শাহাদুজ্জামানের আলাপ
গল্প নিয়ে গল্প
শাহাদুজ্জামানের লেখালেখির শুরুটা অনুবাদ দিয়ে হলেও পরে ছোটগল্প ও উপন্যাসে তিনি নিজস্ব পাঠক তৈরি করেছেন। ভিন্নধর্মী বর্ণনা ও গল্পের বৈচিত্র্যের কারণে পাঠকপ্রিয় হয়েছেন তিনি। গত ১৭ মে ২০১৬ তারিখে বিজ্ঞাপন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘ফেইসকার্ড প্রোডাকশন’-এর আমন্ত্রণে গুলশানে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে পাঠকের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। সেখানে নিজের লেখালেখি ও অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। সেই আলোচনারই কিছু নির্বাচিত মন্তব্য অংশের শ্রুতিলিখন এই লেখা
বহু আগে আলবেরুনীর একটা কথা আমাকে খুব অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘God, Don’t give me a long life, give me a wide life.’ মানে প্রভু আমাকে দীর্ঘ জীবন দিও না, বরং একটা বিস্তৃত জীবন দাও। বিস্তৃত জীবন মানেই হচ্ছে একটা বিস্তৃত পরিধির কৌতূহল নিয়ে বেঁচে থাকা। একটাই তো জীবন, সেটাকে যত বিস্তৃতভাবে যাপন করা যায়, আমার কাছে মনে হয় সেটাই সার্থকতা।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি চিন্তা করি আমি ডাক্তারি পড়েছি, শুধু ডাক্তারি করলেই পারতাম। কিন্তু এলাম লেখালেখির দিকেও। এটা ওই কৌতূহলেরই কারণে, জীবনের নানা ব্যাপারে কৌতূহল, সেই কৌতূহল থেকেই সীমানা পার হওয়ার চেষ্টা করেছি। লেখালেখি করতে গিয়ে আমি সাহিত্যের দিকে যতটা তাকিয়েছি, জীবনের দিকে হয়তো তার চেয়ে একটু বেশিই তাকিয়েছি।
আমি মনে করি যে সৃষ্টিশীল মানুষের এক ধরনের গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকতে হয় এবং সেটা নিয়মিত, সব সময় একটা চলমান প্রক্রিয়া। জীবনযাপন, পাঠন, পর্যবেক্ষণ থেকে অবিরাম গ্রহণ করা।
আমার মনে আছে, ছোটবেলায় আমি প্রজাপতি ধরতাম। প্রজাপতি খুব সহজে ধরা যায় না। কারণ, একটা জায়গায় তো বেশিক্ষণ স্থির হয়ে বসে না প্রজাপতি। ফলে তাকে ধরার জন্য তার পেছনে না দৌড়িয়ে যদি কোথাও স্থির হয়ে বসি, তাহলে দেখা যায় হয়তো প্রজাপতি নিজে থেকেই আমার মাথায় এসে বসে। ঠিক সে রকম মনে হয়েছে যে, কিছু হওয়ার পেছনে ছোটাটা জীবনে খুব একটা কাজে আসে না। নিজের দিকে যখন তাকাই, আমার মনে পড়ে না যে আমি কখনো কিছু হতে চেয়েছি। হওয়ার কথা উঠলে আমি যে ডাক্তার হয়েছি, সেটাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু হওয়ার চেয়ে আমার বরং আগ্রহ ছিল জীবনের দিকে কৌতূহলে তাকানো। ঠিক লেখক হতে চাইনি কখনো। এই স্থির কৌতূহলই আমাকে লেখক হওয়ার দিকে নিয়ে গেছে। জীবনকে ধরার জন্য ছুটিনি। কৌতূহলী মন নিয়ে জীবনের দিকে তাকিয়েছি, তাতে হয়তো কখনো কখনো জীবন আমার কাছে ধরা দিয়েছে। কৌতূহলের সঙ্গে অবশ্যই আছে প্রশ্নও, যা দেখছি, অনুভব করছি, কেন এ রকম হচ্ছে, এই প্রশ্ন আমাকে এক ভাবনা থেকে টেনে আরেক ভাবনায় নিয়ে গেছে।
