রাস্কিন বন্ডের গল্প
নয়ন ছেড়ে চলে গেলে
রোহানা পর্যন্ত ট্রেনের কামরায় একাই ছিলাম। একটি মেয়ে তার পর উঠল। যে দম্পতি তাঁকে বিদায় জানাতে এসেছিল, সম্ভবত তাঁরা তাঁর বাবা-মা ছিলেন। মনে হলো তাঁরা তাঁর ভালো-মন্দ নিয়েও বেশ উদ্বিগ্ন। আর কোথায় জিনিসপত্র রাখতে হবে, কখন জানালা দিয়ে ঝুঁকবে না এবং কীভাবে অপরিচিত লোকদের সঙ্গে বাক্যালাপ এড়িয়ে চলবে—এসব বিষয়ে ভদ্রমহিলাটি মেয়েটিকে সবিস্তারে জানিয়ে দিল।
তাঁরা বিদায় শুভেচ্ছা জানালেন, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ট্রেনটি স্টেশন ছেড়ে এগিয়ে যেতে লাগল। যেহেতু আমি সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন, যেহেতু কেবল আলো আর আঁধার অনুভূত হয় আমার চোখে, সেহেতু মেয়েটি ঠিক কেমন দেখতে তা আমার পক্ষে বলা মুশকিল ছিল। তবু তাঁর গোড়ালিতে চটাস চটাস শব্দ শুনে আমি বুঝেছিলাম, সে ঘরে পরার চটি পরেছিল।
তাঁকে কেমন দেখতে এটা বুঝে উঠতে আমার বেশ কিছুটা সময় নিতে হবে, আর হয়তো আমি কখনোই তা বুঝতে পারব না। তবু তাঁর কণ্ঠস্বর আমার ভারি ভালো লাগল, আর ভালো লাগল তাঁর চটির আওয়াজ।
'আপনি কি দেরাদুন পর্যন্তই যাবেন?'
আমি নিশ্চয়ই এক অন্ধকার কোণে বসেছিলাম, কারণ আমার কণ্ঠস্বর তাঁকে চমকে দিয়েছিল। সে একটু অবাক হয়েই বলল, 'আর কেউ আছে কি না, আমি বুঝতে পারিনি!'
ঠিক, এ রকম তো মাঝেমধ্যেই হয়, যখন ভালো দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন লোকেরা তাদের সামনে কী আছে, তা বুঝতে পারে না। মনে হয়, তাদের এত কিছু দেখার আছে যে তারা হয়তো তাই দেখতে পায় না; যেখানে যারা ভালো দেখতে পায় না অথবা খুব কম দেখে, তারা শুধু গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলোতে গুরুত্ব দেয়, যা তাদের বাকি ইন্দ্রিয়গুলোকে দারুণভাবে চাঙ্গা রাখে।
'আমি তো আপনাকে লক্ষই করিনি,' আমি বললাম, 'কিন্তু বুঝতে পেরেছি আপনি এসেছেন।'
আমি ভেবে পাই না, আমার অন্ধত্ব প্রকাশ পাওয়া থেকে আমি তাঁকে বিরত করতে পারব কি না। মনে হয়, এটা হয়তো খুব একটা কঠিন কাজ হবে না, যদি কি না আমি নিজের বসার জায়গাটায় স্থির থাকি।
'আমি সাহারানপুরে নামছি। চাচি আমাকে নিতে আসছেন।'
'তাহলে বরং খুব বেশি পরিচিতি বাড়িয়ে লাভ নেই। চাচিরা সাধারণত জাঁদরেল হয়ে থাকেন।'
'তা আপনি কোথায় যাচ্ছেন?'
'এই প্রথমে দেরাদুন, আর তার পর মুসৌরি।'
'ওহ আপনি কী সৌভাগ্যবান! আমার মুসৌরি যেতে ইচ্ছে করে। আমার পাহাড়-পর্বত দারুণ লাগে, বিশেষ করে অক্টোবরে!'
