মুক্তগদ্য
সুবোধ ঘোষের গল্প পড়ার পর
কবিবন্ধু অঞ্জন আচার্য সন্ধান দিয়েছিল গল্পকার সুবোধ ঘোষের। বলেছিল, ‘পড়ে দেখ। বিশেষ করে তাঁর অযান্ত্রিক ও ফসিল গল্প দুটি। মূর্খই তো রয়ে গেলি। পড়ে একটু শিক্ষিত হ।’ বিনিপয়সায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য গুগল সার্চ দিয়ে গল্প দুটি খুঁজলাম। পেলাম না। মনে পড়ল গত বছর রোদেলা প্রকাশনী থেকে আরেক কবিবন্ধু রাহেল রাজিবের ভূমিকা ও সম্পাদনায় সুবোধ ঘোষের শ্রেষ্ঠ গল্প বেরিয়েছিল। প্রকাশক রিয়াজ খান সাহেবকে বললাম একটা বই দিতে। অকৃত্রিম বন্ধু মি. খান যথারীতি কার্পণ্য করলেন না।
প্রথমেই পড়া ধরলাম ফসিল। ভালো লাগল। খুব। কিন্তু গল্পটার শেষে একটা চমক দেওয়ার ব্যাপার আছে। ওই যে, ‘লক্ষ বছর পরে, এই পৃথিবীর কোনো একটা জাদুঘরে, জ্ঞানবৃদ্ধ প্রত্মতাত্ত্বিকের দল উগ্র কৌতূহলে স্থির দৃষ্টি মেলে দেখছে কতগুলো ফসিল!’―এটাকে চমক বলা যায় কি না ঠিক জানি না। হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। গল্পে চমক থাকা ভালো না খারাপ সেটা তাত্ত্বিকরা ভালো বলতে পারবেন। ভালো-খারাপ যাই হোক, অঞ্জন আচার্যের কথাই সঠিক, গল্প হিসেবে ফসিল আমাকে শিক্ষিত করেছে বটে। গল্পের এমনতর ভাবনাটা বা আঙ্গিকটা হয়তো আগে কখনো পাইনি। পেয়েছি কি? ঠিক মনে পড়ে না।
তারপর জতুগৃহ। ভালো লাগেনি। গল্পটা অনেক বিখ্যাত, শুনেছি। সিনেমা-টিনেমাও নাকি হয়েছে গল্পটি নিয়ে হিন্দি-বাংলায়। গল্পের গল্পটাও অনেকটা জনপ্রিয় বাংলা-হিন্দি সিনেমার মতো বটে। রেল জংশনে পাঁচ বছর পর সাবেক স্বামী-স্ত্রীর পুনঃসাক্ষাৎ। এমন গল্প আগে কোথাও পড়েছি। এমনও হতে পারে, যার লেখা এমন গল্প পড়েছি তিনি হয়তো সুবোধ ঘোষের এই গল্প থেকে কাহিনীটা মেরে দিয়েছেন। হতে পারে। আজকাল তো খুব মারামারি চলে। সিনেমায়, নাটকে, গল্প ও উপন্যাসে দেদারসে মারামারি চলছে। কিংবা এও হতে পারে, এমন গল্প কখনোই পড়িনি। হয়তো গল্পটা আমার ভেতরে আগে থেকেই সুপ্ত ছিল। কে জানে! তবে গল্পের ভাষাজাদু অসাধারণ! মুগ্ধ করেছে। এই একটি কারণে পাঠক হিসেবে আমার কাছে গল্পটা উতরে গেছে।
যাক, এবার তাহলে দেখা যাক ‘অযান্ত্রিক’ কেমন। গল্পটি নিয়ে মহামতি ঋত্বিক ঘটক সিনেমাও বানিয়েছিলেন। দেখেছি বহু বহুদিন আগে। ভুলেটুলে গেছি এত দিনে। এক টানে পড়ে ফেললাম। খুব ভালো লাগল। খুব। মনে হলো, এত কিছু জানলেন কী করে ভদ্রলোক! গাড়ির কলকব্জা সম্পর্কেও দেখছি তার মেলা দখলদারত্ব, মাইরি! এক জীবনে লোকটা এত অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন কী করে! সময় পেলেন কোথা থেকে? পরে, শ্রেষ্ঠ গল্পের সব কটি গল্প পড়াশেষে এই লেখকের জীবন সম্পর্কে খোঁজটোজ নিয়ে জানলাম―ভদ্রলোক জীবনকে নিংড়ে, রাস্তার ধারে আখের রস বিক্রেতারা মেশিনে আখকে যেভাবে নিংড়ায়, তেমনি অভিজ্ঞতা নিয়েছেন। বিচিত্র ছিল তাঁর কর্মজীবন। বাসের কন্ডাক্টর