মুক্তগদ্য

বাঙালির বৈশাখী খাবার

Looks like you've blocked notifications!

মানকচু ভাজা আর অম্বল চালিতার।

মাছের সরুয়া রান্ধে জিরা সম্বার।।

কাইট্টা লইছে কই মাছ চরচরি খারা।

ভালা কইরে রান্ধে বেনুন দিয়া কাল্যাজিরা।।

একে একে রান্ধে সব বেনুন ছত্রিশ জাতি।

শুকনা মাছ পুইড়া রান্ধে আগল বেসাতি।।

বাঙালি যে ভোজনরসিক, তার পরিচয় বহন করছে মৈমনসিংহ গীতিকার মলুয়া আখ্যানের এই কাহিনীকাব্যটি। শুধু কি কাব্যে, বাঙালির জনজীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে এ ভূখণ্ডে উৎপাদিত ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন রকম সুস্বাদু খাবারের তালিকা। ভাত, মাছ, শাকসবজি, ফলফলাদি, দুধ, ঝাল, টক, তিতা, মিষ্টান্ন—সব ধরনের খাবারে বাঙালির অরুচি নেই। আর যখন বারো মাসে তেরো পার্বণের দেশে ক্ষণে ক্ষণে লাগে উৎসবের আবেগ, তখন তো কথাই নেই। অপরিহার্যভাবে নির্দিষ্ট কিছু খাবার এর সঙ্গী হয়। যেমন হয় ধর্ম-বিত্ত নির্বিশেষে সব বাঙালির মিলনক্ষণ পয়লা বৈশাখ, তথা বাংলাবর্ষের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখে। শুধু পয়লা বৈশাখের দিনই নয়, এ উৎসবকে দীর্ঘায়িত করতে কোনো কোনো সময় তা এক মাস পর্যন্ত টেনে নেওয়া হয়। আবার বাংলা সনের শেষতম মাস চৈত্রের শেষ দিন, অর্থাৎ চৈত্রসংক্রান্তিকে বরণ করে নেওয়ার জন্য মহাধুমধাম করে উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। অনেক জায়গায় চৈত্র মাসজুড়ে। এই চৈত্রসংক্রান্তির উৎসবের আনন্দ আরো দীর্ঘায়িত করে বৈশাখী উৎসব। তাই চৈত্র-বৈশাখকে উপজীব্য করে বাঙালির রসনাকে আরো বেশি চারিয়ে দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কিছু খাবারকে এ উৎসবের শরিক হতে হয়। বিশেষ করে, বৈশাখের নতুন দিনগুলোতে ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবারের সঙ্গে সঙ্গে বিচিত্র সব খাবারে বাঙালির রসনাবিলাস পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।

প্রথমেই ভাতে-মাছে বাঙালির প্রধানতম খাবার ভাতের কথায় আসা যাক। “চৈত্র মাসের শেষ দিনের (অর্থাৎ চৈত্রসংক্রান্তির শেষ দিন গত রাত্রে) সন্ধ্যায় গৃহিণীরা এক হাঁড়ি পানিতে স্বল্প পরিমাণ অপক্ব (আম) চাউল ছেড়ে দিয়ে সারাটি রাত ভিজতে দেন এবং তার মধ্যে একটা কচি আমের ডাল বসিয়ে রাখেন। ‘পয়লা বৈশাখের’ ভোরবেলায় সূর্যোদয়ের পূর্বে ঘুম থেকে উঠে তাঁরা ভেজা চাল গৃহের সবাইকে খেতে দেন। ঘরের সবাই মিলে অথবা একে একে তা খেতে থাকে; আর হাঁড়িতে ডোবা আমের শাখা দিয়ে গৃহিণীরা সকলের গায়ে পানি ছিটাতে থাকেন। তাঁদের ধারণা, এতে করে গৃহে নতুন বছরের শান্তি নেমে আসবে।” বর্ণনাটি মুহম্মদ এনামুল হকের বাংলা নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ নামক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত। বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন পয়লা বৈশাখের দিন অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানের নাম আমানি। বেশি দিন আগের কথা নয়, পাকিস্তান আমলেও অতি ধার্মিক মুসলমানের ঘরেও এই অনুষ্ঠান পালনের রেওয়াজ ছিল। এখনো তা বাংলার ঘরে ঘরে পালিত হয়ে থাকবে। বৈশাখের দগ্ধ দিনে এক থালা পান্তা খেয়ে মাঠে লাঙল দিতে যেতেন বাংলার চাষিরা। বেশ কয়েকটি জেলায় এ রীতির প্রচলন ছিল। বর্তমানকালে নাগরিক ঢঙে আমরা যে পান্তাভাত-ইলিশ খাই, তা এ-রীতিকে অনুসরণ করেই হয়তো প্রচলন হয়েছিল।

