আমি সব সময়ই লিখতে চেয়েছি: সালমান রুশদি
সালমান রুশদির পুরো নাম আহমেদ সালমান রুশদি। জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৯ জুন ভারতের কাশ্মিরের দেভানাগারিতে। ১৯৮১ সালে তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস মিডনাইট’স চিলড্রেন বইয়ের জন্য বুকার পুরস্কার জেতেন। ভারতীয়-ব্রিটিশ নাগরিক রুশদির বেশিরভাগ গল্প ও উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ভারতীয় উপমহাদেশের। ঐতিহাসিক ঘটনাবলী তার লেখার উঠে এসেছে জাদুবাস্তবতাকে আশ্রয় করে। তাঁর চতুর্থ উপন্যাস ‘দ্য সাটানিক ভার্সেস’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে। এই বইটি বেশ আলোচিত ও সমালোচিত হয়। বিশেষ করে বিভিন্ন দেশের মুসলিমরা বইটির নিষিদ্ধের দাবি জানায়। এই বইটির জন্য প্রাণনাশের হুমকিও দেয়া হয় রুশদিকে। ব্রিটিশ সরকার সে সময় রুশদির জন্য আলাদা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। ২০০০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করা শুরু করেন রুশদি। ২০১৩ সালের ২৭ শে মার্চ সালমান রুশদির এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল দ্য টকস ওয়েবসাইটে।
প্রশ্ন : জনাব রুশদি, আপনি কি আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পৃথিবীকে দেখেন?
সালমান রুশদি : এক কথায় বললে, ‘না’ (হাসি)। আমার মনে হয় বিশ্বের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা একজন লেখক হিসেবে এই মুহূর্তে আশাবাদী হওয়াটা কঠিন। যা হোক, অন্ধকার ভালো কৌতুক সৃষ্টি করে।
প্রশ্ন : আপনার লেখার অনুপ্রেরণা কী?
সালমান রুশদি : আমার আর কিছুই করার নেই। আমি সব সময়ই লিখতে চেয়েছি। আরেকটা যে পরিকল্পনা আমার মাথায় ছিল, আমি অভিনেতা হতে চেয়েছিলাম। তবে সেটা কাজ করেনি। আমার ইচ্ছা আছে মিডনাইটস চিলড্রেন-এর ওপর যদি কোনো চলচ্চিত্র হয় তাহলে জ্যোতিষীর (fortuneteller) চরিত্রটায় আমি অভিনয়ে করতে চাই। আমার মনে হয়েছে যেহেতু আমি গল্পের কাঠামোটা সাজিয়েছি তাই এটা নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরি হলে জ্যোতিষীর চরিত্রটাই আমার করা উচিত।
প্রশ্ন : কিন্তু ছবিটা তো বানানো হয়েছে। আপনি কি এতে ছিলেন?
সালমান রুশদি : আমাকে পরিচালক নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে আমি নিজেই সরে যাই। কারণ দর্শকরা যখন পর্দায় আমাকে দেখবে তখন তাদের মনে প্রশ্ন আসবে, এটা সালমান রুশদি না? গল্প থেকে তখন দর্শকদের মনোযোগ সরে যাবে। তাই শেষমেশ আমার দৃশ্যগুলো কেটে ফেলতে বলেছিলাম।
প্রশ্ন : ব্যাপারটা খুব খারাপ।
সালমান রুশদি : তবে আমার আফসোস হচ্ছে আরেক জায়গায়। উইল ফেরেল কোম্পানির কাছ থেকে তাদের ‘তাল্লাদেগা নাইটস’ (Talladega Nights) মঞ্চনাটকে অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়েও করিনি।
প্রশ্ন : কোন চরিত্রে অভিনয়ের জন্য আপনাকে বলা হয়েছিল?
সালমান রুশদি : এটা তখন শুধুমাত্র একটা আইডিয়া ছিল। মাত্র একটা দৃশ্য যেখানে তিনজন ড্রাইভারের চরিত্রে তিনজন মানুষকে দেখানো হবে যারা সাধারণত অভিনয় করে না। এই তিন ড্রাইভারের চরিত্রে ঠিক করা হয়েছিল জুলিয়ান স্ন্যাবেল, লু রিড ও আমাকে। ইউনিফর্ম ও হেলমেট পরে আমাদের মঞ্চে উঠে ধীরগতিতে হেঁটে মঞ্চ পেরিয়ে যেতে হবে। হলে সেটা ভালোই হতো কিন্তু তখন আমরা কেউ সময় দিতে পারিনি। আমি একটা বই লেখার কাজে ব্যস্ত ছিলাম, লউ ব্যস্ত ছিল মিউজিক ট্যুর নিয়ে আর জুলিয়ানও কী কাজে যেন ব্যস্ত ছিল। তাই আর আইডিয়াটা বাস্তব রূপ পায়নি।
প্রশ্ন : সম্প্রতি আপনি আপনার পলাতক জীবনের ঘটনা নিয়ে একটি আত্মজীবনী প্রকাশ করেছেন। ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর আয়াতুল্লাহ খোমেনি আপনাকে হত্যার ফতোয়া জারি করেছিলেন। এত বছর পর এই হুমকি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার পর নিশ্চয়ই ভালো লাগছে?
