পাঠ প্রতিক্রিয়া

সপ্ত গ্রন্থ ভ্রমণ বৃত্তান্ত

Looks like you've blocked notifications!

 

আমি প্রতিদিনই কিছু না কিছু পড়ার চেষ্টা করি। প্রতিটি বই পড়ে সংক্ষিপ্ত হলেও পাঠ-উপলব্ধি টুকে রাখাটা আমার অভ্যাস। এগুলোকে একধরনের ‘লিটারারি নোট’ বলা যেতে পারে। এর সাহিত্যমূল্য থাকলেও থাকতে পারে। আমি নিশ্চিত নই। সাম্প্রতিক সময়ে পড়া সাতটি বইয়ের পাঠ উপলব্ধি দেওয়া হলো এখানে। 

এক

চিনুয়া আচেবে তাঁর ‘থিংস ফল এপার্ট’ উপন্যাসে মূলত সংস্কৃতির দ্বন্দ্বকে শৈল্পিকভাবে চিত্রায়ত করতে চেয়েছেন। সফলতার সঙ্গে তিনি তা পেরেছেন বটে। ওমোফিয়ো গ্রামের ইবো জনগোষ্ঠীর যে জীবন, সমাজ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং যে ইতিহাস তিনি তুলে ধরেছেন উপন্যাসটিতে, তা শুধু প্রাচীন নাইজেরীয় সংস্কৃতি নয়, পুরো আফ্রিকার সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। উপন্যাসটির বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ এই একটাই। উপন্যাস এভাবেই ইতিহাস, ঐতিহ্য, নৃতত্ত্ব ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে। 

ওমোফিয়ার ইবো জনগোষ্ঠীর সমাজ যুগের পর যুগ অপরিবর্তিত অবস্থায় চলে আসছিল। নতুন ধর্ম, নতুন ঈশ্বর নিয়ে ওমোফিয়ায় হাজির হন ইংল্যান্ডের খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা। ওমোফিয়ায় তাঁরা ধর্মভিত্তিক নানা তৎপরতা শুরু করেন। নতুন ধর্ম ও সংস্কৃতি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে ওমোফিয়া ও এর আশপাশের গ্রামে। তাতে বিভক্তি দেখা দেয় ওমোফিয়ার প্রাচীন যূথবদ্ধ সমাজে। নতুন ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে থাকে প্রজন্ম। তাতে ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে থাকে হাজার হাজার বছরের মূল্যবোধ, ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা ও সংস্কৃতির স্বকীয়তা। আগ্রাসী খ্রিস্টীয় সংস্কৃতি সবকিছু ভেঙে চুরমার করে দিতে থাকে। যাজকরা শুধু ধর্ম প্রচার করেন না, শুধু গির্জা ও স্কুল বানান না; তাঁরা আদালত প্রতিষ্ঠা করেন, বিচারব্যবস্থা চালু করেন, স্থানীয় অধিবাসীদের নানা অপরাধের শাস্তি দেন। ওমোফিয়ার ইবোদের প্রাচীন সংস্কৃতিকে কুসংস্কার বলে প্রচার করতে থাকেন তাঁরা। 

বিদেশি শেতাঙ্গ খ্রিস্টানদের কার্যক্রম ও আধিপত্যবাদী আচরণ ক্ষুব্ধ করে তোলে ওমোফিয়ার গোত্রপ্রধান ওকোনকুয়োকে। সংস্কৃতির এই আগ্রাসন সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। ফলে সে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। ডাক দেয় মহাসমাবেশের। সমাবেশ বন্ধ করতে সেখানে উপস্থিত হয় খ্রিস্টান পেয়াদারা। ক্রোধোন্মত্ত ওকোনকুয়ো এক পেয়াদাকে কুঠারাঘাতে হত্যা করে। বাকি পেয়াদারা ভয়ে পালিয়ে যায়। সে ভেবেছিল ওমোফিয়ার জনগণ পেয়াদাদের পথরোধ করে ধরে হত্যা করবে। অথচ তারা তা করে না। ওকোনকুয়ো বুঝতে পারে, তার নিজের জনগোষ্ঠী যতই ক্ষুব্ধ হোক, শেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে কোনো সর্বাত্মক কর্মসূচি তারা পালন করবে না। তাদের প্রাচীন সেই শৌর্য-বীর্য এখন আর কিছু অবশিষ্ট নেই। সবকিছু ঘুণপোকায় খেয়ে গেছে। সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু ওকোনকুয়ো বিদেশি সংস্কৃতির সঙ্গে আপস করবে না কিছুতেই। শেষ পর্যন্ত সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।

