বাংলাদেশের ভাস্কর্য : ভোক্তার রুচি ও শিল্পীর স্বাধীনতা
সব মূর্তিই যেমন ভাস্কর্য নয়, তেমনি ভাস্কর্যকে মূর্তি বলা চলে না। অর্থাৎ, ভাস্কর্য আর মূর্তি এক জিনিস নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে ভাস্কর্য কী? খুব সহজ করে যদি বলতে হয়, ভাস্কর্য হলো শিল্প। প্রসঙ্গক্রমে অনিবার্যভাবে এখনই নিশ্চয়ই আরেকটি প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়াবে, তাহলে শিল্প কী? ভাস্কর্য-প্রশ্নে গা বাঁচিয়ে গেলেও এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ নয়। শিল্পের সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞাও নেই। বিভিন্ন মনীষী শিল্প সম্পর্কে তাঁদের নানা রকম মতামত ব্যক্ত করেছেন।
নিউইয়র্কের ‘মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট’-এর প্রথম পরিচালক ও ইতিহাসবিদ আলফ্রেড এইচ বার মন্তব্য করেছেন, ‘শিল্পকলার সংজ্ঞা দেওয়া বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।’
লন্ডনের ‘টেট আর্ট গ্যালারি’র প্রাক্তন পরিচালক জন রথেনস্টাইনের মতে, ‘শিল্পীর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে শিল্প।’ অর্থাৎ শিল্পী তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী শৈল্পিক যে বিষয় বা বস্তু সৃষ্টি করবেন, তাকে শিল্প বলা যেতে পারে। স্পেনের দার্শনিক ও লেখক জর্জ সান্টায়না মনে করতেন, শিল্পের কাজ হচ্ছে ‘মানুষকে আনন্দ দান করা।’
যদিও বিভিন্ন মনীষী শিল্পকলাকে নানাভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন, তবে একটি বিষয় সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত, সেটি হলো—শিল্পকলা মূলত একটি অভিব্যক্তি, শিল্পী ও দর্শকের মধ্যে একটি আত্মিক যোগাযোগের সেতু এবং সর্বোপরি একটি নতুন কিছুর নির্মাণ।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, দুর্গা-প্রতিমাও তো আনন্দ দেয়, তাহলে তা শিল্প বা ভাস্কর্য নয় কেন? নয় তার কারণ, তাতে নতুন কিছু নির্মাণের প্রয়াস নেই। অর্চনার জন্যই তার সৌন্দর্যবর্ধন করা হয় এবং সেটা প্রথাগত। সুতরাং তাকে কোনোভাবেই ভাস্কর্য বলা চলে না।
প্রসঙ্গ যেহেতু মূর্তি নয়, সেহেতু মূল প্রসঙ্গ ভাস্কর্যে ফিরে আসা যাক। বাংলাদেশের ভাস্কর্যচর্চা প্রথাবদ্ধতায় আবদ্ধ। ভাস্কর্য মূলত তিন ধরনের—রিয়েলিস্টিক বা মূর্ত ভাস্কর্য, অ্যাবাস্ট্রাক্ট বা বিমূর্ত ভাস্কর্য এবং রিলিফ, অর্থাৎ টু ডাইমেনশনাল ভাস্কর্য। বাংলাদেশে এ তিন ধরনের ভাস্কর্যের প্রচলন থাকলেও অন্য দুটির তুলনায় রিয়েলিস্টিক বা মূর্ত ভাস্কর্যের প্রচলন সর্বাপেক্ষা। এই রিয়েলিস্টিক ভাস্কর্যকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটি গোছালো মূর্ত ভাস্কর্য, অন্যটি অগোছালো মূর্ত ভাস্কর্য। বাংলাদেশে গোছালো মূর্ত ভাস্কর্য অধিক সমাদৃত, যা অর্ধশিল্পসমৃদ্ধ। ‘অর্ধ’ শব্দটির ব্যবহার এ কারণে যে, শিল্পবোধ ব্যাপারটা প্রাকৃতিক। প্রকৃতি গোছানো নয়, বরং অগোছালো সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ। সুতরাং শিল্প অগোছালো সৌন্দর্যকেই দাবি করে। নিরলংকার পরিচ্ছন্ন বাণীর মতই গোছানো ভাস্কর্যশিল্পের