রবীন্দ্র-নৃত্যনাট্যে বিদ্রোহী নারী
নৃত্যনাট্যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ছিল এক নতুন দিনের সূর্যের মতো। সেই সূর্য আজও নতুন। একটি দৃষ্টান্ত দিলে পরিষ্কার হবে বিষয়টি। ১৯১৯ সালের ৫ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেট ভ্রমণে আসেন। সৈয়দ মুর্তাজা আলীর ভাষায়- কবিকে রাজোচিত সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কবির আসনের সামনে টেবিলে মোড়ানো ছিল মণিপুরী মেয়েদের তৈরি টেবিল ক্লথ। বয়ন নৈপুণ্যের জন্য টেবিল ক্লথখানা কবির খুব ভালো লাগে। তখনই তিনি মণিপুরীদের তাঁত ও জীবনযাত্রা দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কথা প্রসঙ্গে এ নৃত্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেন, "graceful best form of physical exercise"। সিলেট ভ্রমণ শেষে কবি ত্রিপুরার মহারাজা বীরেন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের আমন্ত্রণে আগরতলায় কদিনের জন্য আতিথ্য গ্রহণ করেন। আগরতলার শিলচরে কবি আবারও মণিপুরী নাচ দেখেন। তিনি মহারাজাকে অনুরোধ করেন, শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের মণিপুরী নাচ শেখাতে একজন শিক্ষক দেওয়ার জন্য। ১৯২০ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ত্রিপুরার মহারাজা, মণিপুরী নৃত্যগুরু বুদ্ধমন্ত্র সিংহকে পাঠিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। ওই বছর শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে ও বিশ্বভারতীতে প্রথমবারের মতো নৃত্যকে গ্রহণ করা হয় শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবে।
শান্তিনিকেতন ছিল শিল্পচর্চার এক চমৎকার পীঠস্থান। এ সম্পর্কে কবির স্নেহধন্য শান্তিদেব ঘোষ বলেন- “১৯১৯ সালে ‘শারদ্যোৎসব’ নাটকের পূর্বে, ১৯১৪ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত পরপর ‘অচলায়তন’, ‘ফাল্গুনী’ ও ‘ডাকঘর’ নাটক কয়টির কতকগুলো গানের সঙ্গে যে ধরনের নাচ হতো, তা শেখানো-পড়ানো কোনো প্রকার ধ্রুপদী নাচ নয়। প্রত্যেকেই গানের ছন্দের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজেরা স্বাধীনভাবে পদচারণা করতেন, মনের আনন্দে। যাদের কোনো ছন্দবোধ ছিল না সেইরূপ বেতালারা এই দলে স্থান পেত না। ‘অচলায়তন’ নাটকের শোনপাংশুরা যখন যে যার নিজের মতো নেচে যেতেন, তখন পিয়ারসন তাঁর দেশজ নাচের ঢঙে ঐ দলের সঙ্গে নাচে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯১৪ সালে প্রথম যখন ‘ফাল্গুনী’ নাটকের অভিনয় হয় তখন যুবক দলকে কয়েকটি উল্লাসের গানের সঙ্গে নাচতে হয়েছিল। কিন্তু এই নাটকের ‘অন্ধ বাউল’-এর চরিত্রে গান গেয়ে গুরুদেবকে যে কটি গানে নাচতে হয়েছিল, তা ছিল ঐ নাটকের উল্লেখযোগ্য ঘটনা।”
রবীন্দ্রনাথের পৃষ্ঠপোষকতায় বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃত্যকলা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯২৬ সালে। শান্তিদেব ঘোষের সাক্ষ্যে জানা যায়, তিনি নৃত্যকে শিক্ষণীয় বিদ্যা হিসেবে বিদ্যালয়ে এবং বিশ্বভারতীতে স্থানদানের ইচ্ছেয় মণিপুরী নাচ শেখানোর ব্যবস্থা প্রথম গ্রহণ করেন ১৯২০ সালে বুদ্ধমন্ত্র সিংহকে এবং ১৯২৫ সালে নবকুমার সিংহকে আগরতলা থেকে আনিয়ে। বাঙালির নৃত্যকলা উন্নয়নে রবীন্দ্রনাথ ভারত ও বহির্ভারত থেকে নৃত্যগুরুদের নিয়ে আসেন শান্তিনিকেতনে। তিনি রচনা করেন নৃত্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘মায়ার খেলা’, ‘চণ্ডালিকা’, ‘শ্যামা’, ‘নটীর পূজা’ নৃত্যনাট্য। এসব নৃত্যনাট্য উপস্থাপনায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন দ্রুপদী নৃত্য, গুজরাটের গরবা, শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডি, জাভাবালির নাচ প্রভৃতির সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের মণিপুরী নৃত্যের ধ্রুপদী আঙ্গিক প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নেন। ১৯২৫ সালে ইতালি থেকে অধ্যাপক জোসেফ তুচ্চি এবং কার্লো ফার্মিকি অনেক বইপত্রসহ শান্তিনিকেতনে আসেন। ওই বছর শ্রাবণ মাসে ‘বর্ষামঙ্গল’ অনুষ্ঠানে কবির কিছু গানের সঙ্গে একক ও দলবদ্ধ নাচ প্রদর্শিত হয়। অরূপ রতনের পর ‘শেষবর্ষণ’ শান্তিনিকেতনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান, যার মধ্য দিয়ে নৃত্যভিত্তিক মূকাভিনয় প্রবর্তিত হয়। ১৯২৬ সালে মাদ্রাজ থেকে বাসুদেবন পড়তে আসেন শান্তিনিকেতনে। তিনি এবং দক্ষিণ ভারতের ই. কৃষ্ণ আয়ার ছেলেমেয়েদের ভরতনাট্যম নৃত্য প্রশিক্ষণ দেন। আর এ নৃত্যের পূর্ণ প্রয়োগ হয় ১৯৩৮ সালে ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যে। ১৯২৭ সালে ‘নটীর পূজা’ অভিনয় হয় কলকাতায় জানুয়ারি মাসে। পরের ফেব্রুয়ারি মাসে বসন্তোৎসব উপলক্ষে ‘নটরাজ’ নামে আবৃত্তি ও নৃত্যগীতপূর্ণ নাটিকার অভিনয় হয়। ডিসেম্বর মাসে নটরাজের অদলবদল করে ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতায় যখন নৃত্যগীতি ও আবৃত্তিসহযোগে সেটি অভিনীত হয়, তখন তা পরিবর্তিত হয়ে নতুন নাম হয় ‘ঋতুরাজ’। এই নাটিকায় নেচেছিল ছাত্রীরা নবকুমার সিংহের কাছে শেখা মণিপুরী আঙ্গিকে। ‘ফাল্গুনী’ নাটক এবং বর্ষামঙ্গলের গীতিনৃত্য ছিল মনোমুগ্ধকর। ১৯২৯ সালে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ১১ মাঘ উৎসব উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ও দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ একদল গানের শিক্ষার্থী সেখানে পৌঁছেন। সেখানে ‘নটরাজ’ ও ‘ঋতুরঙ্গ’-এ ছাত্রীরা নেচেছিল মণিপুরী ও গরবা নাচের ঢঙে। ওই সময় ঠাকুরবাড়িতে মাঘ উৎসবের নৃত্য প্রদর্শনী দর্শকরা টিকেট কিনে দেখেছিল। এসব নৃত্য বিন্যাসের ক্ষেত্রে নৃত্যগুরু বুদ্ধমত্ত সিংহ ও নবকুমার সিংহের অবদান স্মরণীয়।
রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে ১৯৩০ সালে শান্তিনিকেতনে আসেন নৃত্যাচার্য উদয়শঙ্কর। তাঁর পরিবেশনা ও নৃত্যবিন্যাস কবিকে অনুপ্রাণিত করেছিল। সে প্রভাব দেখা যায় কবির ৭০তম জন্মজয়ন্তীতে ‘নটীর পূজা’ প্রযোজনায়। সেখানে প্রতিমা দেবীর নেতৃত্বে ভারতবর্ষের নৃত্য আদর্শের সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন হাঙ্গেরির লোকনৃত্য এবং ইউরোপের মডার্ন ড্যান্সের। রবীন্দ্রনাথ নৃত্যের সঙ্গে অভিনয়কেও গুরুত্ব দিয়েছেন। দৈহিক সঞ্চালনের সঙ্গে মূকাভিনয়, আবৃত্তির সঙ্গে নৃত্যাভিনয় ও যোজন-বিয়োজন তাঁর কাছে মূল্যবান ছিল। ১৯৩১ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত সময়কে বলা হয় ‘শাপমোচন’ যুগ। ইতিমধ্যে ১৯৩৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ‘তাসের দেশ’, ‘চণ্ডালিকা’ রচনা করেন নৃত্যনাট্যের আদলে। ওই বছর ‘বিদায়-অভিশাপ’ নাট্যকাব্য আবৃত্তি ও নৃত্য প্রয়োগে পরিবেশিত হয়। তাঁর ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘শ্যামা’ পরবর্তীকালে ‘চণ্ডালিকা’ নৃত্যাভিনয়ে পশ্চিমা ব্যালের আদর্শ অনুসৃত হয়েছিল। নৃত্যনাট্যগুলো ভারতীয় পুরাণ ও বিভিন্ন ধ্রুপদী নৃত্যের (ভরতনাট্যম, কথাকলি, মণিপুরী, কত্থক) ব্যাকরণ ব্যবহার থেকে বিচ্যুত থাকেনি। ১৯৩৪ সালে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন কল্যাণী আম্মা। তিনি আশ্রমে ছিলেন মাত্র তিন মাস। তাঁদের কেউই নিয়মিত শিক্ষাদান করার জন্য না থাকায় শান্তিনিকেতনে স্বাভাবিকভাবে ধ্রুপদী নৃত্য শিক্ষায় বারবার ছেদ পড়ে। তবে ১৯৩৫ সাল থেকে প্রকৃতপক্ষে শান্তিনিকেতনে নিয়মিতভাবে নৃত্যশিক্ষা এগুতে থাকে। ১৯৩৬ সালে বিশ্বভারতীতে সঙ্গীত ও নৃত্যের একটি পাঠক্রম প্রস্তুত হয়। বলা যেতে পারে ১৯৩৬ সালের আগ পর্যন্ত কলকাতায় সেই অর্থে ধ্রুপদী নৃত্যের চর্চা হতো না। কবির উদ্যোগে ধ্রুপদী নৃত্যচর্চার দুয়ার খুলে যায়। বাংলা ধ্রুপদী নৃত্যের জন্যেও রবীন্দ্রনাথ প্রাতঃস্মরণীয়।
২.
