মানুয়েল আলারকন এচেভেররিয়ার গল্প
বৃষ্টি
প্রাক-শরতের কনকনে ঠান্ডা এক সকালে সে ট্রেনে করে পৌঁছাল দক্ষিণের এই পরিচ্ছন্ন শহরে। কামরার জানালা দিয়ে শহরটাকে প্রথম দেখল সে। একপাশে ধূসর সাগর আর অন্যপাশে শতাব্দী প্রাচীন জঙ্গলের মাঝে যেন শহরের ঘরবাড়ি সব উঁকি দিচ্ছে। তাজা বাতাস বুক ভরে টেনে নিল সে। উত্তরের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরিয়েই চাকরিটা পেয়ে গেল, তাই দক্ষিণের এই শহরে আসা। ২২ বছরের যৌবনের দম্ভ, তার জীবনের রাস্তা শুধু সামনের দিকে দৌড়ায়। ছবির মতো সুন্দর একটা কাঠের বাড়ি ভাড়া নিল সে। চারপাশে ছোট ছোট পাহাড়, দেবদারুর বন আর নীল-সাদা-লাল ফুলের মেলা বসেছে।
জায়গাটা ভীষণ নিস্তব্ধ আর লোকজনও বেশ হাসিখুশি। অফিসটা তার বাড়ির এতই কাছে যে পাহাড়ি রাস্তাটা দিয়ে রোজ প্রায় দৌড়ে অফিস যেত সে। সিমেন্টের তৈরি অসংখ্য সিঁড়ি সাপের মতো এঁকেবেঁকে পাহাড়ে উঠে এসপ্লানেডে গিয়ে শেষ হয়েছে। সেখান থেকে নদীর মোহনা আর ছোট দ্বীপগুলো ছবির মতো মনে হয়।
ওখানেই মিউনিসিপালিটির একটি বাড়িতে তার অফিস। বড় বড় জানালার ফ্রেমে সব নৈসর্গিক শোভা যেন আটকে রয়েছে। রোজ সকালে ভরপেট প্রাতঃরাশ সেরেই ওই রাস্তা ধরে হাঁটত সে। সকালের স্যাঁতসেঁতে ঠান্ডায় তার গায়ে কাঁপুনি ধরে যেত। ওর বাড়ির মালকিন এলগা নামের গোলগাল জার্মান ভদ্রমহিলা রোজ দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসত আর নিয়মমাফিক রোজ বলত : “সন্ধ্যেবেলা দেখা হবে তাহলে। তবে বৃষ্টি থেকে সাবধান। এখানকার বৃষ্টিতে তুমি তো অভ্যস্ত নও..."
এলগা ঠিক কী বলতে চাইছেন ভাবতে ভাবতে সে অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে যেত, কয়েকটা পাথর ডিঙাবার পরই তার অদ্ভুত কথাগুলো সে বেমালুম ভুলে যেত।
সেদিন সকাল থেকেই আকাশ মেঘে ঢাকা, দমকা উত্তরে হাওয়ার দাপট আর বড় বড় জলের ফোঁটা আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস দিচ্ছিল। সে বেরোবার সময় এলগা তার পথ আটকাল : ‘বাছা, এখনি বৃষ্টি নামবে। এখন নাইবা বেরোলে। তোমরা উত্তরের লোকেরা তো এমন বৃষ্টির সাথে পরিচিত নও।’
এ কথার মাথামুন্ডু বুঝতে না পেরে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
‘ম্যাডাম, আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি উত্তরের লোক ঠিকই, তবে এখানকার বৃষ্টির সাথে তো আমাকে মানিয়ে নিতেই হবে।’
কাঁচের দরজা ঠেলে রাস্তায় নেমে পড়ল সে। পেছন ফিরে দেখল, এলগা জানলার শার্সিতে মাথা রেখে তার যাওয়ার পথেই তাকিয়ে রয়েছে। হাড়কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে সে পাহাড়ি রাস্তায় প্রায় দৌড়ে উঠতে আরম্ভ করল। হঠাৎ সেই বড় বড় জলের ফোঁটা অঝোরে ঝরতে শুরু করল। তার শরীর বেয়ে নেমে আসা বৃষ্টির ফোঁটা নিয়ে খেলতে খেলতে সে হেসে