'হ্যাঁ, এটাই তো সবচেয়ে আদর্শ সময়,' স্মৃতিকে ভর করে বললাম, 'বুনো ডালিয়ায় পাহাড়গুলো ঢেকে যায়, সূর্যের কিরণ তখন চমৎকার থাকে, আর রাতের বেলা আপনি কাঠ জ্বেলে তার সামনে বসে একটু গলা ভিজিয়ে নিতে পারবেন। বেশির ভাগ পর্যটক এ সময় বাড়ি ফিরে যায়, ফলে রাস্তাগুলো নিস্তব্ধ ও প্রায় জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে। হ্যাঁ, অক্টোবরই সর্বোৎকৃষ্ট!'
সে চুপচাপ ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমার কথাগুলো তাঁকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল কি না অথবা সে আমাকে এক রোমান্টিক নির্বোধ মনে করল কি না। ঠিক তক্ষুনি আমি ভুলটা করেছিলাম।
'বাইরেটা কেমন দেখাচ্ছে?'
মনে হলো সে এ রকম প্রশ্নে অদ্ভুত কিছু খুঁজে পেল না। আচ্ছা আমি যে দৃষ্টিহীন, সেটা কি তাঁর নজরে এসেছে? কিন্তু তার পরের প্রশ্ন আমার সন্দেহ দূর করে দিল।
'আপনি জানালা দিয়ে কেন বাইরেটা দেখছেন না?'
আমি স্বচ্ছন্দে বার্থ বরাবর এগিয়ে এসে জানালার চৌকাঠটা অনুভব করলাম। জানালাটা খোলা ছিল। আর জানালাটার দিকে মুখ ফিরে থাকলাম, যেন সম্মুখের নৈসর্গিক দৃশ্য আমি পর্যবেক্ষণ করছি।
ইঞ্জিনের ধকধকানি, চাকার ঘরঘরানি শুনছিলাম, আর মনের চোখে টেলিগ্রাফের খুঁটিগুলোর দ্রুত পেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্য অনুভব করলাম। সাহস করেই বলে উঠলাম—
'আপনি খেয়াল করেছেন, গাছগুলো ছুটছে যেখানে মনে হচ্ছে আমরা স্থির আছি?'
'এমনটাই তো ঘটে থাকে। আপনি কি কোনো প্রাণী দেখতে পাচ্ছেন?'
'না তো!' বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বললাম, কারণ আমি জানতাম দেরাদুনের কাছাকাছি বনে প্রায় কোনো প্রাণীই ছিল না।
জানালার পাশ থেকে ঘুরে মেয়েটির মুখোমুখি হলাম, আর কয়েক মুহূর্ত আমরা নীরবে বসে রইলাম।
'আপনার মুখটা কিন্তু দারুণ!' মনে হচ্ছে বেশ সাহসী হয়ে উঠেছি, কিন্তু মন্তব্যটা ছিল ঝুঁকিহীন। তোষামোদকে খুব কম মেয়েই দূরে ঠেলে রাখতে পারে। সে একথায় মিষ্টি হাসল, বলা যায় সে এক মৃদু খিলখিল হাসি।
'আমার মুখটা যে দারুণ, এটা ভালো বললেন। কিন্তু আমার মুখটা সুন্দর এ কথা লোকের মুখে শুনতে শুনতে আমি বেশ ক্লান্ত!'
ওহো, তাহলে আপনার মুখটা সত্যিই সুন্দর! এ কথা ভাবতেই বেশ জোরে বলে উঠলাম, 'শুনুন, একটা দারুণ মুখাবয়ব সুন্দর হতেই পারে!'
'আপনি না খুব দুঃসাহসী যুবক! কিন্তু আপনি এতটা গম্ভীর কেন?'
