ ছিল পাকিস্তানিদের।
নিষ্ঠুরতা, পাশবিকতা এবং সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি ছিল ঠিক ইহুদিদের প্রতি নাৎসিদের মতো। নাৎসিরা ইহুদিদের নিচু জাতের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করত এবং তাদের নিধনযজ্ঞের মধ্য দিয়ে ইউরোপের সমস্যা সমাধান করতে চেয়েছিল। অনুরূপভাবে পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের মনোভাব ছিল, ‘Bengalees have been cleansed and selected properly for at least one generation.’
নাৎসিরা প্রথমে তরুণ, যুবক এবং সমর্থ পুরুষদের হত্যা দিয়ে নিধনযজ্ঞ শুরু করলেও শিশু, বৃদ্ধ, নারীদের নির্বিচারে নিধন করতে থাকে ১৯৪১ সালে বলকান অঞ্চল থেকে। যুদ্ধবন্দি হত্যাসহ অন্যান্য নিষ্ঠুরতায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছায় তারা।
তাদের অত্যাচারের সঙ্গে পাকিস্তানের সেনাদের আরো মিল রয়েছে হিন্দুনিধনের ঘটনায়। একাত্তরে হিন্দুদের প্রতি শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সুচিন্তিত ও নির্মম। কারণ, তারা ধর্মভিত্তিক হত্যাকাণ্ডকে বৈধ করে তুলেছিল। তারা মনে করত, পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে এই উপমহাদেশের হিন্দু আধিপত্যের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র আবাসভূমির জন্য মুসলমানদের বিদ্রোহের কারণে।
এই হিন্দুবিদ্বেষ মনোভাব বছরের পর বছর লালিত হয়ে এসেছে। এ জন্য গণহত্যায় হিন্দু নিশ্চিহ্ন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। জনৈক গবেষকের ভাষায়, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের পর গোটা দেশে কেবল একটি উদীয়মান ও অস্তগামী রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ হয়নি, একাধিক জাতিগত দ্বন্দ্বও শুরু হয়ে যায়। এতে উভয় পক্ষের নির্যাতন শুরু হয়, তবে এর সূত্রপাত ঘটে ২৫ মার্চের আক্রমণের পর। পাকিস্তানি সরকারের পরিকল্পনার শিকার হয় দুই জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি। এর প্রথম শিকার হয় হিন্দু সম্প্রদায়, যাদের কেবল নির্যাতন করা হয়নি; বরং তাকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও পারিবারিক ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত এমনকি ধ্বংসও করা হয়। হিন্দুরা তাদের হৃত অবস্থান কোনোদিন উদ্ধার করতে পারেনি বাংলাদেশে। সম্প্রদায়গতভাবে তারাই ১৯৭১ সালের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী।’
এমনকি ধর্ষণকেও তারা বৈধ বলে মনে করত। চীনের নানকিংয়ে জাপানি সেনা কর্তৃক ধর্ষণ, রাশিয়ায় নাৎসিদের বলাৎকার এবং আর্মেনিয়া ও বসনিয়ার নারী নির্যাতনের সাযুজ্য রয়েছে বাঙালি নারী ধর্ষণের ঘটনায়। পাকিস্তানিদের বাঙালি নারী ধর্ষণের লক্ষ্য ছিল পরিবার, সম্প্রদায় ও জাতিকে মানসিকভাবে আহত ও পঙ্গু করা।
মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধে পরাজিত ও বাঙালি জাতিকে বশীভূত করতে না পারার যাতনা তারা মেটাত নারী ধর্ষণ করে। এটা ছিল ভয়ংকর মনোবিকারজাত। সার্বরা মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করেছিল ‘ইথনিক ক্লিনজিং’-এর উপায় হিসেবে। জহির রায়হানের তথ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’-এ যুদ্ধকালীন এসব নির্মম বাস্তবতাই উন্মোচিত হয়েছে।
তবে শামসুর রাহমানের কবিতায় রয়েছে হত্যাযজ্ঞের স্পষ্ট উচ্চারণ : ‘কখনও নিঝুম পথে হঠাৎ লুটিয়ে পড়ে কেউ গুলির আঘাতে/ মনে হয় ওরা গুলিবিদ্ধ করে স্বাধীনতাকেই/দিন-দুপুরেই জীপে একজন তরুণকে কানামাছি করে নিয়ে যায় ওরা/ মনে হয় চোখ-বাঁধা স্বাধীনতা যাচ্ছে বধ্যভূমিতে/ বেয়নেটবিদ্ধ লাশ বুড়িগঙ্গা কি শীতলক্ষ্যায় ভাসে/ মনে হয়, স্বাধীনতা-লখিন্দর যেন/ বেহুলা-বিহীন/ জলেরই ভেলায় ভাসমান।’ (সন্ত্রাসবন্দী বুলেটবিদ্ধ দিন-রাত্রি)