আবার কৌতূহলে কোনো কিছু শুধু দেখলেই হয় না। দেখাটাকে কোনো ভাবনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হলে পঠন-পাঠনের দিকে যেতেই হয়। আমি যা দেখছি, সেটা বুঝতে হলে আমাকে পড়তে হবে, না হলে জীবনের বড় ছবিটা ধরা যায় না। চোখে দেখা যায়, কিন্তু আত্মস্থ করা যায় না। তাই বড় পরিসরে কোনো বিষয়কে বোঝার জন্য পড়াশোনাটা জরুরি। এবং নানা বিষয়ে পড়াশোনাটা জরুরি।
আমি যাদের খুব সৃষ্টিশীল মানুষ মনে করি, সব সময় তাঁদের জীবন দর্শন বোঝার চেষ্টা করেছি, তাঁদের আত্মজীবনী পড়তে গিয়ে দেখেছি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের ঝোঁক ছিল, পড়ালেখা ছিল। কোনো একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে তাঁরা আটকে থাকতেন না।
একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই, আমি জীবনানন্দ নিয়ে অনেক বছর ধরে কাজ করছি। তাঁর জীবন সম্পর্কে জানতে গিয়ে দেখলাম, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি পড়ালেখা করেছেন। তাঁর যে কী ব্যাপক পঠন-পাঠন, ভাবলে আমি থ হয়ে যাই মাঝেমধ্যে। তিনি লিখছেন কবিতা, কিন্তু তাঁর জানার পরিধি আরো অনেক বিষয়ে বিস্তৃত।
১৯২৫ সালের কথা। জীবনানন্দ দাশ একটা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিচ্ছেন, ব্রাহ্ম সমাজের একজনের মৃত্যুতে স্মৃতিচারণ। সেখানে মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি আইনস্টাইনের ‘থিওরি অব রিলেটিভিটি’-এর কথা বলেছেন। তিনি যখন এই কথা বলছেন তার মাত্র বছর কয়েক আগে আইনস্টাইনকে এই তত্ত্বটার জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। যখন জীবনানন্দের ডায়েরি পড়ছি, সেখানে দেখি তিনি আইনস্টাইন ও নিলস বোরের যে তর্ক কোয়ান্টাম ফিজিক্স নিয়ে, সেটা নিয়ে লিখেছেন। কবি হলেও তিনি কিন্তু পদার্থবিদ্যার খুঁটিনাটি পড়ছেন। জীবনের পুরোটা বুঝতে নানা মাধ্যম সম্পর্কে এ ধরনের কৌতূহল থাকা দরকার।
সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, বিজ্ঞান সব বিষয়েই পড়াশোনায় আগ্রহ আছে আমার। একটা সময় এমনও গেছে শুধু পড়ালেখার মধ্যে দিয়েই গিয়েছি। একটা বিষয় থেকে আরেকটা বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সেসব বিষয়ে নানা বইপত্র পড়েছি। তবে এও টের পেয়েছি, অক্ষরকেন্দ্রিক জ্ঞান জগতের একটা ভয়ংকর দিকও আছে। সেখানে আটকে যাওয়ারও আবার বিপদ রয়েছে। সে শুধু অক্ষরের ভেতর জীবনকে দেখায়। কেউ যদি বই পড়ে চলচ্চিত্র বানাতে চায়, সহিত্য করতে চায় কিন্তু পৃথিবীর দিকে, জীবনের দিকে না তাকায়, তাহলে সেটা হবে বইয়ের জগতের পুনরাবৃত্তি। কোকের বোতলের মতো, সব একরকম দেখতে।
