প্রতিরোধের মার্চ
তাজউদ্দীনের মানসকন্যা

ইতিহাস সচেতন বাংলাদেশের কোনো নাগরিককে যদি জিজ্ঞেস করা হয় বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক জীবনের সর্বোচ্চ সাফল্য কী? সবাই একবাক্যে বলবেন যে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সাফল্য ও অবদান ছিল জাতির চরম দুর্যোগের সময় ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে যুদ্ধটাকে বিজয়ের সোপানে পৌঁছে দেওয়া, কিন্তু রাজনৈতিক জীবন তো মানুষের জীবনের একটি দিকমাত্র।
একজন মানুষের রাজনৈতিক চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটে থাকে তাঁর ব্যক্তি চরিত্রের বহুমাত্রিক চিন্তা, চেতনা ও গুণাবলির মধ্য দিয়েই। লোকচক্ষুর অন্তরালেও যখন অনাবৃত বিবেকের হৃদয়টি ঝলমলে সূর্যের মতোই দীপ্ত থেকে যায়, তখনই তো একজন রাজনৈতিক নেতা রূপান্তরিত হন মহামানবে। নিভৃতে তিনি যা সৃষ্টি করেন তা অমরতা লাভ করে তাঁর জনজীবনের সাফল্যের মতোই। কিছু ক্ষেত্রে হয়তো আরো বেশি, যখন নতুন কোনো জীবন বা তরুণ কোনো সত্তা আলোড়িত হয়, বিকশিত হয় ওই মহামানবের নির্মোহ পবিত্র চেতনার সংস্পর্শে। এখানে স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে তাজউদ্দীনের পরলোকগত (২২ আগস্ট ২০০৮) ভাগ্নি আনোয়ারা খাতুন আনারের প্রসঙ্গ।
১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসের ৪ তারিখের রোজনামচায়, রাজনৈতিককর্মী, ২২ বছরের তরুণ তাজউদ্দীন আনারের আসন্ন জন্ম সংবাদটি লিখেছিলেন মুক্তার মতো গুটি গুটি অক্ষরে।
কনিষ্ঠ ভগ্নী মরিয়ম বেগম ও আবুল কাশেম খানের প্রথম সন্তান আনার। নিগুয়ারী-গফরগাঁওয়ের খ্যাতনামা খাঁ পরিবারের কৃতী সন্তান আবুল কাশেম খান। তাঁর একমাত্র সন্তান আনার। স্ত্রী ও প্রিয়জনদের ছেড়ে তিনি পরলোকগমন করেন, যখন আনার দুধের শিশু মাত্র। সে যুগের গ্রামের আবহাওয়ায়, মেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়টি তেমন প্রাধান্য লাভ করেনি। পিতৃ স্নেহবঞ্চিত আনার যাতে উপযুক্ত শিক্ষাদীক্ষা পেয়ে বড় হয়ে উঠতে পারে সেই চিন্তায় তাড়িত হন উদীয়মান রাজনীতিবিদ তাজউদ্দীন, তিনি তখনো অবিবাহিত। আনারকে লালনপালনের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন। আনারকে তিনি ঢাকা শহরে নিয়ে আসেন। কলেজছাত্র তাজউদ্দীনের পরলোকগত বড় ভাই ওয়াজিউদ্দীন আহমদের একমাত্র পুত্রসন্তান দলিলউদ্দীন আহমদ ও ছোট ভাই আফসারউদ্দীন আহমদও তখন বসবাস করছেন শহরে, তাঁরই স্নেহ ছাঁয়ায়। পুরনো ঢাকা শহরের ১৭ নভেম্বর কারকুন বাড়ি লেনের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য আনারের নতুন জীবন শুরু হলো বড় মামা তাজউদ্দীনের বিশেষ তত্ত্বাবধানে। আনার বাংলাবাজার স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হলো। রয়াল স্টেশনারি থেকে ইংরেজি ও বাংলা হাতের লেখার খাতা কেনা হলো।
বড় মামা যত্নের সঙ্গে আনারকে হাতের লেখা প্র্যাক্টিস্ করাতেন। লেখাপড়া, আচার-আচরণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও ব্যক্তি-চরিত্রের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বড় মামার হাতে হলো আনারের হাতেখড়ি (পরবর্তী সময়ে রাজবন্দি হিসাবে সুদীর্ঘকাল কারান্তরীণ থাকার কারণে তাজউদ্দীন তাঁর সন্তানদের হাতেখড়ি বা তত্ত্বাবধানের সুযোগ খুবই কম পেয়েছেন)। আনারের চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল যে তিনি সহজেই পারতেন