চট্টগ্রামে এখনো বৈশাখ মাসের সকালবেলায় এক মুঠো চাল ও নলবিশিষ্ট মাটির পানপাত্র ‘কত্তি’তে পানি খেয়ে অনেক চাষি মাঠ চাষ করতে যান। তাঁরা মনে করেন, এতে করে সারা শরীর সারা বেলা শীতল থাকে। আদিম রীতির পরিচায়ক এ অনুষ্ঠানটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষ পাক করতে ও তাকে সঞ্চয় করে রেখে বাসি করে খেতে শিখেছে। কৃষকের পান্তাভাত খাওয়ার পেছনে সারা বছর ভালো ভালো খাবার-দাবার খাওয়ার কামনাটাই প্রকাশ পেয়েছে। অবশ্য পয়লা বৈশাখের সারাটি দিন ধরে যে শুধু পান্তা খেয়ে কৃষক পেট পুরে তাও নয়, বছরের শুরুর এই দিনে সবাই চায়, প্রতিটি বেলায় ভালো ভালো খাবার খেতে। এতে করে সারা বছর ভালো ভালো খাবার খেয়ে জীবন ধারণ করা যাবে বলে তাদের বিশ্বাস।

মাছ নিয়ে বাঙালির উৎসাহ কম থাকে না পয়লা বৈশাখের দিনে। কুমিল্লায় গড়ে উঠেছে বড় বড় মাছ খাওয়ার ঐতিহ্য। ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ প্রবাদ থেকে এই ধারার প্রচলন হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। সুতরাং সারা বছরই যাতে মাছ খাওয়া যায়, তাই বছরের শুরুর দিনক্ষণ পয়লা বৈশাখ থেকে এ ধারা বজায় রাখা চাই। প্রায় প্রত্যেক পরিবারে পয়লা বৈশাখে মাছ রান্না করা হবে, এ ঐতিহ্য কুমিল্লায় দীর্ঘদিন ধরে পালন করে আসছে স্থানীয় বাসিন্দারা। তাই বিশাল বিশাল মাছের সমারোহে মেলার প্রচলনও রয়েছে এ অঞ্চলে। এ মেলায় কে কার আগে বেশি দাম দিয়ে বড়সড় মাছ কিনবে, সে প্রতিযোগিতার হিড়িক পড়ে যায়।

নববর্ষের প্রথম দিন এখানকার কোনো কোনো বাড়িতে বড় বড় মাছের মুদ্রার আকারের আঁশ ঘরের চালে শুকাতে দেওয়া হয়। লোকবিশ্বাস, হয়তো টাকা আসবে বছরজুড়ে। কোনো কোনো বাড়ির ছেলেমেয়েরা বাদির গোটা নামের এক ধরনের গাছের গোটা খেয়ে গোসল করত। তাদের বিশ্বাস, এতে করে শরীর সুস্থ থাকে, সারা বছর কোনো রোগে আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ থাকে না।  

পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে বিভিন্ন প্রকার খাওয়া-দাওয়া ও এ-সম্পর্কিত রীতিনীতি সম্পর্কে প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক আহমদ ছফা এক জায়গায় লিখেছেন, ৩১ চৈত্র, যেদিন বছরের শেষ, রাতে খাওয়ার সময় সকলে সামান্য পরিমাণে হলেও তিতা খাবার খেয়ে থাকেন। এই তিতা খাবারের মধ্যে একটা প্রতীকী ব্যাপার রয়েছে। যে বছরটি পার হয়ে এলাম, সে বছরের ব্যথা-বেদনা-দুঃখ-শোক সবকিছুই বিসর্জন দিয়ে নতুন একটা বছরে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে যাচ্ছি। তিতা খাওয়া হচ্ছে সে দুঃখ-বেদনা ধুয়ে ফেলার প্রতীক। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি, ৩১ চৈত্র পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরা হতো এবং পয়লা বৈশাখে খাওয়ার জন্য মাছ রান্না করে রাখা হতো।

পয়লা বৈশাখে হিন্দু সম্প্রদায় চালের নাড়ু তৈরি করে রাখে এবং তা পয়লা জ্যৈষ্ঠে খায়। এ-সম্পর্কিত একটি প্রবাদও রয়েছে—বৈশাখে রাখে, জ্যৈষ্ঠে খায়/যত পায়, তত চায়।

