আমার রবীন্দ্রনাথ : প্রেম ও প্রার্থনায়, আনন্দ-বেদনায়
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল ছোটবেলাতেই, আমার ফুপার কল্যাণে। তিনি ছিলেন ঘোরতর রবীন্দ্রপ্রেমী। কত গান আর কবিতা যে তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল, এখন ভাবলেও অবাক লাগে। তাঁর কণ্ঠটাও ছিল উদাত্ত, ফলে তাঁর পাঠ বা আবৃত্তি খুবই আকর্ষণ করত আমাকে। আমি অবাক হয়ে যেতাম তাঁর রবীন্দ্রপ্রেম দেখে। আমাদের পরিবারটি ছিল পুরোনো কালের যৌথ পরিবার। বাড়িতে বাবা-চাচা-ফুপু, তাঁদের ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন মিলে অনেক মানুষ প্রায় ৫০/৬০ জন। তাঁদের ভেতর থেকে আমি বিশেষভাবে ফুপার ভক্ত হয়ে গেলাম। মনে হলো, তিনি সবার থেকে আলাদা।
ফুপার কাছ থেকেই আমার প্রথম রবীন্দ্রনাথকে চেনা। তিনি শুধু পড়তেন না, ব্যাখ্যাও করতেন অসাধারণভাবে। রবীন্দ্রনাথকে তিনি বলতেন, ‘প্রফেট অব পোয়েট্রি’। এগুলো ছোটবেলার কথা। বড় হয়ে, তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তত দিনে আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরিয়ে গেছি, লেখালেখির জগতে ঢুকেছি তারও আগে। এই দীর্ঘ সময়ে আমি বহু-বহুবার ভেবেছি কেন তিনি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এত বিভোর ছিলেন! কেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়েই সারা জীবন কাটিয়ে দিলেন? সেদিন এই কথাটি জিজ্ঞেস করতেই গিয়েছিলাম। এর আগেও তাঁর সঙ্গে আমার নানা বিষয়ে অনেক কথা হতো। পারিবারিক কোনো আলাপ নয়, আমাদের গল্পের ধরনই ছিল অন্য রকম। কিন্তু কোনোদিন এই কথা জিজ্ঞেস করা হয়নি। এবার জিজ্ঞেস করার আগে তাঁর প্রিয় একটি কবিতা পাঠ করে শোনালাম, গীতাঞ্জলি থেকে—
যদি তোমার দেখা না পাই প্রভু,
এবার এ জীবনে
তবে তোমায় আমি পাইনি যেন
সে কথা রয় মনে।
যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই
শয়নে স্বপনে।
এ সংসারের হাটে
আমার যতই দিবস কাটে,
আমার যতই দু’হাত ভরে উঠে ধনে,
তবু কিছুই আমি পাইনি যেন
সে কথা রয় মনে।
যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই
শয়নে স্বপনে।...
যাঁর কৈশোরকে তিনি ভরিয়ে রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে, তাঁর কণ্ঠেই প্রিয় কবির প্রিয় কবিতা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে গেলেন, চোখ ভরে উঠল জলে, নীরব হয়ে রইলেন দীর্ঘ সময়। একসময় আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি যে সারা জীবন রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ করে গেলেন, কী পেলেন তাঁর কাছ থেকে?’ উত্তরে তিনি একটিমাত্র বাক্য বললেন। আমার ধারণা, সারা পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথকে এ পর্যন্ত যত মানুষ ও লেখক ব্যাখ্যা করেছেন, তাঁদের কেউই এ রকম কথা বলেননি। তিনি বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথ মানুষের ভেতরে ঈশ্বরের অ্যাকোমোডেশন দেখিয়েছেন!’