পড়া মানে তো অন্যের চিন্তার ভেতর থাকা। নিজের চিন্তা তৈরি করার জন্য জীবনের দিকে তাকিয়ে নিজের সঙ্গে মোকাবিলারও দরকার আছে। তাই একটা সময় আমি বইয়ের জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকার জীবনের দিকে তাকিয়েছি। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে মার্কস, ফুকো, দেরিদা এঁদের নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক ফেলে আমি কাজের সূত্রে চলে গিয়েছিলাম গ্রামে। চার-পাঁচ বছরের জন্য গ্রামীণ স্বাস্থ্য প্রকল্পের ডাক্তার হয়ে দেশের নানা জায়গায় থেকেছি। বগুড়া, ময়মনসিংহ, রংপুরসহ আরো বিভিন্ন অঞ্চলের দুর্গম এলাকায় ঘুরেছি। সেটা আমার জন্য খুব উপকারী ছিল। আমার এই চেনাজানা, লেখাপড়ার জগতের বাইরের একটা পৃথিবী। বাংলাদেশের মানুষের জীবনের নানা মাত্রা দেখার সুযোগ হলো। তবে পড়াশোনা যে বাদ দিয়েছি, তা নয়। গ্রামেগঞ্জে যেখানে থেকেছি, বই আমার নিত্যসঙ্গী। কিন্তু তখন চোখ শুধু বইয়ের পাতায় না, জীবনের নানা বৈচিত্র্যে। বলা বাহুল্য, জীবন যে শুধু গ্রামে আছে তা তো না, শহর-বন্দর, নগরজীবন সব জায়গাতেই তা বহমান। আমি সেই জীবনের দিকে নজর রাখার কথা বলছি। আমার জন্য গ্রামের জীবন ছিল নতুন অভিজ্ঞতা।
আমার গল্পের কথা যদি বলি, আগেই বলেছি গল্প লিখব এমন কোনো পরিকল্পনা ছিল। আমি লেখালেখি শুরু করেছি খুব সিরিয়াস বিষয়ের প্রবন্ধ অনুবাদের মাধ্যমে। সেই সময়ে শিল্প ও রাজনীতির সম্পর্কটা বুঝতে চাইতাম। সেই সূত্রে অনেক অনুবাদ করেছি শুরুতে। মার্কসবাদী নন্দনতত্ত্ব ছিল আমার প্রথম অনুবাদ। অনুবাদে অন্যের লেখার আড়ালে আমার নিজের ভাবনা, অভিজ্ঞতা এসব প্রকাশ করা যাচ্ছে না এমন অনুভব থেকেই গল্প লেখার শুরু। আমার লেখা প্রথম গল্প ‘অগল্প’, কিন্তু প্রথম ছাপা হওয়া গল্প ‘জ্যোৎস্নালোকের সংবাদ’। তবে গল্প লিখতে শুরু করলেও আমি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলাম শিল্পসাহিত্যের অন্য মাধ্যমগুলোর সঙ্গে। ফিল্ম সোসাইটি, গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন, পেইন্টিং গ্রুপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলাম।
প্রচলিত ধারার ন্যারেটিভের বাইরে আমি যে গল্প লিখেছি, সেই গল্প লেখার ফর্মের ক্ষেত্রে ফিল্ম, নাটকের আন্তর্জাতিক নানা নিরীক্ষা আমাকে প্রভাবিত করেছে। গদারের ফিল্ম, ব্রেখটের নাটকের অ্যান্টি লিনিয়ার ন্যারেটিভ আমাকে আকর্ষণ করেছে। আবার আমি দেখেছি এ ধরনের ন্যারেটিভ ভাঙার চল আমাদের লোকজীবনেও আছে। আমার মনে আছে, আমি গ্রামের হাটে, ফেরিঘাটে ক্যানভাসারদের গল্প বলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। ক্যানভাসারদের ওই গল্প বলার ঢংটা আমাকে খুব আকৃষ্ট করত, তারাও ঠিক লিনিয়ার ন্যারেটিভে গল্প বলত না। গ্রামের হাটে ক্যানভাসারদের কোনো মজমা দেখলেই আমি দাঁড়িয়ে যেতাম শুনতে, তাদের গল্প ন্যারেশনের টেকনিকটা উপভোগ করতাম।