মূল সৌন্দর্যকে ব্যাহত করে। এখানে রাফ অর্থে অগোছালো শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে। একটি বাণী বা কবিতার পঙ্ক্তি যদি স্টেটসমেন্ট বা বিবরণমূলক হয়, তাহলে তার আবেদন তাৎক্ষণিক। আর যদি তা তির্যক বা ঘুরিয়ে বলা হয়, তখন তা বহুরৈখিক ভাবনার উদ্রেক করে, যাকে শিল্পোত্তীর্ণ বলা হয়। এই বহুরৈখিকতাই শিল্পের মূলমন্ত্র। মূলত শিল্প তাই, যা মানুষকে ভাবতে এবং সৌন্দর্য উপলব্ধি করাতে বাধ্য করে। কোনো কোনো ভাস্কর্য আছে, যার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে চমকে উঠতে হয়। এই চমকানোটাই প্রকৃত শিল্পের ইঙ্গিত করে।
মানুষের সৌন্দর্য জীবন্তেই প্রস্ফুটিত। তার সচল ভঙ্গিমা সৌন্দর্যের আধার। মৃত মানুষ অসুন্দর নির্জীব। ভাস্কর্য যদি মৃত মানুষের মতো হয়, তখন তার সৌন্দর্যও নির্জীবতায় পর্যবসিত হবে। সুতরাং ভাস্কর্য হবে জীবন্ত মানুষের মতো চঞ্চল, উদ্দীপনাময়। নিথর, নিস্তরঙ্গতায় সমুদ্র অসুন্দর। উথাল-পাথাল ঢেউয়েই সমুদ্রের আসল সৌন্দর্য বিদ্যমান।
ভাস্কর্যের প্রসঙ্গ এলে যে মানুষটির নাম পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে দাঁড়ায়, তিনি মাইকেল অ্যাঞ্জেলো। যাঁর নির্মিত ভাস্কর্য দর্শককে চমকে উঠতে বাধ্য করে। এই চমক প্রতিমূর্তির জন্য নয়, বরং মূর্তি নির্মাণের নিখুঁত কৌশল ও প্রাকৃতিক সারলীকরণতার জন্য। তাঁর নির্মিত ‘পিয়েটা’র কথাই ধরা যাক। তা কি শুধুই মনুষ্যমূর্তি? নাকি এর এক্সপ্রেশন আরো অন্য কোনো কিছুর নির্দেশ দেয়? কিংবা নিকট অতীতের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বাংলা ভাষাভাষী শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজের কথাই ধরা যাক, যিনি রবীন্দ্রনাথের আনুকূল্য ও প্রশ্রয় পেয়েছিলেন। তাঁর ভাস্কর্যে নিটনেসের বড়ই অভাব। চূড়ান্ত রাফনেস বা অগোছালো ভাবই তাঁর সারবত্তা। উল্লিখিত শিল্পীদের ভাস্কর্য ও আমাদের ভাস্কর্যের দিকে প্রকৃত সান্দৌর্যিক দৃষ্টিতে তাকালেই শিল্পবিচারে এর পার্থক্য সহজেই অনুমেয়।
বাংলাদেশের সাহিত্যে, সংগীতে বা চিত্রকলায় বহুরৈখিক ভাবনার যে সমারোহ, তা ভাস্কর্যে নেই বললেই চলে। যে কারণে ভাস্কর্য শিল্পটি সীমবদ্ধতায় আবদ্ধ। কিন্তু কী এর কারণ? তা কি শুধুই শিল্পীর চিন্তার দীনতা? শিল্পীর সাহস ও চিন্তার দৈন্য স্বীকার করে নিলেও বিতর্কের সমাধান হয় না। তাতে আরো একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। সব শিল্পীই কি একযোগে দীনতার শিকার? তা কি হয় কখনো? ভাস্কর্যের সহধর্মিণী চিত্রকলায় যে বাংলাদেশের সুনাম পৃথিবীর এপার থেকে ওপারে ছড়িয়ে পড়ল—সুলতান, জয়নুল, শাহাবুদ্দিন... তাহলে?
এর প্রধান কারণ, ভাস্কর্য শুধু শিল্পীর একার চিন্তা ও দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল নয়, এতে ভোক্তাও জড়িত। ভোক্তার রুচির ওপরও এর দায় অনেকখানিই নির্ভরশীল। শিল্পীর স্বাধীনতা আর ভোক্তার রুচি ও সৌন্দর্যবোধের অসামঞ্জস্যতাই বাংলাদেশের ভাস্কর্যের দুরবস্থার কারণ। ভোক্তার রুচি, সৌন্দর্যবোধ এবং শিল্পীর স্বাধীনতা—যত দিন এ দুয়ের মুক্তি না ঘটছে, তত দিন এ দেশে ভাস্কর্যশিল্পেরও মুক্তি নেই।