মূল কাহিনীর সঙ্গে নানা উপকাহিনী জুড়ে দিয়ে উপন্যাসটিকে এক মহাকাব্যিক দ্যোতনা দিয়েছেন আচেবে। কাহিনীর সঙ্গে কীভাবে উপকাহিনীর ফিউশন ঘটাতে হয়, তা টের পাওয়া যায় আচেবের এই উপন্যাস পাঠে। ঐতিহাসিক উপন্যাস কেমন হওয়া উচিত, কীভাবে লিখতে হয় ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস, তা সফলভাবে দেখিয়েছেন তিনি। সর্বাত্মকভাবে তিনি উপন্যাসের ইউরোপীয় ঐতিহ্যকে অস্বীকার করেছেন। কলাকৈবল্যবাদ তথা শিল্পের জন্য শিল্প তত্ত্বের ঘোর বিরোধিতা রয়েছে তার উপন্যাসটিতে। তিনি মনে করতেন, মানুষের কল্যাণে শিল্প, শিল্পের কল্যাণে মানুষ নয়। যাঁরা মনে করেন মানুষ বা সমাজের প্রতি শিল্পীর কোনো দায়বদ্ধতা নেই, তাদের উদ্দেশে তাঁর বক্তব্য, ‘অনাদিকাল থেকে শিল্প মানবকল্যাণে নিয়োজিত। সমস্ত মহৎ সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি হয়েছে মানুষের কথা মাথায় রেখে। সুতরাং শিল্পী কোনোভাবে মানুষের প্রতি দায়িত্বহীন হতে পারে না।’ তিনি মনে করতেন, সাহিত্যিকরা জাতিকে পথ দেখায়। তারা জাতির শিক্ষক। মূলত তা-ই প্রতিভাত হয়েছে তাঁর এই উপন্যাসে। 

কবীর চৌধুরী জীবনে বহু ভালো বইয়ের ভালো অনুবাদ করেছেন। একই সঙ্গে করেছেন বহু ভালো বইয়ের বাজে অনুবাদও। তাঁর ভালো অনুবাদ ছিল গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ বা ‘প্রেম ও কলেরা’। অসাধারণ মনে হয়েছিল পড়ে। এরকম আরো অনেক ভালো অনুবাদ তাঁর আছে। ‘থিংস ফল এপার্ট’ নামটির বাংলায়ন করেছেন তিনি ‘সবকিছু ভেঙে-চুরে যায়’। এটি তাঁর একটি বাজে অনুবাদ। শব্দের আক্ষরিক অনুবাদের যন্ত্রণায় পাঠক অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে পারেন। লেখা শেষ করে হয়তো সম্পাদনার জন্য সম্ভবত একটিবার চোখ পর্যন্ত বুলাননি তিনি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। পাঠক হিসেবে আমি শুধু কাহিনীটা আত্মস্থ করা ছাড়া আর কিছুই পাইনি উপন্যাসটি পড়ে। পায়নি আচেবের ভাষারীতি কিংবা আঙ্গিকের ধরন। যত বড় অনুবাদকই হোন না কেন, প্রত্যেক অনুবাদকের অনুবাদকর্ম সুসম্পাদিত হওয়া উচিত বলে মনে করি।

যাই হোক, আচেবে সত্যিকার অর্থেই একজন মহান ঔপন্যাসিক। তাঁর এই উপন্যাস শুধু নাইজেরীয় বা আফ্রিকানদের জন্য নয়, সংস্কৃতির এই আগ্রাসনের কালে সারা পৃথিবীর সব জনগোষ্ঠীর জন্য এটি প্রাসঙ্গিক।
৫ মার্চ, ২০১৬

দুই

মিগেল দে সেরভানতেসের জগদ্বিখ্যাত ‘দন কিহোতে দে লা মানচা’ উপন্যাসটি বহুদিন নেড়েচেড়ে দেখেছি আজিজ মার্কেটের বই বিক্রয় কেন্দ্র প্রথমা, বিদিত বা তক্ষশিলায়। তরুণ ঘটকের অনুবাদ। কিনব, কিন্তু সাহসে কুলায় না। প্রায় পনের শ টাকায় দুই খণ্ডের বিশাল উপন্যাসটি কিনে যদি ঠকি! পড়ে যদি মজা না পাই! টাকাগুলো যদি জলে যায়! 

ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত চারখণ্ডের নোবেল ভাষণ পড়ে শেষ করলাম সম্প্রতি। মারিও ভার্গাস ইয়োসাসহ অন্তত সাত নোবেলজয়ীর ভাষণে ‘দন কিহোতে’র প্রশংসা পড়ে বইটির প্রতি আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। ইয়োসার মতে, এটি একবিংশ শতাব্দীর উপন্যাস। সাহস করে কিনেই ফেললাম একদিন। বেশ কিছুদিন পড়ে ছিল আলমিরার তাকে। বইটির দিকে তাকালেই ভয় লাগত। বাপরে, এত বড় বই! কী করে পড়ব! আবার একটা দীর্ঘশ্বাসও বুকের ভেতরে ঘুরত―এমন বই না পড়েই ফেলে রাখব! 