আমি যখন কর্মসূত্রে ঢাকার বাইরে চলে যাই, তখন ছুটিতে ঢাকায় আসতাম নাইট কোচে। নগরবাড়ী ঘাটে ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে হতো। সেই ফেরিঘাট ওই রাতের বেলাতেও বেশ জমজমাট থাকত। সেখানে বিভিন্ন ধরনের ক্যানভাসাররা নানা রকম ওষুধ, বিশেষ করে সেক্সচুয়াল পটেন্সির ব্যাপারে ওষুধ বিক্রি করত। আমি দেখতাম তার সেই ওষুধ বিক্রির জন্য কীভাবে গল্পটা সে তৈরি করছে। একটা গল্পের ভেতর আরেকটা গল্প ঢুকিয়ে বেশ জটিল একটা ন্যারেটিভ তারা তৈরি করত। বিষয়টা আমার দারুণ লাগত। পরে দেখেছি আমার গল্পে সেই প্রবণতাটা প্রভাব ফেলেছে। আমার গল্পগুলো নন-লিনিয়ারই বেশি। গল্প ভেঙে বলার মধ্যে একটা মজা আছে। এই মজা আমি ওই ক্যানভাসারদের গল্প বলার স্টাইলে দেখেছি।
আমি কখনো কোনো চরিত্র, ঘটনা বা স্থান মাথায় রেখে গল্প শুরু করি না। আমার শুরুটা হয় একটা আইডিয়া থেকে। আমাকে লেখার উৎসাহ জোগায় একটি আইডিয়া। তার পর সেই আইডিয়াতে আমি ডালপালা লাগাই। আমি অনেক সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কাজ করেছি, কিন্তু চেষ্টা করেছি ভারী বিষয়টাকে সহজভাবে বলতে। সেটা একটা চ্যালেঞ্জ। এ ব্যাপারটাতে রূপকথার ন্যারেটিভ আমাকে সাহায্য করেছে। রূপকথায়, আমাদের লোককথাগুলোতে হালকা চালে ঘটনাগুলো বললেও এর ভেতর জীবনের অনেক গভীরবোধ নিহিত থাকে।
শিল্পকে শেষ বিচারে বিনোদন দেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। কিন্তু বিনোদনেরও নানা স্তর আছে। তারকোভোস্কির চলচ্চিত্রের বিষয় খুব সিরিয়াস, কিন্তু তার মধ্যেও বিনোদন রয়েছে, গভীর অর্থে বিনোদন রয়েছে। বড় শিল্পে নানা মাত্রা এবং স্তরের বিনোদন থাকে।
লেখালেখি করে জনপ্রিয় হওয়ার কোনো প্রবণতা আমার কখনো ছিল না। আমার যে কৌতূহল, জীবন নিয়ে যে প্রশ্ন এগুলোকে মোকাবিলা করার জন্যই আমি লেখাকে বেছে নিয়েছি। লেখালেখিটা আমার জন্য তাই একটা অধ্যবসায়ের ব্যাপার, আমার জীবনযাপনেরই একটা অংশ। আমি আমার নিজের মগ্নতাতেই লিখি, তাতে হয়তো অন্য অনেক মানুষকেও সে লেখা স্পর্শ করে, তা লক্ষ করি।
তবে আমি আমার লেখার ব্যাপারে পাঠকদের প্রতিক্রিয়াকেও গুরুত্ব দিই। আমার খুব ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষ আছে, যারা আমার লেখার ক্রিটিকাল পাঠক। লেখালেখি বা সৃষ্টিশীল যেকোনো কাজের শুরুতে প্রশংসা পাওয়ার একটা লোভ থাকে। এটাও এক ধরনের ফাঁদ। কারণ, তখন লোকে এমন লোকজনের কাছে লেখা শেয়ার করে যে আমার প্রশংসা করবে। সেসব বন্ধুই রাখে, যারা তার এক ধরনের আত্মশ্লাঘাকে তৃপ্তি দেবে। যে তার সমালোচনা করছে বা তার কাজটাকে ভালো বলছে না, তার কাছ থেকে সে দূরে সরে থাকে। কিন্তু লেখালেখির জন্য এটা খুব ক্ষতিকর। লেখকের জন্য সত্যিকার সৎ সমালোচক বন্ধু দরকার।
আমার এমন কয়েকজন সমালোচক বন্ধু আছে। তাঁদের আমার কোনো লেখা পড়তে দিলে সেটার কঠোর সমালোচনা তারা করে। কোনো ছাড় দেয় না। বন্ধুকৃত্য করে না। তাদের মন্তব্য আমাকে খুবই উপকৃত করে। তবে সে অর্থে আমার কোনো গুরু নাই। আমি কোনো লেখকগোষ্ঠীর সঙ্গেও জড়িত নই। আমার লেখালেখি অনেকটাই আমার ইন্ডিভিজ্যুয়াল জার্নি।
আমাদের প্রজন্মে মার্কসবাদের, সমাজতান্ত্রিক ভাবনার একটা বড় প্রভাব ছিল। ১৯৯০-এর পর থেকে সমাজতন্ত্র যেভাবে ভেঙে পড়ল, সেটা ছিল আমাদের প্রজন্মের জন্য স্বপ্নভঙ্গ। আমরা একটা ক্রসরোডের মধ্যে এসে পড়লাম। আমাদের পেছনের যে জীবন সেটা নিয়ে দ্বিধা তৈরি হলো। আবার আমাদের সামনের কোনো বিশেষ গন্তব্য নেই। আমার ‘বিসর্গতে দুঃখ’ বইটা সেই ক্রসরোডের গল্প। সেই উপন্যাসের শফিক চরিত্রটাও ওই প্রজন্মের, ওই সময়ের একজন প্রতিনিধি।
মিলান কুন্দেরার একটা বই আছে, যেটা অনেকটা একটা ‘পারসোনাল ডিকশনারি’। একেকটা শব্দ নিয়ে তাঁর নিজের ব্যাখ্যা ওই ডিকশনারিতে লিখেছেন। ‘বিসর্গতে দুঃখ’ বইটার ক্ষেত্রে ওই বইটা আমাকে প্রভাবিত করেছে। যে ছেলেমেয়েরা একটা সাধারণ জীবন চায়নি, সংসার-চাকরি-বেতন-বোনাস-প্রমোশন, রোববার থেকে বৃহস্পতিবার এই ছকের বাইরে যারা জীবনটাকে ভেবেছে, এর বাইরে গিয়ে কিছু একটা করতে চেয়েছে, তাদের জন্য ওই সময়টা কঠিন ছিল। শফিক তেমন একজন মানুষ। তেমন মানুষদের জীবন অবশ্য সব সময়েই কঠিন।
লেখার জন্য একজন লেখককে প্রতিনিয়ত নিজের সময়ের সঙ্গে থাকতে হবে। যেমন ‘বিসর্গতে দুঃখ’ গল্পটা আমি এখন আর লিখতে পারব না। সেটা একটা নির্দিষ্ট সময়ের গল্প ছিল। আশপাশের সময়টাকে বুঝতে হলে নিজের থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে হয়। অন্যের অভিজ্ঞতাকে বুঝতে হবে। নিজের এবং অন্যদের অভিজ্ঞতাকে তুলনা করে দেখতে হয়। তাহলেই সময়টাকে বোঝা যায়।
আমি পাঠকের মধ্যে শুধু আবেগের বাষ্প তৈরি করতে চাই না, তার চিন্তাকেও উসকে দিতে চাই। আমার অনেক গল্পে আমি গল্প বলতে চাইনি, শুধু একটা দৃশ্য দেখাতে চেয়েছি, একটা ছবি তৈরি করতে চেয়েছি। আমাদের চারপাশে এত ঘটনা ঘটছে, এত গল্পের আনাগোনা রয়েছে, যে জীবনের দিকে তাকালে দেখা যাবে একের পর এক গল্প আসছে, যাচ্ছে।
আমার লেখায় অনেক লেখকেরই প্রভাব আছে। জীবনানন্দ দাশ আমাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছেন। জীবননান্দের জীবনীভিত্তিক একটা উপন্যাসের কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছি। প্রথম আলোর ঈদসংখ্যায় তার অংশবিশেষ ছাপা হয়েছে। আমার মনে হয়েছিল যে জীবননান্দের প্রভাব থেকে বের হতে হলে তাঁকে আমার সম্পূর্ণভাবে বুঝতে হবে। তাঁকে বোঝার প্রক্রিয়া হিসেবেই তাঁকে নিয়ে উপন্যাস লেখার চিন্তা। তাঁকে নিয়ে উপন্যাসটা লেখার আগে সাত/আট বছর ধরে লেখাপড়া করেছি। এটা আমার ব্যক্তিগত একটি যাত্রা ছিল। সেই যাত্রাটা আমি আমার উপন্যাসে তুলে ধরেছি।
সাহিত্যের মূল বিষয় হয়তো পুরোনো কিন্তু কীভাবে সেটা বলা হচ্ছে, সেই পরিবেশনার নতুনত্বের দিকে আমি নজর দিই। তা ছাড়া এই কথাটাও তো ঠিক যে পৃথিবীতে এখন ৬০০/৭০০ কোটি মানুষ বেঁচে আছেন, তার মধ্যে আমার জীবনটা মৌলিক। কারণ আমার জীবনের অভিজ্ঞতাটা আর কারো নেই। আমার লেখার বিষয়, উপস্থাপনে আমার জীবনের সেই ইউনিকনেসটা ধরার চেষ্টা আমি করি। সাহিত্য আমার কাছে সেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সামাজিকীকরণ।
কৃতজ্ঞতা : মেজবাউর রহমান সুমন
শ্রুতিলিখন : ফাহিম ইবনে সারওয়ার