যুদ্ধসময়ের বাংলাদেশে, সেই ভয়াল একাত্তরে প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর আশঙ্কায় যাদের বুক কেঁপে উঠেছে, সেই চিত্র ধরা রয়েছে কবিতার চরণে চরণে। স্বাধীনতার জন্য কবির আর্তি আর ধ্বংসলীলাও রয়েছে কবিতায়, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা/তোমাকে পাওয়ার জন্যে/আর কতকাল ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?/আর কতকাল দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?’ (তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা)
কবিতায় আমরা পাই স্বাধীনতার মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর নাম, মুক্তিযোদ্ধা, গেরিলা, পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা, ধর্ষিত নারীর আহাজারি, সন্তানহারা মায়ের আকুতি, যুদ্ধে যাওয়া সন্তানের জন্য শুভকামনা, গণহত্যা, লুণ্ঠন, স্বাধীনতার শপথ সবই। একটি অভিব্যক্তি স্মরণীয়, ‘হঠাৎ স্তব্ধতা বিদীর্ণ হয়ে যাবার একটি শব্দ আমরা শুনতে পাই/ হঠাৎ চব্বিশটি রক্তাক্ত দেহ-রমণী, শিশু, যুবক, প্রৌঢ়/ আমরা দেখতে পাই এক মুহূর্তের জন্যে/ রক্তাক্ত এবং লুণ্ঠিত/ দ্বিতীয়বার আর নয়/ রক্তাক্ত, লুণ্ঠিত এবং প্রাণহীন/ দেয়ালের পায়ের কাছে চত্বরে তারা শুয়ে আছে।’ (অন্তর্গত, সৈয়দ শামসুল হক)
জসীমউদ্দীনের কবিতায় আছে একাত্তরে দগ্ধ গ্রামের কথা। সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ‘গেরিলা’ কবিতায় যখন দক্ষিণ ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, বাংলাদেশ, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিকের কথা বলেন, তখন এসব দেশের হত্যাযজ্ঞকেই ইঙ্গিত করেন এবং প্রতিরোধ যুদ্ধের চিত্র তুলে ধরেন।
কম্বোডিয়ার জেনোসাইড নিয়ে কবিতা লিখেছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। ফজল শাহাবুদ্দীনের ‘বাংলাদেশ একাত্তরে’ আছে, ‘বাংলাদেশ আগুন লাগা শহর আর লক্ষ গ্রাম/ বাংলাদেশ দুর্গময় ক্রুদ্ধ এক ভিয়েতনাম।’
আর শহীদ কাদরী মনে করিয়ে দেন, ‘যদিও বধ্যভূমি হল সারা দেশ, তবু ঘরে ফিরবার ব্যাকুলতা আমরা উন্মুখ।’ (ব্ল্যাকআউটের পূর্ণিমায়)
পিকাসোর বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘গোর্নিকা’ স্পেনের গৃহযুদ্ধের হত্যাযজ্ঞের সাক্ষ্য। দিলওয়ারের মতো কবি একাত্তরের বাংলাদেশের চিত্রকে ঠিক সেভাবেই স্মরণ করেন ‘যুদ্ধ যখন মানবতার পরিত্রাণ’ কবিতায়।
নাসির আহমেদ ‘বুকের ভেতরে বাজে’ কবিতায় লেখেন, ‘পিকাসোর গোয়ের্নিকার ভয়াল চিৎকারে যেন মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যায়।’
আবার আসাদ চৌধুরী ‘বারবারা বিডলার-কে’ কবিতায় ভিয়েতনামের প্রসঙ্গ তাঁর নিজের জন্মভূমির প্রেক্ষাপটেই তুলে ধরেন। মোহাম্মদ রফিক ‘রোকসানা ও রোকসানা’ কবিতায় একাত্তরে পাকিস্তানিদের নারী নির্যাতনের ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কোনো কোনো কবি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার কথা বলতে হিরোশিমা ও নাগাসাকির নিরাপরাধ ও হতভাগ্য মানুষের পরিণতির কথা লিখেছেন।
স্বধর্মী মানুষের প্রতি পাকিস্তানিদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়ও কবিতায় আছে রবিউল হুসাইনের ‘প্রিয়তমা বাংলাদেশ’ কবিতায়। কবিতায় বহু শব, বহু মৃতের কথা ঘুরেফিরে এসেছে। কবি আনওয়ার আহমদ অন্যায্য মৃত্যু দেখে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরে উচ্চারণ করেছেন, ‘ধর্মের নামেও মানুষের ছাউনি ও সম্বল ছাই হয়/ এই বিস্ময় পুরোপুরি ধারণের আগে/ আমার সর্বাঙ্গে প্রচণ্ড তেজে জ্বলে ওঠে ন্যায়সঙ্গত আগুন।’(স্বাধীনতা নিরেট গদ্য)
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতায় সেই আগুন আরো দ্বিগুণ করে তুলেছেন। ‘এদেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়?’