ভাবলাম, এবার তাঁর জন্য একটু হাসার চেষ্টা করে দেখি, কিন্তু এই হাসির চিন্তাটা আমাকে কেবল উদ্বিগ্ন ও নিঃসঙ্গ করে তুলল।
'শিগগিরই আমরা আপনার গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছি।'
'ভাগ্যিস এটা অল্পসময়ের ভ্রমণ! আমি না দু-তিন ঘণ্টার বেশি ট্রেনে বসে থাকতে পারি না।'
হ্যাঁ, শুধু তাঁর কথা শোনার জন্য যেকোনো সময়কাল ধরে বসে থাকতে প্রস্তুত ছিলাম। তাঁর কণ্ঠস্বরে ছিল পাহাড়ি নদীর উচ্ছলতা। সে ট্রেন ছেড়ে যেতে না-যেতেই হয়তো এই অতি সংক্ষিপ্ত আলাপনের কথা ভুলে যাবে, কিন্তু তাঁর স্মৃতি আমার মনে বাকিটা ভ্রমণ পথ থেকে যাবে, হয়তো বা আরো কিছুটা বেশি সময়!
ইঞ্জিনের বাঁশিটা তীক্ষ্ণ শব্দে বেজে উঠল। চাকাগুলো তাদের শব্দ ও ছন্দের পরিবর্তন ঘটাল। মেয়েটি উঠে পড়ে তাঁর জিনিসপত্র গোছাতে লাগল। আমি বুঝতে পারছিলাম না, তাঁর চুলটাকি খোঁপা করা আছে না বিনুনি করা। সম্ভবত কাঁধের ওপর তাঁর এলোচুল এসে পড়েছে, নাকি তাঁর চুলগুলো ছোট করে কাটা?
ধীরে ধীরে ট্রেনটি স্টেশনে ঢুকল। বাইরে কুলি ও বিক্রেতাদের চিৎকার-চেঁচামেচি। আর কামরার দরজায় এক তীক্ষ্ণ মহিলাকণ্ঠ, অবশ্যই সেই জাঁদরেল চাচির!
'চলি।'
আমার খুব কাছেই সে দাঁড়িয়ে, এতই কাছে যে তাঁর চুলের সুগন্ধ আমাকে প্রলুব্ধ করছে। মনে হলো হাত দিয়ে তাঁর চুলটা ছুঁয়ে দেখি। কিন্তু সে চলেই গেল। শুধু তাঁর চুলের সুগন্ধ তখনো সেখানে ছড়িয়ে ছিল।
দরজায় একটা হৈ-হট্টগোল চলছিল। এক ভদ্রলোক কামরায় ঢুকে আধোগলায় মার্জনা চাইলেন। দরজাটা তারপর দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল, আর গোটা জগৎটা আবার বন্ধ হয়ে এলো। আমার জায়গায় ফিরলাম। গার্ড বাঁশি বাজাল আর আমরা চলতে লাগলাম। আবার খেলার সুযোগ পেলাম, পেলাম এক নতুন সহযাত্রী।
ট্রেনের গতি বাড়ছিল। চাকাগুলো সুর তুলল। কামরাটিও দুলেদুলে আওয়াজ করতে লাগল। জানালাটা পেয়ে তার সামনে গিয়ে বসলাম, কেবল চেয়ে রইলাম সেই আলোর দিকে যে আলো আমার কাছে এক গভীর আঁধার মাত্র।
জানালার বাইরে কত কিছু ঘটে চলেছে, বাইরে যা ঘটছে তা অনুমান করাটা একটা বেশ মজার খেলা হতে পারে।
আগত যাত্রীটি আমার দিবাস্বপ্ন ভঙ্গ করল।
'আপনি নিশ্চয়ই হতাশ হবেন, কারণ সদ্য নেমে যাওয়া সহযাত্রীটির মতো আকর্ষণীয় ভ্রমণসঙ্গী আমি নই!'
'সে এক দারুণ মেয়ে। আচ্ছা, আপনি কি একটু জানাবেন তাঁর চুলটা লম্বা না ছোট?'
'ঠিক মনে করতে পারছি না।' একটু হকচকিত হয়ে আবার বললেন, 'তার চোখ দুটো কেবল দেখেছিলাম, তাঁর চুল নয়। তাঁর চোখ দুটো সুন্দর, কিন্তু সেগুলো কাজের নয়। সে সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন। আপনি খেয়াল করেননি?'
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি গান থেকে গল্পটির নামকরণ করা হয়েছে – রাস্কিন বন্ড)
গল্পটি ইংরেজি থেকে অনূদিত