তাঁর এই কথাকে ব্যাখ্যা করার মতো ভাষা আমি আজও শিখে উঠতে পারিনি। কী অর্থ ওই ‘অ্যাকোমোডেশন’ শব্দটির? তা-ও ‘মানুষের ভেতরে ঈশ্বরের অ্যাকোমোডেশন!’ লক্ষ করুন প্রিয় পাঠক, ঈশ্বরের ভেতরে মানুষের অ্যাকোমোডেশন নয় কিন্তু, বরং ‘মানুষের ভেতরে ঈশ্বরের অ্যাকোমোডেশন!’ ধরুন, একটা ছোট্ট ঘরে আপনি এক হাজার লোকের থাকার ব্যবস্থা করতে চান। পারবেন? না, পারবেন না। কেন পারবেন না? ‘অ্যাকোমোডেশন’ হবে না! এত ছোট্ট ঘরে এত লোকের ‘অ্যাকোমোডেশন’ সম্ভব নয়! অর্থাৎ ক্ষুদ্র কোনো কিছুর ভেতরে বৃহৎ কোনো কিছুর ‘অ্যাকোমোডেশন’ হয় না! অথচ রবীন্দ্রনাথ সেটিই করেছেন! ‘ক্ষুদ্র ও সসীম’ মানুষের ভেতরে ‘বৃহৎ ও অসীম’ ঈশ্বরের ‘অ্যাকোমোডেশন’ দেখিয়েছেন! এটিই কি ফুপার কথাটির ব্যাখ্যা? আমি জানি না। ব্যাখ্যা করতে পারি না।
এই হচ্ছে আমার প্রথম রবীন্দ্রনাথ-দর্শন।
ছোটবেলা তো একরকম, কিন্তু যৌবন থাকে উদ্দামতায় ভরা। ওই বয়সে রবীন্দ্রনাথ সার্বক্ষণিকভাবে সঙ্গে থাকেন না আসলে। তখন তারুণ্যের জয়গান গাওয়া হয়, শুধু রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে চলে না। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা বলি, তখন ব্যান্ড সংগীতের রমরমা সময়, বাজার প্রায় দখল করে নিয়েছিল। নব্বই দশকেও ব্যান্ড সংগীত, নাচানাচি, হৈচৈ ইত্যাদি চলত। সে সময় ব্যান্ড সংগীত যেমন শুনছি, তেমনই রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে যোগ দিচ্ছি এই রকম। কিন্তু ঘরে ফিরে এসে, গভীর রাতে, যখন একা, তখন কবিতা বলতে জীবনানন্দ দাশ এবং গান বলতে রবীন্দ্রসংগীত। রবীন্দ্রনাথের কাছে বারবার ফিরতেই হতো। তাঁর কত গান যে আমার সংগ্রহে আছে, আর কত গান যে শুনেছি বলতে পারব না! তাঁর প্রায় সব গল্প-উপন্যাস আমার পড়া; প্রবন্ধ আর কবিতা সব পড়া না হলেও বেশ কিছুই পড়া। অবশ্য এখন তাঁকে পড়ার ব্যাপারটা অনিয়মিত। কিন্তু গান শোনাটা একদম নিয়মিত। সেটা আজকে থেকে নয়, বহুদিন আগে থেকেই। রবীন্দ্রসংগীত আমাকে একটা-না-একটা শুনতেই হবে, প্রতিদিনই। এটা কি জোর করে? না। মনের টানেই। আর তিনি এমনই এক শিল্পী যে একেক সময় একেকভাবে আমার কাছে ধরা দেন। একটি গান এক বয়সে এক ধরনের অর্থ নিয়ে ধরা দেয়, পরে সেটিই আবার আলাদা অর্থ নিয়ে হাজির হয়।
