নিজের কথায়

নাসিরুদ্দীন-কন্যা নূরজাহান বেগম

Looks like you've blocked notifications!

নূরজাহান বেগম মহিলা সাপ্তাহিক সাহিত্য পত্রিকা বেগম-এর সম্পাদিকা। ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই কলকাতায় তাঁর বাবা মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীনের হাতে জন্ম এই সাপ্তাহিকটির। তার পর প্রায় চার দশক ধরে নূরজাহান বেগম-এর সম্পাদনার কাজ করে আসছেন। দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে তাঁদের সঙ্গে পত্রিকাটিও কলকাতার ওয়েলেসলি স্ট্রিট থেকে ঢাকায় পাটুয়াটুলীতে স্থানান্তরিত হয়। এই ওয়েলেসলি স্ট্রিটে নূরজাহান বেগম ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত কাটিয়েছেন। মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীন ছিলেন ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক। সওগাত অফিস ছিল বাড়িতেই। প্রতি সন্ধ্যায় সাহিত্য মজলিস বসত সেখানে। সেই সুবাদে তখনকার খ্যাতনামা প্রগতিশীল কবি-সাহিত্যিকদের নূরজাহান বেগম খুব কাছ থেকে দেখেছেন।

মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীন মুক্ত মনের মানুষ ছিলেন। প্রগতিশীল সাহিত্য শিবিরে তাঁর অবস্থান ছিল। পাশাপাশি বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণে তিনি অসংখ্য দুঃসাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। নূরজাহান বেগমের হাতেখড়ি বাবার কাছেই। আজ এই বাহাত্তর বছর বয়সেও বাবার নির্দেশিত পথ ধরেই হেঁটে চলেছেন তিনি।

মাসিক সওগাত অর্ধশতাব্দীজুড়ে বাঙালি মুসলমান প্রগতিশীল লেখকদের সাহিত্যচর্চার পথ যেমন প্রশস্ত করেছিল, তেমনি অসংখ্য লেখিকার প্রথম পদচারণা এখানে। দেশ বিভাগোত্তর কালে এর পরিধি আরো বিস্তৃত হয়। বাঙালি মুসলিম লেখিকা, সমাজসেবী, সংস্কৃতিকর্মীদের পীঠস্থান হয়ে দাঁড়ায় মেয়েদের জন্যই আলাদা করে গড়া সাপ্তাহিক বেগম এবং ‘বেগম ক্লাব’। অনেক বিদেশি প্রতিনিধিও এখানে সংবর্ধনা পেয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব সময় অব্দি বেগম এবং ‘বেগম ক্লাব’ এই বাংলার নারী আন্দোলনে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছিল। পরবর্তীকালে আরো কিছু মহিলা পত্রিকার আবির্ভাব ঘটলেও পত্রিকাকেন্দ্রিক লেখিকা-সমাবেশ, চর্চাস্থল এত বড় কলেবরে আর কোথাও দেখা যায়নি।

এহেন ঐতিহ্যসমৃদ্ধ পাটুয়াটুলীর সওগাত প্রেস থেকে এখন আর সওগাত বের হয় না। পাকিস্তানবিরোধী ১৯৬৯-এর উত্তাল আন্দোলনের দিনগুলোতে তা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে বেগম সপ্তাহান্তে প্রকাশিত হয়। ‘বেগম ক্লাব’-এর ধূসর, মলিন অডিটরিয়ামটি এখানে। আগের জৌলুস, জমজমাট ভাব সেই কবে অন্তর্হিত হয়েছে। নূরজাহান বেগম বেগম-এর নথিপত্র নিয়ে প্রতিদিন এখানেই বসেন। সঙ্গে আছেন মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীনের কম্বাইন্ড হ্যান্ড রওশন। রওশন একই সঙ্গে সওগাত-এর প্রেসবয়, বেয়ারা, ম্যানেজার ছিলেন। এখন এই প্রৌঢ় ফোরম্যানের দায়িত্বরত।

আমরা নূরজাহান বেগমের স্মৃতিচারণধর্মী সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করি ’৯৬-এর ১৫ জুন বিকেল ৩টা নাগাদ। বেগম-এর কাজ একা সামলাতে গিয়ে তাঁর দুপুরের খাওয়া তখনো হয়ে ওঠেনি। সাক্ষাৎকারের মাঝখানে আমাদের অনুরোধে তিনি খেতে উঠলেন। কিন্তু খাওয়ার থেকে পরিবেশনই ছিল মুখ্য। সওগাত সাহিত্য মজলিসে ভরপেট আতিথেয়তার জন্য মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীন কিংবদন্তি ছিলেন। তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরি বাঙালি মুসলমানদের সাহিত্য স্মৃতিগারে বিচরণরত প্রায় আধ ডজন সাদা বেড়ালকে খাইয়ে তবে নিজে খেলেন।

