উপন্যাস কিস্তি ১৮

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন

Looks like you've blocked notifications!

কেউ জানে না কোন তুফানে!

মায় তরাতরি পাওয়ে পুবের ঘরের বারিন্দায় আইয়া ওঠোনের আগেই তুফানের ঝাপটা আসা শুরু হইয়া যায়। পরানে মায়ের পানি থাকে না! ইইস্সি রে! খোদা! তুফানের আগে আগে পোলাটারে ঘরে তোলতে পারা গেলো না! দেহো তো! তুফাইন্না বাতাসের কেমুন ছোলা ছাড়ছে! পুবের ঘরের বারিন্দা বলতে মাথার উপরে খালি চালটা; নাইলে তো সকল দিকই খোলা।

মায়ে আইসা পুতেরে ধরার আগেই বনবনাইন্না বাতাসের ঝটকা একটার উপরে আরেকটা আওয়া ধরে। আইয়া ঝাপটার উপরে ঝাপটা দিতে থাকে অসুইখ্যা ছেড়াটারে শইল্লে। শোঁ শোঁ আওয়াজ তুইল্লা গাছের ঠাইল্লারা ধুমাধুম বাড়ি দেওয়া ধরে একেক ঘরের চালে চালে। বাতাসের তোড়ে চোখ আন্ধা হইয়া যায় মায়ের।

দুনিয়ার ধুলামুলা, পাতা-ছাতা কতো কী উড়তাছে তুফাইন্না বাতাসে! দেহো দেহি! এইটা কী হইলো! মায়ে আইয়া তার আঞ্চল দিয়া পুতের মাথাটারে মোছতে থাকে। ধুলাটি তো সরান লাগে মাথার তেনে! ইছ! কী হইতাছে এটি! কিয়ের তেনে না শেষে কী হইয়া যায়!

পুতের মাথাখান আর উদাম বুক পিঠ আলগোচ্ছে একবার ঝাড়ে মায়, একবার আলগোচ্ছে পোছা দেয়। দিতে দিতে তার খেয়াল হয় যে; ইসুফ মিয়ায় কিন্তুক শোওনে নাই, সেয় উইট্টা বসা। আল্লা রছুল! মায়ের অন্তরটা ধক কইরা ওঠে! নিজে নিজে ওঠ-বস করোনের তাকতটা আইতাছে তাইলে পুতের! আলা দিনে দিনে ভালার দিকে যাইবো অর শইল! আল্লা! রহম করো, রহম করো!

ভিতরে ভিতরে আল্লারে জপতে থাকে মায়ের পরান, আর মোখে সেয় কোনোরকমে কয়, ‘বাজান! এট্টু কষ্ট কইরা ওঠ। আয়, মায় তরে ঘরের ভিতরে লইয়া যাই! তুফানের ছোলার ভিতরে পইড়া থাকোনের কাম নাই, বাবা! আহো!’ মায়ে পুতের দিগে হাত বাড়ানি দেয়।

‘এইনেই থাকি মা?’ পোলায় আধামাধা বেঁকা কইরা ঘাড়খান তোলে মায়ের দিগে, ‘ঠান্ডাটায় আরাম লাগতাছে।’

‘থাকবি?’ মায়ে হরদিশা গলায় জিগায়; ‘ভিতরে বাইরে পুরা কাঁচা হইয়া রইছে যে বাবা তর শইল! ঠান্ডা বাতাসের ঝাপোটটা লাগলে আবার কিয়ের তেনে কী অয়! ডরাই বাজান।’

‘থাকি মা।’ পুতে আস্তে-মুস্তে পাটিতে আবার কাৎ হইতে হইতে কয়; ‘আর কী হইবো!’

পুতে কথাখান কয়, না য্যান মায়ের কইলজাটারে ছিদ্রি কইরা দেয়! হেইরপর আর কোনো কথা কওনের থাকে না মায়ের। একটা টু আওয়াজ করার বলও থাকে না হের শইল্লে। না না! দিন-দুনিয়ার আর কোনো বিষয়েই পুতেরে না-কথাখান কওনের আর কোনো হিম্মত মায়ের পরানে নাই! একবার না কইয়া দেখছে তো সেয় ! দেখছে তো সেই না-এর ফলখান কী ফলছে! তার পুতের কপালের এই যে গরদিশ, তার মূলে যে তার মায়ের মোখের সেই না-খানই দায়ী না; সেই কথা কে কইতে পারে!

কেউরে মোখ ফুইট্টা কিছুই কইতে পারে না ইসুফ মিয়ার মায়ে, কিন্তু তার নিজ অন্তর ঘুইস্সা ঘুইস্সা কান্দতাছে নিশিদিন, পুতের বেদনায়। মায় যুদি সেইদিন অমুন কুইদ্দা না ওঠতো, পুতের নাক-মোখ বরাবর অমুন খেঁজি-ভেটকি না দিতো, তাইলে আউজকার এই গরদিশ কী আইতো তার পুতের জিন্দিগিতে! মায়ের অন্তরে বারবার কয় যে, আইতো না।

যেমুন খয়খুশি হালে যাইতাছিল দিন, তেমুনই খয়খুশি হালে যাইতে থাকতো। যুদি সেয় না-কথাখান না কইতো; যুদি অই তেইরা কোরোধ আর আন্ধা চেতের শনি মায়েরে ভর না করতো, তাইলে এমুন গজবের তলে পড়তো না তার পোলার জীবন! কিয়ের মধ্যে কী হইয়া গেলো! তার সোনার চানেরে নিজ হাতে ধইরা এমুন গরদিশের দিকে ঠেইল্লা দিলো সেয়! পেটে না ধরছিলো সেয় অরে! তারে কেমনে নিজ হস্তে দুক্ষের গাতায় ফালাইলো এই মায়ে। সেয় মা, না ডাইন!

পুতের সেবাযতনের কামে যতখোন থাকে, ততখোন এই সেই কথাগিলি মোনে আহে না। কিন্তু যেই হাতখান আজাইর হয়, অমনেই সগল কথা মনে ভাসে; অমনেই মায়ের ভিতরটা কাঁপানি দিয়া ওঠে। দিন-রাইত তলে তলে তার অন্তর-কান্দুনি চলতাছে যে চলতাছেই। কোনো থামাথামি নাই অই কান্দুনির।

এই তো, গেলো মাঘ মাসের ঘটনা এইখান। মাঘ গিয়া ফাল্গুন গেছে, আইছে চৈত মাস; লগে লইয়া আইছে গরদিশরে। অখন নয়া বছরের পইল্লা মাস, এই যে যাইতাছে গা; কিন্তুক পুতের জিন্দিগি আছে সেই গরদিশের তলেই।

মায়ের মনে খোনে খোনে এই চিন্তা ওঠে; না, তার হাত-পাও ঠোঙ্গাইয়া অচল হইয়া যাইতে থাকে। আহ হারে! এই নি অচল হওনের কাল! আগে পুতে সচল-সুস্থিরখান হউক; তখন গুঁজা-ল্যাংড়া যা হওনের হইয়া পড়বো নে এই পিছামারা মায়। অখন এইটা তবদা-খাওনের খোন না। না না!

ইসুফ মিয়ার মায়ে তার পুতেরে তুফাইন্না বাতাসের দমকের মধ্যেই থাকতে দিয়া আবার তরাতরি উঠানে নামে। এইবার ছোটা দেয় সে রান্ধন ঘরের দিগে। মেঘ নামোনের আগে আগে রান্ধন ঘর তেনে পুতের মোখে দেওনের খাওনটারে আনোন তো লাগে! তশতরিতে তরিজুত কইরা ছিইল্লা রাখা আছে আট-দশখান তালের শাঁস। বেইল ফুরানের আগে আগে এইটুক এট্টু পুতের মোখে দেওয়ানের ইচ্ছা আছে মায়ের।

মায় ইসুফ মিয়ারে থুইয়া গিয়া সারেও না, অমনেই ধুমধুমাইয়া মেঘ নাইম্মা যায়। আর আর সোমে, এমুন তুফানের কালে আগে বাতাসের দমক বন্ধ হয়; দুনিয়া কতখোন থোম ধরা থাকে, তারপর মেঘ নামে। আজকা কী কারবার! বাতাসের মতোন বাতাস দমকাইতাছে একদিগে, আরেকদিগে ঝমঝমাইয়া নাইম্মা গেলো গা মেঘ! চোখ বুইজ্জা, কাইত হইয়া পইড়া থাকা ইসুফ মিয়ার নাকে মোখে বিষ্টির ছাঁট আইয়া ঝামটা মারে। মা রে! কী শীতল! তার চোখ আপনে-আপনে খুইল্লা যায়। দেহো, কিমুন ঝুম মেঘ হইতাছে! লগে কেমুন শিল পড়তাছে!

এত্তা এত্তা বড়ো বড়ো শিল! চক্ষের সামনে এই এত্তা বড়ো উঠানখানে ধাপধুপ শিল পইড়া সাদা খলবলা হইয়া ওটতাছে। মাথার উপরের টিনের চালে শিল পইড়া বাড়ি খাইতাছে—টক্কর টক্কর টুস, টক্কর টক্কর টুস। শিল কি উঠানে উঠানে পড়ে, না ইসুফ মিয়ার পরানের ভিতরে পড়তাছে! ওম্মা! ইসুফ মিয়ার কিমুন ধোক্কা লাগতে থাকে! সেয় বেধোন্ধা চক্ষে চাইয়া থাকে।

উঠানে বিছাইয়া থাকা সেই শিলের দিগে চাইয়া থাকতে থাকতে, চালে শিল পড়ার সেই আওয়াজ কানে নিতে নিতে আঁতকা ইসুফ মিয়ার পরান ফোঁপানি দিতে থাকে। সীমাছাড়া ফোঁপানি দিতে থাকে।

কিছুর মধ্যে কিছু না, তার চক্ষে পানি আইতে থাকে। ক্যান! পানি আহে ক্যান! গেলো মাঘ মাসরে মোনে আহে ক্যান তার!

সেই মাঘ মাসে তার এমুন তুফান বেহাল অবস্থা যে, সেইটা কেউরে কইয়া বুঝানের সাধ্যি ইসুফ মিয়ার নাই। আগে অন্য সময়ে যেমুন তেমুন; এই মাঘ মাসে সেয় দেখে যে, তার পরানে কেমুন জানি উথালপাথাল, তুফান তুফান লাগে! লাগে জুলেখার লেইগা। অরে দেখলেই ভিতরে ভিতরে একটা কেমুন জানি ঝটকা বাড়ি খাওয়া ধরে তার! জুলেখারে চক্ষের সামনে যতখোন দেখে, নিজের ভিতরে সেই বাড়ি তার লাগতেই থাকে লাগতেই থাকে! বাড়ি পড়া থামে না!

দেখলে তো এমুন হইতে থাকেই; আবার যখন দূরে থাকতাছে, যখন জুলেখায় চক্ষের অগোচরে, তখনও নিজ পরানের ভাবসাব বেশি সুবিধার বোঝে না ইসুফ মিয়ায়! সেয় এদিগে যতো দূরেই থাকুক; জুলির কথা মোনে আইলো, না পরানের ভিতরে ঘাই কইরা লাফ দিয়া ওঠলো গজার মাছখান। তার বাদে ঘাই খালি পড়তেই থাকে, পড়তেই থাকে। পড়া আর বিরাম দেয় না। এমুন তো আগে কোনোদিন লাগে নাই ইসুফ মিয়ার! সেই মাঘ মাসে দিনরে তার দিন লাগে না, রাইতেরে তার রাইত মোনে অয় না।

খালি মোনে অইতে থাকে যে, যাই জুলিরে দিয়া একনজর দেইক্ষা আহি। তয়, এমুনই কপালের ফের ইসুফ মিয়ার; না দেখলে একদিগে কইলজা জ্বলতে থাকে; ওদিগে দেখলেও লাভ কী! দেখলে কইলজা ঠান্ডা অয় না; তার পরান আরো পোড়তে থাকে! শান্তি পায় না ইসুফ মিয়ায়।

কেমনে কেমনে জানি অই মাঘ মাস তেনে জুলেখারে দেখোনের বাঞ্ছাখান আর যেনতেন ঘটনা থাকে না তার অন্তরে। কেমুন একরকম জ্বালা কেমনে জানি ক্রমে বাইড়া সীমাছাড়া হইয়া যায়! ইসুফে তারে সামলানি দেয় সেই খ্যামতাখানও য্যান তার নাই হইয়া যায়, তার নিজের অজানিতে। অখন ইসুফে কই যায়, কার কাছে কয়, তার অন্তর-বেদনার কথা!

কেমনে দিনে দিনে এই ছেড়ীর লেইগা তার ভিতরে এমুন বেদিশা আগুনজ্বলা ধরলো! দবদবাইয়া যে আগুন জ্বলে, সেই আগুনে তো দবদবাইয়াই নিভভা যায়। শেষ আছে তার। শেষ হয় সে। কিন্তু ইসুফের ভিতরের আগুন নিভে না, শেষ হয় না। ইসুফে দেখে তার ভিতরে আগুন জ্বলে ঠিক; তয় ঘুইস্সা ঘুইস্সা জ্বলে সেই অগ্নি!

তাগো দেশে জারের দিনে আইল্লার ভিতরে তুষে ঢাকা থাকে যে আগুন, নিজের ভিতরে সেয় সেই আগুন জ্বলতে দেখে। ধিকিধিকি জ্বলে আগুন তার শইল্লে, জুলির লেইগা! ধিকিধিকি জ্বলে আগুন সর্বক্ষণ তার অন্তরে, জুলির লেইগা!

এমুন কেমনে অয় সেয় দিশা করতে পারে না। জুলিরে তো সেয় দেখতাছে গুঁড়াগাঁড়া কাল তেনেই। ইসুফের ছয় বচ্ছরের ছোটো এই ছেড়ী। তার চক্ষের সামনে, তার লগে লগেই তো ডাঙ্গর হইছে জুলি। নিজ চক্ষে দেখা যে, এই ছেড়ী হইলো মায়ের কোলে কোলে থাকুনী, আহ্লাদের পুটলী, ঢেপী মাইয়া। গেরামের আর-হগলতের মতোন না এই ছেড়ী। সেয় থাকে মায়ের পাহারায়, ছোটোকাল তেনে। তারে আর আর পোলাপাইনরা নিজেগো লগের একজোন মোনে করার কোনো সুযোগই তো পায় না কোনোদিন।

জুলেখার মায় তার মাইয়ারে কোনোদিগে পাও বাড়াইতে দিলে তো! কোনো পোলাপাইনের লগে বাড়ির নামায় খেলতে যাইতে দিলে তো! জুলেখায় নিজেগো ভিটার সীমানায় খাড়া দিয়া কোনো কোনোসোম গেরামের আর আর পোলাপান গো খেলতে দেখছে চুপচাপ। কিন্তু সেয় আইয়া খেলোনে জোটে নাই। তার মায়ের নিষেধ আছে যে!

কিন্তু ওদিগে দেহো গা, যেই পোলাপাইনই জুলেখা গো বাইত গেছে, হেরে বাতাসা হাতে দিয়া জুলির মায়ে সোনাধন কইরা কইছে; ‘থাকো ধন। আমাগো বাইত থাকো। জুলির লগে খেলো।’ গেরামের ছেড়ীরা গেছে কোনো কোনো সোম; খেলছে। কিন্তু ছেড়া পোলাপাইনে অই বাইত গিয়া করবো কী ! তারা যায় নাই। দুনিয়ায় তাগো খেলোনের বিষয়ের কমতি আছে নি! আর, কেউর ঘরেই তো বাতাসার অভাব নাই। তাগো মায় হাতে ধইরা দিলেও তারা পায়; না দিলেও নিজেরা কারে উইট্টা লইয়া লইতে তাগো আটকায় না। তাইলে অই বাইত গিয়া বাতাসা খাওনের তাগো ঠেকা কী!

এমনে এমনে গেরামের ছেড়া পোলাপাইনরা জুলেখার লগে খেলতে যায়ও নাই, তারে কোনোদিন খেলতে আইতে ডাকেও নাই। তারা করছে কী—যেই জুলেখারে দেখছে, অমনেই সগলে জোক্কার দিয়া ওঠছে একলগে! ‘আহ্লাদী এক ঢেঁপের খই, এত্তা টোমর পাইলি কই! আহ্লাদী এক ঢেঁপের খই। অই জুলেখা ঢেঁপের খই!’

সেই জোক্কার হুইন্না জুলেখায় কানতে কানতে একদিগে লৌড় দিছে অর মারে ডাক দিয়া আনোনের লেইগা। আরেকদিগে পোলাপাইন সগলে হুড়মুড় ছুট দিয়া যে যেদিগে পারছে নাই হইয়া গেছে। জুলেখার মায়ে ধরবো কারে!

(চলবে) 

সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন  (কিস্তি ১৭)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৫)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১৪)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন  (কিস্তি ১৩)​
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১২)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১১)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ১০)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৯)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (কিস্তি ৮)​
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (সপ্তম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (ষষ্ঠ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (পঞ্চম কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (চতুর্থ কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (তৃতীয় কিস্তি)​
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (দ্বিতীয় কিস্তি)
সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন (প্রথম কিস্তি)