মানিক ও গোর্কি : কতটা লেখক কতটা রাজনৈতিক কর্মী?
‘শিল্পগুণের প্রশ্নে বামপন্থী সাহিত্য ব্যর্থ’— এই ধারণা যাঁরা প্রকাশ করে আসছিলেন তাঁদের ভুল প্রমাণ করেছেন কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ তাঁর জন্মদিন। ১৯০৮ সালের আজকের দিনে জন্ম নেন এই বিখ্যাত বাঙালি লেখক। সেই হিসেবে আজকের দিনটি বাংলা সাহিত্যের জন্য এক ঐতিহাসিক দিন।
মার্ক্স-এঙ্গেলসের বস্তুবাদী প্রগতিশীল দর্শনের ধারক ছিলেন মানিক। বুর্জোয়া শ্রেণির সঙ্গে আপস করে তিনি আরো সচ্ছল জীবনযাপন করতে পারতেন, তা তিনি করেননি। স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেছেন, ‘আমি মানুষ হিসেবে সর্বদাই সর্বহারা শ্রেণির পাশে। আরো একজন খেটে খাওয়া মানুষের মতন আমি লেখার মজুর। সাহিত্যিক বলে সমাজের কাছে আমার বিশেষ সুবিধে নেয়ার অধিকার নেই।’
যাঁরা বলেছিলেন, ‘কমিউনিস্ট পার্টি মানিককে নষ্ট করে দিল’, তাদের মানিক দাঁতভাঙা জবাব দিলেন ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘চতুষ্কোণ’-এর মতো উপন্যাস ও ‘প্রাগৈতিহাসিক’র মতো ছোটগল্প লিখে। আমাদের এই শ্রেণিভিত্তিক সমাজ-কাঠামোতে যেহেতু গণসাহিত্য বা গণসংস্কৃতি বলে কিছু যথার্থরূপে দাঁড়াতে পারেনি, সেহেতু শিল্প মাত্রই শ্রেণিশিল্প বলতে পারি— শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব তাকে করতেই হবে। এখন প্রশ্ন হলো, শিল্পী হিসেবে আপনি কোন শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করবেন? নিজের অবস্থানটা পরিষ্কার করতে মানিক বলেছিলেন, ‘সমাজে যখন কোনো শ্রেণি রয়েছে তখন কোনো শ্রেণির প্রতি আমার পক্ষপাত তো থাকবেই। আমার দেশের অধিক মানুষের যখন নিজের ঘর নেই, আহার নেই, অর্থ নেই, তখন আমি লিখে বাড়ি-গাড়ির স্বপ্ন দেখি কী করে! সেটা তো আমার শ্রেণির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার শামিল হবে।’
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পরিষ্কারভাবে মার্কসবাদী সাহিত্যকর্মী ছিলেন, মার্কসবাদী রাজনৈতিক কর্মী না।যে কথা আমরা হয়তো ম্যাক্সিম গোর্কির ক্ষেত্রে বলতে পারব না। গোর্কির সাহিত্য যতটা মার্কসবাদী দায়িত্বপালনে নিযুক্ত, মানিকের সাহিত্য ততটা না। অবশ্য সেইভাবে মানিকের জন্য কাজটি করার সুযোগও ঘটেনি। তবে এ কথা নিশ্চয় বলা যায়, গোর্কি আগে শিল্পী, তারপর আন্দোলনকর্মী। যে কারণে লেলিন তাঁর কর্মীদের বারণ করে দিয়েছিলেন গোর্কিকে সবসময় বিরক্ত না করতে। এর কারণ হয়তো, লেখক গোর্কিকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে তাঁর শিল্পীসত্ত্বাকে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে নিযুক্ত করতে চাননি লেলিন। গোর্কি সেটি করতে সফল হয়েছিলেন বলেই মার্কসবাদী আন্দোলন বিশ্বব্যাপী স্তিমিত হয়ে পড়লেও গোর্কির সাহিত্যকর্ম বিক্রি হওয়া কিন্তু বন্ধ হয়নি। এখনো তার ‘মা’ উপন্যাসটি বিশ্বে সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় আছে।
ভ্লাদিমির নাবোকফকের মতো অনেকেই, ‘The Mother a very second-rate production’ বললেও এর জনপ্রিয়তাকে অস্বীকার করতে পারেননি। সুধীন্দ্রনাথ যে বললেন, ‘আমার জানতে বাকি নেই যে সাম্য ও মৈত্রীর মন্ত্র সেধে মানুষ মুক্তি পায় না, নামে পিশাচের পর্যায়ে। উপরন্তু অনাবশ্যক নরবলি ছাড়া বিদ্রোহের যে অন্য কোনো পরিণাম আছে, তা আমি ভাবতে পারি না; [...] অতএব গোর্কির বিপ্লববিলাসে আমার সহানুভূতি নেই।’এটা দর্শনগত বিভেদ থেকে বলা। এর উত্তরও দিয়েছেন গোর্কি নানাভাবে। তিনি ১৯০৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর এলিওনস্কি নামে জনৈক লেখককে লিখেছিলেন :
‘কাদের জন্য এবং কোন উদ্দেশ্যে তুমি লিখবে? এই প্রশ্ন নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে তোমাকে। তোমাকে বুঝতে হবে যে, আমাদের কালে সবচেয়ে যোগ্য ও দামি, আর সেইসঙ্গে সর্বাধিক মনোযোগী ও খুতখুতে, পাঠক হচ্ছে গণতন্ত্রমনা শ্রমিক ও কৃষক- যারা লিখতে-পড়তে শিখে গেছে। কোনো বইয়ের ভিতরে তারা সবচেয়ে বেশি করে যা চায় তা হলো তাদের সামাজিক ও নৈতিক নানা প্রশ্নের সদুত্তর, মুক্তিলাভের প্রণোদনা- এই কথার সম্পূর্ণ অর্থ যা ঠিক ততখানিই। তারা অস্পষ্টভাবে অনেক কিছুই বুঝতে পারে। তারা অনুভব করে যে মিথ্যে-ভরা জীবন তাদের পিষে ফেলছে; তারা বুঝতে চায় ঐ মিথ্যার স্বরূপ, আর তার থেকে বাঁচতে চায়।’[‘মা : পাঠকের নিজস্ব পাঠ’- হায়াৎ মামুদ]
এ ক্ষেত্রে আমি বলব, গোর্কির চেয়ে মানিক লেখকের শিল্পীসত্তার বিষয়ে অধিক মনোযোগী ছিলেন। যে কারণে তিনি বলতে পেরেছেন, ‘পার্টির কাছে সস্তা হাততালি পাবার উৎসাহে লেখায় যদি আন্তরিক সৃজনশীলতাকে বিসর্জন দিয়ে পার্টির তাৎক্ষণিক লাইন অনুযায়ী ফরমায়েশি গল্প লিখতে বসেন, তাহলে পার্টির দোষ নয়, দোষ লেখকের।’
তাই হয়তো দিন শেষে গোর্কির বেশি কিছু লেখাকে পার্টি-সাহিত্য বলে আখ্যায়িত করলেও মানিকের লেখাকে সেটি বলার সুযোগ থাকে না।