নূরজাহান বেগমের সাক্ষাৎকারটি আমরা টেপ রেকর্ডারে গ্রহণ করি। প্রতিলিপিটি কয়েকটি সাব হেডিং-এর আওতায় সাজানো হলেও স্বতঃস্ফূর্ততা অক্ষুণ্ণ রাখার তাগিদে তাঁর মুখের ভাষাটিতে আমরা হাত দিইনি।

আমার শৈশব

আমার জন্ম ১৯২৫ সালের ৪ জুন চাঁদপুরের পাইকারদী গ্রামে। ছোটবেলায় গ্রামেই ছিলাম। দুবার জলে পড়ে অতিকষ্টে বেঁচেছি। তখন বাবা, মা ও আমাকে কলকাতায় নিয়ে এলেন। এই প্রথম আমাদের কলকাতায় আসা। ১১ নম্বর ওয়েলেসলি স্ট্রিট ছিল কলকাতায়। আমরা তখন ওখানে থাকতাম। যখন কলকাতায় এলাম তখন সওগাত-এর খুব জমজমাট অবস্থা। কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে অনেক কবি-সাহিত্যিককে খুব কাছ থেকে দেখেছি। ছোট ছিলাম বলে সবার দারুণ স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছি। আমাকে সবাই ‘নূরী’ বলে ডাকতেন। বাবা বাইরে চলে গেলে ওঁরা যদি লেখা দিতে আসতেন, আমাকে ডেকে বলতেন, ‘নূরী, তোমার বাবা এলে বলো, আমি এই লেখাগুলো দিয়ে গেলাম।’ লেখকদের এই লেখাগুলো বাবা ফিরে এলে রাতে তখন তাঁকে দিতে যেতাম। তখন মনে হতো যেন বিরাট একটা কাজ করে ফেলেছি।

ছোটবেলা থেকে যে পরিবেশ আমি পেয়েছি, আমরা মনে হয় না বাংলাদেশের কোনো মেয়ে তা পেয়েছে। কারণ, কাজী নজরুল ইসলাম, আবুল কালাম আজাদ, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল ফজল থেকে আরম্ভ করে তৎকালীন মুসলিম সাহিত্যিক এবং হিন্দু সাহিত্যিকরাও বিকেলে সওগাত মজলিসে এসে বসতেন। সেই পরিবেশটা আমি পেয়েছিলাম। তখন আমি কিছু না বুঝলেও মায়ের চারপাশে ঘুরতাম। মনে হতো, বাড়ির ভেতর বিরাট কিছু হচ্ছে এবং সেখানে চা-নাশতা আমায় পৌঁছে দিতে হবে। আমাদের বাড়িতে যে মেয়েটি কাজ করত তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতাম। আর কাজী সাহেবের জন্য বিশেষ করে নিয়ে যেতাম পান ও জর্দা। সবচেয়ে আনন্দের দিন সেদিন আমার ছিল, যেদিন দেখলাম একটি প্রাইভেটকার গোলাপ ফুল দিয়ে সাজিয়ে কাজী সাহেবকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নাগরিক সংবর্ধনায়। কী অপরূপ দৃশ্য! সে দৃশ্য আমি জীবনেও ভুলব না। কাজী সাহেব সংবর্ধনার পরই সওগাত অফিসে এসে ডাকলেন, ‘নূরী!’ আমাকে নূরী ডাকতেন তিনি। এর একটা ইতিহাস আছে। আমাকে বাবা আদর করে ডাকতেন ‘নূরু’। কাজী নজরুল ইসলামের নিজেরই ডাকনাম নুরু ছিল। তখন তিনি বললেন, ‘না, ওকে আমি নূরীই ডাকব।’ তারপর তিনি একটা থলে থেকে বের করে দেখালেন সোনার কলম, সোনার দোয়াত। কাজী সাহেবের সে কী আনন্দ!

সাহিত্য মজলিসে নারী!

