সেলিনা হোসেন : শাণিত ও শক্তিশালী গদ্যের নির্মাতা
সেলিনা হোসেন- কথাসাহিত্যিক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক। তাঁর লেখার জগৎ বাংলাদেশের মানুষ, তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। জীবনের গভীর উপলব্ধির প্রকাশকে তিনি শুধু কথাসাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, শাণিত ও শক্তিশালী গদ্যের নির্মাণে প্রবন্ধের আকারেও উপস্থাপন করেছেন। বেশ কয়েকটি উপন্যাসে তিনি বাংলার লোক-পুরাণের উজ্জ্বল চরিত্রসমূহকে নতুনভাবে এনেছেন। তাঁর উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে সমকালের সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংকটের সামগ্রিকতা। বাঙালির অহংকার ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তাঁর লেখায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
সেলিনা হোসেন ভালোবাসেন মানুষের সম্পর্কগুলো নিয়ে লিখতে। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘মানব-মানবীর সম্পর্ক, নারী-পুরুষ তথা মা-মেয়ে, মা-বাবা, বাবা-ছেলে প্রভৃতি সম্পর্কের বিশ্লেষণ এবং অভিজ্ঞতা বিচিত্র প্রভাব রেখেছে আমার লেখাজোকায়, আর এসব সম্পর্ক বিশ্লেষণের মাধ্যমে নতুন নতুন গল্প লিখেছি আমি।’
এ রকমই একটা লেখা ‘টানাপোড়েন’, মানবজীবনের সম্পর্ক জটিলতার গল্প। একসময় গড়ে ওঠা সম্পর্কের সূত্র, আরেক সময় তা ছিঁড়ে যায়। এর অন্তরালে কাজ করে ব্যক্তি মানুষের নিজস্ব ভাবনা। নিজস্ব নিয়মে জীবন পরিচালনার আকাঙ্ক্ষা এবং নিজস্ব ভুবন কাকে নিয়ে তৈরি হবে সেই তাড়না। প্রবল জলোচ্ছ্বাসে একদিন ভেসে যাওয়া সমুদ্র উপকূলবর্তী কতিপয় গ্রামের মানুষ এই উপন্যাসের চরিত্র।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে, এ দেশের লেখালেখির ইতিহাসে নারী লেখকের আগমন খুব বেশি নয়। যে কজন আছে তাদের বিভিন্ন প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হয় শুধু ‘নারী লেখক’ বলেই। যে কারণে যাঁরা আছেন তার সংখ্যাও অত্যন্ত কম। এরই মধ্যে তিনি অনেক আগেই লেখনীর বিষয়বস্তু, বিপুল সৃষ্টি ও শক্তি দিয়েই তাঁর সাহিত্যিক স্থান পাকাপাকি করে নিয়েছেন। তিনি একাধারে কথাসাহিত্যিক, লেখক ও ঔপন্যাসিক।
তাঁর সৃষ্ট অধিকাংশ চরিত্র সংগ্রামী ও সংবেদনশীল। ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও আন্দোলন তাঁর ঔপন্যাসিক সত্তাকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছে। তাঁর উপন্যাসে রয়েছে একদিকে শ্রেণি সংগ্রামের উদ্দীপনা, অপরদিকে শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন। এসবের একটা সূত্র সেলিনা হোসেনের জন্ম ও লেখক হিসেবে বেড়ে ওঠার মধ্যেই পাওয়া যাবে।
১৯৭১ সালে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে তার লেখা উপন্যাস আছে। এসব উপন্যাসে যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মাণ করা হয়েছে ব্যক্তির বেঁচে থাকার সংকট, মূল্যবোধের রূপান্তর, ধর্মীয় বিশ্বাসের অনুষঙ্গে আঘাত, মৃত্যু, স্বজন হারানোর বেদনার ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা মানুষের জীবন।
আজ তিনি ৭০ বছরে পা দিলেন। এই অতিক্রান্ত বছরের মধ্যে প্রায় ৫২ বছর তিনি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত আছেন। এই দীর্ঘ সময় ধরে তার লেখার সংখ্যাও অনেক। বিষয় বৈচিত্র্যেও তা অনন্য। মূলত বাংলা সাহিত্যে এখন অবধি যে কজন লেখক বিপুল ঋদ্ধিতে টিকে আছেন, তাঁদের মধ্যে সেলিনা হোসেন একজন।
সেলিনা হোসেনের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন। বেড়ে ওঠা রাজশাহী শহরে। তাঁর পৈতৃক নিবাস অবশ্য লক্ষ্মীপুর জেলার হাজিরপাড় গ্রামে। বাবা এ কে মোশাররফ হোসেন এবং মা মরিয়মন্নেসা বকুল। সেলিনা হোসেনের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে। তিনি ১৯৬৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সংবাদপত্রে উপসম্পাদকীয়তে নিয়মিত লিখতেন। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘উৎস থেকে নিরন্তর’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। উল্লেখ্যযোগ্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘কাঠকয়লার ছবি’, ‘ঘুমকাতুরে ঈশ্বর’, ‘লারা’, ‘ভূমি ও কুসুম’, ‘যাপিত জীবন’, ‘যমুনা নদীর মুশায়রা’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১৯৮০ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮১ সালে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে কামাল মুশতারি স্মৃতি পুরস্কার, ১৯৯৪ সালে ফিলিপস্ সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৪ সালে অলক্তা সাহিত্য পুরস্কার, ২০১০ সালে রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার লাভ করেন। আজ এই গুণী মানুষটির জন্মদিন, তাঁর প্রতি জন্মদিনের শুভেচ্ছা রইল।