স্মরণ
কালজয়ী কবিতার রচয়িতা কবি বন্দে আলী মিয়া
‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর,
থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।
পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই,
এক সাথে খেলি আর পাঠশালায় যাই।’
অথবা
‘বর্ষার জল সরিয়া গিয়াছে জাগিয়া উঠিয়াছে চর
গাঙ শালিকের গর্ত খুঁড়িয়া বাঁধিতেছে সবে ঘর।’
অথবা
ময়নামতির চরের মতো ও বিখ্যাত কালজয়ী কবিতার রচয়িতা কবি বন্দে আলী মিয়ার আজ ২৭ জুন ৩৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৯ সালের ২৭ জুন রাজশাহীর কাজীহাটের বাসভবনে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরে পাবনার রাধানগরের ‘কবিকুঞ্জ’তে তাঁকে সমাহিত করা হয়। ১৯০৯ সালের ১৭ জানুয়ারি পাবনার শহরের রাধানগরের নারায়ণপুর মহল্লায় জন্ম গ্রহণ করেন কবি বন্দে আলী মিয়া। তাঁর বাবার নাম মুন্সী উমেদ আলী মিয়া এবং মাতা নেকজান নেসা। কবির শৈশব ও কৈশোর কেটেছে পাবনার গ্রামীণ ও নাগরিক পরিমন্ডলে। মাত্র পাঁচ-ছয় বছর বয়সে তাঁকে রাধানগর মজুমদার একাডেমিতে (বর্তমানে আরএম একাডেমি) তাঁকে ভর্তি করা হয়।
১৯২৩ সালে সেখান থেকেই ম্যাট্রিক পাস করেন এবং চিত্রবিদ্যায় ডিপ্লোমার জন্য কলকাতার ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমিতে ভর্তি হন। পরে ১৯২৬ সালে তাঁর বাবার ইচ্ছানুসারে শহরের জেলাপাড়া মহল্লার রাবেয়া খাতুনের সাথে তাঁর প্রথম বিয়ে হয়। পরবর্তী সময়ে তিনি আরো তিনটি বিয়ে করেন। ওই তিন স্ত্রীর নাম হেনা, শামসুন্নাহার ও পরীবানু। তিনি ১৯২৭ সালে কৃতিত্বের সাথে চিত্র বিদ্যায় ডিপ্লোমা কোর্স শেষ করেন এবং একই বছর কলকাতার আশুতোষ লাইব্রেরি কর্তৃক শিশুতোষ বই ‘চোরজামাই’ প্রকাশ করেন। পরে তিনি প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহীম খাঁর অনুপ্রেরণায় করটিয়া সাদত কলেজে ভর্তি হয়ে কিছু কাল এফএ পড়েন।
১৯২৯ সালে অধ্যাপক মুহাম্মদ মনসুরউদ্দীন থাকতেন কলকাতার বালিগঞ্জের মে-ফেরারি রোডে। বাড়িওয়ালা ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবি বন্দে আলী মিয়া অধ্যাপক মনসুরউদ্দীদের সাথে দেখা করতে গেলে তিনি, সুরেনবাবু ও তাঁর বিদ্যুষী স্ত্রী প্রজ্ঞা দেবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য কবিকে সেখানে নিয়ে যান। তাঁদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে আলাপ পরিচয় এমনকি স্বরচিত বইপত্রেরও আদান-প্রদান হয়। সে সময়ে কলকাতা করপোরেশন স্কুলসমূহের অধিকর্তা ছিলেন ক্ষিতীশ চট্টোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন এই দম্পতির জামাতা।
একদিন প্রজ্ঞা দেবী জামাতার কাছে কবি বন্দে আলী মিয়ার চাকরির জন্য সুপারিশ করেন। তিনি করপোরেশনের এক স্কুলে কবির চাকরির ব্যবস্থা করেন। প্রায় ১৬ বছর কবি করপোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা করেন।
কলকাতায় থাকার সুবাদে সমকালীন পত্রপত্রিকার সাথে কবি বন্দে আলী মিয়ার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর কিছুদিন পর কবি ‘ইসলাম দর্শন’ -এর সাথে জড়িয়ে যান। করপোরেশন স্কুলে শিক্ষক থাকাকালে তিনি ‘কিশোর পরাগ’, ‘শিশু বার্ষিকী’, ‘জ্ঞানের আলো’ প্রভৃতি মাসিক পত্রিকার সম্পাদনার কাজেও জড়িত ছিলেন।
১৯৩২ সালে কবি বন্দে আলী মিয়ার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘ময়নামতীর চর’ প্রকাশিত হয়। বইটি প্রকাশ করে কলকাতার ডি এম লাইব্রেরি। কবির এই ‘ময়নামতীর চর’ কাব্যগ্রন্থ পড়ে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রশংসাপত্র পাঠান। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর কবি ঢাকায় সাহিত্য লিখে এবং ছবি এঁকে জীবিকা নির্বাহ করতে শুরু করেন। কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৬২ সালে শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। পরে ১৯৬৫ রাজশাহী বেতারকেন্দ্রে স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে চাকরি গ্রহণ করেন এবং একই বছর সাহিত্য-প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ পাকিস্তান সরকারের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৭৮ সালের ২১ জানুয়ারি রাজশাহীর উত্তরা সাহিত্য মজলিস কর্তৃক সংবর্ধনা জ্ঞাপন এবং পদক ও পুরস্কার পান। অবশেষে কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৭৯ সালের ২৭ জুন রাজশাহীর কাজীহাটের বাসভবনে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। কোকড়ানো ঝাকড়া চুল, উন্নত নাসিকা, টানা চোখ, ভরাট মুখমণ্ডল এবং স্নেহপ্রবণ হাসি মুখের অধিকারী কবি বন্দে আলী মিয়া নিরিবিলি ও অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের মানুষ ছিলেন। কখনো তাঁকে উত্তেজিত, রাগারাগি, চেচামেচি করতে দেখা যেত না। আপন ভুবনে তিনি বিচরণ করতেন। লেখালেখি নিয়েই তিনি সর্বদা ব্যস্ত থাকতেন। লেখালেখির জন্য তাঁর কোনো বাঁধাধরা সময় ছিল না।
মহান এই কবির স্মৃতি রক্ষার্থে দীর্ঘ ৩৭ বছরেও গড়ে উঠেনি কোনো প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৭ সালে তরুণ কবি মজিদ মাহমুদ, আবু জাফর মুহম্মদ মোহসিন, শফিকুল ইসলাম শিবলী, মোসতাফা সতেজ, আয়কর আইনজীবী আব্দুল আজিজ, কবি আব্দুলহেল বাকী, সাংবাদিক আখতারুজ্জামান আখতার, আব্দুল মজিদ দুদু, এস এম আলম মিলে প্রথম বন্দে আলী স্মরণ পরিষদ গঠন করেন। কিছুদিন পরই তার কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে যায়। কবি বন্দে আলী মিয়াকে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ সরকারের মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়। কবি বন্দে আলী মিয়ার বর্ণাঢ্য জীবন এবং বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ওপর বরেণ্য কবি ও সাহিত্যকরা নানা স্মৃতিকথা লিখেছেন।