গণহত্যার অনুপুঙ্খতা রয়েছে তাঁর কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে। ‘নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ/ মুণ্ডুহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বীভৎস শরীর/ ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে—আমি ঘুমতে পারি না আমি ঘুমুতে পারি না’।
যে হলোকস্ট ছিল ‘হরর অব অল হররস’ সেই গণহত্যা থেকে প্রাণে বেঁচে আসা ইতালির ইহুদি কবি প্রিমো লেভি লিখেছেন Shema নামক কবিতা। অন্যদিকে ডারফুর গণহত্যার বিরুদ্ধে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা। William F. DeVault-এর Darfur (Jesus Wept) একটি বিখ্যাত কবিতা। এর কয়েকটি চরণ এ রকম—Half a million dead in Darfur, in the Sudan./100 times the innocents who died on 9/11./Children. Women, Men, Genocide./Wake up and see./ Wake up and see./ Wake up and see/ why Jesus wept.
লক্ষণীয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অজস্র কবিতা রচিত হলেও গণহত্যার বিশদ বিবরণ কবিতা থেকে পাওয়া যায় না। আবার হত্যাযজ্ঞবিরোধী কবিতা সে অর্থে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া লক্ষণীয় নয়; বরং উপন্যাসে সেই পরিচয় অনেক নিবিড়।
নাৎসিদের জঘন্য হত্যাকাণ্ডের বিবরণ রয়েছে Schindler’s List উপন্যাসে। টমাস কেনালির উপন্যাসটির চলচ্চিত্রায়ণও হয়েছে।
Christoph Fischer এর বিখ্যাত উপন্যাস The Luck of the Weissensteiners হলোকস্টের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পূর্ব ইউরোপের একটি শহরের তিন জাতির জীবন চিত্রিত হয়েছে এর বৃহৎ প্রেক্ষাপটে। ইহুদি ও ক্যাথলিক পরিবারের কাহিনীর ভেতর ঢুকেছে বিশ্বযুদ্ধের ভয়ংকর বাস্তবতা।
প্রথমে ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং পরে কমিউনিস্ট দ্বারা কুক্ষিগত স্লোভাকিয়া শহরটি যুদ্ধের নির্মমতার প্রত্যক্ষ সাক্ষীতে পরিণত হয়। উপন্যাসটি পাঠ করলে সেখানে বঞ্চনা, ভয়, অবিশ্বাস, প্রতারণার বিপরীতে পরিবারের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর নানান নাটকীয়তার সাক্ষাৎ মিলবে। দুঃসহ মানসিক যন্ত্রণা আর অকল্পনীয় বিড়ম্বনার সঙ্গে লড়াই করে মানুষের জয়ী হওয়ার ইতিহাস পাওয়া যায় আখ্যানে।
প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মানুষের বেঁচে থাকার কাহিনীই লেখক বলেছেন। যারা কখনো হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কথা শোনেনি কিংবা সেনাবাহিনীর আগ্রাসন দেখেনি, তাদের কাছে এই উপন্যাস জেনোসাইডের অনবদ্য দলিল হিসেবে খ্যাত হবে।
হলোকস্টের আরেকটি উপন্যাস Markus Zusak-এর The Book Thief। ১৯৩৯ সালের নাৎসি জার্মানের কাহিনী এটি। মিউনিখের বাইরে বসবাসকারী এক নারীর কাহিনী; যে অন্যের জিনিস চুরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। একদিন একটি বই চুরি করে সে তার পালিত পিতা ও প্রতিবেশীদের সহায়তায় পড়তে শুরু করে। ঠিক তখনই যুদ্ধের বোমাতঙ্কের ভেতর ইহুদি নিধন শুরু হয়। সে সময় তাদের বাসায় একজন ইহুদিকে লুকিয়ে রাখে সে। চোর কীভাবে মানবতার দিগন্তে উচ্চতায় আরোহণ করে তার দৃষ্টান্ত এটি।