সালমান রুশদি : হ্যাঁ। আমি দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেছি এই ঘটনাগুলো বলার জন্য। কারণ আমি জীবনের এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে ঘটনাগুলো লিখতে চেয়েছিলাম, যখন সব জাগতিক চিন্তা আমার মধ্যে আর কাজ করবে না এবং আমি নিরপেক্ষভাবে লিখতে পারব। আমি আবেগতাড়িত হয়ে কিছু লিখতে চাইনি। আমি চাইনি এটাকে অপেরার কোনো টিভি শোর একটি পর্বের মতো করে শেষ করতে। তাই এটা লেখার জন্য আমি দীর্ঘ ২৩ বছর অপেক্ষা করেছি। শুধু সেই ফতোয়াবন্দি দিনগুলোর কথাই নয় এখানে আমার জীবনের শুরুর দিককার কথাও রয়েছে। আগে আমি কখনো আত্মজীবনী লেখার কথা ভাবিনি।
প্রশ্ন : কেন লিখতে চাননি?
সালমান রুশদি : আগে যখন কেউ আমাকে এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করত, আমি বলতাম, আমার আগ্রহ নেই। কেন আমি আত্মজীবনী লিখব? নিজের ব্যাপারে লেখার কোনো আগ্রহ আমার নেই। আমি লেখক হয়েছি অন্যদের নিয়ে লেখার জন্য।
প্রশ্ন : আপনার মধ্যে কি কখনো নস্টালজিয়া ভর করে না?
সালমান রুশদি : না। দুর্ভাগ্যবশত আমি একটি কৌতূহলোদ্দীপক জীবনের অভিশাপ অর্জন করেছি।
প্রশ্ন : আপনার জীবনের ওপর যদি হুমকি না থাকত তাহলে কি আজকে আপনি অন্যরকম একজন লেখক হতেন?
সালমান রুশদি : না। আমার জীবন সম্পর্কে যদি আপনার কোনো ধারণা না থাকে, আমার জীবনের কোনো ঘটনা যদি আপনি না জেনেই আমার বইগুলো পড়েন, তাহলে দেখবেন ১৯৮৯ সালে আমি যে বইটি লিখেছি সেখানে অন্যরকম কিছু নেই। আমার মনে হয় না, আমার এই সময়ের লেখায় কোনো বৃহদাকার বিচ্ছেদের ছায়া পাবেন। আমার মনে হয়, বইগুলোর নিজস্ব একটা যাত্রা আছে এবং নিজেদের মতো করেই তারা সেটার ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।
প্রশ্ন : আপনি কি জীবনটাকে পেছন ফিরে দেখার তাড়না বোধ করেন?
সালমান রুশদি : না, সে রকম কিছু নেই। এখন আর আমাকে কোনো কিছু নিয়ে সতর্ক থাকতে হয় না। ১৫ বছর হয়ে গেছে, এটা দীর্ঘ সময়। গত ১০ বছর ধরে আমি নিউইয়র্ক ও লন্ডনে বাস করছি এবং আমি পুরোপুরি সহজবোধ্য একটি জীবন যাপন করছি।
প্রশ্ন : আমি শুনেছি ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ চলচ্চিত্রটি তৈরির সময় বেশ কয়েকবার এর নাম ও শুটিং লোকেশন পরিবর্তন করা হয়েছিল। এটা কি মুসলিম মৌলবাদীদের ভয়ে?
সালমান রুশদি : না। যেটা হয়েছিল, ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ছবিটির দৃশ্যধারণ করা হয়। গণমাধ্যম যখন কোনো চলচ্চিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয় তখন তারা সারাক্ষণ সেটার পেছনে লেগে থাকতে পছন্দ করে। নিরিবিলিতে কাজ করাটা তখন কঠিন হয়ে যায়। তাই ছদ্মনামে ছবিটা শুটিং করা হয়েছিল, যাতে ব্যাপারটা কারো নজরে না আসে। সাংবাদিকদের জানিয়ে এ ধরনের ছবির কাজ করাটা খুব মুশকিল। তারা বারবার সেটে আসতে চাইবে, কথা বলতে চাইবে, সাক্ষাৎকার ছাপাতে চাইবে।
প্রশ্ন : আপনি কি ভারতে বেশ বিখ্যাত?
সালমান রুশদি : (মৃদু হাসি) হ্যাঁ, অল্পস্বল্প। তবে ম্যাডোনা বা ইউটু ব্যান্ডের মতো বিখ্যাত না। আমি বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে পারব। যদিও বেশির ভাগ লেখকদের জীবনই খুব ব্যক্তিগতভাবে কাটে কারণ নিজের কাজটা ঠিকভাবে করার জন্য তাঁদের নিমগ্নতার প্রয়োজন হয়।