শুধু নাড়ু নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু পরিবারগুলোতে তৈরি হতো মোয়া, মুড়ি-মুড়কি ইত্যাদি। চিত্রিত বা শখের হাঁড়িতে করে যেসব মুসলিম পরিবারের সঙ্গে তাদের সখ্য ছিল, তাদের বাড়িতে পাঠানো হতো পয়লা বৈশাখের শুভেচ্ছাস্বরূপ। আর মুসলিম পরিবারগুলোতে পিঠা-পুলি।

বৈশাখী খাবারের মধ্যে আরেকটি জনপ্রিয় নাম কচিকাঁচা আম। মাঘের শেষের দিকটায় মধুভরা বোলে ভরে যায় বাংলার আমগাছগুলো। আর সেগুলোতে ফল আসে বৈশাখের নব আনন্দের দিনে। নববর্ষের শুরুটা তাই কাঁচা আমের ভর্তা আর তার টক অথচ সুস্বাদু রসে মাতোয়ারা হয় এখানকার ছেলেমেয়ের দল।

পয়লা বৈশাখ মানেই মেলার ম্যালা আনন্দ ছোট ছোট ছেলেমেয়ের কাছে। এই মেলাগুলোতে পাওয়া যায় বিচিত্র ধরনের ভাজাপোড়া জাতীয় খাবার। লেখক অজিতকুমার গুহের বর্ণনায় নববর্ষকে উপলক্ষ করে বিভিন্ন খাবার-দাবার তৈরির চমৎকার বর্ণনা রয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, “ছোটবেলার আর একটা কথা মনে পড়ে। চৈত্রের সংক্রান্তি আসার কয়েক দিন আগে থেকেই আমাদের ঢেঁকিঘরটা মুখর হয়ে উঠতো। নববর্ষের প্রথম দিন ছেলেমেয়েদের হাতে নাড়ু, মোয়া, ছানার মুড়কি ও সরভাজা দিতে হবে; তারই আয়োজন চলতে থাকতো।...মেলায় আর এক দিকে ডালা, কুলো, বেতের ও বাঁশের তৈরি নানা রকম সাজি, মাছধরার চাঁই, হাল ইত্যাদিও আছে। ঐ দোকানগুলো পেরিয়ে একটু ডান দিকে গেলেই দেখা যেতো নানারূপ ফল ও তেলে ভাজার দোকান। বিন্নিধানের খৈ পাওয়া যেত এই মেলায়। আমার ঠাকুমা চাকরদের নিয়ে মেলায় যেতেন। মাঠের ধারে একটি ঘর থেকে তিনি মেলা দেখতেন। তারপর চাকরদের দিয়ে চিত্রিত করা হাঁড়িতে বিন্নিধানের খৈ, গুড়ের বাতাসা ও জিলিপি কিনে আনতেন। বাড়িতে এসে সকলের হাতে মুঠো করে বিন্নিধানের খৈ, গুড়ের বাতাসা আর জিলিপি দিতেন। আমাদের তা দিয়ে মহা আনন্দ উৎসব সমাপ্ত হত।” শুধু নাড়ু-মোয়া  নয়, সে সময়কার বৈশাখী মেলায় পাওয়া যেত ঝুড়ি, তিলের নাড়ু, চিনার নাড়ু, ঢ্যাপের নাড়ু, নারকেলের নাড়ু, চিড়ার নাড়ু, মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা, কদমা-খাগড়াই, হাওয়াই মিঠাই, রসগোল্লাসহ মজার মজার দারুণ সব ছেলেভোলানো খাবার। ছাঁচে তৈরি মিষ্টান্নের মধ্যে ছিল গজা, হাতি, ঘোড়া, হরিণ, পাখি, আম, কাঁঠাল, প্রার্থনালয় বা বসতবাড়ির আকৃতি, সন্দেশ চমচম। আর ছিল তেঁতুল, আম আর কুল-বরইয়ে তৈরি মজাদার সব আচার। এখনো বৈশাখী মেলায় হরহামেশা এগুলো দেখতে পাওয়া যায়।