একটা উদাহরণ দিই। একটা গল্প লিখেছিলাম ‘বড় বেদনার মতো বেজেছ’ নামে। ওই গল্পে একটা কথা আছে। গল্পের নায়কের মুখেই শুনুন, ‘প্রেম আমার কাছে কী জানেন? রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে না, বড় বেদনার মতো বেজেছ; ওই রকম। প্রেম যদি বেদনার মতো বেজে না ওঠে, তাহলে সেটি প্রেম নয়। আমার জীবনে অনেক ভালোলাগা এসেছে। হয়তো প্রেমও এসেছে। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। কেন? কারণ, সেই প্রেম বেদনার মতো বেজে ওঠেনি।’ ওই সময় গানটি আমার কাছে নারী-পুরুষের প্রেম অর্থেই ধরা দিয়েছিল। কিন্তু গানটির অর্থই বদলে গেল কলিম শরাফীর কণ্ঠে শুনে। একটা প্রামাণ্যচিত্র হয়েছিল তাঁকে নিয়ে। তিনি তো বাধ্য হয়েই দেশত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ব বাংলায় এসেছিলেন; ওই প্রামাণ্যচিত্রে যখন এই প্রসঙ্গ আসে, মানে তাঁর দেশত্যাগের প্রতীকী চিত্রটির কথা বলছি, তখন তিনি অসামান্য এক দরদভরা বেদনা দিয়ে গেয়ে ওঠেন, ‘বড় বেদনার মতো বেজেছ তুমি হে...।’
ঠিক সেই মুহূর্তে আমার কাছে গানটির অর্থ বদলে যায়, মনে হয় এই ‘তুমি’ মানে হারানো জন্মভূমি, যেখানে আর কোনোদিন ফেরা হবে না। তাঁর বেদনাটি আমি অনুভব করে উঠি। কারণ, আমার নিজের জন্মভিটে, আমার পূর্বপুরুষের বাড়ি, যেখানে আমার বাবা জন্মেছিলেন, মৃত্যুকেও বরণ করেছিলেন ওই বাড়িতে, যেখানে আমার মা নতুন বউ হয়ে এসেছিলেন, এমনকি আমার দাদিও, সেই শতবর্ষের পুরোনো বাড়িটি পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সেখানে আর কোনোদিন ফেরা হবে না আমার। কলিম শরাফীর কণ্ঠে গানটি শুনে আমার চোখ ভিজে ওঠে। আর তার পর থেকে সব হারিয়ে যাওয়া ‘তুমি’র কথা মনে হলেই গানটি মনে আসে। এমনকি মায়ের কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেও।
রবীন্দ্রনাথ এমন এক শিল্পী, যিনি একটা গান কিংবা কবিতার ভেতরে হাজারটা অর্থ ধরে রেখেছেন, যা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে আমার কাছে ধরা দেয়। আমার নিজের ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এমনভাবে মিশে আছেন যে তাঁকে ছাড়া আমার চলেই না। কোনো কিছুতেই যখন স্বস্তি মেলে না, কোনো মুখ আমাকে শান্তি দেয় না, সব মিলিয়ে একটা প্রচণ্ড অস্থিরতা ভর করে, মনে হয় এক ধরনের স্বস্তি এবং শান্তি দরকার, তখন রবীন্দ্রনাথের গানের ভেতরে ঢুকে পড়ি। প্রেম বা প্রার্থনা, স্বস্তি, শান্তি, আনন্দ বা আশ্রয়—সবই মেলে তাঁর কাছে। আর তিনি তো সেই অসামান্য শিল্পী, যিনি প্রেম ও প্রার্থনাকে অবলীলায় একাকার করে ফেলেছেন। দুটো বিষয়কে তো তিনি আলাদা করে দেখেনইনি, বরং সমার্থক করে তুলেছেন। যা কিছু প্রেম তা-ই প্রার্থনার যোগ্য, যা কিছু প্রার্থনা তা-ই প্রেমের যোগ্য। এ রকম উদাহরণ আপনি আর কোথায় পাবেন, বলুন? তাঁর এ ধরনের গান যখন শুনি, মনটা শান্ত হয়ে আসে; নমিত ও স্থির হয়ে আসে। আর তাই, রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া দিনযাপন এক অসম্ভব ব্যাপার মনে হয় আমার কাছে।