উঠল। বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে মাতোয়ারা চারপাশ। বৃষ্টিধারা তার মুখে আর হাতে পড়ে ছলকে উঠছিল। অদ্ভুত এক শিরশিরানি আচ্ছন্ন করে ফেলল তাকে। হাঁটার গতি সে বাড়িয়ে দিল। বৃষ্টি যেন তাকে স্নান করিয়ে দিচ্ছিল। সে আশ্রয় খুঁজতে লাগল ত্রস্ত পায়ে। কী মনে হতে সে নিজের হাতের দিকে তাকাল। তার শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের হিমেল স্রোত বয়ে গেল : তার শরীর থেকে দুধের মতো পাতলা মাংসের রস বেরিয়ে আসছে। সে থমকে দাঁড়িয়ে আরো ভালো করে দেখল। হাত ছেড়ে মুখের দিকে যেন এগিয়ে আসছে! তার মনে হলো, চামড়াটা কেমন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আতঙ্কে তার গলা থেকে অস্ফুট আর্তনাদ বেরিয়ে এলো। এতক্ষণে সে এলগার কথার মর্মোদ্ধার করতে পারল। বৃষ্টির দাপটে তার শরীর গলে যাচ্ছে। সে আতঙ্কে বাড়ির দিকে দৌড়াতে শুরু করল। তার পা দুটো যেন নরম তুলতুলে হয়ে যাচ্ছে। আতঙ্কে দিশেহারা সে দেখল তার প্যান্ট গলে বেরিয়ে আসছে এক চটচটে সাদা রস আর ধুইয়ে দিচ্ছে তার জুতো দুটোকে।
আবার সে নিজের হাতের দিকে তাকালো। নাহ্, এখন হাত দুটোর কোনো আকার নেই। আঙুলগুলো অনিয়তাকার স্ফীত হয়ে উঠেছে। পা দুটো আকারবিহীন স্তম্ভে রূপান্তরিত হয়েছে। রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সে। ইতিমধ্যে তার শরীরটা একতাল মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়েছে।
জীবনের শেষ মুহূর্তে সে দেখল তার শরীরটা সম্পূর্ণ গলে গিয়ে নর্দমার দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। শেষে তার শরীরটা কাদায় মিশে গেল। আর অবিশ্রান্ত বৃষ্টি তার ফাঁপা জামাকাপড় ধুইয়ে সাফ করে দিল।
কিছুক্ষণ পর বৃষ্টির তীব্রতা কমে এলো, আকাশটাও বেশ দ্রুত পরিষ্কার হয়ে গেল। মেঘের চাদর ছিঁড়ে এক ঝলক উঁকি দিল সূর্য। এই সময় একটা বড় লাল ছাতা হাতে এলগা হন্তদন্ত হয়ে এলো। রাস্তার ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জামাকাপড় দেখেই সে আর্তনাদ করে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল : ‘বেচারা! কতবার বারণ করলাম! কিন্তু ছেলেটা আমার কথা কানেই তুলল না। উত্তরের লোকেরা বুঝতেই পারে না এখানে এই দক্ষিণে কেমন মর্মভেদী প্রবল বৃষ্টি আসে!’
(মানুয়েল আলারকন এচেভেররিয়ার জন্ম ১৯৪৯ সালে, চিলির ভিনিইয়া দেল মারে অঞ্চলে।পেশায় ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার। এখন পর্যন্ত ৩০টিরও বেশি গল্প লিখেছেন। চিত্রকর ও ফোটোগ্রাফার হিসেবেও তিনি পরিচিত। মূল গল্প : Lluvia. বাংলায় 'বৃষ্টি' গল্পটি তাঁর আত্মজীবনীতে সংকলিত হয়েছে। জীবনের প্রথম চাকরিতে যোগ দিতে তিনি যখন পুয়ের্তো মন্ত শহরে যান, সেখানকার প্রবল বৃষ্টিপাতের মধ্যে দিন কাটে তাঁর। সেই স্মৃতিই 'বৃষ্টি' গল্পের উৎস। গল্পটি মূল স্প্যানিশ থেকে অনূদিত হয়েছে।)