‘নাইট’ নাৎসিদের মৃত্যুপুরীর বীভৎসতা নিয়ে লিখিত। এর ভেতর একটি তরুণ ইহুদি বালকের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার বয়ান রয়েছে। যেখানে তার পরিবারের সদস্য, তার সারল্য আর তার ঈশ্বরেরও মৃত্যু ঘটেছে। ব্যক্তিক অনুভূতিতে ভাস্বর আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির মতোই ‘নাইট’-এর কাহিনী এই আতঙ্ক শিহরিত ও অমোচনীয় ঘটনা দ্বারা পূর্ণ।
লেখকের প্রত্যাশা এ ধরনের শোকের যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। ‘দি অ্যাসল্ট’ উপন্যাসে হল্যান্ডে নাৎসি বাহিনীর বর্বরতা বিবৃত হয়েছে। ১৯৪৫ সালের শীতের রাতে একটি ডাচ শহরে নাৎসি জার্মানরা একটি সাধারণ পরিবারের সকলকে হত্যা করে; তবে প্রাণে বেঁচে যায় ছোট ছেলে ১২ বছরের আন্তন। আন্তনের জীবনে বহন করতে হয় সেই হিংস্রতার স্মৃতি। তার বেঁচে থাকা জীবনে সেই নিরপরাধীদের হত্যাকাণ্ড মেনে নিয়ে টিকে থাকতে হয়।
Irène Némirovsky এর Suite Française ১৯৪০ সালে জার্মানদের দ্বারা প্যারিস দখলের বাস্তবতায় লিখিত। এমনকি এই নারী লেখককে ইহুদি হওয়ার কারণে নির্বাসনে পাঠানো হয় এবং সেখানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ৬৪ বছর পর্যন্ত তাঁর এই উপন্যাসটি গোপন ও অজ্ঞাত স্থানে ছিল। নাৎসি সেনাদের দখলে থাকা জীবনের কষ্ট প্রকাশ পেয়েছে এর কাহিনীতে।
ক্যারেন লেভিন রচিত ‘হ্যানা’স সুটকেস : এ ট্রু স্টোরি’ ১৯৩১ সালে নাৎসি কর্তৃক চেক প্রজাতন্ত্র দখল ও পরে হ্যানা ও তার পরিবারের শোচনীয় পরিণতির কথা নাটকীয় আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হয়েছে। ২০০০ সালে জাপানের টোকিও হলোকস্ট এডুকেশন সেন্টারে হ্যানা ব্রাডির একটি সুটকেস এসে পৌঁছায়।
সেন্টারের পরিচালক অনুসন্ধান চালিয়ে হ্যানা ও তার পরিবারের ঘটনা জানতে পারেন। হলোকস্টের সূত্র ধরে ইহুদিদের কাহিনী আছে ‘সোফি’স চয়েস’ এবং ‘দি হাইডিং প্লেস’ উপন্যাসে। শেষের উপন্যাসটিতে হল্যান্ডের বাসিন্দারা নাৎসিদের হাত থেকে ইহুদিদের রক্ষার জন্য গোপন সুড়ঙ্গ তৈরি করেছিল।
মানুষে মানুষে এই ভালোবাসা যুদ্ধের বীভৎসতার বিরুদ্ধে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সংঘটিত জেনোসাইডের বিস্তৃত বিবরণ আছে Azriel Feuerstein-এর The Tumbler গ্রন্থে। নাৎসিদের পুড়িয়ে মারার গ্যাস চেম্বারগুলো কেবল স্মৃতিকথা নয়, কথোপকথনের আঙ্গিকেও তুলে ধরেছেন লেখক। Christopher Huh রচিত ও ২০১৩ সালে প্রকাশিত KEEPING MY HOPE ঐতিহাসিক উপন্যাস।
নাৎসিদের দ্বারা ধৃত এক কিশোরের মৃত্যু অভিজ্ঞতার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এ গ্রন্থের আখ্যানে। গ্যাস চুল্লির আঙিনা ও নির্যাতন ক্যাম্পের ভেতর থেকে বেঁচে ফেরা এরই জীবনসংগ্রামে টিকে যায়। কিন্তু বিপুল সংখ্যক মানুষের হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি নিয়ে তাকে বাকি জীবন পার করতে হয়।
আইরিশ চ্যাং রচনা করেছেন চীনের গণহত্যা নিয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দি রেপ অব নানকিং—ফরগোটেন হলোকস্ট অব ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু’।
১৯৩৭ সালে তিন মাসে জাপানিরা তিন লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে হারিয়ে যাওয়া সেই গণহত্যাকে আবার জাগিয়ে তোলার পুরো কৃতিত্ব আইরিশ চ্যাং-এর। ম্যানবুকার জয়ী এলিসন পিকের ‘ফার টু গো’ অনবদ্য গ্রন্থ। নাৎসিদের বন্দিশিবিরের বিবরণ আছে কার্লো মাটাসের ‘ডানিয়েলস স্টোরি’তে।
হেরম্যান ওউক অসাধারণ ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখে জেনোসাইডকে স্মরণীয় করে রেখেছেন তাঁর ‘দ্য উইন্ডস অব ওয়ার’-বইতে। সিঙ্গারের ‘শোশা’ হলোকস্টের নাটকীয় আখ্যান হিসেবে গণ্য। কেবল হিটলারের নিধনযজ্ঞ নয়, রচিত হয়েছে আর্মেনিয়ানদের গণহত্যার ওপর গ্রন্থ ‘দি বারনিং টাইগ্রিস’, সুদানে সংঘটিত নির্মমতা নিয়ে ‘টিয়ার্স অব দ্য ডেজার্ট’।
উপন্যাসের বৃহৎ পরিপ্রেক্ষিত না থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাসটিতেই গণহত্যার উন্মোচন লক্ষণীয়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘একটি কালো মেয়ের কথা’ একাত্তরে বাংলাদেশের যুদ্ধের বাস্তবতায় গণহত্যা ও ধর্ষণের নির্মম চিত্র প্রকাশিত হয়েছে।
আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ উপন্যাসে ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যার বিবরণ রয়েছে। হত্যার লক্ষ্যবস্তু কারা তা জানিয়েছেন লেখক, ‘জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের সঙ্গে সেনাবাহিনীর শলাপরামর্শ চলছে শুনলাম।...চার শ্রেণীর মানুষকে ওরা দেশ থেকে নির্মূল করবে... বুদ্ধিজীবী, আওয়ামী লীগার, কম্যুনিস্ট ও হিন্দু।’
শওকত ওসমানের ‘দুই সৈনিক’ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি গ্রামে কিছু সংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য কর্তৃক বাঙালি নারী ধর্ষণ, পাশবিক অত্যাচার ও নির্যাতনের চিত্র রয়েছে। ‘নেকড়ে অরণ্যে’ও পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী কর্তৃক সংঘবদ্ধভাবে বাঙালি নারী ধর্ষণ ও পাশবিক অত্যাচারের কাহিনী বিবৃত হয়েছে।
ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থের উপন্যাস ‘বন্দী দিন বন্দী রাত্রি’তে ধর্ষণের চিত্র রয়েছে, ‘খান সেনারা বাংলার বুকে তখন ফুলের মতো বাংলার নারীকে ধর্ষণ করে চলে। স্তন কেটে ওরা পৈশাচিক খুশিতে লোফালুফি করে। পাশবিক উল্লাসে ওরা ফেটে পরে যখন বেয়নেটের নির্মম খোঁচায় কোন নারীর গোপন অঙ্গ থেকে রক্ত ঝরে।’
রিজিয়া রহমানের ‘রক্তের অক্ষর’-এ যুদ্ধে বিপন্ন নারীর কথাই চিত্রিত হয়েছে। পূর্বেই বলা হয়েছে পাকিস্তানের এ ধরনের কর্মকাণ্ড ছিল গণহত্যার অংশ।
রাবেয়া খাতুনের ‘ফেরারী সূর্য’ উপন্যাসে হত্যাযজ্ঞের বিবৃতি এ রকম, “বাসায় ফেরার পথে এক লোকের মুখে শুনলেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বাঙালি সদস্যদের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সংঘাত এবং অগুণিত লাশের কথা। স্টেশনের মালগাড়ি ভর্তি অগুণিত লাশ আর লাশ। কারফ্যু, ত্রাস, গোলাবৃষ্টি তার মধ্যেও খবর চাপা থাকেনি। ইয়াহিয়ার নেকড়ে সেনারা শহরের মধ্যে অগুণিত লোক হত্যা করেছে। বুদ্ধিজীবীদের ঘর থেকে ডেকে গুলি করেছে, ট্রাকভর্তি কুলকন্যাদের ধরে নিয়ে গেছে ক্যান্টনমেন্টে। আক্রান্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়, কয়েকটি ছাত্রাবাস, পত্রিকা অফিস, প্রেস ক্লাব, বাংলা একাডেমি। আক্রমণ থেকে রেহাই পাইনি পূত শহীদ মিনার, ছাত্রীবাস, মেডিক্যাল হাসপাতাল।...পাকিস্তানি সৈন্যরা আগে খুঁজত আওয়ামী লীগার এখন খোঁজে ‘মুক্তিলোগ’।”
সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘যুদ্ধ’ এবং ‘গেরিলা ও বীরাঙ্গনা’ উপন্যাসত্রয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার বিবরণ এবং দেশের মধ্যে গণহত্যার ঘটনা উপস্থাপিত হয়েছে।
রশীদ হায়দারের ‘অন্ধকথামালা’য় হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন স্পষ্ট, ‘মেজর সাহেব তো পরিষ্কার বললেন, যারা পাকিস্তান রক্ষার জন্য কাজ করবে তাদের মালাউনদের ছেড়ে যাওয়া সমস্ত জমিজমা বাড়িঘর, টাকা পয়সা, মালমাত্তা সমান ভাগে ভাগ করে দেয়া হবে।’
ইমদাদুল হক মিলনের ‘কালোঘোড়া’, ‘ঘেরাও’, ‘মহাযুদ্ধ’, ‘রাজাকারতন্ত্র’, ‘বালকের অভিমান’ প্রভৃতি উপন্যাসে পাকিস্তানবাহিনীর বর্বরতা নিপুণ বর্ণনায় উন্মোচিত হয়েছে। ‘কালোঘোড়া’য় হিন্দু জনগোষ্ঠীর দেশত্যাগের কথা আছে।
মোস্তফা কামালের ‘জনক জননীর গল্প’ উপন্যাসে বাঙালির বিরুদ্ধে রাজাকারদের ভূমিকার অনুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া যায়। উপরন্তু অগ্নিসংযোগ, হত্যাকাণ্ড এবং নারী নির্যাতনের প্রসঙ্গও রয়েছে তাঁর উপন্যাসে। অন্যদিকে সৈয়দ শামসুল হকের একাধিক উপন্যাসে হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের কাহিনী রয়েছে।
‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’ এবং ‘অন্তর্গত’-এর কাহিনীতে জেনোসাইডের অনেক উপকরণ উপস্থাপিত হয়েছে। ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাসে জলেশ্বরীতে হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী ও তাদের দোসর বিহারীদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার বিবরণ আছে, আছে নারী নির্যাতনেরও কথা।
অনুরূপভাবে হুমায়ূন আহমেদের একাধিক উপন্যাসে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা, রাজাকার বাহিনীর তৎপরতা চিত্রিত হয়েছে। তাঁর ‘অনিল বাগচীর একদিন’ উপন্যাসটি সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন এবং নিপীড়নের চিত্র হিসেবে অনন্য। আমজাদ হোসেনের ‘যুদ্ধযাত্রার রাত্রি’ উপন্যাসে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের কথা আছে।
বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে বেশ কয়েকজন গল্পকার লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের পটভূমির গল্প। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্পগুলোর মধ্যে ইমাদাদুল হক মিলনের ‘লোকটি রাজাকার ছিল’ অন্যতম। আর মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে শওকত ওসমানের ‘জন্ম যদি তবে বঙ্গে’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘জলেশ্বরীর গল্প’, আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা’, আবুবকর সিদ্দিকের ‘মরে বাঁচার স্বাধীনতা’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘অপঘাত’, সেলিনা হোসেনের ‘আমিনা ও মদিনার গল্প’, হুমায়ূন আহমেদের ‘শীত’, ‘উনিশশো একাত্তর’, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘কেয়া’, ‘আমি এবং জারমান মেজর’, মইনুল আহসান সাবেরের ‘ভুলবিকাশ’।
এসব গল্পকার বর্ণনার মধ্য দিয়ে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে গণহত্যার প্রসঙ্গ উন্মোচন করেছেন। যদিও অনুপুঙ্খ বর্ণনা খুব কম সংখ্যক গল্পে উপস্থাপিত হয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর গণহত্যার তালিকায় পাকিস্তান একটি অপরাধী রাষ্ট্রের নাম। কারণ লাখো বাঙালির প্রাণের বিনিময়ে তারা সেদিন তাদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে চেয়েছিল। অথচ বাঙালি জাতিগোষ্ঠী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর কোনোরূপ অন্যায় পীড়ন করেনি। তবু বাঙালির প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের বর্বর ও নৃশংস আচরণ বিশ্বের কাছে তাদের ঘৃণ্য মানসিকতাকে প্রকাশ করে দিয়েছিল।
পাকিস্তানিদের আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ড ছিল ফ্যাসিস্টদের মতো। তাই তারা পোষণ করেছিল জাতি বা ধর্ম সম্প্রদায় বিদ্বেষ, হত্যা করেছিল নিরীহ নিরপরাধ জনসাধারণকে। সেই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড আমাদের সাহিত্যের নানান আঙ্গিকে আত্মপ্রকাশ করেছে বাস্তবতার আঙিনা দিয়ে। যেমন বিশ্বের অন্যান্য গণহত্যাকে কেন্দ্র করে উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে।
পৃথিবীর মানব জনগোষ্ঠীকে নির্মম নিধনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য উচ্চকণ্ঠ হওয়া এবং হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার লেখকরাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের একমাত্র ভরসা। আশা করা যায় জেনোসাইড সাহিত্যের আরো শাখা-প্রশাখাকে সমৃদ্ধ করবে এবং হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে জেগে উঠবে লক্ষ প্রাণ।
পৃথিবীব্যাপী কুখ্যাত জেনোসাইড
আর্মেনিয়ান গণহত্যা : ১৯১৫-১৯২৩; তুর্কিরা হত্যা করে এক কোটি ৫০ লাখ মানুষ।
ইউক্রেন : ১৯৩২-১৯৩৩; সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট স্টালিনের জন্য দুর্ভিক্ষে নিহত হয় আট লাখ মানুষ।
ইউরোপ : ১৯৪১-১৯৪৫; হলোকস্ট-ইহুদি নিধন ও অন্যান্য হত্যাযজ্ঞ, সর্বোচ্চ সংখ্যা এক কোটি ৭০ লাখ। (নিহত হয় ইহুদি, রোমানিয়া, পোলিশ, সোভিয়েত জনতা ও অনেক বলশেভিক নেতা)
পূর্ব ও মধ্য ইউরোপ থেকে জার্মান বিতাড়ন ও হত্যা : ১৯৪৫-১৯৫০; নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ।
গুয়াতেমালা : ১৯৬২-১৯৯৬; মায়া মানবগোষ্ঠী নিধন, নিহতের সংখ্যা দুই লাখ।
নাইজেরিয়া : গৃহযুদ্ধ ১৯৬৭-১৯৭০; নিহত সর্বোচ্চ ৩০ লাখ।
বাংলাদেশ : ১৯৭১; নয় মাসে ৩০ লাখ নিহত।
কম্বোডিয়া : ১৯৭৫-১৯৭৯; কমিউনিস্ট খেমাররুজরা হত্যা করে ১০ লাখ মানুষকে।
রুয়ান্ডা : ১৯৯৪-১৯৯৪; তুতসি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যা, নিহত অন্তত ১০ লাখ।
সুদান : ডারফুর সংঘাত ২০০৩-২০১০; নিহত অন্তত চার লাখ।
বুরুন্ডি : গোষ্ঠী নিধন, ১৯৭২-১৯৭২; নিহতের সংখ্যা এক লাখ।
নামিবিয়া : ১৯৮৪-১৯৮৮; নিহতের সংখ্যা ৭৫ হাজার।
বসনিয়া : ১৯৯৫; নিহতের সংখ্যা সাড়ে আট হাজার।
চীনের নানকিংয়ে গণহত্যা : জাপান কর্তৃক ধর্ষণ ও হত্যাযজ্ঞ, ১৯৩৭-১৯৩৮; নিহত অন্তত তিন লাখ।
লেখক : অধ্যাপক ও পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।