সত্য ও সুন্দরকে ধারণ করতে। ন্যায়নীতির প্রশ্নে মামার মতোই তিনি ছিলেন আপসহীন। নিকট আত্মীয়স্বজনের কোনো অন্যায়কে তিনি কখনো প্রশ্রয় দেননি বা সমর্থন করেননি। প্রখর দায়িত্ব ও পরিমিতি বোধসম্পন্ন, মিতভাষী, নিরহঙ্কারী, সমাজ সচেতন, দানশীলা ও নেপথ্যচারিণী আনারের সংস্পর্শে যাঁরাই এসেছেন, তাঁরাই হয়েছেন চমৎকৃত। সত্য ও সুন্দরের অন্বেষণকারী সবাই হয়েছেন আলোকিত ও অনুপ্রাণিত। ১৯৫৯ সালের ২৬ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ সৈয়দা জোহরা খাতুনের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। আনারের সঙ্গে বেগম তাজউদ্দীনের শুরু হয় পরিচয়ের পালা। অচিরেই কন্যাসম আনার হয়ে ওঠেন তার বড় মামির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য স্নেহাষ্পদ বন্ধু ও বিশ্বস্ত সঙ্গী। বড় মামা ও মামির তিন কন্যা ও সর্বকনিষ্ঠ এক পুত্রসন্তানের জন্য তিনি ছিলেন এক পরম স্নেহের আশ্রয়। বড় মামার মতোই প্রচারবিমুখ। তিনিও পছন্দ করতেন নেপথ্যে থাকতে। অথচ তাঁর উষ্ণ উপস্থিতি ছড়ানো থাকত সর্বত্রই। রান্না, গান সেলাইয়ে যার সমান পারদর্শিতা। দর্শন, কাব্য, রাষ্ট্রনীতিতে যাঁর বিপুল আগ্রহ তিনি একই উদ্যম নিয়ে ইডেন গার্লস কলেজ থেকে যোগ দিয়েছেন ছাত্র রাজনীতিতে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা (যিনি নিজেও ছিলেন ইডেন গার্লস কলেজের ছাত্রী), কবি ও সমাজকর্মী কাজী রোজী, অধ্যাপিকা সাঈদা গাফফার প্রমুখের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন অসহযোগ আন্দোলনে। সোচ্চার হয়েছেন স্বাধিকারের দাবিতে।
১৯৭১ সালের চরম দুঃসময়ে আনার আপা অবতীর্ণ হয়েছেন এক নির্ভীক মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকায়। নবপরিণীতা আনার সে সময় অন্তঃসত্ত্বা। এরই মাঝে তিনি ও তাঁর মুক্তিযোদ্ধা স্বামী শামসুল আলম চৌধুরী সাঈদ নিজস্ব বাসগৃহে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ ইত্যাদি অতি প্রয়োজনীয় রসদের ভাণ্ডার ও আশ্রয় গড়ে তোলেন। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হন তার প্রাণপ্রিয় স্বামী। তিনি উদ্ধার পান আনারের উপস্থিত বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার কারণে।
আনার যেদিকেই গিয়েছেন, সেদিকেই ছড়িয়েছেন, মমতার স্নিগ্ধ আলো। নিজেও আলোর সন্ধান করেছেন প্রতিনিয়ত। রোগব্যাধির সঙ্গে যখন এক হাতে লড়ছেন তখন অন্য হাতে তুলে নিয়েছেন জীবনশক্তি স্বরূপ বই। হৃদক্রিয়া যন্ত্রটি চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কয়েক মুহূর্ত আগেও চোখ বুলিয়েছেন তাঁর দৈনিক সকালের প্রিয় সাথী সংবাদপত্রের পাতায়।
কন্যা আনার, স্ত্রী আনার, তিন সুযোগ্য কন্যা সুমি, রুমী ও ঊর্মির সার্থক মাতা ও আত্মমর্যাদাশীল নিবেদিত আনার- আমাদের পরমপ্রিয় আনার আপা ছিলেন আমাদের সবার জন্যই এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। ভবিষ্যতেও থাকবেন।
তাঁর প্রাণের অংশজুড়ে ছিলেন যে বড় মামা, যাঁর হাতে তাঁর হাতেখড়ি, তিনি নারী মুক্তি ও সোনার মানুষ গড়ে তোলার মধ্যে দিয়েই আত্মনির্ভর ও আত্মমর্যাদাশালী সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্নের একটি সার্থক ফসল হলেন আনার। তাজউদ্দীনের মানসকন্যা।
প্রকাশিতব্যগ্রন্থ ‘মুক্তির কাণ্ডারী তাজউদ্দীন : কন্যার অভিবাদন’ থেকে।
শারমিন আহমদ : বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে।