হুমায়ুন আজাদ
বহুমাত্রিক ও প্রথাবিরোধী এক লেখক
এ দেশের প্রথাবিরোধী এবং বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদ, যিনি ধর্ম, মৌলবাদ, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কারবিরোধিতা, যৌনতা, নারীবাদ, রাজনৈতিক এবং নির্মম সমালোচনামূলক বক্তব্যের জন্য আশির দশক থেকে ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হন। সচেতনভাবে তিনি পরিহার করতেন গতানুগতিক চিন্তাধারা। আশির দশকের শেষভাগ থেকে সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য রাখতে শুরু করেন তিনি।
এ সময় সাপ্তাহিক ‘খবরের কাগজ’ পত্রিকায় হুমায়ুন আজাদ সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখতে শুরু করেন। সামরিক শাসনের বিরোধিতা দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক লেখালেখির সূত্রপাত। ২০০৩ সালে প্রকাশিত ‘আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম’ গ্রন্থটি প্রধানত রাষ্ট্রযন্ত্রের ধারাবাহিক সমালোচনা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যভিচারের প্রামাণিক দলিল এই গ্রন্থ।
আজাদের অন্যতম প্রণোদনা ছিল প্রথাবিরোধিতা। কবিতা, উপন্যাস ও রচনা সর্বত্রই তিনি প্রথাবিরোধী ও সমালোচনামুখর। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত গুস্তাভ ফ্লবেয়ারের আদলে প্রবচনগুচ্ছ লিখে এ দেশের শিক্ষিত পাঠক সমাজকে আলোড়িত করেন তিনি। আজাদের লেখায় বিজ্ঞানমনস্কতার ছাপ স্পষ্ট। তবে তিনি নিজেই ছিলেন তাঁর চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাসের প্রধান মুখপাত্র। একটি বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার স্বপ্ন ছিল তাঁর। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকেই তিনি মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ গড়ার পক্ষে অনুকূল বলে মনে করতেন।
গদ্যের জন্য বেশি জনপ্রিয় হলেও আমৃত্যু কাব্যচর্চা করে গেছেন ড. আজাদ। ষাটের দশকের কবিদের সমপর্যায়ী আধুনিক কবি ছিলেন তিনি। সমকালের পরিব্যাপ্ত হতাশা, দ্রোহ, ঘৃণা, প্রেম ইত্যাদি তাঁর কবিসত্তার প্রধান নিয়ামক। প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম ‘অলৌকিক ইস্টিমার’, যা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে। কাব্যগ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেন ১৯৬৮-১৯৭২-এর রাত-দিনগুলোর উদ্দেশে। মূলত কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক হলেও নব্বইয়ের দশকে একজন প্রতিভাবান ঔপন্যাসিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন হুমায়ুন আজাদ। মৃত্যু অবধি তাঁর প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা ১২টি। তাঁর ভাষা ছিল দৃঢ়, কাহিনীর গঠন সঙ্গতিপূর্ণ এবং রাজনৈতিক দর্শন স্বতঃস্ফূর্ত। ১৯৯৪ সালে তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেন ‘ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল’-এর মধ্য দিয়ে। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘সব কিছু ভেঙে পড়ে’। আর এই বইয়ের জন্য তিনি পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। ২০০২ সালে ‘১০,০০০, এবং আরো ১টি ধর্ষণ’, ২০০৩ সালে ‘একটি খুনের স্বপ্ন’ এবং ২০০৪ সালে প্রকাশিত ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ উপন্যাসগুলোতে রাজনৈতিক বক্তব্যই রচনার প্রধান বিষয়। ভাষাভঙ্গী ও কাহিনী- দুদিক দিয়েই সেই সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার ওপর আজাদের বাস্তবিক ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়।
নবম শ্রেণীতে পড়ার সময়ই কবিতাচর্চা শুরু করেন হুমায়ুন আজাদ। তবে তাঁর প্রথম লেখা ছাপা হয়েছিল দৈনিক ইত্তেফাকের শিশুপাতা কচিকাঁচার আসরে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭০টির বেশি। আজাদের ১০টি কাব্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ২২টি সমালোচনা গ্রন্থ, আটটি কিশোরসাহিত্য, সাতটি ভাষাবিজ্ঞান-বিষয়ক গ্রন্থ তাঁর জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। ১৯৯২ সালে নারীবাদী গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘নারী’ প্রকাশ করে গোটা দেশে সাড়া জাগান। বইটি ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছিল। এ গ্রন্থ তাঁর বহুল আলোচিত গবেষণামূলক কাজ হিসেবেও স্বীকৃত। তাঁকে ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১২ সালে সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম এবং ভাষাবিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়। তাঁর রচিত কিশোরসাহিত্য ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত ‘আব্বুকে মনে পড়ে’ জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে ২০০৩ সালে।
জীবনের শেষার্ধ্বে অকুতোভয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা, সামরিক শাসনের বিরোধিতা, নারীবাদী বক্তব্য এবং একই সঙ্গে নিঃসংকোচ যৌনবাদিতার জন্য তিনি ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং ব্যক্তিগত অভীষ্ট তাঁর সাহিত্যকে প্রবলভাব প্রভাবান্বিত করেছিল। লেখার মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে তীব্র আক্রমণের কারণে হত্যাচেষ্টার শিকার হন তিনি। ২০০৪ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত বইমেলা থেকে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিজের বাসায় যাওয়ার পথে ঘাতকদের আক্রমণের শিকার হন অধ্যাপক আজাদ।
২০০২ সালে জার্মান কবি হাইনরিখ হাইনের ওপর কাজ করার জন্য জার্মান সরকারের কাছে বৃত্তির আবেদন করেছিলেন হুমায়ুন আজাদ। ২০০৪ সালের ৭ আগস্ট ওই গবেষণা বৃত্তি নিয়ে জার্মানি যান তিনি। তবে ১১ আগস্ট রাতে একটি পার্টি থেকে ফেরার পর আবাসস্থলে আকস্মিকভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন হুমায়ুন আজাদ। ১২ আগস্ট ফ্ল্যাটের নিজ কক্ষে তাঁকে পাওয়া যায় মৃত অবস্থায়। হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর পর জার্মান সরকারের তত্ত্বাবধানে মিউনিখে তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে পাওয়া সব জিনিসপত্র ঢাকায় হস্তান্তর করে তাঁর পরিবারের কাছে। ওই জিনিসপত্রের ভেতরই পাওয়া যায় তাঁর হাতের লেখা তিনটি চিঠি। চিঠি তিনটি আলাদা তিনটি পোস্ট কার্ডে লিখেছেন বড় মেয়ে মৌলি, ছোট মেয়ে স্মিতা এবং একমাত্র ছেলে অনন্য আজাদকে। অনুমান করা হয়, ওই লেখার অক্ষরগুলোই ছিল আজাদের জীবনের শেষ লেখা।