অবশেষে পড়া শুরু করলাম। খুব ধীরগতিতে এগোয় পাঠ। আমিও নাছোড়। পড়তেই হবে। কী আছে এই উপন্যাসে, কেন এটিকে আধুনিক উপন্যাস বলা হয়, দেখতে হবে। টানা আড়াই মাসের প্রচেষ্টায় পাঠ শেষ হলো। প্রথম খণ্ডের চেয়ে দ্বিতীয় খণ্ডের পাঠ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। এগিয়ে যাচ্ছিল দ্রুতগতিতে।

অবশেষে শেষ হলো পাঠ। না, টাকা জলে যায়নি। সত্যি এক অসাধারণ উপন্যাস। এই উপন্যাস পাঠ করে ঋদ্ধ হই প্রজ্ঞার উদ্ভাসে, কৌতুক ও ব্যঙ্গের বিরল সংশ্লেষে। সেরভানতেস নির্মাণ করেছেন মানুষের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা এবং আর্তির এক মহাকাব্য। উপন্যাসটিতে জীবনের প্রায় সবকিছু নিয়ে নানা গল্প শুনিয়েছেন লেখক। ভাষা, সাহিত্য, প্রেম, লোভলালসা, পাপপুণ্য, জীবনযুদ্ধ, অপরাধজগৎ, যুদ্ধ, স্বপ্ন―সবই আছে বইটিতে। আরোপিত নয়, স্বতঃস্ফূর্তভাবে, অসাধারণ আঙ্গিকে। হাস্যরসের মাধ্যমে ঘটনার পর ঘটনা পরিবেশন করেছেন লেখক। অনুবাদক তরুণ ঘটকের মতে, ‘এই উপন্যাস শুধু যে স্পেনের ‘মহাভারত’ তাই নয়, এতে আছে সেই প্রাজ্ঞতা, যা পৃথিবীর মননশীল পাঠক অন্বেষণ করে থাকেন।’

উপন্যাসটির পাঠশেষে মনে হচ্ছে, পৃথিবীতে পড়ার মতো এত এত বই। এক জীবনে এত পাঠ কি সম্ভব? মাঝে মাঝে মন খারাপ হয় এই ভেবে―আহা, কত কিছু না পড়েই একদিন মরে যাব! কোলবালিশে হেলান দিয়ে পাঠানন্দে ডুবে থাকা আর কখনো হবে না। যারা বইয়ের পাঠক তাদের জন্য প্রকৃতি সদয় হয়ে আরেকটা জীবন যদি বরাদ্দ করে দিত। আহা!

১৫ মার্চ, ২০১৬

তিন

প্রাচীন সুমেরীয় মহাকাব্য ‘গিলগামেশ’-এর পাঠ শেষ হলো আজ। মহাকাব্যটির দুটি অনুবাদ আমার কাছে রয়েছে। বহুদিন আগে প্রথমটির ফটোকপি সংগ্রহ করেছিলাম প্রয়াত নাট্যকার সেলিম আল দীনের চাপে পড়ে। কিন্তু পড়িনি। পড়েছি বলে তাঁকে ফাঁকি দিয়েছিলাম। বহুদিন ধরে বইয়ের বস্তার মধ্যে অবহেলায় পড়ে ছিল এটি। ফটোকপি বলে পড়ার আগ্রহ জাগেনি কিংবা দুর্বোধ্য লেগেছিল। প্রথম কটি পৃষ্ঠা ফটোকপি করা হয়নি বলে অনুবাদকের নামটি নেই। এবারের বইমেলা থেকে সংগ্রহ করলাম মোহাম্মদ জামানকৃত অনুবাদটি। এটি দিব্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত। এটিই পড়লাম। পড়াশেষে দুটো অনুবাদ মিলিয়ে দেখলাম, মোহাম্মদ জামানের অনুবাদটির চেয়ে আমার সংগ্রহে থাকা অনুবাদটি অনেক সুখপাঠ্য, ভাষা অনেক সুললিত এবং কিছুটা বিস্তারিতও। মোহাম্মদ জামান কোথাও কোথাও সংক্ষিপ্ত করেছেন বলে মনে হলো। তবে দিব্যপ্রকাশ বইটি প্রকাশ করায় পাঠকদের জন্য উপকার হয়েছে। কেননা আমার সংগ্রহে থাকা অনুবাদটি এখন দুর্লভ। কোথাও নেই বললেই চলে। আছে কি? ঠিক জানা নেই।

গিলগামেশ মহাকাব্যটি না পড়লে তথ্যটি অজানাই থেকে যেত যে, গুরুত্বপূর্ণ তিনটি সেমেটিক ধর্মগ্রন্থে যে মহাপ্লাবনের কথা বলা হয়েছে, তা আসলে প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার মহাকাব্য গিলগামেশে বর্ণিত মহাপ্লাবনেরই পুনর্বয়ান বা বিনির্মাণ মাত্র। বাইবেলের কথাই ধরা যাক। বাইবেলে বর্ণিত মহাপ্লাবনের কাহিনীটির উৎপত্তি ঠিক বাইবেলীয় নয়, আসলে সুমেরীয়। আবার, বাইবেলে বর্ণিত কাহিনীটিকে ঠিক গিলগামেশের বিনির্মাণ বলা যায় কি? কেননা একই কাহিনী আবার ব্যাবিলনীয় সংস্কৃতিতে উটনাপিসটিম ও আটরাহাসিস নামে প্রচলিত ছিল বা আছে। বলা যায়, এই দুই কাহিনী থেকেই গিলগামেশে মহাপ্লাবনের কাহিনীটি প্রবাহিত হয়েছে এবং গিলগামেশ থেকে বাইবেলে। কিংবা এও হতে পারে, গিলগামেশ থেকে নয়, উটনাপিসটিম ও আটরাহাসিস থেকেই বাইবেল কাহিনীটি আহরণ করেছে। 

বোঝাই যাচ্ছে, ব্যাবিলনীয় উটনাপিসটিমই কখনো আটরাহাসিস, কখনো নোয়া আর কখনো নূহ। গিলগামেশে প্লাবন ডিক্রিকারী ক্ষত্রীয় দেবতা এনলিল, প্রাচীন ইসরায়েলি মহাকাব্য ইয়াউইস্ট উৎসের বা জে-তে তিনি ইয়াহ্ওয়ে এবং বাইবেলে এসে তিনি হয়েছেন ইলাহ্। গিলগামেশের প্লাবনভূমির নাম শুরুপাক নগরী, বাইবেল পরবর্তী ধর্মগ্রন্থে সেই প্লাবনভূমির নাম হয়েছে কুফা নগরী। চরিত্র ও স্থানের নাম বদল হয়েছে শুধু, কাহিনী একই।

২৫ মার্চ, ২০১৬

চার

কবিবন্ধু অঞ্জন আচার্য সন্ধান দিয়েছিল গল্পকার সুবোধ ঘোষের। বলেছিল, ‘পড়ে দেখ। বিশেষ করে তার অযান্ত্রিক ও ফসিল গল্প দুটি। মূর্খই তো রয়ে গেলি। পড়ে একটু শিক্ষিত হ।’ বিনিপয়সায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য গুগল সার্চ দিয়ে গল্প দুটি খুঁজলাম। পেলাম না। মনে পড়ল গত বছর রোদেলা প্রকাশনী থেকে আরেক কবিবন্ধু রাহেল রাজীবের ভূমিকা ও সম্পাদনায় সুবোধ ঘোষের শ্রেষ্ঠ গল্প বেরিয়েছিল। প্রকাশক রিয়াজ খানকে বললাম একটা বই দিতে। অকৃত্রিম বন্ধু মিস্টার খান যথারীতি কার্পণ্য করলেন না।

প্রথমেই পড়া ধরলাম ফসিল। ভালো লাগল। খুব। কিন্তু গল্পটার শেষে একটা চমক দেওয়ার ব্যাপার আছে। ওই যে, ‘লক্ষ বছর পরে, এই পৃথিবীর কোনো একটা জাদুঘরে, জ্ঞানবৃদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিকের দল উগ্র কৌতূহলে স্থির দৃষ্টি মেলে দেখছে কতগুলো ফসিল!’―এটাকে চমক বলা যায় কি না ঠিক জানি না। হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। গল্পে চমক থাকা ভালো না খারাপ সেটা তাত্ত্বিকরা ভালো বলতে পারবেন। ভালো-খারাপ যাই হোক, অঞ্জন আচার্যের কথাই সঠিক, গল্প হিসেবে ফসিল আমাকে শিক্ষিত করেছে বটে। গল্পের এমনতর ভাবনাটা বা আঙ্গিকটা হয়তো আগে কখনো পাইনি। পেয়েছি কি? ঠিক মনে পড়ে না।

তারপর জতুগৃহ। ভালো লাগেনি। গল্পটা অনেক বিখ্যাত, শুনেছি। সিনেমা-টিনেমাও নাকি হয়েছে গল্পটি নিয়ে হিন্দি-বাংলায়। গল্পের গল্পটাও অনেকটা জনপ্রিয় বাংলা-হিন্দি সিনেমার মতো বটে। রেলজংশনে পাঁচ বছর পর সাবেক স্বামী-স্ত্রীর পুনঃ সাক্ষাৎ। এমন গল্প আগে কোথাও পড়েছি। এমনও হতে পারে, যার লেখা এমন গল্প পড়েছি তিনি হয়তো সুবোধ ঘোষের এই গল্প থেকে কাহিনীটা মেরে দিয়েছেন। হতে পারে। আজকাল তো খুব মারামারি চলে। সিনেমায়, নাটকে, গল্প ও উপন্যাসে দেদার মারামারি চলছে। কিংবা এও হতে পারে, এমন গল্প কখনোই পড়িনি। হয়তো গল্পটা আমার ভেতরে আগে থেকেই সুপ্ত ছিল। কে জানে! তবে গল্পের ভাষাজাদু অসাধারণ! মুগ্ধ করেছে। এই একটি কারণে পাঠক হিসেবে আমার কাছে গল্পটা উতরে গেছে। 

যাক, এবার তাহলে দেখা যাক ‘অযান্ত্রিক’ কেমন। গল্পটি নিয়ে মহামতি ঋত্বিক ঘটক সিনেমাও বানিয়েছিলেন। দেখেছি বহু বহুদিন আগে। ভুলেটুলে গেছি এতদিনে। এক টানে পড়ে ফেললাম। খুব ভালো লাগল। খুব। মনে হলো, এত কিছু জানলেন কী করে ভদ্রলোক! গাড়ির কলকব্জা সম্পর্কেও দেখছি তার মেলা দখলদারিত্ব, মাইরি! এক জীবনে লোকটা এত অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন কী করে! সময় পেলেন কোথা থেকে? পরে, শ্রেষ্ঠ গল্পের সব কটি গল্প পড়াশেষে এই লেখকের জীবন সম্পর্কে খোঁজটোজ জানলাম―ভদ্রলোক জীবনকে নিংড়ে, রাস্তার ধারে আখের রস বিক্রেতারা মেশিনে আখকে যেভাবে নিংড়ায়, অভিজ্ঞতা নিয়েছেন। বিচিত্র ছিল তাঁর কর্মজীবন। বাসের কন্ডাক্টর হিসেবে কর্মজীবনের শুরু। এ ছাড়া ট্যুইশন, ট্রাক ড্রাইভার, সার্কাস পার্টিতে ক্লাউনের ভূমিকায় এবং আরো বহু কর্মের অভিজ্ঞতা নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় বিভাগের সহকারীর চাকরি নেন। ক্রমে সিনিয়র অ্যাসিট্যান্ট এডিটর, অন্যতম সম্পাদকীয় লেখক। এক জীবনে অভিজ্ঞতার এমন বৈচিত্র্য যাঁর, তাঁর কথাসাহিত্য খারাপ হওয়ার তো কোনো রাস্তা নাই। ইচ্ছে করলেও কি তিনি খারাপ লিখতে পারবেন? মোটেই না।

তারপর পড়লাম ‘থিরবিজুরি’। নিজেকে সত্যিকার অর্থেই অবোধ বালক মনে হলো―মহৎ সাহিত্য পড়াশেষে প্রতিবারই নিজেকে যা মনে হয়। মনস্তত্ত্বের এত গভীরে, এত চমৎকারভাবে, এত অসাধারণ ভাষায় বাংলা গল্প কি খুব বেশি লেখা হয়েছে? নিজেকেই প্রশ্ন করি। পাঠ-অভিজ্ঞতা বলল―না, খুব বেশি লেখা হয়নি না। তুমি হাতে গুনতে পারবে। 

তারপর পড়লাম ‘পরশুরামের কুঠার’। আহা ধনিয়া! নয়াবাদের বারবণিতা ধনিয়া। অসংবৃতা এক রঙিন মরীচিকার মূর্তি জ্বেলে কী ভয়ঙ্করভাবে সে টেনে নেয় আমাকে তার নিটোল বুকে, জংঘায়! গল্পকে কতটা নির্মেদ রেখে, টান টান রেখে, ভাষার জাদুতে মোহাবিষ্ট করে, পাঠকের মনস্তত্বে কীভাবে হামানদিস্তা চালাতে হয়―পড়ে এই কথা জানলাম। তার মানে শিক্ষিত হলাম এবং অঞ্জনকে ধন্যবাদ জানালাম। অঞ্জন, তোর প্রাপ্যটা নিয়ে নে।

তারপর একে একে চিত্তচকোর, যাযাবর, ঠগের ঘর, পরিপূর্ণা, পারমিতা, গোত্রান্তর, তমসাবৃতা, অপপোকার, লঘু আরণ্যক, জলরাক্ষস, প্রিয়ংবদা, কলপুরুষ―এক টানা পড়ে যাই। থামলেই সুবোধ ঘোষের অদৃশ্য হাত ঘাড়ের কাছে টের পাই। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তিনি বলে যান―‘পড়, পড় হারামজাদা। গল্প-উপন্যাস লিখিস! ব্যাটা নাবালক! বোগাস কোথাকার! পড়। দেখ, জীবনকে কীভাবে গল্পে উপস্থাপন করতে হয়। দেখ, লেখার জন্য হাতের কবজিটাকে একই সঙ্গে কতটা ইস্পাতকঠিন আর তুলতুলে নরম রাখতে হয়।’ আমি পড়ে যাই। 

এবং সর্বশেষ ‘সুন্দরম’। গল্পটি পড়া শেষ করে ঐ চলন্ত বাসের এক কোণে, জানালার পাশে, পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃসঙ্গ এবং ভয়াবহ আবেগপ্রবণ আমি কেঁদেই ফেলি। খুব গোপনে। না, অন্তরে সুড়সুড়ি দেওয়া কাহিনীর জন্য নয়, গল্পের পাত্রপাত্রীর জন্যও নয়। কাঁদি নিজের অপরাঙ্গমতার কথা ভেবে। কাঁদি একজন শক্তিশালী গল্পকারের কথা ভেবে। হায়, আমার জন্মের আগেই তিনি এই পৃথিবী ত্যাগ করেছেন। কত বিশাল মহীরূহ ছিলেন! কী প্রকাণ্ড! আমি তাঁকে চোখের দেখা দেখলাম না! শুধু বাংলা ভাষায় লেখার জন্য বিশ্বখ্যাতি পেলেন না। আহা বাংলা ভাষা, আমরি বাংলা ভাষা।

বাংলা ভাষার প্রিয় গল্পকারদের মধ্যে এতদিন ছিলেন আটজন। আজ থেকে আরেকজন যোগ দিলেন―সুবোধ ঘোষ। ঠিক দিলেন নয়। দিলেন বললে বেয়াদবি হয়। নাকি? বলতে হবে সানন্দে যোগ করে নিলাম। হে মহাপাণ, আপনাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম। 

৩১.মার্চ, ২০১৬

পাঁচ

দই দুধ ঘোল আর ঘি বেচতে শ্রীরাধা মথুরা নগরীতে যায় ষোলোশো গোপীর সঙ্গে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের শুরু থেকে ছত্রখণ্ড পর্যন্ত ষোলোশো গোপীর কথাই উল্লেখ আছে। এক গ্রামে ষোলোশো গোয়ালিনী থাকে? আচ্ছা, কবির কল্পনাকে না হয় মেনেই নেওয়া যাক। কিন্তু বৃন্দাবনখণ্ডে এসে গোপীর সংখ্যা এক লাফে হয়ে গেল ষোলো হাজার! ষোলো সহস্র গোপী রাধা সঙ্গে যাএ।’ কাব্যকলার দেবীর শির বন্দনা করে যুবক স্বকৃত নোমান জানতে চাচ্ছে, ওলো বাসলীর বরপ্রাপ্ত বড়ু চণ্ডিদাস, এ কি আপনার ভুল, নাকি ইচ্ছাকৃত? 

দানখণ্ড পর্যন্ত শ্রীকৃষ্ণের ওপর দেবত্ব আরোপ করেননি বড়ুমিয়া। মানে এই পর্যন্ত কৃষ্ণ মানুষের মতোই আচরণ করেন। বৃন্দাবনে গরু চরান, বাঁশী বাজান, শ্রীরাধার জন্য আকুল হয়ে থাকেন, তার স্তনে হাত দেওয়ার এবং দুই স্তনের কলস গলায় বেঁধে রূপের গঙ্গাজলে ডুব দেওয়ার বাসনা প্রকাশ করেন। যমুনার ঘাটে রাধার ননী ফেলে দেন, পসরা লুটে দই খেয়ে ফেলেন, সাতনরী হার কেড়ে নিতে চান। সবই মানবীয় আচরণ। 

কিন্তু নৌকাখণ্ডে দেখা যাচ্ছে যমুনায় ঝড়-তুফানের মধ্যে মনের আনন্দে নৌকা ডুবিয়ে রাধাকে কোলে নিয়ে ভাসতে লাগলেন! শোনো কথা বড়ুর! ঝড়কবলিত নদীতে কেউ কাউকে কোলে নিয়ে ভাসতে পারে? এটা কি কৃষ্ণের ওপর দেবত্ব আরোপ, নাকি দুজনার কামনদীতে ভাসার ব্যাপারটা উপমা দিয়ে বোঝাতে চাইলেন? দুটোই হতে পারে। তবে পাঠক হিসেবে আমি একে উপমা হিসেবেই ধরে নিচ্ছি। পণ্ডিতগণ কী বলেন?

৯ মে, ২০১৬

ছয়

মনুসংহিতার সর্বনাশটা ঘটেছে মূলত একটি অধ্যায়কে কেন্দ্র করে―ধর্মানুষ্ঠান অধ্যায়। এ অধ্যায়টি পড়ে মনে হলো মানবতার এমন চরমতম অপমান পৃথিবীর অন্য কোনো শাস্ত্রে ঘটানো হয়নি। ভারতবাসী হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যে জাতপ্রথার প্রচলন তা তো বেদ আর মনুসংহিতাজাতই। ধর্মানুষ্ঠান অধ্যায়ে শূদ্রদের যেভাবে অপমান করা হয়েছে তা মানবেতর প্রাণীকেও করা হয়নি। মূলত এই ভয়াবহ শ্রেণিবৈষম্যের কারণেই সনাতন ঐতিহ্যের ভারতবর্ষে ইসলামের অনুপ্রবেশ সহজ হয়েছে এবং সৃষ্টি হয়েছে নানা গৌণ ধর্মসম্প্রদায়ের। শ্রীচৈতন্য বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তন করে ভক্তি আর প্রেমের বন্যা বইয়ে না দিলে হিন্দু ধর্ম হয়তো আরো ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়ে যেত।

কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে খেয়াল করি, মনুসংহিতার রাজধর্ম, রাষ্ট্রনীতি, দায়ভাগ ও বিচার, সমাজনীতি―এই অধ্যায়গুলো এতই অসাধারণ যে, পৃথিবীর অন্য কোনো শাস্ত্রে মানবজীবনের এত খুঁটিনাটি বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি। রাজধর্ম অধ্যায়টির কাছে তো নিকোলো ম্যাকায়াভেলির ‘দ্য প্রিন্স’কে খুবই তুচ্ছ মনে হলো। ম্যাকায়াভেলি তার গ্রন্থে রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনা বিষয়ে রাজাদের যে উপদেশ দিয়েছেন, মনুসংহিতার উপদেশগুলো তার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি শক্তিশালী। এতদিন আমি রাজধর্ম, রাষ্ট্রনীতি ও রাজনীতি বিষয়ে প্রাচীনতার দিক থেকে প্লেটোর রিপাবলিক, এরিস্টটলের পলিটিক্স ও ম্যাকায়াভেলির দ্য প্রিন্সকে শ্রেষ্ঠ মনে করতাম। অথচ এখন মনে হচ্ছে ওগুলোর চেয়ে মনুসংহিতা কোনো অংশে কম নয়।

মনুসংহিতার আটটি অধ্যায় পড়ে হিন্দুধর্মের খুব গভীরে ঢুকতে পেরেছি। শুধু হিন্দুধর্ম কেন, বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতিকেও ধরতে পেরেছি খুব গভীরভাবে। এই সংস্কৃতির শেকড়ের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাঙালি মুসলমানের আচরিত সংস্কৃতির শত শত উপাদান যে হিন্দুসংস্কৃতিজাত তা তারা জানেই না। না জেনেই এই সংস্কৃতির চর্চা করে যাচ্ছে। এই সংস্কৃতি এতটাই গভীরে প্রথিত হয়ে আছে যে, তাদের যদি বলা হয় এটা তো তোমার সংস্কৃতি নয়, এটা হিন্দুর সংস্কৃতি―তারা বিশ্বাস তো করবেই না, উল্টো বরং মারতে আসবে।

সেদিন জনৈক বন্ধু আমার হাতে বইটি দেখে বলেছিল, খুব বাজে একটা বই। সে ব্রাহ্মণ গোত্রীয়। তার কথায় প্রভাবিত হয়ে আমি বইটি পড়ব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু খুব ভালো লাগছিল বলে পাঠ থামালাম না। এখন মনে হচ্ছে, না পড়লে আমি বরং বহু বিষয়ে মূর্খই থেকে যেতাম। শুধু ধর্মানুষ্ঠান অধ্যায়টি পড়ে যদি আমি বইটি রেখে দিতাম, তবে হয়তো অনাগত দিনে সেই বন্ধুটির মতোই বলতাম এটি আসলেই একটা বাজে বই। এখন আবারও এই উপলব্ধি হচ্ছে―কোনো কিছুই আসলে ফেলনা নয়। জ্ঞানের কোনো সীমা নেই। জ্ঞান এক অনন্ত সমুদ্রের নাম।

১৫ এপ্রিল, ২০১৬

সাত

এমন চরম বিপ্রতীপ, এমন করুণ বিপর্যয়, এমন সর্বনাশা পরিসমাপ্তি গ্রিক নাটকে তো নয়ই, পৃথিবীর কোনো নাটকে, গল্পে বা উপন্যাসে আছে কি না আমার জানা নেই। ‘রাজা ইদিপাস’ এক আত্মবিশ্বাসী মানুষের নিঃস্বতার কাহিনী। এ কাহিনী শুধু কোনো সুউচ্চ চূড়া থেকে অতল গহ্বরে পতনের নয়, এটি মানুষের সমস্ত অর্জনের, সমস্ত উত্তরাধিকারের চরম বিপর্যয়, মানুষের সমস্ত সম্পর্ক, মানব পরিচয়ের বিপর্যয়ের অন্ধকারের কাহিনী। পৃথিবীর লেখকদের সৃষ্ট আর কোনো চরিত্র ইদিপাসের মতো এমনভাবে সভ্যতার অন্তর্বিরোধকে স্পষ্ট করে তুলেছেন কি না জানি না। রূপক ও প্রতিমা দিয়ে কাহিনীর মধ্যে সভ্যতা ও বর্বরতার দ্বন্দ্ব এবং বিপর্যয়কে যেভাবে দেখিয়েছেন মহামতি সফোক্লেস, তা রীতিমতো বিস্ময়কর।

ইদিপাস যাকে খুঁজছেন সে তিনি। আবার তিনি তার থেকে পৃথক। তিনি রাজা, থীবসের ত্রাণকর্তা, তিনি খুঁজছেন এক হত্যাকারীকে, যে হত্যাকারী তিনি নিজেই। এক ইদিপাস খুঁজছেন আরেক ইদিপাসকে। যে কথাগুলো ইদিপাস বলছেন, তিনি সেই কথাগুলোর অর্থ জানেন না, বা তিনি যা বলছেন তার পূর্ণ তাৎপর্য তার কাছে স্পষ্ট নয়। আর স্পষ্ট নয় বলেই সন্ধান-কাল-দৈর্ঘ্য বেড়ে চলে, কাহিনী জটিল হয়ে ওঠে। এই জটিলতার সৃষ্টিতে ভাষার প্রয়োগ একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিয়েছে। এই ভাষা প্রহেলিকার ভাষা।

এ নাটক শুধু সভ্যতা থেকে বর্বরতার দিকে নয়, বরং সভ্যতার মূলের দিকে যাত্রা। মানুষের চরমতম রহস্যকে জানা। এ এমন এক নাটক যে শুধু এই কথারই প্রতিধ্বনি করে―‘গ্লোথি সাউতোন’ বা ‘আত্মনং বিদ্ধি’ বা ‘নো দাইসেলফ’ বা ‘মান আরাফা নাফসাহু’ বা ‘নিজেকে জানো’। ইদিপাস সত্যকে জানতে চেয়েছেন, জেনেছেন নিজেকে। যে একই সঙ্গে ইদিপাসের মা এবং স্ত্রী―সেই ইওকাস্তা এবং জ্ঞানী তেইরেসিয়াস দুজনেই দু-ভাবে তাকে এই ‘জানা’ থেকে বিরত রাখতে চেয়েছেন। ইদিপাস শুনলেন না। তিনি নিজেকে জানতে চাইলেন। বেছে নিলেন কঠিন পথ, যে পথ তার জীবনে প্রলয় ডেকে আনল। তবু শেষ পর্যন্ত প্রলয় নয়, বিপর্যয় নয়―শেষ পর্যন্ত আসলে নিয়মেরই প্রতিষ্ঠা। যে নিয়ম পশুত্বের নয়, মানুষের, সমাজ সংহতির নিয়ম। 

জ্ঞানী তেইরেসিয়াস বলেছিলেন, জ্ঞান বড় ভয়ঙ্কর। জ্ঞান আসলেই ভয়ঙ্কর। রাজা ইদিপাস আমাদের এমনভাবে বিহ্বল করে, আমরা এই ভয়ঙ্করের মুখোমুখি হতে ভয় পাই। অন্তত নাটকটি পড়ে এমনই উপলব্ধি হয়। অর্থাৎ ‘জানা’র দিকে অগ্রসর হতে আমাদের ভয় জাগে। তবু আমাদেরকে জানতে হবে, সত্যকে খুঁজতে হবে। যত কঠিন, যত নির্মম, যত নিষ্ঠুর হোক―এই নাটক আমাদের বলে দেয়―নিজেকে জানো। জানো, আরো জানো। জ্ঞানই চেনায় মানুষের সত্তাকে, তার সভ্যতার মূল রূপকে। এই জানার মধ্য দিয়ে সমস্ত সুখ আর সমস্ত নিরাপত্তার মধ্যে থেকে উদ্ভাসিত হয় মানুষের নগ্নমূর্তি। 

প্রণাম হে মহান সফোক্লেস।

১৮ এপ্রিল, ২০১৬