সেকালে সাহিত্য মজলিসে কোনো মেয়েই দেখিনি। আমি যখন কলকাতায় যাই, তখন একজন মাত্র মহিলা আমি দেখতে পাই, তিনি কবি সুফিয়া কামাল। তখন ছিলেন সুফিয়া এন হোসেন। কবি সুফিয়া কামাল তখন থেকে যে আমার খালা, এখনো তা-ই আছেন। এখনো কোনো সমস্যায় পড়লে তাঁর কাছে ছুটে যাই এবং পরামর্শ নিই।

এই যে আপনি প্রশ্নটা করলেন, মেয়েরা সাহিত্যের মজলিসে আসত কি না। সে যুগে কোনো মেয়ের বাইরে বেরোনো, অফিসে যাওয়া, বিশেষ করে মুসলিম মেয়েদের একেবারে নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু বাবা বললেন, ‘একটা কাজ করো। ভাঙতে হয় তো আমরাই বাধা ভাঙব। আমার স্ত্রী আজ থেকে আর বোরকা পরবে না। আর যারা যারা আমার সঙ্গী আছো, তারাও কেউ বোরকা পরতে পারবে না। এবং যারা যারা সওগাত অফিসে আসবে, তাদের পরিবারের লোকজনদেরও নিয়ে আসবে। নিজেরা নিজেদের মতো আলাপ-আলোচনা করবে। তারপর দেখলাম যাঁরাই আসতেন, সঙ্গে তাঁদের স্ত্রীদেরও নিয়ে আসতেন। অন্দরমহলে তাঁদের সঙ্গে মায়ের খুব আলাপ-আলোচনা চলত। তবে রান্নাবান্না নিয়ে, সেলাই-টেলাই নিয়ে, রাজনীতি নয়। বাবা শেষ পর্যন্ত বললেন, ‘ঘরে আবদ্ধ থাকার দরকার নেই। বের করো এদেরকে।’ কী করে বের করা যায়! ‘চলো, স্টিমারে করে একবার বেড়িয়ে আসার পর তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। কারণ তখন মেয়েরা, আমার মায়েরা তাঁদের স্বামীদের সহযোগিতা পেয়েছিলেন। সমালোচনার কোনো পরোয়া তাঁরা করেননি।

রোকেয়ার স্কুল

কাজী নজরুল ইসলামের সংবর্ধনার পরই রোকেয়া বাবাকে ফোন করে বললেন, ‘নাসিরুদ্দীন সাহেব, আমার স্কুলে আপনার মেয়েকে দেন।’ বাবা বললেন, ‘মেয়ে তো খুব ছোট, কী করে স্কুলে যাবে।’ রোকেয়া বললেন, ‘আমার দাই আছে, ওকে গাড়িতে করে নিয়ে আসবে। কোনো অসুবিধা হবে না।’ বাবা মাকে জানালেন। মা বললেন, ‘না, এত ছোট মেয়ে আমি স্কুলে দেব না।’ বাবা বললেন, ‘যাক না। স্কুলে থাকতে ভালো লাগলে থাকবে, না হয় আমরা নিয়ে আসব।’

আমার তো ওখানে খুব ভালো লাগল, ছোট ছোট বাচ্চা আরো অনেক আছে। তখন আমি বেগম রোকেয়াকে দেখেছি এবং এখনো রোকেয়াকে চোখের ওপরে দেখছি এ জন্য যে প্রতিবছর তাঁকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে এবং তাঁর স্মৃতিটুকু বিলীন হয়ে যায়নি। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী। বেঁটে, চোখে চশমা, সব সময় লম্বা আস্তিনের জামা পরতেন, সাদা শাড়ি, কালো জুতা। এবং তিনি ধীরে ধীরে হাঁটতেন। কথা বলতেন খুব আস্তে আস্তে। এবং প্রতিটি ক্লাসে তিনি রোজ সকালবেলা এসে ছাত্রীসংখ্যা ঠিক আছে কি না, ছাত্রীরা সব আসছে কি না, আমার মনে হয় তা দেখতেন। তিনি এলে আমরা সবাই দাঁড়াতাম। মিটিমিটি হেসে তিনি চলে যেতেন। তিনি ক্লাসে এইট, নাইনের ক্লাস নিতেন। তখন যে শিক্ষাব্যবস্থা তিনি করেছিলেন সেটা হলো, দুপুরবেলা আমাদের টিফিনের পরে ছোট ছোট খাটিয়া আর বালিশ দিয়েছিলেন। আমরা সব লাইন ধরে টিফিন খেয়ে শুয়ে পড়তাম। কোনো কোনো বাচ্চা ঘুমিয়ে পড়ত। আর আমরা যারা দুষ্টু ছিলাম শুয়ে শুয়ে কথা বলতাম, গল্প করতাম। ঘণ্টা বাজলে আমরা ক্লাসে চলে যেতাম। কিন্তু যারা ঘুমিয়ে পড়ত, তাদের আর তোলা হতো না, স্কুল ছুটির সময় বাসার দাই বা অভিভাবক এসে তাদের নিয়ে যেত। কী সুন্দর ব্যবস্থা! তার পর বাবা দেখলেন, মেয়ে একসঙ্গে আরবি, উর্দু, ইংরেজি, বাংলা পড়ছে। এতগুলো ভাষা যদি একসঙ্গে পড়ানো হয়, তাহলে তো মেয়ের শরীর খারাপ হয়ে যাবে। এর পরে আমাকে বাড়িতে নিয়ে এলেন।

বাড়িতে একজন শিক্ষক রাখা হলো, তিনিই পড়াশোনা করাতেন, দেখাশোনা করতেন। তারপর বেগম রোকেয়া বাবাকে আমার ফোন করলেন, ‘আপনার মেয়ে স্কুলে আসছে না অনেক দিন হয়ে গেল। আমি তো স্কুলের কিছু পরিবর্তন করেছি। এখন স্কুলে খ্রিস্টান, হিন্দু, মুসলমান, সব ধর্মের শিক্ষয়িত্রী আছে। স্কুলে পাঠিয়ে দিন।’ স্কুলে সব ধর্মের ছাত্রী ছিল। বাবা আবার আমাকে সাখাওয়াত মেমোরিয়ালে পাঠিয়ে দিলেন। রোকেয়াকে আর পাইনি, ততদিনে উনি মারা গেছেন। আমি ক্লাস ফাইভে ভর্তি হলাম। ম্যাট্রিক দিয়েছি আমি সাখাওয়াত মেমোরিয়াল থেকে।

তো, স্কুলের যে পরিবর্তনটা হয়েছিল, তা অপূর্ব। স্কুল থেকে এমন কোনো বিষয় নেই, যে বিষয়ে আমরা শিক্ষা লাভ করিনি। সাখাওয়াত মেমোরিয়ালে এস্রাজ বাজানো থেকে শুরু করে সেতার, ভায়োলিন-এর প্রতিটির আমরা সা-রে-গা-মা করেছি। হাতেখড়ি করেছি। যেমন সেতার আমার ভালো লাগত, আমি পিকআপ করলাম। ভায়োলিন বাজাতে পারতাম না। হারমোনিয়ামের যে দিদি ছিলেন, তিনি কোরাস গান করাতেন। আরেকটা ছিল সূচিশিল্প। যে সব মেয়ে সূচিশিল্পে ভালো, তিন মাস অন্তর অন্তর একটি প্রতিযোগিতা হতো। এ ছাড়া ছিল আরেকটা প্রতিযোগিতা, অঙ্কন শিল্প। এ ছাড়া নাটক ছিল, খেলাধুলা ছিল। সে সময়ও এসব ব্যাপারে কড়াকড়ি ছিল। আমরা যে সকলের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়েছি তা না। তারা বলেছে, মুসলমান মেয়েদের নাচ-গান শিখিয়ে কী হবে। এসব ইসলামের পরিপন্থী। কিন্তু আমাদের অভিভাবকরা তাদের কথা শোনেননি। তাঁরা বলেছেন, এগুলো করা ভালো, এগিয়ে যাও। তখন তরুণ একটি দল তাঁদের পরিবারকে প্রগতিশীল চিন্তাধারায় আনার জন্য তাঁদের স্ত্রী থেকে শুরু করে সন্তানদের মধ্যে বীজ বপন করেছিলেন।

বাবার কথা

আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি এই ভেবে, আমরা আজকে যেসব প্রগ্রেসিভ কথা বলছি, এটা আমার বাবা বহু আগে বলে গেছেন। উনি পেছনের কথা বলেননি, পেছনে যেতে বলেননি। তিনি বলেছেন, যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তোমরা চলো। যুগধর্মটাকে অস্বীকার করলে তোমাদের কিছু হবে না। আমরা যারা তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি, তিনি তাঁদের মধ্যে এই বীজ বপন করে গেছেন। এ জিনিসটা এখন কল্পনা করা যায় না, কী করে তিনি সেই সময় এসব চিন্তাভাবনা করেছিলেন। মেয়েদের উদ্দেশে সম্মান প্রদর্শনের জন্য ১৯১৮ সালে তিনি রোকেয়ার লেখা দিয়ে সওগাত আরম্ভ করেছিলেন এবং তিনি চিন্তা করেছেন মেয়েদের লেখা কীভাবে সংগ্রহ করা যায়, কোথায় পাওয়া যায়, এসব নিয়ে। ১৯৩০ সালে মহিলা সংখ্যা সওগাত বের করে তিনি অবাক করে দিলেন সবাইকে। গোড়াপন্থীরা যদিও প্রথমে গালাগালি করেছে। কাফের বলেছে। তিনি কী করে ফজিলাতুন নেসাকে, প্রথম বাঙালি মুসলিম মেয়ে, বিদেশে পাঠালেন! তিনি ভাবলেন, যদি একজন মুসলমান মেয়ে উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে যায়, তাহলে মুসলমান মেয়েদের জন্য শিক্ষার পথ প্রশস্ত হবে। এ কাজের জন্য বাবাকে অনেক নাকানি-চোবানি খেতে হয়েছে এবং তাঁর মৃত্যু হতে পারে, এ রকম ঘটনাও ঘটেছে। তিনি ভ্রূক্ষেপ করেননি। এখন বক্তব্য হলো যে, নাসিরুদ্দীন সাহেব যে কাজগুলো করে গেছেন, আমাদের জন্য যে পথ প্রশস্ত করে গেছেন এখনো সাখাওয়াত হোসেন মেয়েদের জন্য, মেয়েদের স্বাধীনতা, অধিকার সম্পর্কে যেসব কথা বলে গেছেন, এসবও আমরা পুরোপুরি এখনো পাইনি। এখনো সংগ্রাম করে যাচ্ছি। আমরা আশাবাদী মেয়েরা যদি শিক্ষিত হই, বেশি দিন লাগবে না এ বাধাগুলো ডিঙিয়ে আসতে।

আশাপূর্ণা দেবী

১৯৪৬-এ আশাপূর্ণা দেবীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। শেষ সংখ্যা মহিলা সওগাত যখন বের করেন বাবা, সে সময় দেখলেন সবার লেখার সঙ্গে ছবি এসেছে, কেবল তিনটি লেখার সঙ্গে ছবি নেই। এক. সুফিয়া কালাম, দুই. আশাপূর্ণা দেবী, অন্যজন জ্যোর্তিময়ী দেবী [বধূরানী গৌরীপুর]। যাহোক তিনি আশাপূর্ণা দেবীর কাছে গেলেন ছবির জন্য। আশাপূর্ণা দেবী বললেন, ‘আমার তো কোনো ছবি নেই। লক্ষ করবেন, কোনো পত্রিকায় তখন পর্যন্ত তাঁর কোনো ছবি ছাপা হয়নি।’ তখন বাবা বললেন, ‘আপনাদের ছবি তোলার জন্য স্টুডিওতে নিয়ে যাব, সঙ্গে সুফিয়া থাকবে।’ বধূরানীকেও তাই বললেন। তাঁদের তিনজনের ছবি নেই, ছবি দরকার। বাবার স্কোডাক গাড়ি ছিল। গাড়ি নিজে চালালেন, আমি পাশে বসা। ওনারা বসলেন পেছনে। স্টুডিওতে ছবি তুলে উনি তাঁদের (আমাদের) বাসায় নিয়ে এলেন। বাসায় এসে কথাবার্তা বলার পর এল নাশতা। নাশতা যখন দেওয়া হলো তখন আশাপূর্ণা দেবী বললেন, ‘দেখেন আমার কোনো সংস্কার নেই, একদম মুক্তচিন্তার মানুষ আমি। কিন্তু শাশুড়ি বাইরে খাওয়াটা পছন্দ করেন না। খেয়ে বাসায় যাব, তখন তিনি জানতে পারবেন এখানে খেয়ে গেছি। এতে তিনি খুবই অসন্তুষ্ট হবেন। ‘আমি এখন খাব না’ এই বলে তিনি প্লেটটা রেখে দিলেন। বাকি সবাই খেলেন। এটাই আমার আজ মনে পড়ছে, কত শ্রদ্ধাবোধ ছিল তাঁর গুরুজনদের প্রতি! আমি আজও তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। আশাপূর্ণা দেবীর মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণে আমি বেগম-এ লিখেছিলাম। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছি। তিনি গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধার যে শিক্ষা আমাদের দিয়ে গেছেন, এটাই আমি লিখেছিলাম, ওই ঘটনাটি উল্লেখ করে।

কবি সুফিয়া কামাল ও বেগম পত্রিকা

সুফিয়া কামাল আমার বাবাকে বড় ভাই মনে করতেন, মাকে বোন মনে করতেন। প্রতি রোববারে তিনি আমাদের বাসায় আসতেন। তখন তার একমাত্র মেয়ে দুলু আমার বান্ধবী ছিল। আমাদের আর্থিক অবস্থা অতটা ভালো ছিল না। রোববারে কেবল আমরা সুখাদ্য খেতাম। খালাম্মার হাতের রান্না এত ভালো ছিল! বাবা সাধ্যমতো বাজার থেকে যা নিয়ে আসতেন, উনি তা দিয়ে চমৎকার রান্না করতেন।

বাবার সঙ্গে খালাম্মার পরিচয় লেখার সূত্রে। বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ-এ বাবা লিখেছেন, ‘সুফিয়াকে আগে কখনো আমি দেখিনি। হঠাৎ একদিন বোরকা পরে এসে বলল, আমি সুফিয়া।’ ইতিমধ্যে সওগাত-এ ওনার বেশ কিছু লেখা ছাপা হয়ে গেছে।

ছোটবেলায় খালাকে ছাড়া মহিলা সাহিত্যিক মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকাকে দেখেছিলাম। উনি কলকাতার বাইরে থাকতেন, যখনই কলকাতায় আসতেন, বাবার সঙ্গে দেখা করতেন, লেখা দিয়ে যেতেন। তারপরই আবার চলে যেতেন।

আমার বিএ পরীক্ষার পর বাবা বললেন, ‘মহিলা সংখ্যা সওগাত দিয়ে মেয়েদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। মেয়েদের দ্রুত এগোতে হবে।’ তখন তিনি সুফিয়া কামালকে ডেকে বললেন, ‘দেখো, মহিলা সংখ্যা সওগাত-এ তোমরা বছরে কয়েকবার ছিটেফোঁটা লিখছ। এতে সাহিত্যের ক্ষেত্রে মেয়েদের বিশেষ কিছু হচ্ছে না। তার চেয়ে কাজ করো, একটা সচিত্র সাপ্তাহিক বের করো। ছবি-টবি দিয়ে ভালো করে বের করলে মেয়েরা উৎসাহিত হবে।’ খালাম্মা খুব উৎসাহিত হলেন। বললেন, এটা করলে তো ভালো হয়। আমি লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে সব বেরিয়েছি। সুফিয়া কামাল বেগম-এর সম্পাদিকা হলেন। বেগম-এর প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদে ছিল রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের একটি বিরাট ছবি। মেয়েদের কিছু লেখা খালাম্মা সংগ্রহ করলেন। অ্যানাউন্স করার পর কিছু কিছু এলো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা অনুবাদের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। মেয়েরা পত্রিকা অফিসে আসতে সংকোচবোধ করত। হাতের লেখা বাইরে বেরোন গোনাহর কাজ। এটা মনে করেও তারা বাইরে লেখা দেবে না। এ রকম পরিস্থিতিতেও আমরা কলকাতায় বেগম চালিয়েছি তিন বছর। তখন যেসব লেখিকা আসতেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন সাঈদা খানম, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, জাহানারা আরজু, সাজেদা খাতুন, সেলিনা খান পন্নী (সেলিনা দোজা)। বেগম তো তিন বছর কলকাতায় চালালাম। তখন আমার সঙ্গে প্রতিভা গাঙ্গুলী ছিলেন। তিনি গুলি খেয়ে মরলেন। প্রতিভা বসু বলে একজন তরুণী ছিলেন। এ ছাড়া আরো হিন্দু মেয়ে যাঁরা আসতেন, তাঁরা লেখা দিতেন। কলকাতা থাকাকালীন আমরা যা যা করেছি, তার একটি হলো প্রীতি সম্মিলনী। বেগম প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে মহিলাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তার মধ্যে অনেক হিন্দু মহিলা এসেছেন, বক্তব্য রেখেছেন। তখন খুব একটা মহিলা সংগঠন মুসলমান মহিলাদের ছিল না। একটা ছিল ‘বঙ্গ মুসলিম মহিলা সমিতি’। সেটায় মাঝেমধ্যে আমরা অংশগ্রহণ করতাম। এবং এর খবর বেগম-এ দিতাম। দেশভাগ হওয়ার পর যেসব ঘটনা এদিকে হতো, সেসব খবর দৈনিক পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করে বেগম-এ দিয়েছি।

বেগম-এর প্রথম পাঁচ মাস আমি ভারপ্রাপ্ত সম্পাদিকা ছিলাম। তারপর দেখা গেল বেগম সুফিয়া কামালের অসুবিধা হয় অফিসে বসতে। কারণ ছেলেমেয়ে, সংসারের দেখাশোনা করার পর (এ ছাড়া তাঁর মা ছিলেন অসুস্থ) খালাম্মার অফিসে এসে বসার বেশি সময় ছিল না। তখন উনি বললেন, ‘এখন নূরজাহানকে সম্পাদিকা করেন, আমি আগে যেমন কাজ করেছি এখনো করব।’ তার পর থেকে আমি এখনো বেগম-এর সম্পাদিকা পদে আছি।

১৯৫০-এ ঢাকায় যখন আসি আমরা তখন বহিরাগত। কারণ আমরা কলকাতা থেকে এসেছি। ঢাকায় যারা অধিবাসী, তারা আমাদের পছন্দ করল না। তারা বলল, কলকাতা থেকে যে মেয়েরা আসছে, ওরা তো খোলামেলা চলবে, ওদের দেখাদেখি আমাদের মেয়েরা বাইরে বেরোতে চাইবে। তারা অনেক মেয়েদের ওপর টর্চার করেছে, নানা রকম জিনিসপত্র দরজার সামনে দিয়েছে। নানারকম উৎপাত করেছে, ইটপাটকেল ফেলেছে। যাতে এখানকার মেয়েরা বার না হয়। এখন ৩৮ নম্বর শরৎ গুপ্ত রোড, যেখানে আমি থাকি, বাবা বললেন, ‘এখানে তোমরা অফিস করো। এখানে কেউ ঢুকতে পারবে না। আমি দেখি, কতটা তোমাদের জন্য করতে পারি।’ ঢাকা আসার পর বেগম উপলক্ষে বাবা একটি সম্মেলন করলেন। সেখানে সুফিয়া কামাল, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, শামসুননাহার মাহমুদ থেকে শুরু করে আরো অনেকে এলেন। আমরা জাঁকজমকের সঙ্গে বেগম-এর কাজ শুরু করলাম। পাটুয়াটুলী ঢুকতে আমাদের আরো দু-তিন বছর লেগেছিল।

লেখিকাদের সান্নিধ্যে

মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা একজন স্বভাব কবি। ওনার মনটা এত উদার! এত সুন্দর মনের মহিলা আমি কম দেখেছি। আমাকে কত উৎসাহ দিয়েছেন। যখন যে লেখা পছন্দ হয়েছে, আমাকে বলেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, যেখানে কোনো লেখিকা পেয়েছেন সঙ্গে করে বেগম অফিসে নিয়ে এসেছেন। অনেক মেয়ের বই বের করার জন্য তিনি প্রকাশকের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন। তারা এখনো তাঁকে স্মরণ করে। মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকার ব্যক্তিগত জীবন ও তেমন কিছু জানি না। তিনি যে স্বামীর ঘর করেননি, কেবল এটুকুই জানি। তিনি খুব স্বাধীনচেতা ছিলেন। কখনো তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে এমন কথা হয়েছে, যেটা উনি সহ্য করতে পারেননি। তিনি স্বাধীনভাবে বেড়াতে চেয়েছেন, এ ক্ষেত্রে হয়তো বাধা এসেছে। সে জন্য উনি আর শ্বশুরবাড়িতে যানওনি। স্বামীর ঘর করেননি। নিজের স্বাধীন চিন্তা নিয়েই জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন।

সৈয়দা মোতাহেরা বানুকে কলকাতায় দেখেছি। যখন আমরা কলকাতা থেকে চলে আসি, আমি খুব কেঁদেছিলাম। কেন যেন আমার খুব কান্না পেয়েছিল। এঁদের সবাইকে ফেলে আমরা চলে যাচ্ছি! মোতাহেরা বানু আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। ‘মা কেঁদো না। দেশ আলাদা হয়ে গেছে। আমরাও চলে যাব।’ অনেক পরে উনি ঢাকা এসেছেন। তখন ওনাকে দেখেছি। তার পর উনি মৃত্যুশয্যায় হাসপাতালে। কী সুন্দর পরিষ্কার কণ্ঠস্বর! আমাকে দেখে বললেন, ‘অঃ তুমি এসেছো। আমি ভালো হয়ে যাব, ভালো হয়ে যাব।’ তারপর তো মারাই গেলেন। সৈয়দা মোতাহেরা বানু কবি ছিলেন। কবিতাই লিখতেন।

ফজিলাতুন নেসা শেষ সময় আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন। এর আগে আমার এক বোনকে ইডেন কলেজে ভর্তি করাতে গিয়ে ওনাকে দেখেছিলাম। আমি গেলাম দেখতে। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছি, মা কেমন আছ। বিলেতে যাওয়ার আগে উনি তো আমাদের কলকাতার বাড়িতে ছিলেন। ফজিলাতুন নেসার মৃত্যুর পর ওনার একমাত্র মেয়ে বাড়িঘর বিক্রি করে লন্ডন চলে গেছে। এখানে থেকে আর কী করবে।

নুরুন্নেসা বিদ্যাবিনোদিনী হাওড়ায় (শ্রীরামপুর) থাকতেন। কলকাতায় আমি তাঁকে দেখিনি। আমি তো শুনেছি, বাবা হাওড়া (শ্রীরামপুর) গিয়ে তাঁর লেখা নিয়ে আসতেন। তিনি পুরোপুরি সংসারী ছিলেন।

কিন্তু অনেক মেয়ের জীবন অনেক বাধা ছিল। যেমন মাজেদা খাতুন, উনি কোনো দিন স্কুলে যাননি। সুফিয়া কামালের মতো একজন বড় লেখিকা। তিনি গল্প লিখতেন। উনি বলতেন, ‘সংসারে কোনো কাজ নেই, আমি লিখতে বসেছি। তখনই ওদিন থেকে গঞ্জনা উঠল, কী ছাইভস্ম লেখে বসে বসে! আর কাজ নেই! মনটা বিষিয়ে উঠত। তারপর যখন লেখাটা শেষ করে রাখতাম, তখন সমস্যা দেখা দিত কাকে দিয়ে পত্রিকা অফিসে লেখাটা পাঠাব।’ ওনাকে অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে। তিনি এখনও বেঁচে আছেন।

আমার কাজ, আমার আদর্শ

আমার বিয়ে হয়েছিল ১৯৫২ সালে, ভাষা আন্দোলনের সময়। সব দিক থেকেই আমি সুখী, আল্লাহর একটি আশীর্বাদ আমার প্রতি। বিয়ের আগেও আমি যেমন বাবার ছায়াতলে ছিলাম, বিয়ের পরও সেই আশ্রয় হারাইনি। আমার স্বামী একজন সাংবাদিক এবং বিয়ের আগে থেকে আমাদের পরিবারের সবকিছু তাঁর জানা ছিল, আমার সম্পর্কে জানা ছিল। এ জন্য এ দিকটাতে কোনোরকম বাধা আজ পর্যন্ত আসেনি। এই যে আমি এখানে বসে আছি, এখান থেকে আমি হয়তো রাত ৭টা-৮টায় বাসায় যাব। তিনি ওই দিকে দুপুরে খেয়ে বিশ্রাম করে আবার বেরিয়ে যাবেন। আমার সঙ্গে হয়তো দেখাও হবে না। কিন্তু এ নিয়ে উনি কোনো কথা বলবেন না। তিনি জানেন, আমি একটি বিরাট দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।

আমি বাবার আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং রোকেয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং সেভাবেই চলছি। আমার মেয়ে দুটি। দুটির মধ্যে ইংলিশে এমএ একটি। অন্যজন সমাজবিজ্ঞানে এমএ। তাদের পড়াশোনা করানোর দায়িত্ব আমি শেষ করেছি। তারা সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে বড় হয়েছে। তাদের বাবা সাংবাদিক, নানা সাংবাদিক। সমাজ সম্পর্কে তাদের মধ্যে প্রাথমিক ধারণার বীজ বপন করেছি। কিন্তু পত্রিকা অফিস করা, নিয়মিত লেখার ব্যাপারে তাদের নিয়ে আসতে পারিনি এ জন্য যে, তারা বলে, ‘তোমরা যেভাবে অফিস করো বা করেছ, এভাবে করতে থাকলে আমাদের জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে। তোমাদের জীবনও ব্যর্থ। কারণ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অফিসে বসে থাকা! আমার জীবন নেই! লাইফ নেই! আমরা এদিক ওদিক যাব না! অনুষ্ঠানে যোগ দিব না! আমি আশা করি, আর এটুকু বয়স হলে ওরা বেরিয়ে আসবে।  তারুণ্যের জোয়ার কমে আসলে, ওরা বেরিয়ে আসবে।’

আমি তো বাবার টাইট প্রোগ্রামের মধ্যে থাকতাম। বাবা আমাকে এদিক-ওদিক কখনও যেতে দিতেন না। আমিও কোনো দিকে কোনো প্রোগ্রাম তাঁর অনুমতি ছাড়া করিনি। আমার স্বামী সিনেমার টিকেট করে নিয়ে এসেছেন, ৬টার শোতে যেতে হবে। বাবা বললেন, টিকেটগুলো ফেলে দাও। আমার সঙ্গে বেগম অফিসে যেতে হবে। আমার স্বামী তখন কিছু বলতেন না। পরে গজর গজর করতেন, ‘এটা একটা কথা হলো!’ এ ধরনের নানা রকমের প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করতে হয়েছে। এখন আনন্দ পাচ্ছি এ জন্য, বাবা মারা যাওয়ার পরও বেগম আমি এই তিন বছর টিকিয়ে রাখতে পেরেছি। ওনার মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল।

 

সূত্র : ‘জানানা মহফিল—বাঙালি মুসলমান লেখিকাদের নির্বাচিত রচনা ১৯০৪-১৯৩৮’, সম্পাদনা শাহীন আখতার ও মৌসুমী ভৌমিক, ইউপিএল, ১৯৯৮