‘পুণ্য কাজ অনুষ্ঠানের পক্ষে জ্যোতিষশাস্ত্রানুমোদিত প্রমস্ত দিন’ পুণ্যাহের কথাও আমরা ভুলিনি। যদিও নববর্ষের প্রথম ক্ষণের এ-অনুষ্ঠানটি এখন পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে জমিদারিপ্রথা বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে। পুণ্যাহ জমিদার কর্তৃক প্রজাদের কাছ থেকে নতুন বছরের খাজনা আদায় করার প্রারম্ভিক অনুষ্ঠানসূচক দিন। জমিদার বা সামন্তদের কাছে খাজনা আদায়ের দিনটি ছিল পুণ্য কাজের শামিল। এই সেদিন, ১৯২০ সাল পর্যন্ত জমিদার ও বড় বড় তালুকদারের কাছারিতে এটি অনুষ্ঠিত হতো। সর্বজনীন এ উৎসবের দিন প্রজারা ভালো ভালো জামাকাপড় পরে তালুকদার-জমিদারের বাড়িতে বাড়িতে খাজনা দিতে যেত। যদিও অনুষ্ঠানটি মূলত পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে হতো, মাসব্যাপীও এটি চলত ঘটা করে, উৎসবমুখর পরিবেশে। নতুন বছরের কিংবা পুরাতনী বছরের বকেয়া খাজনা আদায়ের উদ্দেশ্যে আগত চাষিরা সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে জমিদারদের দেওয়া পান-সুপারি খেতেন। অনেক সময় মিষ্টিও বিতরণ করা হতো দরিদ্র প্রজাসাধারণের মধ্যে।

হালখাতার কথা বলতেই হয়। এটি ব্যবসায়ীদের বকেয়া আদায়ের পক্ষে ‘পুণ্যের দিন’। পয়লা বৈশাখের দিন ব্যবসায়ীরা যার যার মতো করে লাল সালুতে মোড়া নতুন হিসাবের খাতা খোলেন। মুহম্মদ এনামুল হকের এক লেখায় বর্ণিত রয়েছে, “এতে (হালখাতা) তাঁদের কাজ-কারবারের লেনদেন, বাকী-বকেয়া, উসুল-আদায় সবকিছুর হিসাব-নিকাশ লিখে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। নানা কাজ-কারবারে তাঁদের সাথে যাঁরা সারা বছর জড়িত থাকেন, অর্থাৎ যাঁরা তাঁদের নিয়মিত গ্রাহক, পৃষ্ঠপোষক ও শুভার্থী, তাঁদেরকে পত্রযোগে অথবা লোক মারফত দাওত দিয়ে দোকোনে একত্র ক’রে সাধ্যমতো জলযোগে আপ্যায়িত করা হয়।” সাধারণত মিষ্টি দিয়েই এ জলযোগের কাজটি চালিয়ে নেন ব্যবসায়ীরা।

আমাদের দেশের বিভিন্ন আদি জনগোষ্ঠীর লোকেরাও পয়লা বৈশাখ ঘটা করে উদযাপন করে আসছেন নিয়মিতভাবে। বিশেষ করে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার বিভিন্ন সম্প্রদায় যে উৎসব পালন করে থাকে, সেটি উল্লেখযোগ্য। বৈসুক, সাংগ্রাই আর বিঝু বা বিষু—এই তিন উৎসবের প্রথম অক্ষর নিয়ে হয় বৈসাবি। বৈসুক উৎসব পালন করে ত্রিপুরা সম্প্রদায়, সাংগ্রাই মারমারা আর চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায় পালন করে বিঝু বা বিষু উৎসব। বছরের শেষের দুদিন আর নববর্ষের প্রথম দিন বৈসুক উৎসব পালন করে ত্রিপুরা সম্প্রদায়। এ দিনগুলোতে তাদের বাড়িতে বাড়িতে তৈরি হয় পাঁচান পিঠা, মিষ্টান্নসহ নানা রকম মুখরোচক খাবার। বছরের শেষের দিন ‘বিসুমা’তে সম্প্রদায়ের লোকজনের মদ্যপান করাতে কোনোরকম নিষেধ থাকে না। চাকমাদের বিঝু উৎসবও তিনদিনের। ৩০ চৈত্র ফুল-বিঝু, ৩১ চৈত্রের পালিত হয় মূল বিঝু। বছরের শেষের দিনটিতে কমপক্ষে পাঁচ রকমের তরকারি ছাড়াও নাড়ু, বিনি ভাত, সেমাই, শরবত, মিষ্টান্ন ও পাঁচ রকম সবজি দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের খাবার। সকাল থেকেই এই খাবার খাওয়ার ধুম লেগে যায়। কেউ কাউকে দাওয়াত করা ছাড়াই একে অপরের বাড়িতে ভূরিভোজে অংশগ্রহণ করে তারা। আর বছরের শুরুর দিন, যাকে তারা বলে ‘গচ্ছে পচ্ছে’ বা গোর্য্যা পোর্য্যা দিন, অর্থাৎ বছর গড়িয়ে পড়ার দিন। এদিন নিকটাত্মীয়দের দাওয়াত দিয়ে ভাত-মাছ-মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের হাজং সম্প্রদায়ের লোকেরা বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের অনুষ্ঠানকে বলে হঙ্গরানী। উৎসবটি দুই-তিনদিন ধরে চলে। এ উৎসবের সময় বাড়িতে বাড়িতে পিঠা-পায়েস রান্না হয়। আর রান্না হয় ১০৭ ধরনের শাকসবজি দিয়ে এক বিশেষ ধরনের তরকারি। এ তরকারিকে মহৌষধি মনে করে হাজংরা। তারা বিশ্বাস করে, রান্না করা এ তরকারি খেলে অনাগত বছরে কোনোরকম রোগব্যাধি তাদের আক্রমণ করবে না।

মোগলসম্রাট আকবর প্রবর্তিত বাংলা সন শুধু সেকালের সুবা বাংলায় নয়, ভারতবর্ষজুড়ে মোগলশাসিত এলাকায় তা চালু হয়েছিল এবং সেসব স্থানে তখন থেকে বাংলা সন অনুযায়ী বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালিত হতে শুরু করে। বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ তো অবশ্যই, সে সঙ্গে আসাম, উড়িষ্যা, কেরালা, কর্ণাটকসহ বিভিন্ন স্থানের বাংলা সন অনুযায়ী বর্ষগণনা ও একে কেন্দ্র করে বিভিন্ন উৎসব পালনের ঐতিহ্য রয়েছে। বর্তমান ভারতে তো রয়েছেই, সে সঙ্গে এর উত্তরে নেপাল ও দক্ষিণে শ্রীলঙ্কাতেও ঘটা করে বাংলা সনকেন্দ্রিক নববর্ষ পালনের ঐতিহ্য রয়েছে। এ তো গেল ভারতীয় উপমহাদেশের কথা। এ ভূখণ্ডের সীমানা ছাড়িয়ে এর দক্ষিণ-পূর্ব দিকের মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া আর থাইল্যান্ডেও ঘটা করে নববর্ষ পালন করা হয়। এসব ভাতপ্রধান দেশ বা অঞ্চলে নববর্ষের দিনকে উপলক্ষ করে তৈরি হয় বিভিন্ন রকম মুখরোচক খাবার।

বলে রাখা ভালো, বাংলা নববর্ষের এসব খাবারের অনেকগুলো কিন্তু মোগলরা আসার আগেই আমাদের দেশে প্রচলিত ছিল। বাংলা সনের যাত্রা যেহেতু শুরু হয়েছিল একটি ফসলি সন হিসেবে, অর্থাৎ কৃষকের ফসল ফলানোর ধারা অনুযায়ী, সেহেতু বছরের প্রথম মাস বৈশাখে এসে সে সময়ের অনেক খাবারই বৈশাখী খাবার হিসেবে বাঙালির কাছে পরিগণিত হয়েছিল। যা হোক, আজ বাঙালির সেই সুদিনগুলোর দিকে তাকিয়ে আমাদের জাতীয় উৎসবগুলোকে রাঙাতে চাই আমরা। এতকাল ধরে বাংলার সজীব শরীর থেকে খেয়ে-পরে সতেজ-সবল হয়েছি, আরো অনেক কাল টিকে থাকতে পারব বিশ্বাস করি। এ প্রসঙ্গে সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হকের এক লেখার বিশেষ একটি অংশের উল্লেখ করতে হয়। তিনি লিখেছেন, “বৈশাখ—এই মাস আউশ ধানের মাস, বোরো ধানের মাস, বোনা আমন ধানের মাস, তোষা পাটের মাস, এর কোনোটা বোনা, কোনোটা কাটা, কোনোটা নিড়ানি দেবার মাস। বাংলার কৈ, শিং, মাগুর, শোল, রুই মাছের ডিম দেবার মাস। বৈশাখ মাস বাংলাদেশের প্রধান উৎপাদন কর্মকাণ্ডের সম্ভাবনাময় সূচনার মাস, তাই এ মাস বছরের প্রথম মাস, চৈত্রের পাতা ঝরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে জীবন থেকে দুঃখ, মন থেকে দৈন্য ঘুচে যাবার মাস...।” গোয়ালঘর-ভরা গরু, গোলাভরা ধান আর বিচিত্র সাংস্কৃতিক উপাদানে সমৃদ্ধ মাছে-ভাতে বাঙালির জীবন এখন খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। তাই সব দৈন্য-দুঃখ-দুর্দশা আর জরাজীর্ণতাকে ম্লান করে দিয়ে বৈশাখ তথা নববর্ষ আসুক বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে তিনবেলা খাবারের নিশ্চয়তা নিয়ে। জয় হোক নতুন বছরের। শুভ নববর্ষ।