হিসেবে কর্মজীবনের শুরু। এ ছাড়া ট্যুইশন, ট্রাক ড্রাইভার, সার্কাস পার্টিতে ক্লাউনের ভূমিকায় এবং আরো বহু কর্মের অভিজ্ঞতা নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় বিভাগের সহকারীর চাকরি নেন। ক্রমে সিনিয়র অ্যাসিট্যান্ট এডিটর, অন্যতম সম্পাদকীয় লেখক। এক জীবনে অভিজ্ঞতার এমন বৈচিত্র্য যাঁর, তাঁর কথাসাহিত্য খারাপ হওয়ার তো কোনো রাস্তা নেই। ইচ্ছে করলেও কি তিনি খারাপ লিখতে পারবেন? মোটেই না।
তারপর পড়লাম ‘থিরবিজুরি’। নিজেকে সত্যিকার অর্থেই অবোধ বালক মনে হলো―মহৎ সাহিত্য পড়াশেষে প্রতিবারই নিজেকে যা মনে হয়। মনস্তত্ত্বের এত গভীরে, এত চমৎকারভাবে, এত অসাধারণ ভাষায় বাংলা গল্প কি খুব বেশি লেখা হয়েছে? নিজেকেই প্রশ্ন করি। পাঠঅভিজ্ঞতা বলল―না, খুব বেশি লেখা হয়নি না। তুমি হাতে গুনতে পারবে।
তারপর পড়লাম ‘পরশুরামের কুঠার’। আহা ধনিয়া! নয়াবাদের বারবণিতা ধনিয়া। অসংবৃতা এক রঙিন মরীচিকার মূর্তি জ্বেলে কী ভয়ঙ্করভাবে সে টেনে নেয় আমাকে তার নিটোল বুকে, জংঘায়! গল্পকে কতটা নির্মেদ রেখে, টান টান রেখে, ভাষার জাদুতে মোহাবিষ্ট করে, পাঠকের মনস্তত্বে কীভাবে হামানদিস্তা চালাতে হয়―পড়ে এই কথা জানলাম। তার মানে শিক্ষিত হলাম এবং অঞ্জনকে ধন্যবাদ জানালাম। অঞ্জন, তোর প্রাপ্যটা নিয়ে নে।
তারপর একে একে চিত্তচকোর, যাযাবর, ঠগের ঘর, পরিপূর্ণা, পারমিতা, গোত্রান্তর, তমসাবৃতা, অপপোকার, লঘু আরণ্যক, জলরাক্ষস, প্রিয়ংবদা, কালপুরুষ―এক টানা পড়ে যাই। থামলেই সুবোধ ঘোষের অদৃশ্য হাত ঘাড়ের কাছে টের পাই। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তিনি বলে যান―‘পড়, পড় হারামজাদা। ...এর গল্প-উপন্যাস লিখিস! বেটা নাবালক! বোগাস কোথাকার! পড়। দেখ, জীবনকে কীভাবে গল্পে উপস্থাপন করতে হয়। দেখ, লেখার জন্য হাতের কবজিটাকে একইসঙ্গে কতটা ইস্পাতকঠিন আর তুলতুলে নরম রাখতে হয়।’ আমি পড়ে যাই।
সর্বশেষ ‘সুন্দরম’। গল্পটি পড়া শেষ করে ওই চলন্ত বাসের এক কোণে, জানালার পাশে, পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃসঙ্গ এবং ভয়াবহ আবেগপ্রবণ আমি কেঁদেই ফেলি। খুব গোপনে। না, অন্তরে সুড়সুড়ি দেওয়া কাহিনীর জন্য নয়, গল্পের পাত্রপাত্রীর জন্যও নয়। কাঁদি নিজের অপরাঙ্গমতার কথা ভেবে। কাঁদি একজন শক্তিশালী গল্পকারের কথা ভেবে। হায়, আমার জন্মের আগেই তিনি এই পৃথিবী ত্যাগ করেছেন। কত বিশাল মহীরুহ ছিলেন! কী প্রকাণ্ড! আমি তাঁকে চোখের দেখা দেখলাম না! শুধু বাংলা ভাষায় লেখার জন্য বিশ্বখ্যাতি পেলেন না। আহা বাংলা ভাষা, আমরি বাংলা ভাষা।
বাংলা ভাষার প্রিয় গল্পকারদের মধ্যে এত দিন ছিলেন আটজন। আজ থেকে আরেকজন যোগ দিলেন―সুবোধ ঘোষ। ঠিক দিলেন নয়। দিলেন বললে বেয়াদবি হয়। নাকি? বলতে হবে সানন্দে যোগ করে নিলাম। হে মহাপ্রাণ, আপনাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম।