স্মরণ

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ধর্মে ফেরেন

Looks like you've blocked notifications!

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প ও উপন্যাসের চরিত্র ও আখ্যানগুলো লক্ষণীয়ভাবে ইহজাগতিক। ধর্ম বা ঈশ্বরকে তাদের জীবনে বড় কোনো প্রভাব ফেলতে দেখা যায় না। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে মানিক লিখেছেন, ‘জন্মের অভ্যর্থনা এখানে গম্ভীর, নিরুৎসব, বিষণ্ণ। জীবনের স্বাদ এখানে শুধু ক্ষুধা ও পিপাসায়, কাম ও মমতায়, স্বার্থ ও সংকীর্ণতায়। আর দেশী মদে। তালের রস গাঁজিয়া যে মদ হয়, ক্ষুধার অন্ন পচিয়া যে মদ হয়। ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লীতে। এখানে তাঁহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’ কিন্তু কোনো গল্পে ঈশ্বর বা ভগবানের উল্লেখ প্রায় থাকেই না। এখানে থাকে ক্ষুধা ও জৈবিকতা। ধর্ম এখানে জীবনধর্ম। জীবন রক্ষার জন্য নিরন্তর লড়াই করাই এখানে ধর্ম। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের উল্লেখ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে নেই বললেই চলে। বিজ্ঞানের অনুসন্ধিৎসু ছাত্র এই ক্ষেত্রেও ফ্রয়েডীয় ঘরানার অনুসারী ছিলেন।

শাসকগোষ্ঠী পুরোহিত বা ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে ধর্মকে ব্যবহার করেছেন সম্মোহনের মায়াজাল হিসেবে। ধর্মের রাজ্যে চলেছে এক সম্মোহনের মেলা। সেই সম্মোহনের প্রভাবেই মানুষ ধর্মের আনুষ্ঠানিক দিককেই প্রাধান্য দিতে থাকে। ধর্মের নামে ব্যক্তির স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতেও তারা দ্বিধা করে না। যখন সম্মোহন প্রবল হয়ে পড়ে, তখনই অনুভূতি ও যুক্তি শিথিল হয়ে পড়ে। এই সম্মোহনের পদ্ধতি সব ক্ষেত্রেই সমান। এ পদ্ধতির বিশেষত্ব এই যে, তা প্রধানত মানুষের দুর্বলতার সময়ই বেশি প্রয়োগ করা হয়। জন্মের সময় ও শৈশবে যেমন, তেমনই মৃত্যুকালে ও বিপদের সময় প্রয়োগ দেখা যায় বেশি। কেউ কেউ বলেন যে ধর্ম নামের সান্ত্বনাটুকু বাদ দিলে মানুষের পক্ষে জীবনের দুর্যোগ আর বাস্তবের নিষ্ঠুরতা সহ্য করা সম্ভব নয়। সে কথা অস্বীকার করে ফ্রয়েড ‘দি ফিউচার অব অ্যান ইলিউশন’ গ্রন্থে বলেছেন যে, এই দাবির সঙ্গে তিনি মোটেই একমত নন; বরং এ ধরনের কথা শুধু তার বেলাতেই খাটবে, যার মধ্যে কি না অত্যন্ত শৈশবজীবন থেকেই ধর্ম নামক মিষ্টি বিষ ফুঁড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু মানুষ যদি শান্ত-সুস্থির পরিবেশে বড় হতে পারে, তাহলে তার পক্ষে এ জাতীয় মনোবিকারে ভোগার কথা নয়, আর তাই মনোবিকার-যন্ত্রণার উপশমের জন্য ধর্মের সম্মোহনের চাহিদাও তার থাকবে না।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের কোনো চরিত্র পরকালের পরমান্ন-স্বপ্ন ইহকালে অন্নাভাবের যন্ত্রণাকে লাঘব করে বলে ঘোষণা তো করেই না, স্বীকারও করতে চায় না; বরং নিজের ও পরিবারের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য যেকোনো পদক্ষেপ, তা অনৈতিক হলেও গ্রহণ করতে পরান্মুখ নয়। তার জীবন, জীবনধারণ ও জীবনযাপনই মূল কথা।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে এটাই হচ্ছে প্রায় সব গবেষকের মূল্যায়ন।

০২.

ধাক্কাটা বেশ জোরেই লাগে।

মানিক যখন ডায়েরিতে লেখেন—

“মায়ের দয়া

দয়া চেয়েছি, দয়া পেয়েছি—বহুবার। নিতে পারি নি, কাজে লাগাতে পারি নি, ভুল করেছি। একবার নয়, বারবার। হাত শূন্য, কোথাও পাওনা নেই, কাতরভাবে মাকে ডাকছি—২/১ দিনের মধ্যে হঠাৎ অনুবাদ বা সংকলন বাবদ টাকা এসে গেল। সামলে চললে আর মুস্কিলে পড়তাম না। কিন্তু আমার বাঁকা হিসাব।

সব নিয়মে ঘটেছে। কিন্তু কি আশ্চর্য্য যোগাযোগ! চোখে অন্ধকার দেখছি, মার কাছে আরেকবার ক্ষমা আর দয়া চাইছি—চেনা লোক ডেকে নিয়ে গিয়ে ইন্ডিয়ান পাবলিশিং-এর ‘স্ব-নির্ব্বাচিত গল্প’ বাবদ ন’শো টাকা আগাম পাইয়ে দিল। এরকম অনেকবার হয়েছে।

মন্দির মনে এলে মাকে ডাকতাম, বলতাম—মন্দির নয় মা, ওই মন্দিরে মানুষ যে বিশ্বব্রহ্মা-ময়ী মায়ের পূজা করে সেই মাকেই প্রণাম করছি।

কতরকম ছুঁচিবাই এসে গিয়েছিল। তবু মা দয়া করেছেন। দয়া চাইলে দয়া পাওয়া যায়।

মায়ের রূপ গুণ কিছুই জানি না, কি নিয়মে দয়া করেন তাও জানি না, শুধু এইটুকু জানি যে মায়ের নিয়মের এদিক-ওদিক নেই, জগৎ নিয়মে বাঁধা, কাতরভাবে মায়ের কাছে দয়া চাইলে মা দয়া করেন, এটাও মায়েরই একটা নিয়ম।

নিরুপায় হয়ে দয়া চেয়েছি, হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে- কেবল তাই নয়। আর যখন ঠেকনো দিয়ে পারি না, মার কাছে বড় দয়া চাইতাম—ধনৈশ্বর্য্য নয়, সুস্থ নিশ্চিন্ত হয়ে আরও কিছুদিন বেঁচে থেকে সাহিত্য সাধনা করতে চাই, মায়ের দয়ার নিয়ম বুঝতে চাই—যদি পারি পুরানো শাস্ত্রসংস্কার বিশ্বাসের গণ্ডী (ভেঙে) বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মহাশক্তিকে নিয়ে একখানা বই লিখব। সেকেলে মাকে (লোকে যেমন জানি) একেলে করার সাধ—এযুগের অবিশ্বাসী মানুষের পক্ষে গ্রহণযোগ্যা মননযোগ্যা করার সাধ।

এটা আমার ছেলেমানুষী। মা যদি এটা চাইতেন—মাকে সাহিত্যিক আমার ভরসায় থাকবার দরকার হত না। যে যে রূপে শাস্ত্রে, লোকাচারে ভক্তিতে বিশ্বাসে মাকে কল্পনা করা হয়ে এসেছে—বিজ্ঞানের যুগে ক্রমে ক্রমে মানুষ তা শুধু প্রাচীন ধর্মের নিদর্শন মনে করবে, শিক্ষিত অগ্রণী সমাজে বিশ্বব্রহ্মা—পরিচালনার (যা এখনও বিজ্ঞানের আওতার বাইরে, কোনদিন আয়ত্ত করতে পারবে কি না তাও বিজ্ঞান জানে না) মূল শক্তি ও নিয়ম সম্পর্কে কোন রূপক পরিকল্পনা মানবে না—এ বিষয়ে মাথা ঘামাবে না : এটাই বোধহয় মার নিয়ম।

জানি না—বুঝি না। ভাবতে হবে, মায়ের দয়ায় যদি জানতে বুঝতে পারি।

মায়ের দয়া চেয়ে কিভাবে অসহায় নিরুপায় বিকারগ্রস্ত মৃতপ্রায় মানুষটা জীবন্ত হলাম—কত ছোট বড় অঘটন ঘটে গেল সহজভাবে সাধারণ নিয়মে—আমার কাছে যা আশ্চর্য্য, কল্পনাতীত যোগাযোগ—তারই যেটুকু খেয়াল হয়েছে, ধরতে পেরেছি, লিখে রাখছি।” [তারিখ নেই। তবে ১৭.৮.১৯৫৫ তারিখের পরে লেখা]।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডায়েরিতে এই ‘শ্যামা মা’র প্রথম উল্লেখ ২৫ জুন ১৯৫৪ তারিখে। অর্থাভাবে পুরোটা লেখকজীবনই জর্জরিত ছিলেন মানিক। সেদিন তাঁর আর্থিক দীনতা আত্মবিশ্বাসকে একেবারে তলানিতে নিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎই দেখা গেল, ইউনাইটেড ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মারফত পেলেন ৬১ পাউন্ডের ড্রাফট। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসের সুইডিশ অনুবাদের চেক। আরেক চিঠিতে জানলেন, একই বইয়ের চেক ভাষায় অনুবাদের জন্য পেতে যাচ্ছেন ২৫০০ টাকা। এনবিএ থেকে চিঠি পেলেন যে ফরাসি ভাষাতেও বইটা অনূদিত হতে যাচ্ছে। মানিক এটাকে অভিহিত করলেন—‘মার ক্ষমা আর দয়া বৈকি?’ একটু পরেই লিখলেন, ‘ঠিক এমন অসময়ে মার ক্ষমা আর দয়া ছাড়া কিছুতেই সামলাতে পারতাম না। টাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে নয়। আগুনে হাত দিলে হাত পুড়ে যাবে মায়ের এই নিয়মের সঙ্গে আগুনে হাত না দেবার চেতনাও যে মা দিয়েছেন এই সহজ সত্যটা নানাভাবে বুঝিয়ে দিয়ে।’

মানিকের বিশ্লেষণপ্রবণ মন। এখানেও তিনি বিশ্লেষণ করতে চাইছেন মায়ের দয়ার স্বরূপ। লিখছেন :

“অনেক ঘটা করে মাকে প্রণাম ঠুকে ঠুকে (ঘুষ দিয়ে) চলার মানে হয় না। অণু পরমাণু পোকামাকড় মাছি থেকে পৃথিবীর জীবজন্তু পৃথিবীর বাৎসরিক ঘুরপাক খাওয়া থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব কিছু নিয়মে চলার মূলাধার নিয়মতান্ত্রিক মা। মার জগতে অনিয়ম নেই। মা নিয়মে ক্ষমা করে। নিয়মে দয়া করে।

সমস্ত নিয়ম আমরা যারা বুঝতে পারি না তারা এটাও বুঝতে পারি না যে ক্ষমা এবং দয়াও মায়েরই নিয়ম। বস্তু এবং চেতনার গতি প্রকৃতির মধ্যে এটা খুঁজে পাওয়া যায়।

সচেতনভাবে যে মাকে এই বস্তু আর চেতনার মূলাধার বলে জেনে মার কাছে ক্ষমা আর দয়া চাইবে- মার নিয়মে তার বাস্তব বুদ্ধি আর চেতনার পরিবর্তনের মধ্যেই পাবে মার ক্ষমা আর দয়া।”

ব্যাপারটা এই পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলেও না হয় চলত। কিন্তু মানিকের ডায়েরিতে ‘মায়ের দয়া’ সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে থাকে। এমনকি হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় মদ খাওয়া যখন নিষিদ্ধ, তখন কোনোভাবে ডাক্তার, নার্স এবং দারোয়ানদের চোখ এড়িয়ে দিশি মদের বোতল কিনে নিয়ে আসতে পারার মধ্যেও ‘মায়ের দয়া’ দেখতে পেতেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।

০৩.

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উল্টো বিবর্তন নানাভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবেন পণ্ডিতরা। আমরা বরং এই বলেই ক্ষান্ত দিতে পারি যে—পাঠকের জন্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডায়েরি নয়, তাঁর গল্প-উপন্যাসই চির প্রাসঙ্গিক।