নৃত্যনাট্য হলো মূলত গীতিনির্ভর নাট্যধর্মী নৃত্য। নানা কাহিনী অবলম্বনে এ নৃত্য নির্মিত হয়। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে গীতবাদ্য সংবলিত নৃত্যচর্চার উল্লেখ আছে, আধুনিক পরিভাষায় যাকে বলা যায় নৃত্যনাট্য। রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাগায়ক জয়দেবের গীতগোবিন্দ এমনই একটি গীত-বাদ্য-নৃত্য-বহুল রচনা। এতে নৃত্য-গীতসহ নাটকীয়তা আছে বলেই একে নৃত্যনাট্য হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। পরবর্তীকালে নৃত্যনাট্যের এই ধারার বিলুপ্তি ঘটে। আধুনিককালে নৃত্যনাট্য বলতে যা বোঝায় তার স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর সৃষ্ট নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকা, শ্যামা ইত্যাদি বঙ্গসংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ। রবীন্দ্রনাথ নৃত্যনাট্যের যে ধারা প্রবর্তন করেছেন, পরবর্তী দীর্ঘকাল ধরে সেই ধারাই অনুসৃত হয়েছে। বিশ শতকের মধ্যভাগে সেই ধারার বিবর্তন ঘটিয়ে এর আধুনিকীকরণ করেন উদয়শঙ্কর। রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য মূলত গীতপ্রধান এবং উদয়শঙ্করের নৃত্যনাট্য আবহ সঙ্গীত প্রধান।
মূলত সৃষ্টির স্রোতধারা প্রবাহিত হয় দুই খাতে। কখনও সেই খাত খনন করেন স্রষ্টা নিজেই। আবার কখনও তিনি মরা নদীর সোঁতায় আনেন সৃষ্টিস্রোতের নতুন প্লাবন। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিপ্রতিভার বহু রচনার মূল উৎস আমাদের অগোচরেই থেকে যায়। রামায়ণ, মহাভারত ও বৌদ্ধ সাহিত্যের কিছু অপ্রধান উপাখ্যানের তিনি পুনর্লিখন করেছিলেন নাটকের মাধ্যমে। প্রাচীন সাহিত্যের সমুদ্রগর্ভ থেকে সেঁচে আনা এই গল্পগুলো হয়ত আমাদের যুগদৃষ্টির আড়ালেই থেকে যেত, যদি রবীন্দ্রনাথ এগুলোর প্রাচীন পলেস্তরা খসিয়ে নব-অলঙ্কারে ভূষিত করে আমাদের সামনে উপস্থাপনা না করতেন। এই নাটকগুলোকে কৌশলগতভাবে আমরা রবীন্দ্রনাথের মৌলিক নাটক বলতে পারি না, যেমন ‘ম্যাকবেথ’, ‘হ্যামলেট’, ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ ইত্যাদি নাটককে শেক্সপিয়রের মৌলিক নাটক বলা যায় না। কিন্তু নাট্যসাহিত্যে এই নাটকগুলোর গুরুত্ব কাব্যসাহিত্যে আলঙ্কারিক বা সাহিত্যিক মহাকাব্যগুলোর মতোই।
লক্ষণীয় বিষয়টি হলো কাহিনী পরিবেশনায় রবীন্দ্রনাথের গৃহীত স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার পিছনে ছিল যুগরুচি। অবশ্যই এই রুচি আধুনিক রুচি এবং সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নাট্যরচনার পিছনে রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্য। একটি নির্দিষ্ট বক্তব্য, যা রবীন্দ্রনাথ একটি নির্দিষ্ট নাটকের মাধ্যমে দর্শকের সামনে উপস্থাপিত করতে চাইতেন, তা প্রাচীন কাহিনীর শরীরটিকে দুমড়ে-মুচড়ে একটা মার্জিত নতুন রূপ দিত। বর্তমান নিবন্ধে আমরা সেই মূল আখ্যানগুলোর উৎস সন্ধানে প্রবৃত্ত হবো।
নাট্যকাব্যগুলোকে বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথের যে নাটকগুলোকে ‘ভাঙা নাটক’ আখ্যা দেওয়া চলে, সেগুলো হলো: ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’ (১৮৮১), ‘কালমৃগয়া’ (১৮৮২), ‘রাজা’ (১৯১০), ‘চণ্ডালিকা’ (১৯৩৩); ‘নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকা’, (১৯৩৮), ‘নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা’ (১৯৩৬) ও ‘নৃত্যনাট্য শ্যামা’ (১৯৩৯)। এর মধ্যে ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’ ও ‘কালমৃগয়া’ রামায়ণ অবলম্বনে, ‘নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা’ মহাভারত অবলম্বনে এবং অবশিষ্ট নাটকগুলো বৌদ্ধ সাহিত্য অবলম্বনে রচিত হয়েছে।
‘চিত্রাঙ্গদা’র মূল রচনাটি নাট্যকাব্য। কিন্তু এই কাব্যনাট্য পরে রূপ নিয়েছিল নৃত্যনাট্যের। উপাখ্যানের উৎস মহাভারত। মূল মহাভারতে অর্জুন-চিত্রাঙ্গদার গল্প রয়েছে আদিপর্বের ‘অর্জুনবনবাসপর্বাধ্যায়’-এ। রাজশেখর বসু উদ্ধৃত করা যাক : ‘উলূপীরের কাছে বিদায় নিয়ে অর্জুন নানা তীর্থ পর্যটন করলেন, তারপর মহেন্দ্র পর্বত দেখে সমুদ্রতীর দিয়ে মণিপুরে এলেন। সেখানকার রাজা চিত্রবাহনের সুন্দরী কন্যা চিত্রাঙ্গদাকে দেখে অর্জুন তাঁর পাণিপ্রার্থী হলেন। রাজা অর্জুনের পরিচয় নিয়ে বললেন, আমাদের বংশে প্রভঞ্জন নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি পুত্রের জন্য তপস্যা করলে মহাদেব তাঁকে বর দিলেন, তোমার বংশে প্রতি পুরুষের একটিমাত্র সন্তান হবে। আমার পূর্বপুরুষদের পুত্রই হয়েছিল। কিন্তু আমার কন্যা হয়েছে। তাকেই আমি পুত্র গণ্য করি। তার গর্ভজাত পুত্র আমার বংশধর হবে- এই প্রতিজ্ঞা যদি কর তবে আমার কন্যাকে বিবাহ করতে পার। অর্জুন সেইরূপ প্রতিজ্ঞা করে চিত্রাঙ্গদাকে বিবাহ করলেন এবং মণিপুরে তিন বৎসর বাস করলেন। তার পুত্র হলে চিত্রাঙ্গদাকে পুনর্বার আলিঙ্গন করে ভ্রমণ করতে গেলেন।’
রবীন্দ্রনাথ এ আখ্যানে স্বাধীনতা নিলেন বিস্তৃতভাবে : ‘মণিপুররাজের ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে শিব বর দিয়েছিলেন যে, তাঁর বংশে কেবল পুত্রই জন্মাবে। তৎসত্ত্বেও যখন রাজকুলে চিত্রাঙ্গদার জন্ম হলো তখন রাজা তাঁকে পুত্ররূপেই পালন করলেন। রাজকন্যা অভ্যাস করলেন ধনুর্বিদ্যা; শিক্ষা করলেন যুদ্ধবিদ্যা, রাজদণ্ডনীতি। অর্জুন দ্বাদশবর্ষব্যাপী ব্রহ্মচর্যব্রত গ্রহণ করে ভ্রমণ করতে করতে এসেছেন মণিপুরে। তখন এই নাটকের আখ্যান আরম্ভ।’
পুরুষবেশী চিত্রাঙ্গদা মৃগয়ায় গিয়ে সাক্ষাৎ পান ব্রহ্মচারী অর্জুনের। অর্জুনকে প্রেম নিবেদন করেন। কিন্তু কুশ্রী চিত্রাঙ্গদাকে প্রত্যাখ্যান করেন অর্জুন। তখন চিত্রাঙ্গদা মদনের তপস্যা করে রূপবতী হলেন এবং মিলিত হলেন অর্জুনের সঙ্গে। বছর ঘুরতে না ঘুরতে অর্জুনের রূপতৃষ্ণায় ক্লান্তি এলো। চিত্রাঙ্গদার পরিচয় পেয়ে তিনি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করলেন। সুশ্রী চিত্রাঙ্গদাও তখন রূপের খোলস খসিয়ে ফেলে সত্যরূপে অর্জুনের কাছে ধরা দিলেন।
মণিপুর রাজ্যের বিপদের আভাসে একসময় অর্জুন নারীর মমতায় প্রজা বৎসল, সাহসে শক্তিতে পুরুষের মতো সবল চিত্রাঙ্গদার কথা লোকমুখে জানতে পারে। রবিঠাকুরের প্রকাশে-
শুনি স্নেহে সে নারী
বীর্যে সে পুরুষ,
শুনি সিংহাসনা যেন সে
সিংহবাহিনী।
একজন পুরুষ মনে একজন রমণীয় সবল নারীকে দেখার উদগ্র বাসনায় অর্জুন প্রকাশ করে তার আগ্রহ-
আগ্রহ মোর অধীর অতি
কোথা সে রমণী বীর্যবতী।
কোষবিমুক্ত কৃপাণলতা
দারুণ সে, সুন্দর সে
উদ্যত বজ্রের রুদ্ররসে,
নহে সে ভোগীর লোচনলোভা,
ক্ষত্রিয় বাহুর ভীষণ শোভা।
এমতাবস্থায় চিত্রাঙ্গদা নিজেকে অর্জুনের কাছে নিজেকে প্রকাশ করে এভাবে-
আমি চিত্রাঙ্গদা, আমি রাজেন্দ্রনন্দিনী।
নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী।
পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে
সে নহি নহি,
হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে
সে নহি নহি।
যদি পার্শ্বে রাখ মোরে
সঙ্কটে সম্পদে,
সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে
সহায় হতে,
পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।
আজ শুধু করি নিবেদন-
আমি চিত্রাঙ্গদা রাজেন্দ্রনন্দিনী?
মহাভারতের কাহিনীটির রূপায়ণ রবীন্দ্রনাথের কাছে গৌণ ছিল। নৃত্যনাট্য ত্রয়ীর অন্য দু’টি নৃত্যনাট্যের মতোই এখানেও নায়িকার হৃদয়দ্বন্দ্বই নাটকের প্রধান উপজীব্য। অর্জুনের চরিত্রটি পর্যন্ত এখানে ম্লান। নাটকের বহিরঙ্গের পরিবর্তন তাই এখানে সত্যিই অনুল্লেখনীয়।
কোনো পিপাসার্ত মানুষের পক্ষে অসম্ভব একবার জলপান করে চিরদিনের মতো পিপাসা নিবৃত্ত করা। তবু হাতের কাছে জলাধার পেয়ে এত পিপাসার্ত মানুষটি যদি চেষ্টা করে সবটুকু জল একনিমিষে পান করতে, নিজের কুক্ষিগত করতে তবে তার পরিণাম কত নির্মম তারই আলোকে নাটক এবং নৃত্যনাটক, রবির ‘চণ্ডালিকা’। ‘চণ্ডালিকা’র কাহিনী রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছেন বৌদ্ধ ‘অবদান’ সাহিত্য থেকে। মূল গল্পটি এমন : বুদ্ধের প্রিয় শিষ্য আনন্দ শ্রাবস্তী নগরে কোনো এক ভক্তের গৃহে আহার করে বিহারে প্রত্যাবর্তন করছিলেন। পথে তৃষ্ণার্ত হওয়ায় এক প্রকৃতি নাম্নী এক চণ্ডালিনীর হাতে জল খান। আনন্দের মানবতার বাণীতে মুগ্ধ প্রকৃতি আনন্দের প্রেমে পড়েন। প্রকৃতির মা-মেয়ের সঙ্গে আনন্দের মিলন ঘটানোর জন্য তান্ত্রিক মন্ত্রের সাহায্যে আনন্দকে টেনে আনেন। প্রকৃতি যখন শয্যারচনা করছে, তখন আনন্দের মন্ত্রঘোর কেটে যায়। তিনি মনে মনে বুদ্ধের শরণ নেন। বুদ্ধ প্রকৃতির মায়ের মন্ত্র খণ্ডন করে আনন্দকে ফিরিয়ে আনেন। প্রকৃতি আনন্দের আশা ছাড়ে না। সে আনন্দের পিছু নেয়। কথাটা বুদ্ধের কানে যায়। তিনি প্রকৃতিকে বলেন, আনন্দকে বিবাহ চাইলে পিতামাতার অনুমতি নিয়ে এসো। প্রকৃতি অনুমতি আনলে তিনি তাঁকে আনন্দের মতো বেশ ধারণ করতে বলেন। সে মাথা মুড়িয়ে কাষায় ধারণ করল। ভিক্ষুণী হয়ে সর্বদুর্গতিশোধন ধারিণীমন্ত্র জপ করা মাত্র তার চিত্তের মলিনতা দূর হলো। রবীন্দ্রনাথ মূল কাহিনীটি ছোট ও খানিকটা পরিবর্তন করলেন।
নাটকের কাহিনীতে দেখা যায়, চালকন্যা প্রকৃতির বাঁচার একমাত্র অবলম্বন তার মা। বর্ণপ্রথার বিভাজন এবং লোকাচারের নিষ্ঠুরতায় চাল সম্প্রদায় অস্পৃশ্য, অচ্ছুৎ। সাধারণ মানুষের কাছে বর্ণ-গোত্র সম্প্রদায় যেখানে অনেক বিভেদের বিষয়, সেখানে একজন সন্ন্যাসী, একজন ভিক্ষুর কাছে সব মানুষই সমান। ফলে যখন একদল ভিক্ষু সন্ন্যাসী পথিমধ্যে পিপাসার্ত হয়ে ক্লান্ত, তখন আনন্দ নামের সন্ন্যাসী পিপাসা নিবৃত্তের জন্য জল চান চালকন্যা প্রকৃতির কাছে। সব সংশয় অবসানে জল প্রদান করে প্রকৃতি। মানুষ হিসেবে মানুষকে মূল্যায়ন করায় প্রকৃতি চেয়ে বসে আনন্দকে। অধরা আনন্দকে ধরতে, নিষেধ সত্ত্বেও মায়ের গুণিন শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মা-মেয়ে মিলে ফিরিয়ে আনে আনন্দকে। শুভ মঙ্গলময় প্রাণের উচ্ছ্বাসে আনন্দ যখন ফিরতে বাধ্য হয় তখন সেই আনন্দ আর নেই। সুন্দরের বিপরীতে কুৎসিত এই প্রাপ্তি। মোহ ভঙ্গ হয় প্রকৃতির। আনন্দ প্রকৃতির গৃহে আসার আগেই সে মায়ের মন্ত্রের থালায় লাথি মারে। তারপর প্রবেশ করলে, তার পদধূলি নিয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করে। ক্ষমা প্রার্থনার মধ্যদিয়ে মোহ থেকে মুক্তির বার্তা ঘোষিত হওয়ার মাধ্যমে শেষ হয় নাটক চণ্ডালিকা।
যে সময়ে রবীন্দ্রনাথ ‘চণ্ডালিকা’ ও ‘নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকা’ রচনা করেন, সেই সময় হিন্দুসমাজের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তথাকথিত নিম্নবর্ণীয়রা এই সময় রাজনৈতিক অধিকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিল। মহাত্মা গান্ধী ও অন্য নেতারা হিন্দুসমাজ থেকে অস্পৃশ্যতা দূরীকরণে বিশেষ সচেষ্ট হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও জাতপাতের বিরুদ্ধে তীব্র মত প্রকাশ করে আসছিলেন। এরই প্রতিফলন ঘটেছিল ‘চণ্ডালিকা’য়। মূল কাহিনীর যেটুকু অংশ রবীন্দ্রনাথ এই মতো প্রকাশের সহায়ক মনে করেছিলেন, ঠিক ততটুকুই তিনি গ্রহণ করেন।
১৩০৬ সালের ২৩ আশ্বিন। ‘কথা ও কাহিনী’ কাব্যের পরিশোধ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ জন্ম দিলেন আরো এক নায়িকার। শ্যামা। ১৩৪৬-এর ভাদ্র মাসে শুধু ‘শ্যামা’ চরিত্রটিকে মুখ্য করেই কবি লিখলেন একটি নৃত্যনাট্য। নাম বদলে হলো ‘শ্যামা’। এ নৃত্যনাট্যের আখ্যানবস্তু গৃহীত হয়েছে বৌদ্ধ ‘মহাবস্তু’ থেকে। নৃত্যনাট্য ত্রয়ীর অন্য দুটির মতো ‘শ্যামা’তেও নায়িকার মানসিক দ্বন্দ্ব প্রধান। বণিক বজ্রসেনকে চুরির অপবাদ থেকে বাঁচাতে সে উত্তীয় নামে তাঁর কিশোর প্রেমিককে কোটালের কাছে প্রেরণ করে। কোটাল উত্তীয়কে হত্যা করে বজ্রসেনকে মুক্তি দেয়। বজ্রসেন শ্যামার অপরাধের কথা জানতে পেরে তাকে ত্যাগ করে। মূল কাহিনীতে সামান্য গ্রহণ বর্জন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। মূলে বজ্রসেন ছিল চোর এবং শেষে গণিকাকে আঘাত করে সে তার অলংকারাদি নিয়ে পলায়ন করে। বৌদ্ধ কাহিনীর নীতিটি কামের কুফল প্রদর্শন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্য অন্য ছিল। ঘটনার বুনন এবং চরিত্রগুলোর মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ এখানে সার্থক। ‘শ্যামা’ রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ নৃত্যনাট্য।
৩.
সত্যিকার অর্থে জীবনের নানা প্রান্তে রবীন্দ্রনাথ নারী-ভাবনায় বিবর্তিত হয়েছেন, তবে সবসময়ই নারীর ভেতরে তিনি অজেয় মানব সম্ভাবনার সৌন্দর্য অন্বেষণ করেছেন। প্রাগ্রসর নারী-ভাবনার জন্য সমকালে তাঁকে অবমাননার শিকারও হতে হয়েছে। তবু তিনি একের পর এক সৃষ্টিতে নারী তথা বৃহৎ বিশ্বমানবেরই জয়গান গেয়ে গেছেন। নারী-অধিকার তথা মানবাধিকারের মৌল প্রত্যয়গুলো রবীন্দ্রসৃষ্টিতে ভিন্ন মাত্রায় প্রতিভাসিত। নারীকে তিনি স্বাধিকার প্রমত্ততার কেন্দ্রে প্রতিস্থাপন করেছেন পাশ্চাত্যে নারী অধিকার স্বীকৃতির বহু আগেই। ‘শ্যামা’, ‘চিত্রাঙ্গদা’ ও ‘চণ্ডালিকা’ শীর্ষক তিনটি নৃত্যনাট্যে তিনি নারীমুক্তির ক্ষেত্রে নতুন বিপ্লব সাধন করেছেন। নারীকে তিনি অধিষ্ঠিত করেছেন লিঙ্গনিরপেক্ষ নায়কের আসনে। স্বঘোষিত নারীবাদী না হয়েও নাটক ও অন্যান্য রচনায় নারীর যে মূল্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন, তার দৃষ্টান্ত সমকালেও বিরল। প্রেম ও কর্মশক্তির সমন্বয়ে নারীর ভেতর কল্যাণী রূপের সন্ধান করেছেন রবীন্দ্রনাথ। আর রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যে আমরা খুঁজে পাই প্রকৃতির সমান্তরালে নারী মুক্তির নব আবাহন।